বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


পুত্রেষ্টিযাগে সফল হয়েছেন রাজা দশরথ। এখন চার পুত্রের জনক তিনি। ত্রয়োদশ দিবসে পুত্রদের নামকরণ করলেন কুলগুরু বশিষ্ঠ।

জ্যেষ্ঠং রামং মহাত্মানং ভরতং কৈকেয়ীসুতম্।
সৌমিত্রং লক্ষ্মণমিতি শত্রুঘ্নমপরস্তথা।
বশিষ্ঠঃ পরমপ্রীতো নামানি কুরুতে তদা।।


কেমন গুণবান হলেন দশরথ তনয়রা?

হ্রীমন্তঃ কীর্ত্তিমন্তশ্চ সর্বজ্ঞা দীর্ঘদর্শিনঃ।
তেষামেবং প্রভাবাণাং সর্ব্বেষাং দীপ্ততেজসাম্।
পিতা দশরথো হৃষ্টো ব্রহ্মা লোকাধিপো যথা।।


সৌন্দর্যে, কীর্তিতে, জ্ঞানগরিমায়, দূরদর্শিতায়, অনুদ্ধত স্বভাব, অগ্নিতুল্য তেজস্বী পুত্রদের প্রভাবে ব্রহ্মা যেমন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে থাকেন সেই একই আনন্দ উপভোগ করলেন রাজা দশরথ। যখন পুত্রদের বিবাহের বিষয়ে ভাবছেন তখনই উপস্থিত হলেন মহামুনি বিশ্বামিত্র। দৌবারিকদের আত্মপরিচয় দিয়ে বললেন—

শীঘ্রমাখ্যাত মাং প্রাপ্তং কৌশিকং গাধিনঃ সুতম্।

তোমার রাজাকে শীঘ্র গিয়ে বলো, আমি কুশবংশীয় গাধিপুত্র বিশ্বামিত্র। খবর পেয়েই রাজা দশরথ সন্তুষ্টচিত্তে অতিথি মুনিকে অর্ঘ্যদানে আপ্যায়িত করলেন। প্রহৃষ্টবদনো রাজা ততোঽর্ঘ্যমুপহারয়ৎ।

পরস্পরের কুশল বিনিময়ের পর রাজা দশরথ সম্মানীয় বিশ্বামিত্রকে জানালেন,

অদ্য মে সফলং জন্ম জীবিতঞ্চ সুজীবিতম্। যস্মাদ্বিপ্রেন্দ্রমদ্রাক্ষং সুপ্রভাতা নিশা মম।। পূর্ব্বং রাজর্ষিশব্দেন তপসা দ্যোতিতপ্রভঃ। ব্রহ্মর্ষিত্বমনুপ্রাপ্তঃ পূজ্যোঽসি বহুধা ময়া। তদদ্ভুতমভূদ্বিপ্র পবিত্রং পরমং মম।

আজ রাত্রি অবসানে শুভ সকালে আপনার মতো ব্যক্তিত্বের দর্শনে আমার জন্ম ও জীবন সফল হল। প্রথমেই তপস্যালব্ধ রাজর্ষিশব্দ আপনার মহিমার দ্যোতক।ব্রহ্মর্ষিপদ লাভ করে আপনি আমার সর্বপ্রকারে পূজ্য। আপনার এই হঠাৎ আগমন আমার কাছে পরম পবিত্র অভিজ্ঞতা। তাই আপনার কাম্য প্রার্থনা পূরণ করে আমি নিজেকে অনুগৃহীত বোধ করব। রাজার কথা শুনে বিশ্বামিত্র, পরমং জগাম হর্ষম্ ভীষণ খুশি হলেন। রাজা দশরথের স্বাগত অভ্যর্থনায় বিশ্বামিত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে কয়েকটি প্রশ্নচিহ্ন — কীভাবে তিনি ব্রহ্মর্ষির পূজ্যপদ অধিগত করলেন? তিনি কী জন্মসূত্রে ব্রহ্মর্ষি ছিলেননা? তাঁর অযোধ্যায় আগমনের উদ্দেশ্যই বা কী? বিশ্বামিত্রের অযোধ্যায় আগমনের লক্ষ্য—রাজা দশরথকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে উদ্দেশ্যপূরণ।

