অলঙ্করণ: লেখক।
“বিরিয়ানি
পোলাও
কোর্মা।
কোপ্তা কাবাব দু’ রকম।
মাছের চপ—
মাঝখানে বেরসিকের মতো বাধা দিলে ক্যাবলা: তা হলে বাবুর্চি চাই, একটা চাকর, একটা মোটর লরি, দুশো টাকা—
—দ্যাখ ক্যাবলা-টেনিদা ঘুষি বাগাতে চাইল।
আমি বললাম, চটলে কী হবে? চারজনে মিলে চাঁদা উঠেছে দশ টাকা ছ-আনা”
সেই কবে যেন বিষ্ণু বামনাবতারের রূপ নিয়ে বলিরাজার কাছে ত্রিপাদ ভূমি চাইলেন। বলি স্বীকৃত হলেন। বামন তখন বিশ্বরূপ নিয়ে এক পা রাখলেন পৃথিবীতে, এক পা স্বর্গে। তৃতীয় পদটি নির্গত হল নাভি থেকে, পদ্মনাভ বিষ্ণু তখন বামনরূপে এই পদটি রাখার স্থান চাইলেন। বলি পেতে দিলেন মাথা। জেগে উঠল তাঁর হরিভক্তি। স্বর্গ নয়, মর্ত্য নয়, পাতালে হরি বন্দি হলেন বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু বন্দি হলেন বলির হরিভক্তির জন্য।
ওই বামনাবতারকে বলিরাজা প্রথমে চিনতে পারেননি। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গিয়েছে। বিলম্বিত লয়ের তালে তালে ক্রমশ দুলে উঠছে জগৎ, অমর্ত্য, অমর্ত্যলোক…
ক্যাবলাদের সমস্যা এটাই। তাদের কেউ গুরুত্ব দেয় না। বিদ্যাসাগরের কাহিনি লিখছেন যখন রবীন্দ্রনাথ, জানাচ্ছেন তাঁর পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের কথা, “ইহা হইতেই শ্রোতৃগণ বুঝিতে পারিবেন, একান্নবর্তী পরিবারে কেন এই অগ্নিখণ্ডটিকে ধরিয়া রাখিতে পারে নাই। তাঁহারা পাঁচ সহোদর ছিলেন, কিন্তু তিনি একাই নীহারিকাচক্র হইতে বিচ্ছিন্ন জ্যোতিষ্কের মতো আপন বেগে বাহিরে বিক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন। একান্নবর্তী পরিবারের বহু ভারাক্রান্ত যন্ত্রেও তাঁহার কঠিন চরিত্রস্বাতন্ত্র্য পেষণ করিয়া দিতে পারে নাই।” (চারিত্র্যপূজা/বিদ্যাসাগর)
পোলাও
কোর্মা।
কোপ্তা কাবাব দু’ রকম।
মাছের চপ—
মাঝখানে বেরসিকের মতো বাধা দিলে ক্যাবলা: তা হলে বাবুর্চি চাই, একটা চাকর, একটা মোটর লরি, দুশো টাকা—
—দ্যাখ ক্যাবলা-টেনিদা ঘুষি বাগাতে চাইল।
আমি বললাম, চটলে কী হবে? চারজনে মিলে চাঁদা উঠেছে দশ টাকা ছ-আনা”
সেই কবে যেন বিষ্ণু বামনাবতারের রূপ নিয়ে বলিরাজার কাছে ত্রিপাদ ভূমি চাইলেন। বলি স্বীকৃত হলেন। বামন তখন বিশ্বরূপ নিয়ে এক পা রাখলেন পৃথিবীতে, এক পা স্বর্গে। তৃতীয় পদটি নির্গত হল নাভি থেকে, পদ্মনাভ বিষ্ণু তখন বামনরূপে এই পদটি রাখার স্থান চাইলেন। বলি পেতে দিলেন মাথা। জেগে উঠল তাঁর হরিভক্তি। স্বর্গ নয়, মর্ত্য নয়, পাতালে হরি বন্দি হলেন বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু বন্দি হলেন বলির হরিভক্তির জন্য।
