মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আচার্য দ্রোণের সেরা ছাত্র অর্জুন। ছাত্র অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়?

অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের তত্ত্বাবধানে কুরুপাণ্ডবদের প্রশিক্ষণ শুরু হল। কৌরব ও পাণ্ডব কুমাররা অস্ত্রবিদ্যার একেকটি বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। যুধিষ্ঠির হলেন রথযুদ্ধে কুশল। গদাযুদ্ধনৈপুণ্যে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন ভীম ও দুর্যোধন। নকুল ও সহদেবের শ্রেষ্ঠত্ব অসিসঞ্চালনে। গুরুপুত্র অশ্বত্থামার পারদর্শিতা গুপ্ত অস্ত্র প্রয়োগবিষয়ে।

আর দ্রোণপ্রিয় অর্জুন?

বুদ্ধিযোগবলো‌ৎসাহৈঃ সর্ব্বাস্ত্রেষু চ নিষ্ঠিতঃ। অস্ত্রে গুর্ব্বনুরাগে চ বিশিষ্টোঽভবদর্জ্জুনঃ।।

বুদ্ধি, শত্রুজয়ের উপায় উদ্ভাবনে, শক্তিতে, উৎসাহে, অস্ত্র প্রয়োগে, গুরুর প্রতি প্রীতিপূর্ণ আনুগত্যে সব শিক্ষানবীশ কুমারদের মধ্যে সেরা হলেন অর্জুন। ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের ভয়ের কারণ হলেন অস্ত্রবিদ্যায় সর্বোত্তম অর্জুন এবং সেইসঙ্গে বলশালী শক্তিমান ভীম।এই দুজন পাণ্ডুপুত্র ছিলেন ধার্তরাষ্ট্রদের কাছে অসহনীয়।

এ বার ছাত্রদের অস্ত্রনৈপুণ্য পরীক্ষার সময় হয়েছে। দ্রোণাচার্য জানতে চাইলেন, অস্ত্রবিদ্যায় ছাত্রদের কুশলতা কতদূর। তিনি শিল্পীদের সাহায্যে একটি কৃত্রিম শকুন নির্মাণ করে সকলের অগোচরে সেটিকে একটি বৃক্ষশাখায় রেখে দিলেন। প্রথমে জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের পালা। গুরুর আদেশে লক্ষ্যভেদের উদ্দেশ্যে শরসংযোজন করলেন তিনি।

গুরু দ্রোণ প্রশ্ন করলেন— পশ্য স্যেনং দ্রুমাগ্রন্থং ভাসং নরবরাত্মজ। তুমি বৃক্ষের ওপর শকুনটিকে দেখছ কী?

পশ্যামীতি হ্যাঁ, দেখছি—উত্তর দিলেন ছাত্র।

অথ বৃক্ষমিমং মাং বা ভ্রাতৃন্ বাপি প্রপশ্যসি বৃক্ষটিকে, ভায়েদের, আমায়, সবাইকে দেখছ? একদম যথাযথ উত্তর সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের—তমুবাচ স কৌন্তেয়ঃ পশ্যাম্যেনং বনস্পতিম্। ভবন্তঞ্চ তথা ভ্রাতৃন্ ভাসঞ্চেতি পুনঃ পুনঃ।। আমার পরিমণ্ডলের সবকিছু, বৃক্ষ, আপনি, আমার ভাইরা এবং শকুনটিও সম্মুখে দৃশ্যমান। গুরু দ্রোণাচার্য অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হলেন। ধিক্কার দিয়ে বললেন— নৈতচ্ছক্যং ত্বয়া বেদ্ধুং লক্ষ্যমিত্যেব কুৎসয়ন্। লক্ষ্যভেদে তোমার সামর্থ্য নেই। এরপরে যথাক্রমে দুর্যোধন, ভীম—এঁরাও যুধিষ্ঠিরের মতোই গুরু দ্রোণের প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন এবং একই উত্তর দিয়ে নিজেদের অযোগ্যতা প্রমাণ করলেন। অকৃতকার্য হলেন তাঁরা।
এ বার অর্জুনের পালা। গুরুর আদেশে লক্ষ্যে মনোনিবেশ করলেন অর্জুন।