যত্তু মে হৃদ্গতং বাক্যং তস্য কার্যস্য নিশ্চয়ম্। কুরুষ্ব রাজশার্দ্দূল ভব সত্যপ্রতিশ্রবঃ।।

হে রাজশার্দ্দূল আমার মনোগত অভিপ্রায় কার্যে পরিণত করবার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

এরপর তাঁর ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। সম্প্রতি তিনি একটি যজ্ঞ করছেন যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে মারীচ ও সুবাহু নামে দুই রাক্ষস। ব্রতসঙ্কল্প নষ্ট হওয়ায় তিনি সেই স্থান ত্যাগ করে এসেছেন। যজ্ঞে দীক্ষিত হয়ে কাউকে অভিশাপ দিতে নেই। এখানে এসেছেন বিশ্বামিত্র একটি অনুরোধ নিয়ে। কী সেই অনুরোধ?

কাকপক্ষধরং বীরং জ্যেষ্ঠং মে দাতুমর্হসি। শক্তো হ্যেষ ময়া গুপ্তো দিব্যেন স্বেন তেজসা।।
কাকপক্ষধর (সদ্য জুলপি হয়েছে যার) জ্যেষ্ঠপুত্রটি আমার উদ্দেশ্য সাধনের যোগ্য। আমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে নিজের অতিলৌকিক দিব্যতেজের দ্বারা সে আমার উদ্দিষ্ট কাজে সমর্থ।

যদি তে ধর্মলাভন্তু যশশ্চ প্রিয়ং ভুবি। স্থিরমিচ্ছসি রাজেন্দ্র মে দাতুমর্হসি।।

যদি পৃথিবীতে ধর্ম ও কীর্তি লাভ করতে চান তাহলে, হে রাজেন্দ্র আমাকে রামকে দান করুন।

এই অনুরোধ শুনে শোকে সংজ্ঞা হারালেন রাজা দশরথ। পুনরায় সংজ্ঞা লাভ করবার পর বিষন্নতা গ্রাস করল তাঁকে। প্রস্তাব দিলেন রামের মোটে ষোল বছর বয়স (ঊনষোড়শবর্ষীয়)। প্রস্তাব দিলেন তিনি নিজে তার অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে যাবেন রাক্ষসনিধনে, কিন্তু পুত্রকে দেবেন না।
নৈব দাস্যামি পুত্রকম্। বললেন রামচন্দ্র বালক মাত্র, এখনও তার বিদ্যাশিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি। বল ও অবল কী? সে তা জানে না। অস্ত্রের সামর্থ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান নেই তার,যুদ্ধেও পারদর্শী নয়। তাই সে রাক্ষসদের কূটযুদ্ধে সক্ষম নয়।

বালো অকৃতবিদ্যশ্চ ন চ বেত্তি বলাবলম্। ন চাস্ত্রবলসংযুক্তো ন চ যুদ্ধবিশারদঃ।। ন চাসৌ রক্ষসাং যোগ্যঃ কূটযুদ্ধা হি রাক্ষসাঃ।

এছাড়াও রাজা দশরথ যে রামকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারেন না। জানতে চাইলেন, কী উপায়ে তিনি নিজে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন?অর্থাৎ শত্রুদের শৌর্যের সীমা কতদূর? ঋষি বিশ্বামিত্র জানালেন, দেবদানবযক্ষরক্ষের অবধ্য রাবণ হলেন প্রতিপক্ষ। তিনি স্বয়ং না এসে পাঠিয়েছেন যজ্ঞবিঘ্নকারী মারীচ ও সুবাহু নামে দুই রাক্ষসকে। শঙ্কিতহৃদয়, পুত্রস্নেহে বিগলিতচিত্ত দশরথ হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, রাবণ, দেবদানবগন্ধর্বযক্ষপক্ষীসর্প সকলের অবধ্য, মানবের তো প্রশ্নই আসে না।

