শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

জীবে দয়া মনুষ্যধর্ম। জীবে দয়া কখন যে জিভে দয়া হয়ে যায়! সেরকমভাবে দেখতে গেলে পেট নামক বস্তুটি না থাকলে পৃথিবীতে সভ্যতার বিকাশ ঘটত না। পেটের তাগিদে মানুষ চাষ করেছে। ক্রমে ক্রমে কৃষি হয়েছে কৃষ্টি। আবার এই করে করে সম্পদের বোধ, তার থেকে অধিকারবোধ, তার থেকেও আবার আইনকানুন, চোরচোট্টা, ডাকু, গাঁটকাটা, প্যাঁচপয়জার আর অসভ্যতার জন্ম। আর অসভ্যতার পিছনেও আছে পেট, খিদে। সভ্যতার পিছনেও।

ভরা পেটে শিল্প হয়। খালি পেটেও। দুটোর ধরণ বদলে বদলে যায়। আবার, শুধু খাদ্যাখাদ্যের নিরাপত্তা থাকলেই কর্মের বাসনা কী অকর্মের কী অপকর্মের বাসনা কিংবা সভ্যতা-অসভ্যতা জেগে ওঠে না যে! জীবনবোধ থেকে জেনেটিক্স, রক্তে বহমান স্বভাব অথবা পরিবেশ এবং আরও আরও নানা কিছু মিলে সভ্যতা-অসভ্যতা জেগে ওঠে। এ সবের ওপর নির্ভর করেই সিন্ধু থেকে মিশর কিংবা মায়াসভ্যতার, অজস্র ঠেকে ঠেকে ঠকে চলা, ঠেকে শেখার জীবনবেদের, বাসে-ট্রেনের মহাসংগ্রামে হিপপকেটের অপমৃত্যুর, আনাচে-কানাচে জেগে ওঠা আকস্মিক জীবে দয়ার মায়ালোক গড়ে ওঠে। এর পিছনে জীবনদেবতার অঙ্গুলিহেলন, ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা মহাপুরুষের মহালীলা অথবা পেট আর খিদের যুগলবন্দি; যা কিছুই থাকতে পারে বৈকি!
দি গ্রেট আবার খাবো রেস্তোঁরায় বসে ক্যাবলা এসব ভাবছিল, তার চোখ আটকে ছিল হাতের ‘গরম খবর’ পত্রিকার দুয়ের পাতার পাঁচের কলামে একটা সিনেমার রিভিউতে। রিভিউ করেছেন প্র-সিদ্ধ ক্রিটিক পাগলুরাম গড়গড়ি মশাই। গঙ্গার ওপর শেষবেলার সূর্যের আলোয় ভোঁ ভোঁ করে বয়ে চলা স্টিমারটাকে চাঁদের দিকে ছুটে চলা রকেটের মতো মনে হচ্ছে কেন?

ধর্মতলার সিনেমা হলে একটা বই খুব কাটছে। ক’দিন আগেই চিলচ্চিত্তচঞ্চরী নামের এক ফিল্ম সোসাইটি ধূর্জটি ধর, মানে এই ফিল্মের পরিচালককে বছরের সেরার পুরস্কার দিয়েছে। তাই হলে উপচে পড়ছে লোক আট থেকে আশি।

বিদ্যাসাগর মশাই সুবোধ বালক কোন্ এক গোপালের কথা পেড়েছিলেন। সেই গোপাল একদিন বাসে উঠেছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে রাখাল কী সব করছে। বাস থেকে নেমে গোপাল দেখল যা হওয়ার হয়ে গেছে। তখন সে আর বাড়ি ফিরল না। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে একটা বনে এসে ঢুকল। বনে ঢোকার আগে ভুবনের মাসির সঙ্গে দেখা, সে বলল, ও বনে যেও না খোকা। ভুবন বাঘ সেজে ঘুরছে ওখানে, এক্কেবারে নরখাদক হয়ে গিয়েছে। রক্তের স্বাদ পেয়েছিল কিনা সেবার! তারপর হারাধনের দশটা ছেলেই তার পেটে গিয়েছে। আমাকেই খুঁজছে আসলে। পেলে কড়মড়িয়ে খেয়ে ফেলবে। আমি চললুম। তুমিও ওদিক পানে যেও না, যদি বাঁচতে চাও। তো, এরপর গোপাল ঘাবড়ে গিয়ে ভাবছে কী করি কী করি, এমন সময় দেখল গলায় বকলশ আঁটা কুকুরটা তেড়ে গাল দিতে দিতে ঘরে ফিরে গেল। বাঘটার ওপর তার খুব রাগ। তাকে বাগে আনা যায়নি মোটে। সে বলেছে “ভাই হে, তোমার সুখ তোমারই থাকুক, আমার অমন সুখে কাজ নাই। নিতান্ত পরাধীন হইয়া, রাজভোগে থাকা অপেক্ষা, স্বাধীন থাকিয়া, আহারের ক্লেশ পাওয়া সহস্র গুণে ভাল…” ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪০: স্বভাবে অনন্য সুন্দরবনের বাঘ

