সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

কুরুপাণ্ডবদের মহাগুরু অর্থাৎ গুরুর গুরু ছিলেন পরশুরাম। তিনি কুরুপাণ্ডবদের গুরুপ্রতিম, পিতামহ ভীষ্মের গুরু এবং গুরু দ্রোণাচার্যেরও গুরুতুল্য তাই তিনি মহাগুরু। কুরুপাণ্ডবদের সমসাময়িক বিখ্যাত বীর কর্ণেরও অস্ত্রগুরু ছিলেন তিনি। মহাগুরুর মতোই সম্মানীয় ছিলেন পরশুরাম। এক গৌরবময় পরম্পরার অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁরই অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ ছিলেন মহর্ষি ভৃগু। ভৃগুঋষির মাহাত্ম্য স্থান পেয়েছে মহাভারতের আদিপর্বে। মহাভারতের কথকঠাকুর সৌতি উগ্রশ্রবা নৈমিষারণ্যে শৌনকমুনির অনুরোধে যজ্ঞে সমবেত ঋষিদের সমক্ষে পৃথিবীর আদি বংশাবলীর বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন। সেই প্রসঙ্গেই ভৃগুমুনির কাহিনির অবতারণা। পরশুরাম মহর্ষি ভৃগুর উত্তরপুরুষ, তাই তিনি ভার্গব।

ব্রহ্মাকৃত যজ্ঞাগ্নির শিখা থেকে মহর্ষি ভৃগুর উদ্ভব হয়েছিল। মহর্ষির ধর্মপত্নী দেবী পুলোমা। দাম্পত্যজীবনে যথাকালে গর্ভবতী হলেন তিনি। একদা মহর্ষি ভৃগু স্নানার্থে প্রস্থান করলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে আশ্রমে প্রবেশ করলেন পুলোমা নামে এক রাক্ষস। ভৃগুপত্নী পুলোমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেন সেই আগন্তুক রাক্ষস পুলোমা। ঋষিপত্নী, অতিথি পুলোমাকে, ফলমূলভোজ্য দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। তাঁর আন্তরিকতায় কোনও ত্রুটি ছিল না। অতিথি রাক্ষস পুলোমার মনে তখন খেলা করছে দুষ্টবুদ্ধি। প্রবল কামনার বশবর্তী হয়ে, সেই রাক্ষস, ঋষিপত্নী পুলোমাকে হরণ করতে ইচ্ছুক হলেন। ইদমন্তরমিত্যেবং হর্ত্তুং চক্রে মনস্তদা। তথাগ্নিশরণেঽপশ্যজ্জ্বলন্তং জাতবেদসম্।। তিনি ভাবলেন এইতো অপহরণের সুবর্ণ সুযোগ। পরক্ষণেই হোমগৃহে প্রজ্বলিত অগ্নি তাঁর নজরে পড়ল। এর পূর্বে রাক্ষস পুলোমা, সুলক্ষণা পুলোমাদেবীর রূপমুগ্ধ হয়ে, তাঁকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন।

