রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


অলঙ্করণ: লেখক।

ক্যাবলারা সচরাচর যেটা করে, দাপট আর চাপের সামনে ভেঙে পড়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন খাপছাড়া কিছু একটা করে বসে। অথবা, তারা এমনই বিসদৃশ যে, উল্টো কাজটাই তাদের কাছে সোজা, সহজ আর কর্তব্য বলে মনে হয়। অথবা, তারা অন্যের খাপে মেলে না বলে কখনও মুখে মুখে ‘তক্ক’ করে হেতুবিদ্যা আর যুক্তির গজদন্তমিনার গড়তে চায়।

জগৎ চলে তার নিয়মে। সেই চলায় কতখানি সত্য-মিথ্যা বা ফাঁকি-ভুলের কারসাজি আছে তার হিসেব বৃথা। কারণ জগৎটা এ ভাবেই চলেছে। তাকে যদি গড্ডলিকাপ্রবাহ বলো, অথবা বলো, ‘কাল থেকে ঠিক পাল্টে দেব’, তো তাতে জগতের ক্ষতি-বৃদ্ধি তেমন নেই। কিছুই চলছে না, অথবা সব কিছুই ভালো চলছে, তুমি কিছু পারো না, আমিই সবটা পারি অথবা আজ অপূর্ণ, আগামী সম্পূর্ণ এই বোধগুলো মানুষকে কিছু আত্মবিশ্বাস অথবা অহঙ্কার, কিছু প্রেরণা অথবা সযত্নলালিত স্বপ্নের জগতে আবর্তিত করতে পারে, কিন্তু কিছু ব্লুপ্রিন্ট, কিছু আশ্বাস, বিশ্বাস, অনুমান আর কল্পনা ছাড়া চূড়ান্ত কোনও সত্যে উপনীত হওয়া হয় না। কেবল অনাগতের বিষয়ে মানুষ একান্তই অনভিজ্ঞ বলে নয় তা, কিংবা মনুষ্যতত্বে অবিমৃষ্যকারিতা, হঠকারিতা এই ধারণাগুলি বর্তমান বলেও নয়, আপাত, আপেক্ষিক আর সাময়িক, এই শব্দময় ধারণাগুলো পৃথিবীর বুকে এমনই ক্রিয়াশীল যে কোনওকিছুকে আঁকড়ে বাঁচার দুর্দম বাসনার ওই গড্ডলিকাপ্রবাহ শেষে ছিন্নমূল হয়ে পড়ে। তাই ক্যাবলামির যথার্থ সংজ্ঞা বোধহয়, আজও নেই।

এই যে ‘নরু’ যা কিছু ভেবে ভেবে সারা হয় তাকে যদি ক্যাবলামি না বলে চাতুর্য বলা হয় ক্ষতি কি? এমন চাতুরী না করাটাই বুঝি ক্যাবলামি, এমন ক্যাবলা না হতে পারাই বুঝি চাতুরী আর সার্থকতা!

“মা। আমার আর কি কোনও ভাবনা নেই নরু? আচ্ছা, তুই তো এত ভাবিস, তুই-ই বল দেখি উপস্থিত কাজ উপস্থিত ভাবনা ছেড়ে কি এই-সব বাজে ভাবনা নিয়ে থাকা ভালো? সকল ভাবনারই তো সময় আছে।
নরহরি। এ কথাটা বড়ো গুরুতর মা! আমি হঠাৎ এর উত্তর দিতে পারব না। এটা কিছুদিন ভাবতে হবে, ভেবে পরে বলব।”

দেখা যাক, টেনিদা কী করছে।
“পরদিন গোটা পাড়াটাই পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল।
দি ভজহরি ফিলিম কর্পোরেশন
আসিতেছে–আসিতেছে
রোমাঞ্চকর বাণীচিত্র
বিভীষিকা।
পরিচালনা: ভজহরি মুখোপাধ্যায় (টেনিদা)
কাহিনি: প্যালারাম বন্দ্যোপাধ্যায়।

তার নীচে ছোট ছোট হরফে লেখা: সর্বসাধারণকে কোম্পানির শেয়ার কিনিবার জন্য অনুরোধ জানানো হইতেছে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য মাত্র আট আনা। একত্রে তিনটি শেয়ার কিনিলে মাত্র এক টাকা।