ওই বামনাবতারকে বলিরাজা প্রথমে চিনতে পারেননি। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গিয়েছে। বিলম্বিত লয়ের তালে তালে ক্রমশ দুলে উঠছে জগৎ, অমর্ত্য, অমর্ত্যলোক…
ক্যাবলাদের সমস্যা এটাই। তাদের কেউ গুরুত্ব দেয় না। বিদ্যাসাগরের কাহিনি লিখছেন যখন রবীন্দ্রনাথ, জানাচ্ছেন তাঁর পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের কথা, “ইহা হইতেই শ্রোতৃগণ বুঝিতে পারিবেন, একান্নবর্তী পরিবারে কেন এই অগ্নিখণ্ডটিকে ধরিয়া রাখিতে পারে নাই। তাঁহারা পাঁচ সহোদর ছিলেন, কিন্তু তিনি একাই নীহারিকাচক্র হইতে বিচ্ছিন্ন জ্যোতিষ্কের মতো আপন বেগে বাহিরে বিক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন। একান্নবর্তী পরিবারের বহু ভারাক্রান্ত যন্ত্রেও তাঁহার কঠিন চরিত্রস্বাতন্ত্র্য পেষণ করিয়া দিতে পারে নাই।” (চারিত্র্যপূজা/বিদ্যাসাগর)
এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই বিদ্যাসাগর পথ হাঁটবেন “ক্ষুদ্র একগুঁয়ে ছেলেটি মাথায় এক মস্ত ছাতা তুলিয়া তাঁহাদের বড়বাজারের বাসা হইতে পটলডাঙায় সংস্কৃত কালেজে যাত্রা করিতেন, লোকে মনে করিত একটা ছাতা চলিয়া যাইতেছে। এই দুর্জয় বালকের শরীরটি খর্ব, শীর্ণ, মাথাটা প্রকাণ্ড— স্কুলের ছেলেরা সেই জন্য তাঁহাকে ‘যশুরে কৈ’, ও তাহার অপভ্রংশে ‘কসুরে জৈ’ বলিয়া খেপাইত; তিনি তখন তোতলা ছিলেন, রাগিয়া কথা বলিতে পারিতেন না।”
এও যেন এক বামনাবতারের রূপ, কোনও এক ক্যাবলামির গৌরচন্দ্রিকা, রবীন্দ্রনাথ মনে করিয়েছেন, দূর অতীতে নবদ্বীপে শচীমাতার কোলে এমনই এক দামাল ছেলের আবির্ভাব হয়েছিল। “নিরীহ বাংলাদেশে গোপালের মতো অবোধ ছেলের অভাব নাই। এই ক্ষীণতেজ দেশে রাখাল এবং তাহার জীবনীলেখক ঈশ্বরচন্দ্রের মতো দুর্দান্ত ছেলের প্রাদুর্ভাব হইলে বাঙালিজাতির শীর্ণচরিত্রের অপবাদ ঘুচিয়া যাইতে পারে।”
আমরা কোথাও যেন এসে দাঁড়াই; যেখানে দাঁড়িয়ে মনে হতে পারে, এই যাদের রকে, ঠেকে, আড্ডায় কী চায়ের টেবিলে কিংবা বিদ্যায়তনে, সারস্বত সাধনায়, কর্মে, অকর্মে, সমাজে, জীবনে সকাল-সন্ধ্যায় অবদমিত করার চেষ্টা চলছে অবিরত, কখনও ক্যাবলা, বোকা, নির্বোধ, কিছুই জানো না, তুমি একেবারেই অপাঙক্তেয় এই অভিধায় নিঃশেষে ডুবিয়ে ধরার চেষ্টা চলে কিছু অহং ও কায়েমি