পুলোমার পিতা কিন্তু পুলোমাকে মহর্ষি ভৃগুর হস্তে শাস্ত্রবিধিমতে সম্প্রদান করছিলেন। সেই থেকে রাক্ষস পুলোমা মনে মনে দেবী পুলোমাকে হারানোর জ্বালায় বিদ্ধ হতেন। তাং তু প্রাদাৎ পিতা পশ্চাদ্ভৃগবে শাস্ত্রবত্তদা। তস্য তৎ কিল্বিষং নিত্যং হৃদি বর্ত্ততি ভার্গব।। রাক্ষস পুলোমা, মহর্ষি ভৃগুর হোমগৃহে প্রজ্বলিত অগ্নিকে সাক্ষী মানলেন। অগ্নিদেবকে বারবার প্রশ্ন করলেন, মুখং ত্বমসি দেবানাং বদ পাবক! পৃচ্ছতে। ময়া হীয়ং বৃতা পূর্বং ভার্য্যার্থে বরবর্ণিনী।। হে অগ্নি, আপনি দেবতাদের মুখ, আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, উত্তর দিন। এই শ্রেষ্ঠা নারীকে আমি পূর্বে পত্নীরূপে বরণ করেছিলাম কিনা? তথা সত্যং সমাখ্যাহি জিহীর্ষাম্যাশ্রমাদিমাম্। সত্য বলুন, আমি তাহলে এঁকে এই আশ্রম থেকে অপহরণ করি। কারণ, স মন্যুস্তত্র হৃদয়ং প্রদহন্নিব তিষ্ঠতি। সেই ক্রোধাগ্নি জ্বালা অদ্যাবধি আমাকে দগ্ধ করে। তিনি অগ্নিকে জানালেন, মহর্ষির ভৃগুর সঙ্গে এই সুন্দরীর বিবাহ অসম্মতমিদম্ সম্মত নয়।
এই বিবাহ আদৌ বিবাহ কিনা সেটিতে সন্দেহ আছে তাঁর। অগ্নিদেবকে বার বার জিজ্ঞাসা করলেন, ত্বমগ্নে! সর্ব্বভূতানামন্তঃশ্চরসি নিত্যদা। সাক্ষিবৎ পুণ্যপাপেষু সত্যং ব্রূহি কবে! বচঃ।। হে অগ্নি, আপনি সকলপ্রাণীর অন্তর্লোকে বিরাজমান। তাদের পাপপুণ্যের সাক্ষীতুল্য আপনি, সত্যকথা বলুন। রাক্ষস পুলোমা আরজি জানালেন এই মর্মে যে ভৃগু মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাঁর মনোনীত ভার্যাকে হরণ করেছেন। অতএব সেয়ং যদি তথা মে ত্বং সত্যমাখ্যাতুমর্হসি। আমার বরণীয়া ইনিই সেই নারী আপনি শুধু নিশ্চিত করুন। রাক্ষস পুলোমা ঘোষণা করলেন, অগ্নির সত্যবচনে আস্থা রেখে, অগ্নিকে সাক্ষ্য রেখে, তিনি ভৃগুর স্ত্রীকে হরণ করবেন। রাক্ষসের এই কথায় অগ্নি পড়লেন উভয়সঙ্কটে। দুঃখিত, ভীত, শঙ্কিত হলেন তিনি। এই সাক্ষ্য তাঁকে দুঃখভারাক্রান্ত করে তুলল। একে মিথ্যাভাষণের ভয়, এর পরে আছে, তার দরুণ মহর্ষি ভৃগুর অভিশাপের ত্রাস।

অগ্নিদেব রাক্ষসকে বললেন, তোমার কন্যাবরণ মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা বিধিবদ্ধ বরণ নয়। মন্ত্রবন্ন বৃতা ত্বয়া দেবী পুলোমার পিতা,ভৃগুদত্ত বরলাভের আশায়, তোমাকে নয়, ভৃগুকেই এই যশস্বিনী কন্যা সম্প্রদান করেছেন। পিত্রা তু ভৃগবে দত্তা পুলোমেয়ং যশস্বিনী। দদাতি ন পিতা তুভ্যং বরলোভান্মহাযশাঃ।। এও জানালেন, বৈদিক বিবাহবিধিমতানুসারে মহর্ষি ভৃগু অগ্নিসাক্ষ্য রেখে, আমাকে অর্থাৎ অগ্নিকে সামনে রেখে পুলোমাকে ভার্যারূপে গ্রহণ করেন। ভার্য্যামৃষির্ভৃগুঃ প্রাপ মাং পুরস্কৃত্য দানব! সত্যপরায়ণ অগ্নি যেন অকপট সত্যবচনের সপক্ষে জোরালো সওয়াল করলেন। সেয়মিত্যবগচ্ছামি নানৃতং বক্তুমুৎসহে। নানৃতং হি সদা লোকে পূজ্যতে দানবোত্তম!।। হে দানবোত্তম, এই পুলোমাই সেই দেবী পুলোমা, এভাবেই তাঁকে জানি। মিথ্যা বলতে পারি না। কারণ, মিথ্যাকে এ জগতে কেউই শ্রদ্ধা করে না।

