বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মহর্ষি শৌনকের অনুরোধে সৌতি উগ্রশ্রবা, জনমেজয়ের সর্পসত্রে বৈশম্পায়নকথিত মহাভারতের কুরুপাণ্ডব বংশধরদের উৎপত্তি বিষয়ে বলতে আরম্ভ করলেন।

বৈশম্পায়ন ভারতশ্রেষ্ঠ জনমেজয়কে তাঁর পিতৃপুরুষদের ক্রমানুসারে বংশবৃত্তান্ত বর্ণনা করতে লাগলেন। ভারতবংশীয়দের কীর্তি, ভরত রাজা থেকেই চলে আসছে। এই বংশের পূর্বে যে রাজা জন্মেছেন তারাও ভারত নামেই প্রসিদ্ধ ছিলেন। বংশক্রমে দুষন্ত ও শকুন্তলা পুত্র সেই ভরতের প্রসঙ্গে তিনি বললেন, মা হলেন পুত্রের চর্মকোষমাত্র, কেবল গর্ভধারণকারিনী। পুত্র পিতারই। কারণ পুত্রের দ্বারাই পিতা নবজন্ম লাভ করে থাকেন। তিনি পুত্রপ্রশংসায় আরও বললেন,

রেতোধাঃ পুত্র উন্নয়তি নরদেব!যমক্ষয়াৎ।

সন্তান উৎপাদনের জন্যে শুক্রনিষিক্ত পুত্র যমভবন থেকে পিতৃপুরুষকে উদ্ধার করে থাকে। সেই এক স্বর্গপ্রাপ্তির এবং নরক থেকে উদ্ধারের প্রলোভন। বৈশম্পায়নকে অনুসরণ করে দেখা যেতে পারে, ভরতবংশীয়দের এই বংশক্রম কীভাবে? এবং আদৌ বাধাহীন ভাবে এগিয়ে গিয়েছিল কিনা। তাঁদের পিতৃপুরুষরাই বা কীভাবে এগিয়ে গিয়েছিলেন তথাকথিত স্বর্গসুখের অভিযাত্রায়? জনমেজয়ের পূর্বপুরুষ প্রতীপ রাজার পুত্র শান্তনু। তিনি ছিলেন জনমেজয়ের প্রপিতামহ যে অর্জুন, সেই অর্জুনেরও প্রপিতামহ। বংশের ক্রমটি হল—

শান্তনু—বিচিত্রবীর্য্য—পাণ্ড—অর্জুন—অভিমন্যু—পরীক্ষিত—জনমেজয়।

শান্তনু ও গঙ্গা দেবীর পুত্র দেবব্রত। বিশেষকারণে গঙ্গাদেবী স্বামীকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে রাজা শান্তনু ধীবররাজের পালিতা কন্যা সত্যবতীকে দেখে মুগ্ধ হলেন। পানিপ্রার্থী হয়ে রাজা শান্তনু ধীবর রাজের কাছে গেলেন। ধীবররাজ শর্ত আরোপ করলেন, সত্যবতীর পুত্রকেই রাজসিংহাসনের অভিষিক্ত করতে হবে, অন্য কাউকে নয়। রাজা মনমরা। পুত্র দেবব্রত জানতে চাইলেন পিতার মনকষ্টের কারণ। রাজা জানালেন তুমি শত পুত্র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ— এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সেই কারণে সন্তান বৃদ্ধির জন্য দারপরিগ্রহ শান্তনুর অভিপ্রেত নয়। তবে বেদবিদরা বলে থাকেন এক পুত্র থাকা এবং সন্তানহীনতা সমার্থক।রাজার মনে কী দ্বিচারিতা? সেই বংশ রক্ষার প্রশ্নে দুর্বল হয়ে শান্তনু বললেন—

ত্বঞ্চ শূরঃ সদামর্ষী শস্ত্রনিত্যশ্চ ভারত।নান্যত্র যুদ্ধাত্তস্মাত্তে নিধনং বিদ্যতে ক্বচিৎ।।

হে, বীর, সমর্থ যোদ্ধা, শস্ত্রপরায়ণ ভরতবংশীয়, তোমার যুদ্ধ ছাড়া মৃত্যু নেই। তবে—