স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য, সেই “তারা” ছাব্বিশ ইঞ্চির মাপে ঢুকলেই অনন্যসাধারণ হয়ে উঠছে, আর তা না হলে তাদের কার্যক্রম, ভাবধারা, মতামত সকলই কেমন যেন গলদযুক্ত মনে হতে থাকে কেন? যুক্তি আর ভাববাদের যে দ্বন্দ্ব সেখানে প্রশ্নাতীত ভাববাদ দর্শনের মননে সমর্থিত নয়, শাস্ত্রধারা প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করে, “প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া” যা লাভ করতে হয়, প্রশ্নাতীত উপেক্ষায় তাকে “শাট্ আপ্ ক্যাবলা” বলে নিঃশেষে ‘দাবড়ে’ দেওয়াই কি তবে ভবিতব্য? হ্যাঁ, অথবা না।
এও যেন এক বামনাবতারের রূপ, কোনও এক ক্যাবলামির গৌরচন্দ্রিকা, রবীন্দ্রনাথ মনে করিয়েছেন, দূর অতীতে নবদ্বীপে শচীমাতার কোলে এমনই এক দামাল ছেলের আবির্ভাব হয়েছিল। “নিরীহ বাংলাদেশে গোপালের মতো অবোধ ছেলের অভাব নাই। এই ক্ষীণতেজ দেশে রাখাল এবং তাহার জীবনীলেখক ঈশ্বরচন্দ্রের মতো দুর্দান্ত ছেলের প্রাদুর্ভাব হইলে বাঙালিজাতির শীর্ণচরিত্রের অপবাদ ঘুচিয়া যাইতে পারে।”
আমরা কোথাও যেন এসে দাঁড়াই; যেখানে দাঁড়িয়ে মনে হতে পারে, এই যাদের রকে, ঠেকে, আড্ডায় কী চায়ের টেবিলে কিংবা বিদ্যায়তনে, সারস্বত সাধনায়, কর্মে, অকর্মে, সমাজে, জীবনে সকাল-সন্ধ্যায় অবদমিত করার চেষ্টা চলছে অবিরত, কখনও ক্যাবলা, বোকা, নির্বোধ, কিছুই জানো না, তুমি একেবারেই অপাঙক্তেয় এই অভিধায় নিঃশেষে ডুবিয়ে ধরার চেষ্টা চলে কিছু অহং ও কায়েমি স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য, সেই “তারা” ছাব্বিশ ইঞ্চির মাপে ঢুকলেই অনন্যসাধারণ হয়ে উঠছে, আর তা না হলে তাদের কার্যক্রম, ভাবধারা, মতামত সকলই কেমন যেন গলদযুক্ত মনে হতে থাকে কেন? যুক্তি আর ভাববাদের যে দ্বন্দ্ব সেখানে প্রশ্নাতীত ভাববাদ দর্শনের মননে সমর্থিত নয়, শাস্ত্রধারা প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করে, “প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া” যা লাভ করতে হয়, প্রশ্নাতীত উপেক্ষায় তাকে “শাট্ আপ্ ক্যাবলা” বলে নিঃশেষে ‘দাবড়ে’ দেওয়াই কি তবে ভবিতব্য? হ্যাঁ, অথবা না।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৪: মানিকদা আমি ‘এজে’ আপনার থেকে বড়, কিন্তু আপনি ‘ইমেজে’ আমার থেকে অনেক বড়: জহর
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৪: অনন্তপ্রবাহিনী গঙ্গা, আকাশগঙ্গা, সুরলোক, হিমালয়— কোনটি তাঁর উৎস?
