শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


অলঙ্করণ: লেখক।

ট্রেন চলছে। ঝটপট সব কিছু পিছনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কড়কড়ি ইলেকট্রিকের মালিক বদন কড়কড়ির ছোটো নাতি ট্রেনে চেপেই তার বাবাকে প্রশ্ন করে “ট্রেনটা চলছে কী করে বাবা?”
“ইলেকট্রিকে বাবা।”
“ইলেকট্রিক কী বাবা?”
“আলো-পাখা যাতে চলে বাবা।”
“ট্রেন কীভাবে চলে বাবা, আমাদের মতো পা আছে?”
“চাকা আছে, লাইন আছে, লাইনের ওপর দিয়ে চাকা ছোটে, ওই দেখো বাইরে দেখো, মাঠে কেমন ছাগল চরছে।”
“বাবা! সব পিছনে ছুটছে কেন? ছাগলটা তো পিছনে ছুটে গেল যেন…”
বাবা সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে থাকে। শেষে বলে, আরেকটু বড় হও, বুঝতে পারবে।
ছেলে বলে “বাবা আমি কি ছোটো? বড় নই কেন?”
বাবা উত্তর করে, “তোমার বয়স মোটে পাঁচ, এই বয়সের বাচ্চারা ছোটই হয়।”
“তাহলে বোনের বয়স তো মোটে দুই, বোন কী তবে?”
“বোন-ও ছোট।”
” তুমি কি তবে বড়?”
“হ্যাঁ”
“কেন বড়?”
কেন, তার উত্তর হঠাৎ যোগায় না। এখানে একটা বয়সজনিত গাণিতিক সমাধান বলার চেষ্টা করে বাবা। তারপর বলে,” বড় হলে ঠিক বুঝবে”…
“তুমি তাহলে সব বোঝো?”
এর-ও উত্তর যোগায় না, হাতে ধরা সদ্য কেনা খেলার পাতা, ব্রেজিল প্রথম হাফেই হাফ ডজন গোল করেছে, সেটা তারিয়ে তারিয়ে পড়ার বদলে এইসব… বেশ লেখেন ক্রীড়া-সাংবাদিক ভদ্রলোক, একেবারে মাঠে বসে খেলা দেখার উত্তেজনা পাওয়া যায়।
“কী হল, ও বাবা বলো…”
একটু সুর চড়িয়ে বাবা বলে “এতো বড়ো হয়ে গেছো, এ সব ক্যাবলার মতো প্রশ্ন করিস কেন? সব বুঝে গিয়ে সবজান্তা হয়েছো বুঝি?”
ট্রেন ছুটছে। সব ঊর্ধ্বশ্বাসে পিছনে ছুটছে। যেমন করে একদিন ছুটেছিল একপাল হাতি-ভেড়া-শূকরের দল, পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে বলে।
ম্যাডাম বললেন, “তোমার নাম কী? পড়া করে আসোনি কেন?”
প্লুটো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“নাম বলো…”
ম্যাডাম আজ স্কুলে নতুন জয়েন করেছেন। এখন টিফিনের আগের ক্লাস, এইট বি।
“প্লুটো।”
“মানে… এটা তোমার নাম, না তোমার কুকুরের?”
ক্লাসে হাসির হররা পড়ে গেল।
প্লুটো গম্ভীরভাবে বলল,” আমার ভালো নাম দীপ্তার্ক বসু, ডাক নাম প্লুটো। আমার একটা কুকুর আছে। তার নাম নেপচুন।”
“তো, ডাক নাম তোমার কাছে কে জানতে চেয়েছে। খুব পাকা তো… নিজেকে খুব বোদ্ধা ভাবো? এসব ক্যাবলামি ক্লাসে করবে না। পড়া করোনি কেন?”
“আপনি তো কোনও পড়া দেননি ম্যাডাম, আজ প্রথম দেখলাম আপনাকে।”
ছেলেটার ধৃষ্টতায় বিস্মিত হন নতুন ম্যাডাম মিস ক্যামেলিয়া গুছাইত। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, “তুমি ছোট, সব বোঝো না, আজ তোমাকে কিছু বললাম না। তোমাদের ক্লাস শুরু হয়েছে আজ দু’মাস হল। এত বড় হয়ে গিয়েছ, দায়িত্ববোধ নেই কোনও? আলোর গতি সেকেন্ডে কতো এখনও জানো না কেন?”