দেবদানবগন্ধর্বা যক্ষাঃ পতগপন্নগাঃ। ন শক্তা রাবণং সোঢ়ুং কিং পুনর্মানবা যুধি।।

হে ব্রহ্মর্ষি,তাই এই বালক পুত্রকে আমি দিতে পারবনা।

বালং মে অয়ং ব্রহ্মন্নৈব দাস্যামি পুত্রকম্।

ক্রোধে ফেটে পড়লেন ঋষি বিশ্বামিত্র।

পূর্ব্বমর্থং প্রতিশ্রুত্য প্রতিজ্ঞাং হাতুমিচ্ছসি।

পূর্বে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে তা থেকে এখন সরে আসছেন? এতো রাঘবদের বিরুদ্ধাচরণ। সত্যসন্ধ বিশ্বামিত্রের কাছে যেটি অকল্পনীয় মনে হয়।কারণ রাজা বিশ্বামিত্র ঋষিত্বে উত্তরণের পথে বহু শরণার্থীর অভাবনীয় সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন যে। কুলগুরু বশিষ্ঠ রাজাকে বোঝালেন সধর্ম পালন করুন। ধর্মভ্রষ্ট হওয়া আপনাকে মানায় না। বশিষ্ঠ মুনি রাজা দশরথকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, ঋষি বিশ্বামিত্র, মূর্তিমান ধর্মস্বরূপ এবং অত্যন্ত শৌর্যশালী ও বিদ্বান। ওঁর বিবিধ অস্ত্রের জ্ঞান ত্রিলোকপ্রসিদ্ধ। অস্ত্রবিদ্যাবিষয়ক এই জ্ঞান সকলেরই অজ্ঞাত। এই অস্ত্রবিশারদ ঋষি অতীতের নানা অস্ত্রেরর প্রয়োগবিদ্যা জানেন এবং অভূতপূর্ব সব অস্ত্র সৃষ্টিতেও পারদর্শী তিনি। উনি একাই রাক্ষসদের ধ্বংস করে দিতে পারেন শুধুমাত্র কোন মহৎ উদ্দেশ্যে আপনার পুত্রের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়েই তাকে প্রার্থনা করছেন। বশিষ্ঠ মুনির কথায় আশ্বস্ত হয়ে রাজা দশরথ সন্তুষ্ট চিত্তে রামকে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে গমনের অনুমতি দিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭: ভারতের উত্তরাধিকার, কৌরব ও পাণ্ডবগণ

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৩: সীতার মনে কি আশঙ্কার অশনি সংকেত?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫২: প্রাকৃতিক উপায়ে মাছের ফলন বাড়াতে পুকুরে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণার ভারসাম্য ঠিক রাখা জরুরি

ঋষি বিশ্বামিত্রের তত্ত্বাবধানে রাক্ষসদের বিরুদ্ধে রামচন্দ্রের অস্ত্র ধারণ ছিল মহাযুদ্ধে রাক্ষসদের বিরুদ্ধে যেন একটি প্রশিক্ষণ। কিভাবে তা সহায়ক হয়ে উঠেছিল ভাবীকালে রামের রাক্ষসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ই তার প্রমাণ।

জীবনে কখন কোন প্রস্তাব কিভাবে সংকটকালে সহায়ক হয় আমরা জানি না। স্নেহ, মায়া, বন্ধনের পিছুটান, দন্দ্বাতুর করে তোলে মানুষকে। সংশয়ের, সন্দেহের প্রতিকূলতা,বাৎসল্যরসের আধিক্য জীবনে এগিয়ে চলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাই—”প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে, সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।”