মদ্বাক্যসমকালং তে মোক্তব্যোঽত্র ভবেচ্ছরঃ। বিতত্য কার্ম্মুকঃ পুত্র! তিষ্ঠ তাবন্মুহূর্তকম্।। আমার আদেশ উচ্চারণমাত্রই তুমি শর নিক্ষেপ করবে। তুমি ধনুক আকর্ষণ করে এক মুহূর্ত অপেক্ষা কর। সব্যসাচী অর্জুন গুরুর আজ্ঞায় ক্ষণকাল অপেক্ষা করলেন। গুরু দ্রোণ মুহূর্তে বললেন—পশ্যসীমং স্থিতং ভাসং দ্রুমং মামপি চেত্যুত তুমি শকুনটিকে, বৃক্ষটিকে,আমাকে দেখছ কী?

পশ্যাম্যেকং ভাসমিতি দ্রোণং পার্থোঽভাষত। পার্থ অর্জুন উত্তর দিলেন, শুধুমাত্র শকুনটিকেই দেখছি। আনন্দিত দ্রোণাচার্য প্রিয় শিষ্যকে বললেন—ভাসং পশ্যসি যদ্যেনং তথা ব্রূহি পুনর্বচঃ। শিরঃ পশ্যামি ভাসস্য ন গাত্রমিতি সোঽব্রবীৎ।। যদি শকুনটিকেই দেখে থাক,তবে বল দেখি কোন অঙ্গটি দেখছ? শিষ্যের উত্তর—আমি শকুনটির শরীর নয়, শুধুমাত্র মস্তকটিই দেখছি,অন্য কিছু নয়।

রোমাঞ্চিত দ্রোণাচার্য আদেশ দিলেন— মুঞ্চস্বেতি এবার (শর)মুক্ত কর। অর্জুন আর কোনও বিচার না করে তীর মুক্ত করলেন। তৎক্ষণা‌ৎ তাঁর শাণিত তীক্ষ্ণ তীর বিদ্ধ করল শকুনটিকে। শিষ্যসাফল্যে আপ্লুত আচার্য দ্রোণ অর্জুনকে প্রগাঢ় আলিঙ্গনে অভিনন্দিত করলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২২: রামচন্দ্র ও সীতার পরিণয় এবং কিছু আনুষঙ্গিক কথা

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১: ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির এক অনন্যসাধারণ কোচ স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ

এর কিছুদিন পরে আচার্য দ্রোণ শিষ্যদের নিয়ে চললেন গঙ্গাস্নানে। গঙ্গায় অবগাহনস্নানরত দ্রোণর জঙ্ঘা কামড়ে ধরল একটি জলচর হাঙর বা কুমীর জাতীয় প্রাণী। তিনি তাঁর নিজের সামর্থ্যে নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন, তা না করে তিনি শিষ্যদের আদেশ দিলেন— গ্রাহং হত্বা মোক্ষয়ধ্বং মামিতি ত্বরয়ন্নিব। তাড়াতাড়ি জলচর প্রাণীটিকে হত্যা করে আমাকে মুক্ত কর। আদেশমাত্র অর্জুন অব্যর্থ পাঁচটি শাণিত বাণ দ্বারা জলচর সেই প্রাণীটিকে প্রতিহত করে, খণ্ড বিখণ্ড করে ফেললেন।