অগ্নির বচন শোনামাত্র, হয়তো যাথার্থ্য বিচার না করেই, দানব পুলোমা, মন ও বায়ুতুল্য বেগে বরাহরূপ ধারণ করে পুলোমাদেবীকে অপহরণ করে নিয়ে চললেন। ঋষিপত্নী পুলোমা অন্তঃসত্তা ছিলেন। অপহৃতা পুলোমার গর্ভ স্খলিত হল। মাতৃগর্ভচ্যুত শিশুটি রোষবশত পতিত হওয়ায় ‘চ্যবন’ নামে শ্রুত হলেন। রোষান্মাতুশ্চুতঃ কুক্ষেশ্চ্যবনস্তেন সোঽভবৎ।। গর্ভনিঃসৃত সূর্যের মতো তেজস্বী, ভূমিষ্ঠ বালকের ক্রোধাগ্নিতে ভস্মীভূত হলেন অপহরণকারী রাক্ষস পুলোমা। ঘটনার অভিঘাতে, দুঃখে হতচকিতা, পুলোমা অশ্রুপ্লাবিত নেত্রে, ভৃগুপুত্র চ্যবনকে নিয়ে ফিরে চললেন আশ্রমে। তাঁর চোখের জল, বাঁধ ভেঙ্গে দুঃখের নদীর গতিধারাকে অনুসরণ করল। জগতের পিতামহ ব্রহ্মা, পুলোমাকে নানবিধ সান্ত্বনা দিলে। পুলোমাকে অনুসরণকারিণী নদীটির নাম দিলেন, ‘বধূসরা’। টিকাকার মতে—বধূং পুত্রবধূং পুলোমাং সরতি অনুগচ্ছতীতি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২৬: লৌকিকতার আবরণে অতিলৌকিক গুণবান নায়ক?

যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে…

ক্রুদ্ধ মহর্ষি ভৃগু পুলোমাকে প্রশ্ন করলেন, কেনাসি রক্ষসে তস্মৈ কথিতা ত্বং জিহীর্ষবে। ন হি ত্বাং বেদ তদ্রক্ষো মদ্ভার্য্যাং চারুহাসিনীম্।। রাক্ষস পুলোমা তোমায় হরণ করতে ইচ্ছুক জেনেও কে তোমার পরিচয় জানিয়ে দিল তাকে? আমার পত্নীরূপে তোমার পরিচয়—সেই রাক্ষসের অজ্ঞাত ছিল। ক্রোধান্বিত মহর্ষি ভৃগু সেই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিতে ইচ্ছুক হয়ে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। বললেন—যথাযথ বল, এমন কে আছে? যে শাপের ভয় করে না? কে সেই ব্যতিক্রমী? তত্ত্বমাখ্যাহি তং হৃদ্য শপ্তুমিচ্ছাম্যহং রুষা। বিভেতি কো ন শাপান্মে কস্য চায়ং ব্যতিক্রমঃ।।

পুলোমা জানালেন, অগ্নিদেবই সেই ব্যক্তি যিনি রাক্ষসকে আমার পূর্ববৃত্তান্ত অবহিত করেছেন। অগ্নিনা ভগবংস্তস্মৈ রক্ষসেঽহং নিবেদিতা। মহর্ষি ভৃগু পুলোমার পুত্রকৃত সম্পূর্ণ পরিত্রাণবৃত্তান্ত জেনে নিয়ে অগ্নিকে অভিশম্পাত দিলেন, সর্ব্বভক্ষো ভবিষ্যসি অগ্নি,তুমি সর্বভুক্ হও। অভিশপ্ত অগ্নি ক্রুদ্ধ হয়ে অনুযোগ করলেন কিমিদং সাহসং ব্রহ্মন্! কৃতবানসি মাং প্রতি। হে ব্রাহ্মণ, আমার প্রতি তোমার এ আচরণ দুঃসাহসের প্রকাশ। পক্ষপাতিত্বহীন সত্যভাষণের এই পরিণাম? সত্যকথনে তাঁর অপরাধ কোথায়? যিনি সাক্ষী হয়েও সাক্ষ্যে প্রকৃত সত্য গোপন করে মিথ্যাসাক্ষ্য দেন তিনি নিজের বংশকে অধঃপতিত করে থাকেন। প্রকৃতসত্য জেনেও পাপপুণ্যের কারণাভিজ্ঞ পুরুষ, প্রকৃত সত্যের পক্ষ না নিলে,নিঃসন্দেহে তিনি পাপীই।