এর পরে একটা হাত এঁকে লিখে দেওয়া হয়েছে: বিশেষ দ্রষ্টব্য শেয়ার কিনিলে প্রত্যেককেই বইতে অভিনয়ের চান্স দেওয়া হইবে। এমন সুযোগ হেলায় হারাইবেন না। মাত্র অল্প শেয়ার আছে, এখন না কিনিলে পরে পস্তাইতে হইবে। সন্ধান করুন: ১৮নং পটলডাঙা স্ট্রিট, কলিকাতা।”
ক্রাউড ফান্ডিং!
বিজ্ঞাপনে প্রতারিত হবেন না? শিবরাম একবার জানিয়েছিলেন, কোথায় যেন বাড়ি কিনতে হলে জমির চারপাশের হাওয়াও বর্গফুটে কিনতে হয়। অথবা, সেই কারা যেন রাজাকে কাপড় পরাবে বলে অনেক অনেক, অনেক পরিশ্রম করে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মহামূল্যবান রাজবেশ বানিয়ে এনেছিল? সেই তারাই যদি “ন্যাংচাদার হাহাকার” শুনতে পেত…
“ক্যাবলা বললে-কুরুবক তো ভালোই। এক রকমের ফুল।

—থাম, তুই আর সবজান্তাগিরি করিসনি। কুরুবক যদি ফুল হয়, তা হলে কানিবকও একরকমের গোলাপফুল। তা হলে পাতিহাঁসও এক রকমের ফজলি আম! তা হলে কাকগুলোও এক রকমের বনলতা হতে পারে।
ক্যাবলা বললে-বা-রে, তুমি ডিকশনারি খুলে দ্যাখো না।

শাট আপ! ডিকশনারি। আমিই আমার ডিকশনারি। আমি বলছি কুরুবক এক ধরনের বক–খুব খারাপ, খুব বিচ্ছিরি বক। যদি চালিয়াতি করবি তো এক চাঁটিতে তোর দাঁত…
—দাঁতনে পাঠিয়ে দেব।
—আমি জুড়ে দিলুম: কিন্তু বকের বকবকানি এখন বন্ধ করো বাপু। কী ন্যাংচাদার গল্প যেন বলছিলে?”

টেনিদা জানিয়েছে “স্টার হবে? আমার ন্যাংচাদাও স্টার হতে গিয়েছিল, বুঝলি? এখন নেংচে-নেংচে হাঁটে আর সিনেমা হাউসের পাশ দিয়ে যাবার সময় কানে আঙুল দিয়ে, চোখ বুজে খুব মিহি সুরে দীনবন্ধু, কৃপাসিন্ধু কৃপাবিন্দু বিতরো—এই গানটা গাইতে-গাইতে পেরিয়ে যায়।”

ন্যাংচা দা টেনিদার বাগবাজারের “চোরে চোরে” মাসতুতো ভাই। তার মনে ছিল ফিল্মে ‘নামা’ বা ‘ওঠা’র শখ। কারণ তার অভিনয়ের সঙ্গে ভাব ছিল। অভিনয়ের ভাব আসতো পথে ঘাটে। একদিন সে মুখোমুখি হল “ইউরেকা ফিলিম কোং। নবতম অবদান-হাহাকার”এর।

“ন্যাংচাদা বাগবাজারের ছেলে তুখোড় চিজ। তিন মিনিটে আলাপ জমিয়ে নিলে। লোকটার নাম চন্দ্রবদন চম্পটী–সে হল হাহাকার ফিলিমের একজন অ্যাসিসট্যান্ট।… চন্দ্রবদনকে ন্যাংচাদা ভজিয়ে ফেললে। তার বদনে দুটো ডবল ডিমের মামলেট, চারটে টোস্ট আর তিন কাপ চা ঘুষ দিয়ে-শেষে হাতে চাঁদ পেয়ে গেল ন্যাংচাদা। ওঠবার সময় চন্দ্রবদন বললে—এত করে বলছেন যখন—বেশ, আপনাকে আমি ফিলিমে চান্স দেব। কাল বেলা দশটার সময় যাবেন বরানগরের ইউরেকা ফিলিমে নামিয়ে দেব জনতার দৃশ্যে।”
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১০: আমাদের কোনও শাখা নেই