আচার্যের অন্য শিষ্যরা কিন্তু হতভম্ভ অবস্থায় কর্তব্য স্থির করতে পারলেন না। স্থিরলক্ষ্য সাধনে অর্জুনের সাফল্যে মুগ্ধ হলেন আচার্য। পরম প্রীত ও সন্তুষ্ট দ্রোণাচার্য প্রিয় অসাধারণ ছাত্রটিকে, প্রয়োগ ও সংবরণ কৌশলসহ, অস্ত্রের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও ভীতিজনক ব্রহ্মশির অস্ত্র দান করলেন। তিনি জানালেন এই অস্ত্র বিশিষ্ট ও ধারণ করা দুষ্কর। গৃহাণেদং মহাবাহো! বিশিষ্টমপি দুর্দ্ধরম্। অস্ত্রং ব্রহ্মশিরো নাম সপ্রয়োগনিবর্ত্তনম্।। হে মহাবাহু অর্জুন অস্ত্রটি তুমি গ্রহণ কর। এই অস্ত্রধারণের একটিই শর্ত। কোন মানুষের ওপরে এর প্রয়োগ নিষিদ্ধ। কারণ, দুর্বলের ওপরে প্রয়োগ করলে এর তেজে পৃথিবী দগ্ধ হতে পারে। ন চ তে মানুষেষ্বেতৎ প্রয়োক্তব্যং কথঞ্চন। জগদ্বিনির্দ্দহেদেতদ্ল্পতেজসি পাতিতম্।। সেই কারণেই এটির ধারণে সংযম প্রয়োজন। তদ্ধারয়েথাঃ প্রযতঃ আরও সচেতন করে দিলেন ছাত্রকে।

বাধেতামানুষঃ শত্রুর্যদি ত্বাং বীর! কশ্চন। তদ্বাধায় প্রযুঞ্জীথাস্তদাস্ত্রমিদমাহবে।। যুদ্ধে শুধুমাত্র মানুষ ছাড়া অন্য কোনও শত্রুদ্বারা আক্রান্ত হলে শত্রুকে বাধাদানে এটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। কৃতার্থ শিষ্য বললেন তথেতি তাই হবে।কৃতাঞ্জলিপুটে ব্রহ্মাস্ত্রটি গ্রহণ করলেন অর্জুন। আচার্যদেব মন, প্রাণ উজার করে শিষ্যকে আশীর্বাদ করলেন— ভবিতা ত্বৎসমো নান্যঃ পুমাল্লোঁকে ধনুর্দ্ধরঃ। অজেয়ঃ সর্ব্বশত্রূণাং কীর্ত্তিমাংশ্চ ভবিষ্যসি।। তোমার তুল্য ধনুর্দ্ধর জগতে বিরল হবে। তুমি হবে অজেয় কীর্তির অধিকারী।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…

আচার্য দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামার প্রতি অপরিসীম স্নেহদৌর্বল্য‌। দ্রোণাচার্যের কোপনস্বভাব পুত্রটিও পিতার কাছে ওই ব্রহ্মশির অস্ত্রের দাবীদার হলেন। অসন্তুষ্ট পিতা অনিচ্ছাসত্তেও পুত্রকে শিখিয়েছিলেন এই ব্রহ্মশিরঅস্ত্রবিদ্যা। অশ্বত্থামা অস্থিরমতি, তাই আচার্য দ্রোণ তাঁকেও সচেতন করে বললেন—কখনও চরম বিপদাপন্ন অবস্থাতেও যুদ্ধে কোন মানুষের প্রতি এই অস্ত্র প্রয়োগ নিষিদ্ধ। অস্ত্রদানের পরে শঙ্কিত দ্রোণাচার্য তাঁর সন্দেহ প্রকাশ করে ফেললেন। ন ত্বং জাতু সতাং মার্গে স্থাতেতি পুরুষর্ষভ! হে পুরুষশ্রেষ্ঠ তুমি কখনও সৎপথে অবস্থান করবে না।