যশ্চ কার্য্যার্থতত্ত্বজ্ঞো জানানোঽপি ন ভাষতে। সোঽপি তেনৈব পাপেন লিপ্যতে নাত্র সংশয়ঃ।। অগ্নি মহর্ষি ভৃগুকে সতর্ক করে দিলেন এই বলে—যে, তিনিও ভৃগুঋষিকে অভিশাপ দিতে পারতেন কিন্তু ব্রাহ্মণরা সম্মানীয়, তাই তিনি ঋষিকে রেহাই দিলেন। অগ্নিদেব ঋষিকে অবহিত করে দিলেন, অগ্নি সমস্ত যজ্ঞে অবস্থান করেন। তিনিই দেবতাদের, পিতৃগণেরও মুখস্বরূপ, তিনি সর্বভুক হবেন কীভাবে? শাপমুক্তির উপায় ভেবে বা প্রবল অভিমানেই বোধ হয় অগ্নি অন্তর্হিত হলেন। যজ্ঞকার্য ব্যাহত হল, রন্ধন প্রভৃতি দৈনন্দিন কার্যও ব্যাহত হল। অগ্নির অনুপস্থিতিতে ত্রিলোক অস্থির হয়ে বিপন্ন বোধ করল। এই অবস্থার নিরসনকল্পে দেবতারা ব্রহ্মাকে অনুরোধ জানালেন। ব্রহ্মা অগ্নিকে কোমলস্বরে বোঝালেন, কস্মাদেবং বিমূঢ়স্ত্বমীশ্বরঃ সন্ হুতাশনঃ। হে হুতাশন, তুমি প্রভু হয়েও কীভাবে এইরূপ কর্তব্যজ্ঞানহীন হলে? ত্বং পবিত্রঃ সদা লোকে সর্ব্বভূতগতিশ্চ হ। ন ত্বং সর্ব্বশরীরেণ সর্ব্বভক্ষয়ত্বমেষ্যতি।। তুমি পূত অগ্নি, পৃথিবীতে সকল প্রাণীর আশ্রয়, তুমি তোমার সর্বাবয়বে সর্বভুক হবে না। তাহলে?
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

অপানে হ্যর্চ্চিষো যাস্তে সর্ব্বং ভক্ষ্যন্তি তাঃ শিখিন্! ক্রব্যাদা চ তনুর্যা তে সা সর্ব্বং ভক্ষয়িষ্যতি।। তোমার অধোদেশের শিখা সর্বভুক হবে আর সেই মাংসভোজী স্বরূপ সবকিছু ভক্ষণ করবে। ব্রহ্মা আরও বললেন, যেমন সূর্যশিখার স্পর্শে সবকিছু পবিত্র হয়ে ওঠে তেমনই তোমার শিখায় পূতপবিত্র হবে সবকিছু। যথা সূর্য্যাংশুভিঃ স্পৃষ্টং সর্ব্বং শুচি বিভাব্যতে। তথা ত্বদর্চ্চির্নির্দগ্ধং সর্ব্বং শুচি ভবিষ্যতি।। তোমার তেজের প্রভাবে মহর্ষির অভিশাপ সত্যে পরিণত কর। তুমি দেবতাদের এবং নিজের কারণে যজ্ঞের আহুতি গ্রহণ কর। স্বতেজসৈব তং শাপং কুরু সত্যমৃষের্বিভো!। দেবানাঞ্চাত্মনো ভাগং গৃহাণ ত্বং মুখে হুতম।। অগ্নিদেব সম্মত হলেন এবমস্তু এমনটাই হোক।

দেবগণ ও মুনিগণ আশ্বস্ত হলেন। ঋষিদের যাগাদিকার্যের বিঘ্ন দূরীভূত হল। দেবতারা আনন্দিত হলেন। পৃথিবীর প্রাণীকুল সন্তুষ্ট হল। অগ্নিও ব্রহ্মার নির্দেশে ঘৃণিতভাব মুক্ত হয়ে পরম সন্তোষ লাভ করলেন। অগ্নিশ্চ পরমাং প্রীতিমবাপ হতকল্মষঃ নৈমিষারণ্যে, কথকঠাকুর সৌতি উগ্রশ্রবা, এ ভাবে, ভার্গববংশের উৎপত্তি বর্ণনাপ্রহঙ্গে, অগ্নির প্রতি মহর্ষি ভৃগুর অভিশাপ এবং অগ্নির শাপমুক্তির কাহিনি, সেই সঙ্গে পুলোমারাক্ষসের বিনাশ ও ঋষি চ্যবনের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন সমবেত মুনিঋষিদের সমক্ষে।