সত্যি, তারাগুলো যদি ধাঁ করে ধরাতলে নেমে আলোর গতিতে দৌড়োতো, যদি গরুগুলো আকাশে উড়তো, যদি ফুলগুলো ফুটতো ফটফট শব্দ করে, অথবা যদি হাতি দিয়ে হাল টানানো যেতো… যদি রাতগুলো রঙিন হতো, দিনগুলো বিকাল হল, যদি বিছানাগুলো তেপান্তরের মাঠ হতো, যদি পাখির ভাষা বোঝা যেতো, যদি… যদি এমন অনেক কিছুই হতো তাহলে?
কান পাতলেই শোনা যাবে এই অদ্ভুত বোধ-বুদ্ধির দুনিয়াটা ছোটবেলাকে ছাড়িয়ে অনন্তে মিশেছে। যে বোধ, যে অনুভূতি, যে জিজ্ঞাসা ভোলায়, পাগল করে, ঘুরিয়ে মারে… কৈবল্যবাদী বা বিবাগী বা বাউলের অধ্যাত্মানুসন্ধানের কোণে কোণে সেই বিস্ময়বোধের আলো-আলো ছায়াপাত।
“আকাশটা কাঁপছিল ক্যান/ জমিনটা নাচছিল ক্যান/ বড়পীর ঘামছিল কেন সেইদিন… সেইদিন…”
সুদূরের পিয়াসী কোন্ ঋষি এমন কথাই বলেছিলেন “কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম্”…
কে আবৃত করেছিল? কোথায় কার স্থান ছিল? দুর্গম ও গভীর জল কি তখন ছিল?
কে জানে… কেউ জানে না কেউ জানে না মন জানে? জানে কি আদৌ?
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৩: ধরবো ধরবো করছি কিন্তু…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

ঋষির চিত্তে এমন জিজ্ঞাসা উদ্ভাসিত হয়, বাউলের মনে জেগে ওঠে জানার আকাঙ্ক্ষা, পণ্ডিত বিদ্বান বুদ্ধিমান মানুষ মাথা চুলকে টিকি নেড়ে চশমা সামলে থিওরি আর থিওরেম নিয়ে মাতেন, তাঁদের প্রতিপাদ্য-উপপাদ্য-সম্পাদ্য শুনে জগৎ জয়ধ্বনি করে, কখনও বা দূরে ঠেলে আবারও কাছে টেনে নেয়, মূর্খপণ্ডিতের দল সার্কাসের জোকার হয়ে হাসিয়ে মারে, পণ্ডিতন্মন্য বিদ্বান বা বিদুষী বিদূষকরা ট্রাপিজ বদলান, ধরতে গিয়ে পড়েন নিচের জালে, আবার উঠতে থাকেন সেই মাকড়সাটার মতো, যতক্ষণ না লক্ষ্যে পৌঁছনো যায় থেমো না… “প্রাপ্য বরান্ নিবোধত” বুঝি… লোকে তাঁদের দুঃখে আহা উঁহু করে সমবেদনা জানাতে জানাতে বিস্ময়ে দেখে সেই চশমা সাঁটা বোতাম আঁটা জীবগুলি কেমন জোকারের মতো হাত-পা ছুড়ছে… তাঁদের পতন যেমন মেকি, উত্থান-ও তেমনতর, সকলকে ছোটো করে ক্যাবলা বলে তাদের ক্যাবলামিতেই ভর করে এই উত্থান, তাঁদের অবস্থান যেমন ভেজাল, তেমনই ওই চশমার অন্তর্দৃষ্টি, ওই তত্ত্বানুসন্ধান, ওই নকল জীবনবোধ, ওই হেড আপিসের বড়বাবুর মতো হাবভাবের সবটার ষোলোআনাই কুৎসিত, কদর্য, অনৈতিক ও মহাফাঁকিতে ভরা এক মহাশূন্য।

“সবাই তাঁকে বুঝিয়ে বলে, সামনে ধরে আয়না,
মোটেও গোঁফ হয়নি চুরি, কক্ষনো তা হয় না ।
রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি,
“কারো কথার ধার ধারিনে, সব ব্যাটাকেই চিনি।
নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা,
এমন গোঁফ তো রাখতো জানি শ্যামবাবুদের গয়লা ।
এ গোঁফ যদি আমার বলিস করব তোদের জবাই”—
এই না বলে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায়।
ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়,
“কাউকে বেশি লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায় ।
আফিসের এই বাঁদরগুলো, মাথায় খালি গোবর,
গোঁফ জোড়া যে কোথায় গেল কেউ রাখে না খবর ।
ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি,
মুখ্যুগুলোর মুণ্ডু ধরে কোদাল দিয়ে চাঁচি।
গোঁফকে বলে তোমার আমার–গোঁফ কি কারো কেনা ?
গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।”
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৬: অবশেষে চার হাত এক হল, পঞ্চম-আশা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শুরু করলেন দ্বিতীয় ইনিংস