তো তারপর গোপাল কী ভেবে বনে না ঢুকে পাশের গ্রামে ঢুকেছে। সেখানে তখন মহা ক্যাঁচাল, কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড। রাখাল কখন যেন এই গ্রামে চলে এসে গরু চরাচ্ছে আর গ্রামের লোকেদের নতুন নতুন উপায়ে জব্দ করছে। তো, সেদিনই” বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে” বলে আবার রাখাল মহা চেঁচামেচি জুড়েছে। আগের দিনগুলোতে গ্রামের লোকজন প্রচুর ভুগেছে। আজ তারা আর বেরোয়নি। সিনেমার ক্লাইম্যাক্স। রাখাল দৌড়চ্ছে, পিছনে এ জন্মের বাঘ গতজন্মের স্পয়েল্ড চাইল্ড ভুবন দৌড়চ্ছে। রাখাল “বাবাগো বাঘের খেলো গো” বলে অলিম্পিকের রেকর্ড করা রান দিচ্ছে। এসব দেখে গোপাল সোজা গাছে উঠে গিয়েছে।

গাছে বসে ছিল সেই ভালুকটা, যে আগের জন্মে গোপালকে “মরে গেছে” ভেবে ফেলে গিয়েছিল গাছতলায়, এখন তাকে দেখে নতুন ওঠা মুলোর মতো দাঁত বের করে বলেছে, “হাই গোপালবাবু! হ্যাভ এ গুড্ডে”… এই দেখে গোপাল দাঁত ছরকুটে গাছ থেকে পড়ছে, পড়ছে, পড়ছে। তারপর দেখা গেল মোড়ের মাথায় রাখাল দৌড়ে আসছে, আসছে, আসছে। গোপাল তখনও পড়ছে, পড়ছে, পড়ছে। তারপর রাখাল যেই না সেই গাছতলায় এসেছে, গোপাল তার ঘাড়ে সোজা এসে নামল।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৪: রাজনীতিতে, যুগান্তরেও স্বার্থচিন্তার আবহমান প্রভাব

রাখাল ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে গোপালকে বলল, “ভাইটি, আমার বড় ভুল হয়ে গিয়েছে, মাপ কিজিয়ে, এবারের মতো পথ দাও, পাতলা হই, এখন ইয়ার্কি করে না, মাইরি বলছি, আর তোর পকেট মারবো না… এখন পথ দে, পালিয়ে বাঁচি”… এই বলতে বলতে দেখা গেল একটা জিপ গাড়িতে চড়ে বাঘ এসে নামল। তাকে দেখে গোপাল আর রাখাল দুজনেই গলা জড়িয়ে “বাপরে বাপ” বলে কেঁদে কেটে খাবি খেয়ে জ্ঞান হারালো। বাঘ নেমে এসে যাত্রার বিবেকের সুরে বলল, “রাখাল স্যর, আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? আমাকে বাঘ ভেবে আপনি কত্তো ভয় পেয়েছেন, আমি বাঘ নই মশাই, গেল হপ্তায় আপনি লটারি জিতেছেন, সেই থেকে টিকিটটা দেব বলে ঘুরছি আপনার পিছন, আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি শরতবাবুর লোক, শ্রীনাথ। ছিনাথ বহুরূপী। এই নিন টিকিট!”

রাখাল তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, “কেমন অ্যাক্টো করলাম তাহলে, আমি দেখছিলাম আমার হকের জিনিস নিয়ে সটকে পড়তো পারো কীনা, হুঁ হুঁ বাব্বা! দাও এবার তো টিকিটটা…” বলে হাত বাড়াতেই তার হাতে শ্রীনাথ হাতকড়া পরিয়ে বলল, “আমি ঝানু গোয়েন্দা, নাম শুনেছো আমার? হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছি বাপু তোমাকে ধরবো বলে, বিদ্যাসাগর মশাই সেই কবে থেকে তোমার নামে নালিশ ঠুকে রেখেছেন। এসো, আমার সঙ্গে এসো।”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৭: শ্যামাসুন্দরী দেবীর লোকান্তর গমন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-২২: শরীরচর্চা: জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতন

গোপাল এইসব দেখে তাজ্জব হয়ে গেছিল, সে বলল “তবে যে ভুবনের মাসি বললে এই বনে বাঘ হয়ে ভুবন ঘুরছে”… গাছের ওপর থেকে তখন সেই ভালুকটা বলে উঠল “ওরে ক্যাবলা! আমিই সেই বাঘটা, ভালুকের চামড়া পরে বসে আছি তোদের মতো কচিকাঁচাদের ঘা মারবো বলে। এবার তোকে খাই?”

ওই যে, খিদে আর পেটটা না থাকলে বুঝি…

গঙ্গার ওপর শেষবেলার সূর্যের আলোয় ভোঁ ভোঁ করে বয়ে চলে যাওয়া স্টিমারটাকে লাইটহাউসের মাথায় চড়ে বসা চাঁদের দিকে ছুটে চলা রকেটের মতো মনে হচ্ছে কেন?

ঋণ:
শিরোনাম: অনুপম রায়ের গান থেকে।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content