মহর্ষি ভৃগুর পত্নী পুলোমাকে অপহরণ করে কামনা পূরণ করতে চেয়েছিলেন রাক্ষস পুলোমা। কী আশ্চর্য নামের মহিমা, পুলোমা নামধারিণী একজন নারী, তাঁকে কামনা করছেন পুলোমা নামধারী এক দানব। গর্ভবতী পুলোমাকে অপহরণের সময়ে অগ্নিদেবকে সাক্ষী মেনেছেন দানব পুলোমা। এ যেন অনৈতিকের নৈতিক সমর্থন খোঁজার প্রয়াস। অগ্নিকে স্পর্শ করে অনেক কঠিন প্রতিজ্ঞার শপথ নেওয়া হয়। অগ্নিদহনে পরিশুদ্ধ হয় সোনা। সোনার খাদ জ্বলে ছাই হয়ে যায়, অগ্নিস্পর্শে। অগ্নি উজ্জীবনের প্রতীক, সেই কারণেই কী রাক্ষস পুলোমা তার অনৈতিক আচরণের সমর্থনে একটি জোরালো প্রমাণ হঠাৎ খুঁজে পেলেন? পুলোমা রাক্ষস পুলোমাদেবীকে অপহরণ করতেনই, সেটি আগেই মনস্থ করেছিলেন।

ভৃগুঋষির অনুপস্থিতিতে তাঁর পত্নী পুলোমা আন্তরিকভাবে অতিথিসৎকারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর আচরণে কোন অসঙ্গতি ছিল না। দুর্বৃত্তের ছলের অভাব হয় না। এর একটি যথার্থ উদাহরণ রাক্ষস পুলোমার আচরণ। মহর্ষি ভৃগুর অনুপস্থিতিতে ঋষিপত্নীকে অপহরণ, গর্হিত অপরাধ। পুলোমারাক্ষসের মনে মনে বরণীয়া ছিলেন দেবী পুলোমা। তিনি বিবাহ করতে চেয়েছিলেন সুন্দরী পুলোমাকে। যদিও এ বিবাহ ছিল কুমারী পুলোমার পিতার সম্মতিসাপেক্ষ, যেহেতু পাত্রী পুলোমার মতামত এখানে গ্রাহ্য বিষয় ছিল না। দেবী পুলোমা হয়তো এ বিষয়ে অবহিতই ছিলেন না। পিতার মতানুসারেই শাস্ত্রসম্মতভাবে মহর্ষি ভৃগুর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। পুলোমারাক্ষসের এই বিবেকহীনতায়, দেবী পুলোমাকে হারানোর কষ্ট কাজ করেছিল হয়তো। ষড়রিপুর অন্যতম এই কামের তারণায় এইরকম বলাৎকারের চেষ্টা, আধুনিক যুগেও সংক্রামিত ব্যাধি বিশেষ। আদিম রিপুর প্রকোপে পদস্খলন হয়েছে অনেক মহান ব্যক্তিত্বেরও, এর অনেক উদাহরণ মহাকাব্যে ছড়িয়ে রয়েছে, এখনও তা বিরল নয়। ভৃগুপত্নীর অপহরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ, বিরাট ভূমিকায় রয়েছেন অগ্নিদেব।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৩: মালিকা পরিলে গলে/ প্রতি ফুলে কে-বা মনে রাখে?…

প্রথম আলো, পর্ব-৪: পৃথিবীর প্রথম সুর ও সঙ্গীত কোনটি?