কবি ক্রান্তদর্শী। তাই বলতে পারেন “ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত, পাঠায়েছ বারে বারে”… কবি পরে কী বলেছেন সেটা ভেবে কাজ নেই, বরং দেখা যাক অন্যকিছু, ভাবা যাক অন্যভাবে।
মোট কথা হল, আপেক্ষিকতার এক বিস্ময়কর ইন্দ্রজালে তোমার ওজন বাড়ে কমে, কখনও তুমি ঐরাবত হয়ে অলকনন্দায় আনন্দলহরী তোলো, কখনও নেহাত হস্তিমূর্খ হয়ে কাদা থেকে উঠতে পারো না।

ষষ্ঠীচরণ খেলার ছলে যখন তখন হাতি নিয়ে লোফালুফি করতো বলে শোনা যায়, তাকে ক্যাবলা বলার সাহস কেউ ধরতো কীনা বলা কঠিন, যারা বলবেই, একান্তই কিছু না বলে যারা থাকতে পারে না মোটে, তারা হয়তো হাতিটাকেই ক্যাবলা বলে দাগিয়ে দেবে। শেয়ালের বুদ্ধিতে কখনও কাদায় আটকে মরা তার ভবিতব্য, কখনও বা হাতির সঙ্গে হাতাহাতি করেই কুরুক্ষেত্র বেঁধে যায়।

“কাকা সর্বশেষ ঘোষণা করেন, তাঁকে শ্বেতহস্তীই দিতে হবে এনে, শ্যমরাজ্য কি রামরাজ্য থেকেই হোক, হাতিপোতা কি হস্তিনা থেকেই হোক, করাচী কিম্বা রাঁচি থেকেই হোক, উনি সেসব কিছু জানেন না কিন্তু শ্বেতহস্তী ওঁর চাই। চাই-ই। যেখান থেকে হোক, যে করেই হোক যোগাড় করে দিতেই হবে, তা যত টাকা লাগে লাগুক। এক আধখানা হলে হবে না, অন্তত ডজন খানেক চাই তার, না হলে কালেকশন আবার কাকে বলে?”

কথায় বলে মরা হাতি লাখ টাকা। সেই হাতি যদি জ্যান্ত আর সাদা হয়, তাহলে?
“এই ফর্সা রঙটি বজায় রাখতে হলে সাবান মাখিয়ে একে চান করাতে হবে দু’ বেলা–ভাল বিলিতি সাবান, হুঁ হুঁ পয়সার জন্য পরোয়া করলে চলবে না। নইলে আমার এমন সোনার হাতি কালো হয়ে যেতে কতক্ষণ?”

এর পরে জানা যায়, এ হাতির স্নান নিষিদ্ধ। স্নান করালে শ্বেতহস্তীর গলগণ্ড হয়, রাজার হালে থাকা অভ্যাস কীনা, রীতিমতো সিংহাসনে বসে ধূপধুনো-সহ নিত্যপূজা নেওয়ার অভ্যাস। খাওয়া-দাওয়ায় উদার ও সিদ্ধহস্ত… মানুষ থেকে মহাভারত, শালাদোশালা থেকে ইট-পাটকেল, রসগোল্লা কী কলাগাছ সব তাঁর মুখস্থ হতে পারে। শুধু আলিগড়ি মাখন তিনি সামলাতে পারেন না। পানীয়ের মধ্যে “দুধ, জল, ঘোলের সরবৎ, ক্যাস্টর অয়েল, মেথিলেটেড স্পিরিট–কত আর বলব? কার্বলিক এ্যাসিডেও কিচ্ছু হবে না ওর, তারও দু-দশ বোতল দু-এক চুমুকে নিঃশেষ করতে পারে। কেবল এক—চা খায় না।”

কিন্তু কলাগাছ পেয়ে হাতি আর কিছুর দিকে ফিরেও তাকায় না। ক্রমে বর্ষা সমাগত হলে মেঘ দেখে বপ্রক্রীড়ারত আশ্লিষ্টসানু মেঘের মতোই ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯: ঠাকুরের ঘরণী সারদার গার্হস্থ্য জীবন

“কাকা মাথা ঘামালেন খানিকক্ষণ। বুঝতে পারা গেছে। মেঘ ডাকছে কিনা। মেঘ ডাকলে ময়ূর নাচে। হাতিও নাচতে চাইবে আর আশ্চর্য কি? ময়ূর আর হাতি বোধহয় একজাতীয়? কার্তিক ঠাকুরের পাছার তলায় ময়ূর আর গণেশ ঠাকুরের মাথায় ওই হাতি, আত্মীয়তা থাকাই স্বাভাবিক। যাই হোক, ওর তিন পায়ের শেকল খুলে দাও, কেবল এক পায়ের থাক, নাচুক একটুখানি!”