হ্যাঁ, কারণ, এটাই বাস্তবতা। না, কারণ, এটাই সত্য নয়। যখন বলা হয়, “লব্ধব্যমর্থং লভতে মনুষ্য” যা প্রাপণীয় তা লব্ধ হবেই, দেবগণ-ও তা অতিক্রমে সমর্থ নন। তবে এই অনতিক্রমণীয়ের ধারণা শোক বা বিস্ময়ের চেয়েও বরং এই সত্যকেই প্রতিপাদিত করে যে, ব্যক্তির মূল স্বভাববৈশিষ্ট্যে যা সুপ্ত থাকে তা কোনও পরিস্থতিতেই অন্যের করায়ত্ত্বাধীন হয় না, অপরের প্রভাবে তার পরিবর্তন ঘটে না। “যদস্মদীয়ং ন হি তত্পরেষাম্।” এই বিষয়টির ব্যাখ্যা এমনটাই হতে পারে যে, জীবের অস্তিত্বরক্ষা, বিবর্তন, আত্তীকরণের অভিমুখে যা কিছু অবশ্যম্ভাবী, যা না হলে অস্তিত্ব বিপন্ন হয় আর যা কিছু ইতিবাচক তা ঘটাটাই ভবিতব্য, যেহেতু জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা, সেই কারণে জীবনের তুচ্ছ অর্জন বা অভিজ্ঞতা এবং মানুষের অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তির সংমিশ্রণে এমন অবসম্ভাব্যতার-ই ইঙ্গিত থাকে।
না হলে কালিদাস হবেন কেন? কত কিংবদন্তি ঘুরে ঘুরে নিপাট বোকচন্দর থেকে ক্রান্তপ্রজ্ঞ কবি হয়ে ওঠার যে কাহিনি, তা যদি কপোলকল্পিত হয় বা, তাতেও কিছু আসে যায় না। বোঝা যায়, যে গাছের ডালে বসে নিজের ডালেই কোপ লাগায়, যে বিদুষী স্ত্রীর কাছে নিজের ঢক্কানিনাদ করতে গিয়ে উষ্ট্রকে উট্র বা উষ্টের বেশি বলতে পারে না, তার কবি কালিদাস হয়ে উঠতেও কিছুমাত্র অসুবিধা হয় না। অজ্ঞতার জন্য তার কিছু দুর্ভোগ ও উত্তরণের বন্ধুর পথ থাকে, কিন্তু ক্যাবলামির জন্য তাকে নির্বাসিত হতে হয় না। তবে অজ্ঞতাই কি ক্যাবলামি? নাকি অন্যতর কিছু।
সে কথা থাক। বরং একটু প্যালার দিকে তাকানো যাক।
“তাই বেশ ডাঁটের মাথায় বলেছিলাম, দূর-দূর। হাঁসের ডিম খায় ভদ্দরলোক। খেতে হলে রাজহাঁসের ডিম। রীতিমতো রাজকীয় খাওয়া!”
না হলে কালিদাস হবেন কেন? কত কিংবদন্তি ঘুরে ঘুরে নিপাট বোকচন্দর থেকে ক্রান্তপ্রজ্ঞ কবি হয়ে ওঠার যে কাহিনি, তা যদি কপোলকল্পিত হয় বা, তাতেও কিছু আসে যায় না। বোঝা যায়, যে গাছের ডালে বসে নিজের ডালেই কোপ লাগায়, যে বিদুষী স্ত্রীর কাছে নিজের ঢক্কানিনাদ করতে গিয়ে উষ্ট্রকে উট্র বা উষ্টের বেশি বলতে পারে না, তার কবি কালিদাস হয়ে উঠতেও কিছুমাত্র অসুবিধা হয় না। অজ্ঞতার জন্য তার কিছু দুর্ভোগ ও উত্তরণের বন্ধুর পথ থাকে, কিন্তু ক্যাবলামির জন্য তাকে নির্বাসিত হতে হয় না। তবে অজ্ঞতাই কি ক্যাবলামি? নাকি অন্যতর কিছু।
সে কথা থাক। বরং একটু প্যালার দিকে তাকানো যাক।
“তাই বেশ ডাঁটের মাথায় বলেছিলাম, দূর-দূর। হাঁসের ডিম খায় ভদ্দরলোক। খেতে হলে রাজহাঁসের ডিম। রীতিমতো রাজকীয় খাওয়া!”