নাবালকপুত্রকে একজন তেজস্বী অস্ত্রশাস্ত্রবিদের সুরক্ষা কবচের আবরণে দুর্ধর্ষ রাক্ষসদের মুখোমুখি হতে দিতে দ্বিধান্বিত বাৎসল্যরসে আপ্লুত রাজা দশরথ, যিনি নিজে ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ এবং অযোধ্যার মতো সমৃদ্ধ জনপদের রাজা। তিনি ক্ষাত্রধর্মপালন অস্বীকার করলেন স্নেহাধিক্যবশত অথচ সেই একই পিতা সাংসারিক চাপে সুন্দরী পত্নীর প্রতিশ্রুত বরদানের শর্তরক্ষায় বাধ্য হয়ে প্রিয় পুত্রকে ভরাযৌবনে চব্বিশ বছর বয়সে সস্ত্রীক বল্কল ধারণ করে রাক্ষস অধ্যুষিত অরণ্যজীবনে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সংসারের লীলা বিচিত্র। প্রবল প্রতাপান্বিত রাজাও সাংসারিক শান্তি রক্ষায় আপোস করতে করতে ভেঙ্গে পড়েন। জীবনযুদ্ধে পরাজিত নায়কের মত বিয়োগান্তক পরিণতি হয় তার।

আর বিশ্বামিত্র? এক অনমনীয় ক্ষত্রিয়তেজের আধার ছিলেন যিনি, ক্ষত্রিয় হয়েও আত্মশক্তিবলে ঋষিপদে উন্নীত হয়েছিলেন তিনি। এখানেও আছেন ঋষি বশিষ্ঠ, তবে প্রতিপক্ষ হিসেবে আছেন তিনি। ঋষি বশিষ্ঠের ছিল শবলা নামে এক কানধেনু,সে প্রভুর যে কোনো ইচ্ছাপূরণে সক্ষম। রাজা বিশ্বামিত্র পৃথিবী পরিক্রমণ শুরু করলেন। তিনি অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে হাজির হলেন বশিষ্ঠঋষির আশ্রমে। বশিষ্ঠ শবলার সাহায্যে সদলবলে হাজির রাজাকে ভোজনে পরিতুষ্ট করলেন। শবলা দিকে রাজা বিশ্বামিত্রের লোলুপ দৃষ্টি। তিনি চাইলেন সকল ইচ্ছাপূরণের গাভীটিকে। বশিষ্ঠঋষি গাভীটিকে দিতে অস্বীকার করলেন। বলপূর্বক শবলাকে ছিনিয়ে নিলেন রাজা বিশ্বামিত্র। অসহায় শবলা দিশাহারা হয়ে ঋষিকে প্রশ্ন করলেন তাকে পরিত্যাগ করার কারণ কী? ঋষি জানালেন ক্ষত্রিয়ের অপ্রতিরোধ্য তেজবলে বিশ্বামিত্র সবলাকে হরণ করেছেন। শবলা বুদ্ধি দিলেন ঋষিকে দিব্য ব্রহ্মবলের কাছে ক্ষত্রবল তুচ্ছ। ব্রহ্মন্ ব্রহ্মবলং দিব্যং ক্ষত্রাচ্চ বলবত্তরম্। আপনি আমাকে নিয়োগ করুন আমি এই দুর্বৃত্তের অহংকার চূর্ণ করছি। বশিষ্ঠের আদেশে বিপুল, অপ্রতিরোধ্য, সৈন্যদল সৃষ্টি করে শবলা সপুত্র বিশ্বামিত্রকে বিপর্যস্ত করে তুললেন। এরপর ব্রহ্মতেজের সম্মুখীন বিশ্বামিত্র শত পুত্র এবং সৈন্যদলকে হারিয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়লেন। এরপর প্রবল মনকষ্ট নিয়ে তিনি অনুগ্রহ লাভের আশায়, তপস্যায় মহাদেবকে তুষ্ট করে, সম্মুখে দৃশ্যমান দেবাদিদেব কে বললেন,

যদি তুষ্টো মহাদেব ধনুর্বেদ মমানঘ। সাঙ্গোপাঙ্গোপনিষদঃ সরহস্যঃ প্রদীয়তাম্।।

হে অনঘ অর্থাৎ নিষ্পাপ, আপনি যদি তুষ্ট হয়ে থাকেন তবে আমাকে মন্ত্র ও রহস্যময় অঙ্গ উপাঙ্গের সঙ্গে ধনুর্বেদ প্রদান করুন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২: এখানে দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, বাণিজ্যনীতি এবং বৈদেশিক নীতির চর্চা করা হয়েছে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং ২য় খণ্ড, পর্ব-১৪: তোকে দেখে দশটা লোক শিখবে, কারও ক্ষতি না করেও নিজের ভালো করা যায়…