কিন্তু, ক্রমে সেই নাচ প্রলয়নাচন হয়ে দেখা দেয়। মাঠ-ঘাট পেরিয়ে, বাড়ি-ঘর উপড়ে দিয়ে এসে পড়ে গঙ্গাযাত্রীর দলের মাঝে।

“একদল গঙ্গাযাত্রী একটি আধমড়াকে নিয়ে যাচ্ছিল গঙ্গাযাত্রায়, এমন সময়ে মহাপ্রভু এসে পড়েন। অমন ঘটা করে ঢাক ঢোল পিটিয়ে রাস্তা জুড়ে যাওয়াটা ওঁর মনঃপুত হয় না। উনি ওদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। শোনা গেল, এক একজনকে অনেক দূর অবধি তাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। কেবল বাদ দিয়েছেন, কেন জানা যায়নি, সেই গঙ্গাযাত্রীকে। সেই বেচারা অনেকক্ষণ অবহেলায় পড়ে থেকে অগত্যা উঠে বসে দেহরক্ষা কাজটা এ যাত্রা স্থগিত রেখে একলা হেঁটে বাড়ি ফিরে গেছে।”

শেষে হাতি নামে এক পুকুরে। তাকে তুষ্ট করার সাধ্যসাধনা অসাধ্য হয়ে উঠলে শোনা যায়—

“অপরাধ নিয়ো না প্রভু শ্বেতহস্তী! আমি তোমার ভক্ত—শ্রীচরণের দাসানুদাস। কি বলতে চাও বলো, আমি কান বাড়িয়ে দিচ্ছি। তোমার ভক্তকে তুমি কিছু বলবে না, আমি জানি। হাতির মতো কৃতজ্ঞ জীব দুই নেই, আর তুমি তো সামান্য হাতি নও, তুমি হচ্ছ একজন হস্তী-সম্রাট।”
ক্যাবলারাই বুঝি হাতি পোষার স্বপ্ন দেখে! শ্বেতহস্তী পোষার যে প্রবাদ কথায় আছে, তার শেষ কোথায় হয়? হাতি চলে আপন মনে, পিছনে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, লোকে বলে। বড় বড় স্বপ্নগুলো কেমন করে গোষ্পদে ডুবে মরে? কেমন করে অচরিতার্থ অহং কেবল একটা শুষ্ক আহাম্মকিতে পরিণত হয়?

“কিন্তু হাতিটা অকস্মাৎ শুঁড় দিয়ে কাকার কান পাকড়ে ধরে। কানে হস্তক্ষেপ করায় কাকা বিচলিত হন। কেন বাবা হাতি! কি অপরাধ করেছি বাবা তোমার শ্রীচরণে যে এমন করে তুমি আমার কান মলছ?
কিন্তু হস্তীরাজ কর্ণপাত করে না।…

… অবশেষে হাতি পরাজয় স্বীকার করে তবে কাকার কান শিকার করে তারপরে। আর হাতির হাতে কান সমর্পণ করে কাকা ও যাত্রা প্রাণরক্ষা করেন।
কাকার কানটি হাতি মুখের মধ্যে পুরে দেয়। কিন্তু খেতে বোধহয় তার তত ভালো লাগে না। সেইজন্যই সে এবার রসগোল্লার হাঁড়ির দিকে শুঁড় বাড়ায়।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, অফিসপাড়ার ক্যান্টিন ডেকার্স লেনে কোলাহল

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-২৫: দারুণ দাম্পত্য ও নিদারুণ রসিকতা

যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে কাকা বলতে থাকেন দিসনে খবরদার, দিসনে ওকে রসগোল্লা। হাতি না আমার চোদ্দ পুরুষ। পাজী ড্যাম শুয়ার রাসকেল গাধা, ইস্টুপিট! উঃ, কিছু রাখেনি কানটার গো, সমস্তটাই উপড়ে নিয়েছে। উল্লুক, বেয়াদব আহাম্মোক!”