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৭: স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ‘সাগরিকা’
লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-১: কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়…
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন
প্যালারাম পটলডাঙায় থাকে, সে পিলের রোগে ভোগা পটল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেয়েও রাজভোগের স্বপ্ন দেখা বাঙালি তরুণ। অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীবের প্রতিনিধি প্যালা, “ভদ্র মোরা, শান্ত বড়/ পোষ-মানা এ প্রাণ/ বোতাম-আঁটা জামার নীচে শান্তিতে শয়ান।”
ক্যাবলার মতো প্যালা-ও একটা পিতৃদত্ত সুভদ্র নাম বহন করে, তবে সেটা বেআব্রু জলসায় “আমাদের অনুষ্ঠান আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে” মতোই তাৎপর্যহীন স্কুল-কলেজের খাতার অলংকারমাত্র। প্যালা দেশি শব্দ। অর্থ ঠেকনা বা ঠেস। প্যালা বাসক পাতার রস খেয়ে, পালাজ্বরে ভুগে ভুগে বহু স্বাদের সাধ বুকে আঁকড়ে রেখে কাঁচকলা সিদ্ধতে ভোলা মধ্যবিত্ত প্রাণ। তার বয়ানেই “আমরা পটলডাঙার ছেলে কিছুতেই ঘাবড়াই না। চাটুজ্জেদের রোয়াকে বসে রোজ দু-বেলা আমরা গণ্ডায় গণ্ডায় হাতি-গণ্ডার সাবাড় করে থাকি।”
সুকুমার রায় গঙ্গারামের কথা জানিয়েছিলেন। যদি এই গঙ্গারামের সঙ্গে প্যালারামের দেখা হতো কেমন হবে তাহলে? গঙ্গারাম পিলেজ্বর আর পাণ্ডুরোগে ভোগা এক সৎপাত্র। সে বিদ্যাবুদ্ধিহীন। অর্থাৎ সমাজের চোখে ক্যাবলা, অক্ষম। ঊনিশবার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অকৃতকার্য এক উচ্চবংশজাত জীব। এত শারীরিক-বৌদ্ধিক প্রতিকূলতা নিয়েও সেও যদি কৌলিন্যে উতরে যায়, তাহলে সমাজ কীসে ভোলে? সে অস্থিরমতিকে ক্যাবলামি বলে, বুদ্ধিমত্তার অভাবকে ক্যাবলামি বলে, বিসদৃশ যাপনকে ক্যাবলামি বলে, দুর্বলতাকে ক্যাবলামি বলে, ভদ্রতাকেও, প্রশ্নকে ক্যাবলামি বলে, ভিন্নমতের পোষণকে ক্যাবলামি বলে, মতানৈক্যকে ক্যাবলামি বলে, প্রতিবাদকে ক্যাবলামি বলে, এমনকী নীরবতাকেও ক্যাবলামি বলে।
“এই তো সে দুপ’রে বসে ওই উপরে/ খাচ্ছিল কাঁচকলা চটকে/ এর মাঝে হল কী? মামা তার মোলো কি? অথবা কি ঠ্যাং গেল মটকে?”
ক্যাবলারা ঠিক কেন যে ক্যাবলা তা বোঝা ভারি কঠিন।
প্যালা আর ক্যাবলা বৌদ্ধিক ও চরিত্রগত ভাবে সমান নাও হতে পারে। তবে দিনের শেষে তারা একটা জায়গায় এসে অভিন্ন। তাদের বিপরীতে একজন ‘দাদা’ আছে, যে তাদের সকলকে চমৎকৃত করছে অলীক ভাষণে, সচেতন-অবচেতন-নিশ্চেতনে সেই ‘ক্যারিশমা’ তাদের মোহিত করছে, এবং সেই ‘ঢপের চপ’ গালগপ্পোকে প্রশ্ন করলেই তাদের বোধ ও জ্ঞান আক্রান্ত হচ্ছে। সবটাই খুব মজার আঙ্গিকে ঘটলেও এটাই রূঢ় বাস্তব।
