রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

“মা, দুগ্গাঠাকুর কাকে পানিশমেন্ট দিচ্ছে?”
“ওটা অসুর। পাজি লোক। দেখছো না, লায়ন কেমন চেপে ধরেছে, ওই দেখ, গণেশদাদার শুঁড় না দেখ।”
“মা, শুঁড় কি? ওটা কি এলিফ্যান্ট?”
“না রে বাপু, ওটা ঠাকুর, নমো কর।”
“মা, নমো করলে ঠাকুর কী দেবে?”
“রূপ দেবে, জয়, যশ দেবে, আরেকটা কী যেন দেয় নাকি নিয়ে নেয় কে জানে মনে পড়ছে না।”
“মা, রূপ তো আমার সামনের ডেস্কে বসে। আমার বক্স লুকিয়ে রেখেছিল, ওকে আমি লাইক করি না, দিলেও নেব না মা।”
“ছিঃ বাবিন! ওরা তোমার বন্ধু হয়। এসব তুমি কোথায় শিখছো? চলো, তোমার বাবাকে বলছি।”
“জয় তো রূপের বন্ধু। সেদিন রূপ জয়কে ‘জয়গুরু এনজয় গুরু’ বলেছিল। স্যার শুনতে পেয়ে দু’জনকেই নীলডাউন করে দিল। তারপর গার্ডিয়ান কল…”
“অ্যাই তুই থামবি! ধরে দুটো থাপ্পড় দেব। ওসব বাজে ছেলেদের কথা শুনতে তোকে কে বলেছে? তুমি কি ব্যাড বয়?”
“ওরা তো আমার বন্ধু হয় বললে! আমি গুডবয় মা। তাহলে ওরাও গুডবয়-ই হয় তো!”
“অ্যাঁ! মুখে মুখে তক্কো করতে শিখেছো? এইসব ক্যাবলামি আর অসভ্যতা শিখছো স্কুলে? চলো বাড়িতে আজ। স্কুল খুললে আর যেতে হবে না। এমনিতেই এতো হাবা হলে রূপ কেন, জয়, যশ, আরেকটা কী যেন… যাইহোক, সকলেই বক্স কেড়ে নেবে। গরু চরাতে হবে গরু!”
সামনে থেকে ভিড়টা সরে যেতেই কার্ত্তিক ঠাকুর গণেশকে বললেন, “দেখলি গণশা?”
গণেশ গম্ভীরতর হয়ে “দেখলাম” বলে ইঁদুরের লেজের কাছে ঘুরঘুর করা আরশোলাটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। আরশোলাটা সন্দেশের দিকে এগোতে গিয়ে মায়াবলে স্থির হয়ে আছে। সামনের ভিড়টা না সরলে ব্যাপারটায় একটা হেস্তনেস্ত করা যাচ্ছে না। থাক ব্যাটা ততক্ষণ আটকে।
কার্ত্তিক আবার বললেন, “ছেলেটাকে তোর ক্যাবলা মনে হল? মর্ত্যধামের এখনকার ছেলেপিলেদের মনে পিলে চমকানো প্রশ্ন আছে, কিন্তু উত্তর নেই। শুধু এটা কি আর ওটা কি এইসব…”
পাশ থেকে রিনরিনে গলায় কেন যেন বলল “তাতে কি? প্রশ্ন-ই তো বিদ্যার আদিকথা, কেন শোনোনি ‘কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম্?”
“চুপ কর সরো” কার্ত্তিক ধমকে উঠে বলেন, “ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর কেন, হাঁস বা প্যাঁচা কেন নয়, মা দুর্গা সিংহে চড়ে কী করে ব্যালেন্স করে, গণেশের চাপে ইঁদুর কী করে এখনও বেঁচে আছে, শিবের জন্মদিন কবে, অসুরের বয়স কতো এগুলো প্রশ্ন? ফাজলামি হচ্ছে?”
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩১: আমার মতে, তোর মতো কেউ নেই

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ

লক্ষ্মীদেবী চোখ পাকিয়ে “আমার পেঁচুসোনাকে নিয়ে কোনও কথা বলবি না কেতো” বলতেই কার্ত্তিক সামনে তাক করে থাকা অজস্র ক্যামেরার দিকে মন দিলেন।