সো২স্মি সংশয়মাপন্নস্ত্বয়ি শান্তে কথং ভবেৎ।
একটি অমূলকচিন্তা ব্যক্ত করলেন যা চিন্তিত পুত্রকে বিচলিত করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বললেন,
তোমার অভাবে কী হবে? এই চিন্তায় আমি সংশয়াকুল। পিতার মনস্তত্ত্ব বুঝে উঠতে পারলেন প্রখর বুদ্ধিমান গাঙ্গেয়, গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম ওরফে দেবব্রত। তিনি মন্ত্রীদের কাছে থেকে পিতার অপ্রাপ্তিজনিত দুঃখের কারণ জানতে পারলেন, দাস রাজার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন—

যোঽস্যাং জনিষ্যতে পুত্রঃ স নো রাজা ভবিষ্যতি।
তবু ধীবররাজের সন্দেহ নির্মূল হল না।

তবাপত্যং ভবেদ্ যত্তু তত্র নঃ সংশয়ো মহান্।

কিন্ত আপনার ভাবী সন্তান বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে যে।গঙ্গাপুত্র তাঁর সন্দেহ নিরসন করলেন আরও একটি প্রতিজ্ঞায়—

অদ্য প্রভৃতি মে দাস! ব্রহ্মচর্য্যং ভবিষ্যতি। অপুত্রস্যাপি মে লোকা ভবিষ্যন্ত্যক্ষয়া দিবি।।

আজ হতে আমার ব্রহ্মচর্য্যব্রত শুরু হল। অপুত্রক হয়েও অক্ষয়স্বর্গলোকপ্রাপ্তি হবে আমার। ভয়ানক প্রতিজ্ঞার কারণে তিনি হলেন ভীষ্ম। সত্যবতীলাভে পরিতৃপ্ত পিতা শান্তনু, পুত্র দেবব্রতকে ইচ্ছামৃত্যুলাভের বর দিলেন।

যথাসময়ে সত্যবতী দুই পুত্রের জন্ম দিলেন। চিত্রাঙ্গদ ও এবং বিচিত্রবীর্য্য। শান্তনুর মৃত্যুর পর রাজা হলেন চিত্রাঙ্গদ। গন্ধর্বরাজের সঙ্গে যুদ্ধে অকাল মৃত্যুবরণ করলেন তিনি।বিচিত্রবীর্য্য রাজা হলেন। ভীষ্ম কাশিরাজের তিন কন্যা, অম্বা অম্বিকা ও অম্বালিকাকে স্বয়ংবর সভা থেকে হরণ করে আনলেন। উদ্দেশ্য— তিনজনের সঙ্গেই ভ্রাতা বিচিত্রবীর্য্যের বিবাহদান।

অম্বা এ বিবাহে সম্মত হলেন না। অম্বিকা ও অম্বালিকার পাণিগ্রহণ করলেন বিচিত্রবীর্য্য। তাঁর ভাগ্য কিন্তু মন্দ। বিবাহের সাত বছর পর যক্ষারোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল রাজা বিচিত্রবীর্য্যের। বংশের গতি অক্ষুণ্ণ রাখতে মরিয়া হয়ে উঠলেন রানি সত্যবতী। তিনি নিজের হাতে তুলে নিতে পারতেন শাসনদণ্ড। কিন্তু তা না করে কানীন পুত্র (কুমারী অবস্থার পুত্র) বেদব্যাসকে ডেকে পাঠালেন। নিয়োগপ্রথার আশ্রয় নিলেন। প্রখর বুদ্ধিসম্পন্না সত্যবতী অম্বিকাকে বললেন তুমি নষ্ট প্রায় ভারত বংশকে পুনরুদ্ধার কর।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬: রামচন্দ্রের আবির্ভাব ও বসুন্ধরাকন্যা সীতার অনুষঙ্গ

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫২: প্রাকৃতিক উপায়ে মাছের ফলন বাড়াতে পুকুরে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণার ভারসাম্য ঠিক রাখা জরুরি

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১: রাজার ছেলেদের রাজনীতি-কূটনীতি শেখানোর জন্যই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ

এ বিষয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে অনিচ্ছুক পুত্রবধূকে কোনমতে রাজি করালেন।অম্বিকাকে জানালেন, নির্দিষ্ট দিনে, রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে একজন দেবরস্থানীয়ব্যক্তি অম্বিকার কাছে আসবেন। অম্বিকা সেই বহু দীপালোকে আলোকিত শয়নকক্ষে কুরুকুলমুখ্য ভীষ্ম প্রভৃতি দেবরতুল্য ব্যক্তিত্বদের কথা ভাবতে ভাবতে প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে লাগলেন। সত্যনিষ্ঠ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস তার পিঙ্গল বর্ণের জটাজুট এবং প্রদীপ্ত উজ্জ্বল চক্ষু নিয়ে সেই শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন। অম্বিকা ভয়ে চোখদুটি মুদ্রিত করে ফেললেন

একবারও তাকালেন না ভাবী পুত্রের পিতার দিকে। দুপক্ষেরই হয়তো আগ্রহ ছিল কিন্তু আন্তরিকতা ছিল না। ভালোবাসার সে মিলন নয়। যান্ত্রিকভাবে মিলন সম্পন্ন হল।মহর্ষি ব্যাস জানালেন অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও মাতুঃ স বৈগুণ্যাদন্ধ এব ভবিষ্যতি। মায়ের দোষেই ছেলেটি অন্ধ হবে। পুত্রের জন্মের মন্দের দায়ভার মায়েরই। একটি জাতির এই জ্ঞানদৃষ্টির অন্ধত্বের পরম্পরা চলে আসছে সেই মহাভারতীয় কাল থেকেই। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র জন্ম নিলেন।

অন্ধপুত্র এই বিশাল রাজত্বের রাজা হওয়ার অযোগ্য—এই কথা ভেবে বংশবর্দ্ধক আরেকটি পুত্র কামনায় সত্যবতী তার পুত্র বেদব্যাসকে অম্বালিকার সঙ্গে সঙ্গমে সম্মত করালেন। অম্বালিকাও ব্যাসদেবের সেই ভয়ংকর মূর্তি, তপস্যাক্লিষ্ট রূপ দেখে ভয়ে পান্ডুবর্ণ হয়ে উঠলেন। প্রেমহীন সেই মিলন তো ধর্ষণসদৃশ। ফল কি? ব্যাসদেব জানালেন আমার বিকৃত রূপ দেখে যেহেতু তুমি পান্ডুবর্ণ হয়েছিলে তোমার পুত্র পাণ্ডুবর্ণই হবে। এর নামও হবে পাণ্ডু।

মা সত্যবতীকে জানালেন বেদব্যাস, পরাক্রমশালী জগদ্বিখ্যাত পুত্র হবে অম্বালিকার কিন্তু মায়ের দোষে সে হবে পাণ্ডুবর্ণ। এরপরেও আরেকটি আরও নিখুঁত বংশরক্ষক পুত্র চাই কুরুকুলবধূ সত্যবতীর। তাই আবারও অম্বিকাকে নিয়োগ করলেন। আর অনুরোধ নয়, নির্মম নিয়োগ। পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে রেখে দেবকন্যা তুল্যা অম্বিকা এবার শাশুড়িমায়ের আদেশ অমান্য করলেন। অপ্সরাতুল্যা রূপবতী দাসীটিকে নিজের অলঙ্কারে সজ্জিতা করে কাশীর রাজকন্যা অম্বালিকা পাঠিয়ে দিলেন সেই কৃষ্ণবর্ণ বেদব্যাসের কাছে। সেই দাসীটি ব্যাসদেবের কাছে গিয়ে অভিবাদন করলেন। তাঁর অনুমতি নিয়ে সেই মিলন স্থানে প্রবেশ করে ঋষিকে বিশেষ সমাদরে নানাভাবে পরিচর্য্যা করলেন। সন্তুষ্টচিত্তে বাক্যবিনিময়ের পরে অনুরাগ জ্ঞাপন করে অঙ্গস্পর্শসুখ ও কামসম্ভোগে তুষ্ট হলেন ঋষি।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৩: সীতার মনে কি আশঙ্কার অশনি সংকেত?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭: পঞ্চমের কথা মতো ড্রাম ছেড়ে অমরুতের পিঠের উপর স্যাম্পল রিদম বাজাতে শুরু করলেন ফ্রাঙ্কো!