ঘটনাচক্রে হোমগৃহে তাঁর জ্বাজ্বল্যমান উপস্থিতি ছিল তখন। এমন বিশ্বস্ত সাক্ষীকে রাক্ষস পুলোমা ছাড়বেন কীভাবে? অগ্নি যে সকল প্রাণের অন্তরাত্মায় মিশে আছেন। পঞ্চভূতের অন্যতম হলেন, তেজোময় অগ্নি। বিশুদ্ধতার, পবিত্রতার অঙ্গীকারে, অগ্নির স্পর্শ আবশ্যিক। অগ্নিদেবের সত্যকথনকেই আংশিক প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করেছেন পুলোমাদানব। এ যেন, একরকম অনৈতিক আচরণের, মরাল সাপোর্ট সংগ্রহের চেষ্টা।

এই অগ্নিকেই সাক্ষী রেখে মহর্ষি ভৃগুর বিবাহও সম্পন্ন হয়েছিল।অগ্নি, নিন্দিত মিথ্যাসাক্ষ্য দেননি। অগ্নিদেবের সাক্ষ্যের অপব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন রাক্ষস পুলোমা। ঘটনার যথার্থ বর্ণনায়, দানব হয়তো, নিজেকে প্রবঞ্চিত মনে করেছেন।এই ঋষিপত্নী পুলোমাই সেই রাক্ষসের প্রাক্তন অভীপ্সিতা—এই সত্যভাষণ অগ্নিদেবের বিপদ ডেকে এনেছে। মহর্ষি ভৃগু পত্নীর প্রতি প্রবল সমবেদনায় আবেগোচ্ছ্বাসে ক্রুদ্ধ হয়ে অগ্নিকে যে অভিশাপটি প্রদান করলেন তা অগ্নির দাহিকাশক্তির অবমূল্যায়ন। একজন মহর্ষির আবেগকে চালিত করেছে অপর এক রিপু ক্রোধ, যেটি তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়, মানুষের বিচারবুদ্ধি নষ্ট করে দেয়। একজন মহর্ষিও ক্রোধকে জয় করতে অক্ষম হন এমনই তার অমোঘ প্রভাব। অগ্নির দাহিকাশক্তির বিধ্বংসী রূপটি এই অভিশাপের ফলে প্রকট হয়ে উঠল, কল্যাণময় রূপটি নয়। বাস্তবিকই অগ্নির মধ্যে সৃজনী শক্তি এবং সর্বভুক সত্তা দুটিই বিরাজমান। অবহেলিত হলেই অগ্নি ধ্বংস ডেকে আনে। যেমনটি অভিশপ্ত, অভিমানী, অভিশাপ মুক্তির চেষ্টায় মরিয়া,অগ্নির স্বেচ্ছা অন্তর্ধানে জগত ও জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। অগ্নি নিজে প্রজ্বলিত হয়ে তাঁর তেজোরাশি দিয়ে প্রাণশক্তি যোগান, আবার ক্ষণিক অনবধানতায় সবকিছু জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেন। প্রাপ্য সম্মান না পেলে, অকারণে অবমানিত হলে, যাঁর শিরদাঁড়া উন্নত এমন ব্যক্তিত্বের, বিধ্বংসী সত্তা জেগে ওঠে। ব্যক্তিত্বের একটি দিক অবদমিত থাকে বোধ ও চেতনার আলোকে, অপরটি শুভবোধে উদ্দীপ্ত চরিত্রের অপর দিক। অগ্নির এই দ্বৈতসত্তার উদ্বোধন হল সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার পরামর্শে।

এই কাহিনিসূত্রে ‘বধূসরা’ নামে নদীটির মনোজ্ঞ নামকরণ মুগ্ধ করে। নির্যাতিত ব্যথিত বধূ পুলোমার চোখের জলের বহমান ধারা তাঁকে অনুসরণ করেছিল।তাই সেই নদীর নাম হল ‘বধূসরা’। অশ্রুজল যে মিশে রয়েছে উৎপীড়িতা কত ভরতবংশীয় বধূদের জীবনে,সেই সব, কত শত অশ্রুনদীর ধারা সতত অনুসরণ করে তাঁদের যাপনচিত্রের প্রেক্ষিতে, কে তার হিসাব রাখে? মহাকাব্যের যে কত শত ব্যাখ্যাগম্য কাহিনি ছড়িয়ে আছে তার বিস্তৃত পরিসরে,সেই বৃত্তান্তগুলি চিন্তা উজ্জীবিত করে,ভাবনাকে উন্নত করে তোলে। এমনটাই বোধ হয়, বহুমুখী, বহুমাত্রিক মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content