অন্ধের হস্তিদর্শন ঠিক কী যেন? হাতির গায়ে, কানে, শুঁড়ে কিংবা লেজে হাত বুলিয়ে কারা যেন হাতিটা কেমন জানতে চেয়েছিল। রায় বেরিয়েছিল তৎক্ষণাৎ, কিন্তু হাতিটা আর হাতি না থেকে নেহাত্ গরু, অজগর কিংবা ডাইনোসর বলেই মনে হয়েছিল তাদের। তত্ত্বচিন্তকরা বেশ ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, একদেশদর্শিতায় ভুগে ভুগে যারা পৃথিবীকে চৌকো, চাঁদটাকে হাতের মুঠোয়, দিল্লিটাকেই লাড্ডু আর মোয়াকে সর্বদাই ছেলের করায়ত্ত ভাবেন, তাদের জন্যই সোনার পাথরবাটি কিংবা আকাশকুসুমের নিদান, নিদেনপক্ষে হাতিমি কিংবা বকচ্ছপের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা করে করে এঁরা হাঁসজারু কিংবা হেঁসোরাম হুঁশিয়ার হয়ে ঠোঙাভরা বাদাম-ভাজা খেয়েও গেলেন না, না খেয়েও দিব্যি হজম করে ফেলেন।

বোকামি খারাপ নাকি আহাম্মকি? ক্যাবলারাই বেশি হাবা নাকি হাঁদারাই বেশি ক্যাবলা? সর্দি ভালো নাকি জন্ডিস? পেটখারাপ না পিলের ব্যামো কোনটা বেশি নির্বিষ? শেষে মনে হবে নাতো সোজা-বাঁকা, সস্তা-দামি কিংবা তুমি-আমি সকলেই ভালো? যখন মনে হবে কর গুণে হিসেব মেলানোর সময় থাকবে তো?

“কাকার কথা হাতিটা যেন বুঝতে পারে; সঙ্গে সঙ্গে জল থেকে উঠে আসে। ও হরি, একি দৃশ্য! গলার নীচের থেকে যে অব্দি জলে ডোবানো ছিল, হাতির সেই সর্বাঙ্গ একেবারে কুচকুচে কালো, যেমন হাতিদের হয়ে থাকে। কেবল গলার উপর থেকে সাদা। অ্যাঁ, এ আবার কী বাবা?
তাকিয়ে দেখি, পুকুরের কালোজল হাতির রঙে সাদা হয়ে গেছে। শ্বেতহস্তীর আবার একি লীলা?

কর্ণহারা হয়ে সে শোকও কাকা কোনো মতে এ পর্যন্ত সামলে ছিলেন, কিন্তু হাতির এই চেহারা আর তার সহ্য হয় না। এত সাধের তার সাদা হাতি–!”

এ গল্প এখানেই শেষ করা ভালো। পথ, রথ, মূর্তি সকলেই যখন স্বয়ং দেবরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন বলে ভাবেন, যখন রজ্জু দেখেই সর্পভয়, হাওয়া দিলেই প্রলয়ের পদপাত, আগুন থাকলেই ধোঁয়া, বোমের জবাবে গুলির নিশানাকেই বিপ্লব অথবা মেঘ দেখলেই বৃষ্টি কিংবা আলো ফুটলেই বুঝি অলীক স্বপ্নের ভোর ভেবে নেওয়াটাই বুঝি নিয়ম হয়েও নিয়ম নয়, অস্বাভাবিক রকমের স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়ামাত্র, তখনও বিশ্বাস হারানোর পাপ, অবিশ্বাসের নিরন্তর পুণ্য, তর্কহীন বিশ্বাসে বস্তুগত লাভের মোহমায়া, মহাজ্ঞানী মহাজনের মার্গদর্শন আর, সদাজাগ্রত ছোটছোট বড়বড় ক্যাবলামির ঔদ্ধত্য কোন্ সে ঝড়ের ভুলে ফুল ঝরায় নাকি সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটিয়ে তোলে হৃদয়নন্দনবনের পারিজাত… তা কেউ জানে না, কেউ জানে না, মন জানে?—চলবে।

ঋণ স্বীকার:
হাতির সঙ্গে হাতাহাতি: শিব্রাম চক্কোত্তি
গোঁফচুরি: সুকুমার রায়
আকাশটা কাঁপছিল ক্যান: শাহ্ আলম সরকার
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content