পরম প্রীত হয়ে দাসীকে বললেন—অভুজিষ্যা ভবিষ্যতি তুমি অদাসী হবে, অর্থাৎ দাসত্ব থেকে মুক্তি দিলেন তাকে। জানালেন, হে শুভলক্ষণান্বিতা তোমার উদরের গর্ভে কোন শ্রেষ্ঠ পুরুষই এসেছেন। তিনি ধার্মিক এবং এবং জগতে বুদ্ধিমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হবেন।কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের এই পুত্র বিদুর নামে জন্মগ্রহণ করলেন। মা সত্যবতীকে সব কথাই জানিয়েছিলেন ঋষি ব্যাস। বিচিত্রবীর্য্যের ক্ষেত্রে (অর্থাৎ প্রজননক্ষেত্রে) ভার্যা এবং দাসীর ক্ষেত্রে দ্বৈপায়নের ঔরসে দেবতুল্য এবং কুরুবংশবর্দ্ধক তিনটি পুত্র জন্ম নিল।

প্রথম, অম্বিকার গর্ভজাত অন্ধপুত্র ধৃতরাষ্ট্র। অদ্ভুত নামটি তাঁর। অন্ধত্বহেতু তিনি রাষ্ট্রধারণে ব্যর্থ।ঋষি ব্যাসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী দশ হাজার হস্তীতুল্য বলশালী, বিদ্বান, শ্রেষ্ঠ রাজর্ষি, ভবিষ্যতে একশত এক পুত্র এবং একটি কন্যার পিতা। রাজোচিত গুণসম্পদের অভাব ছিল না তাঁর। ঋষির, নিয়োগকর্ত্তা পিতার রক্তস্রোতের উত্তরাধিকার তাঁর মধ্যে প্রবহমান, অথচ শতপুত্রের একজনও বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন নন। ভাগ্যের পরিহাসে তাঁর পুত্রদের কেউই জ্যেষ্ঠর শ্রেষ্ঠত্বের আসনটি পাননি। জ্ঞানচক্ষুহীনতায় দিকভ্রান্ত পথিকের মতো রাজনীতির সঠিক পথ ভুলে যান এবং পরে অনুশোচনায় দগ্ধ হন। মানবোচিত হৃদয়দৌর্বল্যে পুত্রস্নেহকাতর হয়ে সন্তানকৃত অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন, পুত্রদের অবিমৃষ্যকারিতায় ইন্ধন যুগিয়ে শেষে পশ্চাত্তাপে কষ্ট পান— এমনই বিচিত্রবীর্য্যের নামাঙ্কিত কৌরবদের উত্তরাধিকার।

দ্বিতীয়, অম্বালিকার পুত্র পাণ্ডু, বিখ্যাত পঞ্চ পাণ্ডবের পিতা। জন্ম থেকেই পাণ্ডুবর্ণ, এ যেন তাঁর জীবনের রঙ, বড় বর্ণহীন সে জীবন। জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বহেতু রাজা হলেন তিনি। পাণ্ডুবর্ণের দীপ্যমান পাণ্ডুর রূপ মুগ্ধ করলো রাজা কুন্তীভোজের দত্তককন্যা, রূপবতী,ধর্মপরায়ণা, যৌবনবতী, ব্রতচারিণী, কুন্তীকে।

স্বয়ংবরসভায় পাণ্ডুকেই বরণ করলেন তিনি। এরপর ভীষ্মের মতানুসারে মদ্রদেশের রাজকন্যা মাদ্রীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন পাণ্ডু।সফল রাজার মতোই বহু রাজ্য জয় করে শান্তনু ও ভরতকৃত কুরুরাজ্যের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনলেন তিনি। হঠাৎ রাজোচিত খেয়ালের বশে দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনে গিয়ে মৃগয়ায় সময় অতিবাহিত করতে লাগলেন। একদিন তিনি এক মহারণ্যে মৈথুনরত হরিণ ও হরিণীকে পাঁচটি তীক্ষ্ণ বাণে বিদ্ধ করলেন।এই হরিণটি ছিলেন কিমিন্দম নামে এক মুনি। সেই মুনি লোকলজ্জাবশত হরিণরূপিণী ভার্যার সঙ্গে বনের নিভৃতে সঙ্গমে নিরত ছিলেন।মুনির মৃগরূপ রাজার অজানা ছিল,তাই ব্রাহ্মণহত্যার পাপে দুষ্ট হলেন না রাজা। কিন্তু যে কোন সঙ্গমই যে সন্তানপ্রাপ্তির সূচনা। তা ছাড়াও সকল প্রাণীর হিতাকাঙ্খী কোনও জ্ঞানীব্যক্তি প্রাণীর অভীষ্ট মৈথুনের সময় প্রণীটিকে কী বধ করতে পারে? রাজাকে প্রশ্ন করলেন হরিণরূপী ঋষি।