অসুর এতক্ষণে কথা বললেন।

“ছেলেপিলে এমন হবে না কেন? বাবা মার কাণ্ড দেখেছো? মহালয়াটাও ভালো করে শোনে না। গণেশের পাশে ওইটাকে বছরের পর বছর তার বৌ বলে চালিয়ে দেয় আর বিসর্জনের আগে আমার মুখটা খোলা পেয়ে যত্তো বাতিল সন্দেশ গুঁজে তাতে ধূপ জ্বেলে… ম্যাগো, ছিঃ!” চোখ ছলছল করে ওঠে মহিষাসুরের।

কার্ত্তিকের সামনে ভিড়টা এতক্ষণে পাতলা হয়েছে। ঠোঁটে টেনে রাখা হাসিটা ধরে রাখতে রাখতে ময়ূরবাহন বললেন, “সরো, এদের ইস্কুল অথবা পড়ার ঘরে সারপ্রাইজ ভিজিট করিস? কতবার তোকে বলেছি… এটা একটা যুদ্ধ, শিরদাঁড়াগুলো সোজা করে লং লাস্টিং করতে গেলে একটা স্ট্র্যাটেজি লাগে। মন, বুদ্ধি, আত্মা, ইন্দ্রিয়ের মধ্যের নড়বড়ে সাঁকোগুলো মজবুত কর। নৈলে একদিনের ছোট্ট সাইক্লোনে কোথায় যে উড়ে যাবে আর খুঁজে পাবি না।”
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, পূর্বোত্তরে ইতিহাস ঐতিহ্যে হাতি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

সরস্বতী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এমন সময় শোনা গেল…
“ঠাকুরকে নমো করো, বলো আমাকে একটু বিদ্যা দাও।”
“মাম্মি! গডেসের গুড নেম কি?”
“দুর্গা। দুগ্গাঠাকুর।”
“আমার দুর্গা তোমার দুর্গার সেই আন্টি?”
“সে আবার কী?”
“মাম্মি, গডেসের মাথার ওপর ওটা কি?”
“ওটা নয় সোনা। উনি শিবঠাকুর।”
“জানো! আমাদের স্কুলবাস চালায় শিবুদা, তার গায়ে নাকি অসুরের মতো জোর। আর দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়ি টানে কার্ত্তিক, ও সবসময় শিবুদার কাছে বকা খায়।”
“এসব তোমাকে কে দেখতে বলেছে? তোমাকে বাসে লক্ষ্মীমাসির পাশে বসে একমনে রাইম পড়তে বলেছি না? তা না করে এইসব জিনিস গেলো? চলো আজ বাড়ি, বাবা তোমাকে তুলোধোনা করবে, আজ তোর খাওয়া বন্ধ। এত চেষ্টা করে শেষে তো ঐ কার্ত্তিকের মতো হবি, সব জলাঞ্জলি গেলো গো!”
” মা আমাকে শুধু শুধু বকছো, গডেসের হাতে ওই খুন্তি না হাতা ওটা কী মা? ওটা আমাকে দেবে, ওটা আমার চাই!”
“চোপ!! আদরে বাঁদর হচ্ছো দিন দিন, ফাজলামি হচ্ছে? ওটা গদা। চল্ আজ বাড়ি, গদা চাই না তোর? ওই গদা-ই আজ তোর পিঠে ভাঙবো।”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪০: মা সারদার নিজবাটি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৭: সাধারণের প্রতি পাণ্ডবদের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ কোন মহাভারতীয় শিক্ষা?

সামনের ভিড় সরে গিয়েছে অনেকক্ষণ। বাইরে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। প্যাণ্ডেলে লোক ঢোকা এবছরের মতো বন্ধ। মা দুর্গা হাসি হাসি মুখে অসুরের দিকে তাকিয়ে আছেন। শিবের ঢুলু ঢুলু চোখের ঘোর ঘোর ভাব কেটে গিয়েছে। চোখ পাকিয়ে কার্ত্তিকের দিকে তাকিয়ে শিব স্থির হয়ে আছেন। কার্ত্তিকের মুখের হাসিটা আর দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটা এ সব বলল কী করে? ওর মা কাকে গালটা দিয়ে গেল? সেই আরশোলাটা কী করে যেন অসুরের বাবরির ফাঁকে ঢুকে গিয়েছে। দাঁতের সারির ফাঁকে একটা গাঁদার পাপড়ি আটকেছে। সেদিকে তাকিয়ে দুর্গতিনাশিনী মনে মনে বললেন, “ছেলেটা ঠিক হয়েছে বাপের মতো, ক্যাবলা কাত্তিক কোথাকার, ছোঃ!”
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content