ক্যাবলার মতো প্যালা-ও একটা পিতৃদত্ত সুভদ্র নাম বহন করে, তবে সেটা বেআব্রু জলসায় “আমাদের অনুষ্ঠান আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে” মতোই তাৎপর্যহীন স্কুল-কলেজের খাতার অলংকারমাত্র। প্যালা দেশি শব্দ। অর্থ ঠেকনা বা ঠেস। প্যালা বাসক পাতার রস খেয়ে, পালাজ্বরে ভুগে ভুগে বহু স্বাদের সাধ বুকে আঁকড়ে রেখে কাঁচকলা সিদ্ধতে ভোলা মধ্যবিত্ত প্রাণ। তার বয়ানেই “আমরা পটলডাঙার ছেলে কিছুতেই ঘাবড়াই না। চাটুজ্জেদের রোয়াকে বসে রোজ দু-বেলা আমরা গণ্ডায় গণ্ডায় হাতি-গণ্ডার সাবাড় করে থাকি।”
সুকুমার রায় গঙ্গারামের কথা জানিয়েছিলেন। যদি এই গঙ্গারামের সঙ্গে প্যালারামের দেখা হতো কেমন হবে তাহলে? গঙ্গারাম পিলেজ্বর আর পাণ্ডুরোগে ভোগা এক সৎপাত্র। সে বিদ্যাবুদ্ধিহীন। অর্থাৎ সমাজের চোখে ক্যাবলা, অক্ষম। ঊনিশবার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অকৃতকার্য এক উচ্চবংশজাত জীব। এত শারীরিক-বৌদ্ধিক প্রতিকূলতা নিয়েও সেও যদি কৌলিন্যে উতরে যায়, তাহলে সমাজ কীসে ভোলে? সে অস্থিরমতিকে ক্যাবলামি বলে, বুদ্ধিমত্তার অভাবকে ক্যাবলামি বলে, বিসদৃশ যাপনকে ক্যাবলামি বলে, দুর্বলতাকে ক্যাবলামি বলে, ভদ্রতাকেও, প্রশ্নকে ক্যাবলামি বলে, ভিন্নমতের পোষণকে ক্যাবলামি বলে, মতানৈক্যকে ক্যাবলামি বলে, প্রতিবাদকে ক্যাবলামি বলে, এমনকী নীরবতাকেও ক্যাবলামি বলে।
“এই তো সে দুপ’রে বসে ওই উপরে/ খাচ্ছিল কাঁচকলা চটকে/ এর মাঝে হল কী? মামা তার মোলো কি? অথবা কি ঠ্যাং গেল মটকে?”
ক্যাবলারা ঠিক কেন যে ক্যাবলা তা বোঝা ভারি কঠিন।
প্যালা আর ক্যাবলা বৌদ্ধিক ও চরিত্রগত ভাবে সমান নাও হতে পারে। তবে দিনের শেষে তারা একটা জায়গায় এসে অভিন্ন। তাদের বিপরীতে একজন ‘দাদা’ আছে, যে তাদের সকলকে চমৎকৃত করছে অলীক ভাষণে, সচেতন-অবচেতন-নিশ্চেতনে সেই ‘ক্যারিশমা’ তাদের মোহিত করছে, এবং সেই ‘ঢপের চপ’ গালগপ্পোকে প্রশ্ন করলেই তাদের বোধ ও জ্ঞান আক্রান্ত হচ্ছে। সবটাই খুব মজার আঙ্গিকে ঘটলেও এটাই রূঢ় বাস্তব।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৪: কিশোরের শুধু কণ্ঠই নয়, তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকেও গানের নেপথ্যে সুকৌশলে কাজে লাগাতেন পঞ্চম
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৩: বায়োপসি মানেই ক্যানসার?
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৭: দু’ মাস আগের এক সন্ধ্যা
হরিহর বিরক্ত হয়ে অপুকে বলেছিলেন “তুমি বড্ড হাঁ করা ছেলে। যা দেখো তাতেই হাঁ করে থাকো কেন অমন? জোরে হাঁটো।”
এটাই বুঝি ক্যাবলামির দৃষ্টান্ত!
পরশুরামের বিরিঞ্চিবাবার প্রবচনগৃহে উঁকি দেওয়া যাক।
“বাবার বেদীর নীচে ডান—দিকে ছোট—মহারাজ কেবলানন্দ বিরাজ করিতেছেন। ইঁহার বয়স কয় শতাব্দী তাহা ভক্তগণ এখনও নির্ণয় করেন নাই, তবে দেখিতে বেশ জোয়ান বলিয়াই মনে হয়। ইনিও গুরুর অনুরূপ বেশধারী, তবে কাপড়টা সস্তাদরের”
ইনি কেবলানন্দ বলেই ‘ছোট মহারাজ’, বড় মহারাজটি যখন বৈবস্বত মনুকে ট্রেনিং দিয়ে, চন্দ্র-সূর্যকে নিয়মিত অয়েলিং করে, নিয়মিত যজ্ঞশালায় একেকজন দেবতাকে ডেকে এনে হৈচৈ ফেলে দিচ্ছেন, তখন এই কেবলানন্দ কি করছেন?