সর্বভূতহিতে কালে সর্বভূতেপ্সিতে তথা। কো হি বিদ্বান্ মৃগং হন্যাচ্চরন্তং বনে।।

ঠিক একই রামায়ণের ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বধের মতো নির্মম পুনরাবৃত্তি। এখানে ঘাতক রাজা,শাসক, তাঁর দায় অনেক বেশি। গুরুতর নৃশংস কাজ সর্বদাই লোকনিন্দিত।

নৃশংস কর্ম সুমহৎ সর্বলোকবিগর্হিতম্।
আরও পড়ুন:

ষাট পেরিয়ে: তীব্র গরমে সতর্ক থাকুন প্রবীণেরা, জেনে নিন কী করবেন, আর কী করবেন না

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৫: শরীর ফিট রাখতে রোজ ভিটামিন টনিক খাচ্ছেন?

ত্বকের পরিচর্যায়: ‘টাকপোকা’ ঠিক কী? এই অসুখে আপনিও আক্রান্ত হতে পারেন, এর প্রতিকার জানেন?

কিমিন্দম মুনি পাণ্ডুকে অভিশাপ দিলেন—

প্রিয়য়া সহ সংবাসং প্রাপ্য কামবিমোহিতঃ।ত্বমপ্যস্যামবস্থায়াং প্রেতলোকং গমিষ্যসি।।

তুমি কামমোহিত হয়ে যে মুহূর্তে প্রিয়ার সঙ্গে মিলিত হবে তখনই তুমি প্রেতলোকে গমন করবে।
পাণ্ডুর শক্ত সমর্থ পৌরুষ নিষ্ফল হল। তিনি ভার্যাদের কাছে এসে ভেঙ্গে পড়লেন। অনুতপ্ত পাণ্ডু মনস্থির করলেন তপস্বীর জীবন যাপন করবেন। তিনি নিয়োগপ্রথার ঘোর সমালোচক। তাঁর মতে—

সৎকৃতোঽসৎকৃতো বাপি যোঽন্যাং কৃপণচক্ষুষা। উপৈতি বৃত্তিং কামাত্মা স শুনাং বর্ত্ততে পথি।।

যে সন্তানকামী ব্যক্তি অন্যের কৃপাদৃষ্টিতে সমাদৃত হয়ে বা অবজ্ঞাতভাবে অন্য পুরুষের দ্বারা পুত্রোৎপাদন কামনা করেন তিনি কুকুরের মতো অপরের অনুগ্রহপ্রার্থী হয়ে থাকেন। অথচ নিজে তিনি নিয়োগপ্রথার ফল। হয়তো নিষ্ফল পৌরুষের স্বাভিমানবোধে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। মনস্থ করলেন প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে তপস্বীর জীবনে মুনিবৃত্তি নিয়ে বাকী জীবন কাটাবেন তিনি। ঋষিরা তাঁকে অবহিত করলেন যে যজ্ঞ, দান তপস্যা,শাস্ত্রসম্মত ব্রতপালন, কোনওটাই পুত্রহীনতার পাপ খণ্ডন করতে পারেনা। ঋষিরা অনুরোধ করলেন—

প্রযত্নং কর্ত্তুমর্হসি।অপত্যং গুণসম্পন্নং লব্ধ্বা প্রীতিকরং হ্যসি।।

যত্নবান হন, অবশ্যই গুণসম্পন্ন আনন্দদায়ক পুত্র লাভ করবেন। রাজা পাণ্ডু কুন্তীকে অনুরোধ জানালেন, তুমি সমবর্ণের বা উত্তমবর্ণের পুরুষ থেকে পুত্র লাভ কর।