মহাবল বিশ্বামিত্র ঋষি বশিষ্ঠ যেন মৃত এমন তাৎপর্যহীন তাঁর উপস্থিতি এমন ভাব করে বিবিধ অস্ত্র প্রয়োগে ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রমকে দগ্ধপ্রায় করে তুললেন। নিরীহ, বিচলিত, পলায়নপর আশ্রমবাসীদের অভয় দিয়ে বিধ্বংসী হয়ে উঠলেন বশিষ্ঠ। দাম্ভিক বিশ্বামিত্রের ব্রহ্মাস্ত্রের প্রতিরোধ করলেন ব্রহ্মতেজের মাহাত্ম্যে।নিজের ক্ষত্রিয়তেজের অবমূল্যায়ন প্রত্যক্ষ করে ব্রাহ্মণত্ব অর্জনের জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করলেন বিশ্বামিত্র। বৈরাগ্য এলো তাঁর মনে। তবুও ব্রহ্মা তাঁকে ‘রাজর্ষি’ সম্মোধনে বুঝিয়ে দিলেন ব্রহ্মর্ষির শ্রেষ্ঠত্ব এখনও রাজা বিশ্বামিত্রের অধরাই রয়ে গেছে।

ইতিমধ্যে ইক্ষ্বাকুবংশের রাজা ত্রিশঙ্কু সশরীরে স্বর্গে যাবেন মনস্থ করে যজ্ঞ শুরু করলেন। ঋষি বশিষ্ঠ তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন তো বটেই, ত্রিশঙ্কুর পুত্রদের ধিক্কার দিয়ে অভিশপ্ত চণ্ডালে পরিণত করলেন। বিকটাকৃতি নিয়ে বিশ্বামিত্রের স্মরণ নিলেন ত্রিশঙ্কু।বিশ্বামিত্র তাঁকে আশ্বস্ত করে যজ্ঞের উদ্যোগ নিলেন। মুনি ঋষিরা বিশ্বামিত্রের এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় সভয়ে যোগ দিলেন। কিন্তু কোন দেবতা যজ্ঞের হবি গ্রহণ করলেন না। নিজের অর্জিত পুণ্য বলে ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গে প্রেরণ করলেন বিশ্বামিত্র। স্বর্গে উপনীত ত্রিশঙ্কুকে দেবতারা বললেন তুমি ইতিমধ্যে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের দ্বারা অভিশপ্ত হয়েছ তাই হেটমুণ্ড হয়ে মর্তে প্রস্থান কর। ত্রিশঙ্কুর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাজর্ষি বিশ্বামিত্র। লক্ষ্যে অটল তিনি। বিশ্বামিত্র নতুন ইন্দ্রপুরী অর্থাৎ সুরলোক সৃষ্টি করলেন। অগত্যা দেবতারা মেনে নিলেন তাঁর সৃষ্টিকে। নতুন নক্ষত্রলোকে ত্রিশঙ্কু উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে বিরাজমান হলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’

ডায়েট ফটাফট: ডাবের জলের এই গুণগুলির কথা জানতেন?

ত্বকের পরিচর্যায়: টানটান ত্বক চাই? বয়স ধরে রাখতে মেনে চলুন ত্বক বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি

এরপরেও বিশ্বামিত্রের ব্রহ্মর্ষি হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা। তখনকার অযোধ্যাপতি অম্বরীষের যজ্ঞানুষ্ঠানে অপহৃত হল যজ্ঞীয় পশুটি। পুরোহিত রাজাকে বললেন, হয় যজ্ঞীয় পশুটি না হয় কোন মানুষ কিনে আনুন। না হলে যজ্ঞ বিনষ্ট হবে। দিশাহারা রাজা এর কোনটারই সন্ধান পেলেন না। তিনি ঋষি ঋচীককে অনুরোধ জানালেন। লক্ষ ধেনুর বিনিময়ে ঋষি ঋচীকের একটি পুত্রকে তিনি কিনতে চান। ঋচীক মুনি বললেন, জ্যেষ্ঠপুত্র মায়ের, কনিষ্ঠটি বাবার প্রিয়,পড়ে থাকল মধ্যম পুত্র। সেই পুত্রটি অর্থাৎ শুনঃশেপ নিজেকে বিক্রয়ের পরামর্শ দিলেন পিতাকে। শুনঃশেপের মাতুল বিশ্বামিত্র তখন পুষ্করতীর্থে তপস্যায় নিরত। পিতৃতুল্য বিশ্বামিত্রের কাছে নিজেকে মুক্ত করবার জন্যে প্রার্থনা জানালেন শুনঃশেপ। বিশ্বামিত্র পুত্রদের কাছে শুনঃশেপের জীবনরক্ষায় আত্মত্যাগের আবেদন জানালেন। পুত্রেরা সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। বিশ্বামিত্র তাঁদেরকে কুক্কুরভোজী নীচ জাতিতে পরিণত হওয়ার অভিশাপ দিলেন। রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের উপদেশানুসারে শুনঃশেপ যূপবদ্ধ অবস্থায় অগ্নির স্তব এবং বিশ্বামিত্র রচিত দুটি গাথা গাইতে লাগলেন। ইন্দ্র এবং বিষ্ণু শুনঃশেপের স্তুতিগীতিতে তুষ্ট হয়ে তাঁকে দীর্ঘায়ু প্রদান করলেন। অম্বরীষের যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল।