“মহাদেব বলিলেন—’আঃ—ছাড়—ছাড়—লাগে, মাইরি এখন ইয়ারকি ভাল লাগে না—চাদ্দিকে আগুন—ছেড়ে দাও বলছি।’
সত্যব্রত বলিল—’আরে অত ব্যস্ত কেন। একটু আলাপ পরিচয় হ’ক। তারপর ক্যাবলরাম, কদ্দিন থেকে দেবতাগিরি করা হচ্ছে?”
বলা বাহুল্য, টেনিদার সহচর ক্যাবলা আর বিরিঞ্চিবাবার সহচর ক্যাবলার গুণগত পার্থক্য আছে, বরং বলা যায়, আচরণগত বৈপরীত্য আছে। একজন যদি হয় সত্যদ্রষ্টা অন্যজন প্রতারক। কিন্তু কী আশ্চর্য! দুজনেই ক্যাবলা! কেন? তা তাদের বিপরীতের চরিত্রগুলির অদ্ভুত সাম্য দেখলেই বোঝা যায়, হাড়ে হাড়ে।—চলবে
ঋণ:
● নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (বনভোজনের ব্যাপার)
● সুকুমার রায় (হুঁকোমুখো হ্যাংলা)
● রাজশেখর বসু (বিরিঞ্চিবাবা)
এটাই বুঝি ক্যাবলামির দৃষ্টান্ত!
পরশুরামের বিরিঞ্চিবাবার প্রবচনগৃহে উঁকি দেওয়া যাক।
“বাবার বেদীর নীচে ডান—দিকে ছোট—মহারাজ কেবলানন্দ বিরাজ করিতেছেন। ইঁহার বয়স কয় শতাব্দী তাহা ভক্তগণ এখনও নির্ণয় করেন নাই, তবে দেখিতে বেশ জোয়ান বলিয়াই মনে হয়। ইনিও গুরুর অনুরূপ বেশধারী, তবে কাপড়টা সস্তাদরের”
ইনি কেবলানন্দ বলেই ‘ছোট মহারাজ’, বড় মহারাজটি যখন বৈবস্বত মনুকে ট্রেনিং দিয়ে, চন্দ্র-সূর্যকে নিয়মিত অয়েলিং করে, নিয়মিত যজ্ঞশালায় একেকজন দেবতাকে ডেকে এনে হৈচৈ ফেলে দিচ্ছেন, তখন এই কেবলানন্দ কি করছেন?
“মহাদেব বলিলেন—’আঃ—ছাড়—ছাড়—লাগে, মাইরি এখন ইয়ারকি ভাল লাগে না—চাদ্দিকে আগুন—ছেড়ে দাও বলছি।’
সত্যব্রত বলিল—’আরে অত ব্যস্ত কেন। একটু আলাপ পরিচয় হ’ক। তারপর ক্যাবলরাম, কদ্দিন থেকে দেবতাগিরি করা হচ্ছে?”
বলা বাহুল্য, টেনিদার সহচর ক্যাবলা আর বিরিঞ্চিবাবার সহচর ক্যাবলার গুণগত পার্থক্য আছে, বরং বলা যায়, আচরণগত বৈপরীত্য আছে। একজন যদি হয় সত্যদ্রষ্টা অন্যজন প্রতারক। কিন্তু কী আশ্চর্য! দুজনেই ক্যাবলা! কেন? তা তাদের বিপরীতের চরিত্রগুলির অদ্ভুত সাম্য দেখলেই বোঝা যায়, হাড়ে হাড়ে।—চলবে
ঋণ:
● নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (বনভোজনের ব্যাপার)
● সুকুমার রায় (হুঁকোমুখো হ্যাংলা)
● রাজশেখর বসু (বিরিঞ্চিবাবা)
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।