স্নেহশীল পিতার এই অপ্রিয় উক্তিতে অসন্তুষ্ট অশ্বত্থামা অজেয় বীর হওয়ার লক্ষ্যে দ্বারকানগরীতে উপস্থিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রস্তাব দিলেন, তাঁর দিব্যাস্ত্রটির বিনিময়ে কৃষ্ণ কী তাঁর সুদর্শন চক্রটি দিতে পারবেন। উদারমনা কূটনীতিবিদ কৃষ্ণ তাঁকে বললেন—তাঁর অস্ত্রসমূহের মধ্যে যেটি উত্তোলন ও রণক্ষেত্রে প্রয়োগে সক্ষম, অশ্বত্থামা সেই অস্ত্রটি গ্রহণ করতে পারেন, বিনিময়ে ব্রহ্মশির অস্ত্রগ্রহণে শ্রীকৃষ্ণ আগ্রহী নন। অশ্বত্থামা বামহাত,ডানহাত এবং দুই হাতেও চক্রটি একচুলও স্থানচ্যুত করতে পারলেন না। কেন সুদর্শনচক্রগ্রহণে অশ্বত্থামার এত আগ্রহ? শ্রীকৃষ্ণের প্রশ্নের উত্তরে অশ্বত্থামা জানালেন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী,তাঁর সঙ্গেই অশ্বত্থামা যুদ্ধ করতে আগ্রহী। সত্য উদ্ঘাটন করে জানালেন— প্রার্থিতং তে ময়া চক্রং দেবদানবপূজিতম্। অজেয়ঃ স্যামিতি বিভো! সত্যমেতদ্ ব্রবীমি তে।। দেবদানবপূজিত চক্রটি আমি প্রার্থনা করেছিলাম কারণ আমি এর দ্বারা অজেয় হতে চাই। এটিই আমার সত্যিকারের মনের কথা। বিরসবদনে,ক্ষুণ্ণমনে প্রস্থান করলেন অশ্বত্থামা।দিব্য ব্রহ্মশির অস্ত্রটি এখন অশ্বত্থামারও হস্তগত।কুরুক্ষেত্রে কুরুপাণ্ডবদের যুদ্ধে দু’পক্ষের দুজন অর্জুন এবং অশ্বত্থামা কেউই এই অস্ত্রটি ব্যবহার করেননি।

যুদ্ধের শেষেপর্যায়ে অশ্বত্থামার প্রতিহিংসার আগুনে হত হয়েছেন পাঞ্চালদেশের ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডীসহ অসংখ্য যোদ্ধা এবং দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র। পুত্রহারা দ্রৌপদীর বেদনায় প্রবল দুঃখে প্রতিশোধ নিতে কৃতসঙ্কল্প হয়ে হত্যাকারী অশ্বত্থামার উদ্দেশ্যে ধাবমান ভীমসেন। তাঁকে রক্ষা করতেই হবে। কারণ ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ, দুষ্টমতি, অস্থিরচিত্ত, অশ্বত্থামার আয়ত্তাধীন ব্রহ্মশির অস্ত্রজ্ঞান। গঙ্গাতীরে অবস্থান করছিলেন অশ্বত্থামা। তাঁর পরিমণ্ডলে আছেন শ্রীবেদব্যাস, নারদ প্রমুখ ঋষিরা। সম্মুখে উদ্যতধনুর্বাণ ভীমসেন, তাঁর পশ্চাতে দৃশ্যমান যুধিষ্ঠির, অর্জুন এবং শ্রীকৃষ্ণ। অশ্বত্থামা তাঁর অমোঘ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। অমৃষ্যমাণস্তান্ শূরান্ দিব্যায়ুধধরান্ স্থিতান্। অপাণ্ডবায়েতি রুষা ব্যসৃজদ্দারুণং বচঃ।।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮: সুন্দরবনের নিশ্চিহ্ন প্রাণী