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

চন্দ্রবদন সাকিন হদিশ বাতলে উঁচু পাঁচিলঘেরা একটা জায়গার কথা বলে যায়। তারপর…
“খানিকটা হাঁটতেই–আরে, ওই তো উঁচু পাঁচিল। ওইটেই নিশ্চয় ইউরেকা ফিলিম।
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল ন্যাংচাদা। বাইরে একটা মস্ত লোহার গেট ভেতর থেকে বন্ধ। তার ওপরে বোর্ডে কী একটা নাম লেখা আছে কিন্তু লতার ঝাড়ে নামটা পড়া যাচ্ছে না-দেখা যাচ্ছে কেবল তিনটে হরফ—এল, ইউ, এম।
এল-ইউ-এম! লাম। মানে ফিলাম। তার মানেই ফিলিম।
ক্যাবলা আপত্তি করলে, লাম! লাম কেন হবে? এফ-আই-এল-এম ফিলম।
টেনিদা রেগেমেগে চিৎকার করে উঠল: সায়লেন্স! আবার কুরুবকের মতো বকবক করছিস? এই রইল গল্প–আমি চললুম।”

ক্যাবলামি করেছো কী মরেছো। চিন্তাশীল নরুর ভাবনা ভাঙাবার জন্য তার ভাগ্নে হরিদাসকে কোলে দিতে চাইলে নরহরির ভাবনার বেগ কমে না। তখন…
“মা। (ছেলে তুলিয়া লইয়া) না বাবা, কাজ নেই তোমার আদর করে।
(নরহরি মাথায় হাত দিয়া পুনশ্চ চিন্তায় মগ্ন)
(কাতর হইয়া) বাবা, আমায় কাশী পাঠিয়ে দে, আমি কাশীবাসী হব।
নরহরি। তা যাও-না মা! তোমার ইচ্ছে হয়েছে, আমি বাধা দেব না।

মা। (স্বগত) নরু আমার সকল কথাতেই ভেবে অস্থির হয়ে পড়ে, এটাতে বড় বেশি ভাবতে হল না। (প্রকাশ্যে) তা হলে তো আমাকে মাসে মাসে কিছু টাকার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে।

নরহরি। সত্যি নাকি? তা হলে আমাকে আর কিছুদিন ধরে ভাবতে হবে। এ কথা নিতান্ত সহজ নয়। আমি এক হপ্তা ভেবে পরে বলব।

মা। (ব্যস্ত হইয়া) না বাবা, তোমার আর ভাবতে হবে না—আমার কাশী গিয়ে কাজ নেই।”
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১: ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির এক অনন্যসাধারণ কোচ স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ

যারা ইউরেকা ফিল্মের জনতার দৃশ্যে নেমে সার্থক হতে চায়, অথবা যারা” “মশলাদার” ভারতবর্ষ খুঁজতে গিয়ে বাহামা দ্বীপপুঞ্জের কাছে ‘রেড ইন্ডিয়ান’ খুঁজে পায়, অথবা, বোতাম আঁটা জামার নিচে শখের ও সুখের ভাবনাগুলোকে দানা-পানি আর দুধ-কলা দেয়, অথবা প্রাণের দায়ে ভাবতে ভাবতে একটা আবিষ্কার করে ফেলে বাথটবেই, আর ”ইউরেকা ইউরেকা” বলে দৌড়ে বেরিয়ে যায় আত্মহারা হয়ে, সেই “তারা” বোকা-চালাক না ক্যাবলা গঙ্গারাম তা ঠিক করার জন্য বাকি সকলে আছে, যাদের রক্তে বোকামি নেই, চালাকিও নেই, ক্যাবলামি নেই, উপেক্ষা নেই, চঞ্চলতাও নেই, হয়তো আছে অনিশ্চিত ”নিয়ম মতে” চলার কিছু দাপট, বেনিয়মের লুকোচুরি, কী যে আছে তারাও হয়তো জানে না, কী যে নেই তাও কি জানে?