ত্বৎকৃতেঽহং পৃথুশ্রোণি! গচ্ছেয়ং পুত্রিণাং গতিম্।

তোমার জন্যেই যেন পুত্রবানদের গতি লাভ করি আমি। কুমারী অবস্থায় কুন্তীর পরিচর্যায় তুষ্ট অতিথি ঋষি দুর্বাশা তাঁকে অভীষ্ট দেবতাকে বশীকরণের মন্ত্র দিয়েছিলেন। সেই মন্ত্রশক্তি প্রয়োগের আদর্শ সময় এখন। আপৎকালীন এই অবস্থায় বংশরক্ষার দায় সম্পূর্ণভাবে এখন রাজমহিষী কুন্তীর। দেবতাদের ক্ষেত্রে সদ্য ফলদায়ক এ মন্ত্র, তাই কুন্তী পাণ্ডুর অনুরোধক্রমে প্রথমে প্রজাস্বার্থরক্ষায় ধর্মরাজের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে যুধিষ্ঠিরের, এরপর ক্ষত্রিয়ের বল সর্বপ্রধান, তাই ক্ষত্রিয় স্বামীর ইচ্ছায় বলবান পবনদেবের সঙ্গে মিলিত হয়ে মহাবীর ভীমসেনের জন্ম দিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের বল ও উৎসাহ অতুল,তাই পাণ্ডুর অনুরোধে ইন্দ্রের ঔরসে জন্ম দিলেন অর্জুনকে। পাণ্ড আরও পুত্রকামনায় ব্যাকুল। তাঁকে যুক্তির ধারে নিরস্ত করলেন কুন্তী, কঠোর হলেন।

এদিকে সপত্নী মাদ্রী কুন্তীর সমান মর্যাদার অধিকারিণী হয়েও পুত্রহীনা, তাই তাঁর দঃখ।রাজা পাণ্ডু কুন্তীক অনুরোধ জানালেন,

সা ত্বং মাদ্রীং প্লবেনেব তারয়ৈনামনিন্দিতে।

তুমি ভেলা হয়ে এর দুঃখত্রাণ কর।

কুন্তী রাজী হলেন একটি শর্তে। একজনমাত্র দেবতাকে আহ্বান জানাতে পারবেন মাদ্রী। মনে মনে বিচার করে মাদ্রী অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে চাইলেন এবং তাঁদের দ্বারা দুটি পুত্রের জননী হলেন।নকুল ও সহদেব। পাণ্ডু মাদ্রীকে আরও পুত্রোৎপাদনের অধিকার দেওয়ার জন্যে অনুরোধ জানালেন কুন্তীকে। একজন দেবতাকে আহ্বান না করে দুজনকে ডেকে নিয়ে প্রতারণা করেছেন মাদ্রী, তাই এ অনুরোধ নাকচ করলেন কুন্তী। তস্মান্নাহং নিয়োক্তব্যা। এ বিষয়ে আর অনুরোধ করবেননা। পঞ্চপুত্রতেই সন্তুষ্ট থাকতে হল পাণ্ডুকে। হস্তিনাপুরে জ্যেষ্ঠা ধৃতরাষ্ট্রপত্নী গান্ধারীও শতপুত্রের মা হয়েছেন। দুই ভাইয়ের পুত্রদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পাণ্ডুরবর্ণের পাণ্ডুর জীবনাবসান হল এক রঙিন বসন্তদিনে। ঋতুর প্রভাবে ‘ভূতসম্মোহনে’ প্রাণীকুল কামাবেশে সম্মোহিত যখন সেই সময়ে রাজা পাণ্ডু ন শশাক নিয়ন্তুং তং কামং কামবলার্দ্দিতঃ*তাঁর কামাবেগকে সংযত রাখতে পারলেননা। তস্য কামঃ প্রববৃধে গহনেঽগ্নিরিবোত্থিতঃ দাবানলের মতো রাজার কামনা বৃদ্ধি পেল। মাদ্রীর সঙ্গে মিলিত হতে চাইলেন‌ তিনি। রাজার মনেই এলো না এর মর্মান্তিক পরিণতি, কিমিন্দম মুনির প্রাণঘাতী অভিশাপ। মৃত্যু হল রাজার।