বিশ্বামিত্র কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল। তাঁর ব্রহ্মর্ষি হওয়ার তপস্যায় অপ্সরা মেনকা তাঁকে কামমোহিত করে তপোভ্রষ্ট করলেন। এক সময় সম্বিত ফিরে পেয়ে লজ্জিত বিশ্বামিত্র আবারও কঠোর তপস্যায় মনঃসংযোগ করলেন। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত দেবতারা অনুরোধ করলেন ব্রহ্মাকে, বিশ্বামত্রকে মহর্ষির সম্মান দান করা হোক। ব্রহ্মা বিশ্বামিত্রকে মহর্ষি সম্মান দান করলেন। কিন্তু ব্রহ্মর্ষি হওয়া বাকি আছে যে। বিশ্বামিত্র কামজয় করতে অভিলাষী হয়ে কঠোরতর তপস্যায় ব্রতী হলেন। বিচলিত ইন্দ্র প্রেমের দেবতা মদনদেবের সঙ্গে অপ্সরা রম্ভাকে পাঠালেন বিশ্বামিত্রকে কামনার জালে বদ্ধ করবার জন্যে।পোড়খাওয়া মহর্ষি বিশ্বামিত্র দেবেন্দ্রের চক্রান্ত বুঝতে পেরে রম্ভাকে শিলায় পরিণত করলেন। বিফল মনোরথে ইন্দ্র ফিরে গেলেন। বিশ্বামিত্রের মানস উত্তরণ ঘটল। তিনি স্থির করলেন আর অভিশাপ নয়। তিনি ঠিক করলেন নৈব ক্রোধং গমিষ্যামি ক্রোধ সংবরণ করে বিনা আহারে অবস্থান করতে লাগলেন তিনি। তপস্যা আরও কঠোর হল তাঁর। সহস্রবৎসর পর তিনি অন্ন গ্রহণের ইচ্ছা করলেন যেই, ইন্দ্র এসে সেই অন্ন প্রার্থনা করলেন। প্রার্থীর প্রার্থনা পূরণেই দাতার মহত্ব। সেই মহত্ব বিশ্বামিত্রের অর্জিত হৃদয়রতন, যা তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন।আরও সহস্র বছর অতিক্রান্ত হল তার কঠোর তপস্যায়। ক্রোধহীন, শান্ত, অবিচলিত, বিশ্বামিত্রের শান্ত সমাহিত রূপ যেন আগ্নেয়গিরির জেগে ওঠার পূর্ব লক্ষণ। বিচলিত, উদ্বিগ্ন, দেবকুল শঙ্কিত হয়ে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে অনুরোধ করলেন, বিশ্বামিত্রকে তার অভীষ্ট প্রদান করা হোক। অবশেষে ব্রহ্মা বিশ্বামিত্রকে ব্রাহ্মণত্ব প্রদান করলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের ব্রহ্মর্ষিপদ অনুমোদন করলেন।
ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্রের একক ধর্মযুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ব্রাহ্মণদের ক্ষমতার আত্তীকরণের শক্তি প্রত্যক্ষ করে তিনি তাদের সমতুল হতে চেয়েছেন। দুই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব। ব্রহ্মর্ষির মানসশক্তি ও ক্ষত্রিয়ের পেশীশক্তির দ্বন্দ্ব। একজন ঋষি সবল, তাঁর গোধন সবলার বলে। রাজা তার সুলভ ক্ষমতার দম্ভে সেই শক্তিকে আয়ত্ত করতে চেয়েছেন কিন্তু সামর্থ্যহীন হয়ে হীনমন্যতায় ভুগেছেন, কিন্তু থেমে থাকেননি। অপরিসীম তাঁর প্রচেষ্টা, মনোমুগ্ধকর তাঁর ঔদার্য। তাঁর মতো লক্ষ্যে পৌঁছতে যাঁরা ইচ্ছুক তাঁদের উৎসাহিত করেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। নিজে একা হাত বাড়িয়ে টেনে তুলতে চেয়েছেন রাজা ত্রিশঙ্কুকেও। বিশ্বামিত্রের উদার মহৎ হৃদয়ে করুণাধারার অবিরামগতি। তাই তিনি ঋষি ঋচীকের পুত্রের প্রাণ রক্ষার্থে নিজের পুত্রদেরও উৎসর্গ করতে দ্বিধান্বিত হননি। শেষ পর্যন্ত পরাজিত করেছেন ষড়রিপুকে। অভিশাপ বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বশিষ্ঠ কিন্তু শবলাকে আঁকড়ে ধরে ত্যাগের বদান্যতায় ধন্য হতে পারেননি। অলৌকিক শক্তির প্রতিকূলতা বিশ্বামিত্রকে নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তার জীবনদর্শন বোধহয় “দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না”। নিজেকে যোগ্য করে তুলেছেন ত্যাগ, তিতিক্ষা, বৈরাগ্যে, সংযমের মাধ্যমে। একটি কাঙ্খিত উচ্চমানে পৌঁছনোর জন্যে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়। রাজা বিশ্বামিত্রের ছিল আত্মশক্তি, যা দিয়ে সুদীর্ঘকালের লড়াইতে তার উজ্জ্বল উদ্ধার — কাঙ্খিত ব্রহ্মতেজ।

মহাকাব্যের ঋষিরা এই মাটির পৃথিবীর।তাঁরা কেউই পার্থিব চাওয়া, পাওয়ার ঊর্ধ্বে নন। তবু সীমার মাঝে অসীম হওয়ার লক্ষ্যে তাঁরা সাধারণের থেকে অনেকটাই অগ্রবর্ত্তী কারণ তপস্যা তাঁদের আত্মশক্তির উৎস। রাজা বিশ্বামিত্রের পার্থিব লিপ্সা ছিল, আরও ছিল ক্ষমতার দম্ভ।ছিলনা ত্যাগ, ইন্দ্রিয়সংযম, ক্রোধসংবরণের ধৈর্য্য। বিশ্বামিত্র অনন্য এই কারণে, তিনি ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে নিজেকে উন্নত করেছেন, গণ্ডীবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছেন, ক্রমে অপার্থিব জগতের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে তাঁর সম্মুখে। মানুষ সর্বদাই তার নিজস্ব সীমার মধ্যেই অসীম হতে চায়। তাই ঋষি বিশ্বামিত্রের এই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার দুর্দম প্রচেষ্টা ও সাফল্য অন্য কোনও প্রেক্ষিতে উত্তরণের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হতে বাধা কোথায়?—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content