নরু বিলক্ষণ জানে কোথায় বাঁধ দিতে হয়, সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে, আর কূল ভাঙে ন্যাংচাদাদের মতো লোকেরা।

“পাঁচিলের পাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছে–গেট-ফেট তো দেখা যাচ্ছে না। খুব দমে গিয়েছে, এমন সময় হঠাৎ ভীষণ মোটা গলায় কে বললে, হু আর ইউ?”
উদ্দেশ্য জানালে উত্তর আসে—
“–ইউরেকা ফিলিম?—গোঁফের তলা থেকে বিচ্ছিরি দাঁত বের করে কেমন খ্যাঁক-খেঁকিয়ে হাসল লোকটা। তারপর বললে, আলবাত ইউরেকা ফিলিম। পার্ট করবে? ভেতরে চলে এসো।
—গেট যে বন্ধ। ঢুকব কী করে?
—পাঁচিল টপকে এসো। ফিলিমে নামবে আর পাঁচিল টপকাতে পারবে না, কী বলো?”

ফিল্মে জনতার দৃশ্যে নামতে গেলে কসরত জানতে হয়, ন্যাংচাদা নেমে পড়ে কাজে, থুড়ি, উঠে পড়ে। পড়ে এমনই যে পতন কেউ আটকাতে পারে না।
“আধঘণ্টা ধ্বস্তাধ্বস্তি করে ঠিক উঠে গেল পাঁচিলের ওপর। বসে একটু দম নিতে যাচ্ছে, অমনি তলা থেকে কারা বললে, আয় রে আয়–চলে আয় দাদা—আয় রে, আমার কুমড়োপটাশ…

আর বলেই ন্যাংচাদার পা ধরে হ্যাঁচকা টান। ন্যাংচাদা একেবারে ধপাস করে নীচে পড়ল।”

চারপাশে তখন নানা রোলের পার্ট চলছে।

“একজন একটা হুঁকো টানছে–তাতে কলকে টলকে কিচ্ছুটি নেই। আর একজনের ছেঁড়া সাহেবি পোশাক কিন্তু টুপির বদলে মাথায় একটা ভাঙা বালতি বসানো। একজনের গলায় ছেঁড়া জুতোর মালা।”
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?

ইউরেকা! মহাজ্ঞানীরা বলে থাকেন, জগত্টাই রঙ্গমঞ্চ, সকল মানুষই নাকি কুশীলব, সুতোয় টানা পুতুল, অভিনয় করে চলেছে নিরন্তর। দরকারে বোকা হয়ে ক্যাবলা হয়ে, অথবা খুব বিজ্ঞের মতো হয়ে যে খেসারতগুলো দিতে হয়, অথবা, যে খোঁচাগুলো না খেলে ঠিক ‘মানুষ’ হয়ে ওঠা যায় না, পঙ্গু হয়েই থেকে যেতে হয় বুঝি…
ঘোষণা করা হয়, নতুন হিরো এসে গিয়েছে।

“ন্যাংচাদা প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু হিরো শুনেই চাঙ্গা হয়ে উঠল। বুঝল, সিনেমায় তো নানারকম পার্ট করতে হয়-তাই ওরা সব ওইরকম সেজেছে, যাকে বলে মেকআপ। তারপর তাকেই হিরো করতে চায়! ন্যাংচাদা নাক আর কোমরের ব্যথা ভুলে একেবারে আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি হাসল। বললে, তা আজ্ঞে, হিরোর পার্টও আমি করতে পারব–পাড়ার থিয়েটারে দুবার আমি হনুমান সেজেছিলুম। কিন্তু চন্দ্রবদনবাবু কোথায়?

সেই জুতোর মালা-পরা লোকটা বললে, চন্দ্রবদন শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে—জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন খেতে। আমি হচ্ছি সুর্যবদন ডিরেকটার।”