বিচিত্রবীর্য্যের এই উত্তরাধিকারীর হৃদয়বিদারক জীবনাবসান। যথেষ্ট সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বেরঙিন জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছিলেন রাজা পাণ্ডু। দুই যোগ্যা সুন্দরী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ঔরসজাত পুত্রের পিতা হতে পারলেন না। ইন্দ্রিয়দ্বার রুদ্ধ করে রাজোচিত জীবনযাত্রা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। অতিলৌকিক গুণের আধার পুত্রদের নামসর্বস্ব পিতা হয়েই রয়ে গেলেন তিনি। কুরুবংশের তথাকথিত রক্তধারার স্রোত অব্যাহত রইল দৈবানুগ্রহে।

ব্যাসদেবের ঔরসজাত কুরুকুলের আর এক পুত্র বিদুর। শূদ্রাদাসীর গর্ভজাত তিনি। তাই রাজোচিত উত্তরাধিকারবঞ্চিত তিনি। ভীষ্ম দেবকরাজার শূদ্রাভার্যার গর্ভে ব্রাহ্মণের ঔরসজাত একটি কন্যার সন্ধান পেলেন। তিনি মহান বিদুরের সঙ্গে কন্যাটির বিবাহ দিলেন। ধার্মিক বিদুর তাঁর নিজের মতোই গুণবান বিনয়ী অনেক পুত্রের জন্ম দিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউই কুরুবংশের রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করতে পারলেন না, শুধুমাত্র বিদুরের শূদ্রামায়ের কারণে। নীলরক্তের ধারায় মহিমান্বিত হতে পারলেননা তাঁরা।

ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর একশত পুত্র ছাড়াও দুঃশলা নামে একটি কন্যাও জন্মেছিলেন। এ ছাড়া এক বৈশ্যা যুবতীর সাহচর্য্যে ধৃতরাষ্ট্রের যুযুৎসু নামে এক বুদ্ধিমান পুত্রও জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।

এসবই বংশরক্ষক পুত্রদের জয়গাথা। কন্যা? গান্ধারী, একমাত্র তিনিই চেয়েছিলেন, কৃতকৃত্যা ভবেয়ং বৈ পুত্রদৌহিত্রসংবৃতা। যদি সত্যং তপস্তপ্তং দত্তং বা যদি বা হুতম্।। গুরবস্তোষিতা বাপি তথাস্তু দুহিতা মম। আমি পুত্র ও দৌহিত্রবেষ্টিত হলে কৃতার্থ হব। যদি সত্যরক্ষা করে থাকি, যদি তপস্যায় ক্লেশ সহ্য করে থাকি, হোমাহুতি দিয়ে থাকি, গুরুদের সন্তুষ্ট করে থাকি যদি, তাহলে আমার একটি কন্যা হোক। কত যুক্তি কত সুকৃতির ফিরিস্তি তবেই কন্যালাভের প্রার্থনা। কন্যার জন্যে প্রার্থনা কুরুবংশীয়দের মধ্যে আর বোধ হয় বিশেষ শোনা যায়নি। অনাদৃত কন্যাদের নিজেদের পিতৃকুলের বংশরক্ষায় তথাকথিত বিশেষ ভূমিকা নেই সেই কারণেই তারা হয়তো প্রার্থিতা হতে পারে না। সেই ঐতিহ্য এখনও সগৌরবে চলে আসছে ভারতীয় সমাজজীবনে। গান্ধারীর প্রার্থনা একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তমাত্র।

ভরতবংশের উত্তরসূরীদের মধ্যে বঞ্চিতের হাহাকার আছে, অতিলৌকিক গুণান্বিত ব্যক্তির অভাব নেই, আছে ধর্মচেতনার আলোকিত উত্তরাধিকার, আবার অনৈতিক চিন্তার কালো আঁধার নিয়ে আছে মানসিকতার নেতিবাচক দিক, পাণ্ডুর জীবনবোধ, জাত্যাভিমানের উন্নাসিকতা, জাতের নামে বজ্জাতি ও বঞ্চিতের দীর্ঘশ্বাস—এই সবকিছুই বহমান ভারতীয় জাতীয় জীবনের প্রেক্ষিত—মহাভারতের চালচিত্র—ভরতবংশীয়দের মূল্যবান উত্তরাধিকার।—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content