এরপর কে ডিরেক্টর সেই নিয়ে ঝামেলা বেঁধে যায়। সত্যিই তো! পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে কে ডিরেক্টর তা ঠিক করা কি চাট্টিখানি কথা! এরপর জানা যায়, ন্যাংচাদার ভালো নাম বিষ্ণুচরণ। তারপর হিরোর রিহার্সাল শুরু হয়। জীবনমাত্রেই নাকি পরীক্ষা, ন্যাংচাদা পাঁচিলে উঠে সিনেমায় নেমেছে। অথবা পাঁচিল থেকে নেমে সিনেমায় উঠেছে বলাও যেতে পারে।
ঘোষণা হয়—
“কোয়ায়েট! সব চুপ। রিহার্সেল হবে। মিস্টার ন্যাংচা—
ন্যাংচাদা বললে, আজ্ঞে?
—এক পা তুলে দাঁড়াও।
ন্যাংচাদা তাই করলে।
এ বার দুপা তুলে দাঁড়াও।
ন্যাংচাদা ঘাবড়ে গিয়ে বললে, আজ্ঞে, দুপা তুলে কি…
বলতেই তারাবদন চটাস করে একটা চাঁটি বসিয়ে দিলে ন্যাংচাদার গালে। বললে, রে বর্বর, স্তব্ধ করো মুখর ভাষণ! যা বলছি, তাই করো। ফিলিমে পার্ট করতে এসেছ দু’পা তুলে দাঁড়াতে পারবে না! এয়ার্কি নাকি?”

এরপর দু’পা তুলে দাঁড়াতেই হয় ন্যাংচাদাকে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই তার নামটি সার্থক হয়ে ওঠে। এরপর বেসুরো ন্যাংচাদাকে গাইতে হয়। নাচতে হয়, ফিল্মে এসে গান-নাচ হবে না সেটা কোনও কথা নয়।

“তারাবদন বললে, রাইট। ও-কে! কাট।
কাট! কাকে কাটবে? ন্যাংচাদা ভয় পেয়ে থমকে গেছে। তারাবদন বললে, এবার তা হলে সন্তরণের দৃশ্য। কী বলো বন্ধুগণ?

সঙ্গে সঙ্গে সকলে চেঁচিয়ে বললে, ঠিক…এবারে সন্তরণের দৃশ্য।”
এরপর এক এঁদো ডোবায় ছুড়ে দেওয়া হয় তাকে। হৈ হট্টোগোলে কোথা থেকে খাকিপোষাকের রক্ষীবাহিনী ছুটে আসে, টেনে তোলে পাঁক থেকে, ততক্ষণে অভিনেতারা অদৃশ্য হয়ে গেছে, ফিল্মের সেট বিলকুল ফাঁকা, শুটিং হয়েছে না শুট আউট বোঝা মুশকিল! সেই রক্ষীরা অবাক হয়।

” ক্যা তাজ্জব! ই নৌতুন পাগলা ফির কাঁহাসে আসলো?”
ব্যাপার কি??
“ব্যাপার বুঝলি? আরে…ওটা মোটেই ফিলিম স্টুডিয়ো নয়…লাম..মানে লুনাটিক অ্যাসাইলাম…অর্থাৎ কিনা পাগলা গারদ। উঁচু পাঁচিল আর লাম দেখেই ন্যাংচাদা ঘাবড়ে গিয়েছিল।”
এই গল্পে এখানেই বিরতি নেওয়া যায়।
এরপরে যদি ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশনের বিভীষিকার বিজ্ঞাপন দেখে—
“আমি শেয়ার কিনব—”
“—এই নিন মশাই আট আনা পয়সা—”
“ওগো বাছারা, আমি এক টাকা এনেছি। আমাদের তিনখানা শেয়ার দাও আর একটা হিরোইনের চান্স দিয়ো”
“আমিও আষ্টো গণ্ডা পয়সা আনুচি—”
“এ বাব্বু, এক এক রূপায়া লায়া, হামকো ভি চান্স চাহিয়ে”

ইত্যাদি ইত্যাদি শুনে খুব চালাকি বা ক্যাবলামিটা করেই ফেলেন, তাহলে কি ছোট হয়ে যাবেন? নাকি বড় হয়ে উঠবেন সক্কলকে ফাঁকি দিয়ে এই মওকায়? নাকি ডাক ছেড়ে বলতে হবে

“যা প্যালা—পকেটে এখনও বারো টাকা চার আনা রয়েছে, ঝট করে দুখানা দেওঘরের টিকিট কিনে আন। দিল্লি এক্সপ্রেস এখুনি ছেড়ে দেবে।”
দাদা অঙ্ক কী কঠিন!

ইউরেকা কখন অজান্তেই যেন বিভীষিকা হয়ে ওঠে।
সখী, বিভীষিকা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়?

ঋণ স্বীকার:
ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
ন্যাংচাদার হাহাকার: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
চিন্তাশীল: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিরোনাম বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর গান থেকে
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content