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

অলৌকিক অস্ত্রধারী পাণ্ডবপক্ষীয় বীরদের উপস্থিতি সহ্য করতে অক্ষম অশ্বত্থামা উচ্চারণ করলেন, পাণ্ডবশূন্য হোক এবং সেই বিখ্যাত অস্ত্রটি নিক্ষেপ করলেন। কৃষ্ণ পরামর্শ দিলেন অর্জুনকে গুরু দ্রোণোপদিষ্ট অস্ত্রটি প্রয়োগের এটিই যথার্থ সময়।অশ্বত্থামার অস্ত্র প্রতিহত করতে ওই ব্রহ্মশির অস্ত্রটির প্রয়োগ আবশ্যক। অর্জুন সকলের মঙ্গল কামনা করে ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। দুই অস্ত্রের অভিঘাতে জ্বলে উঠল প্রলয়াগ্নিতুল্য অগ্নিশিখা, তেজবিচ্ছুরণে ব্যাপ্ত হল পরিমণ্ডল, কম্পমান পৃথিবীতে পর্বত,অরণ্য কেঁপে উঠল,ভয়াবহ শব্দ সৃষ্টি হল। উল্কাপাত শুরু হল। বিশ্বের প্রাণীরা বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হল।

যুযুধান অর্জুন এবং অশ্বত্থামার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন মহামুনি নারদ ও বেদব্যাস।তাঁদের উদ্দেশ্য জগতের হিতাকাঙ্খায় অস্ত্রতেজ নিবারণ।তাঁদের কল্যাণেচ্ছায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্জুন দ্রুত অস্ত্র সংবরণ করলেন। অশ্বত্থামা পারলেন না। তিনি ব্রহ্মশির অস্ত্রের সংবরণবিদ্যা জানতেননা। অপরিমিত তেজের উৎস এই অস্ত্রটি বীর, সত্যবাদী, নিষ্ঠাবান সংযতজীবনে অভ্যস্ত শৌর্যশালী মানুষই প্রয়োগের যোগ্য অধিকারী।অসংশোধিতচিত্ত মানুষ এটি সংবরণ করতে অক্ষম। কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে অতি বিপন্ন অবস্থাতেও অর্জুন গুরুবাক্য লঙ্ঘন করেননি।ব্রহ্মশির অস্ত্রপ্রয়োগে বিরত থেকেছেন। কুযুক্তির অবতারণা করে অশ্বত্থামা সাফাই গাইলেন, বিপন্ন অবস্থায় সমবেত পাণ্ডববীর এবং ভীমসেনের ভীতিজনক উপস্থিতিতে প্রাণরক্ষার্থে তিনি অস্ত্রটি প্রয়োগ করেছেন পাণ্ডবদের নির্মূল করবার লক্ষ্যে। তাঁর আরও যুক্তি মজুদ। ভীমসেনও দুর্যোধনের সঙ্গে অন্তিম গদাযুদ্ধে শাস্ত্রবিরুদ্ধ আচরণ করেছেন আর তিনিও রাগবিদ্বষমুক্ত নন।

সুতরাং অচিরেই পাণ্ডবদের বিনাশ অনিবার্য। বেদব্যাস জানলেন অর্জুন প্রাণহরণের জন্যে নয়, বীর, ধৈর্যশীল, সত্যপরায়ণ অর্জুন গুরুর উপদেশ পালন করেছেন। প্রজাকল্যাণে ক্ষত্রিয়ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। অশ্বত্থামা প্রযুক্ত অস্ত্র প্রতিহত করার ফল হল দ্বাদশবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টি।অস্ত্রসংবরণে অক্ষম অশ্বত্থামা স্বীকর করলেন সেই অস্ত্রটি পাণ্ডবগণের উত্তরাধিকারী অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভস্থ শিশুদের প্রতি নিক্ষেপ করব। এতদস্ত্রমতশ্চৈব গর্ভেষু বিসৃজাম্যহম্। শ্রীকৃষ্ণ অভয় দিলেন—অহং তং জীবয়িষ্যামি দগ্ধং শস্ত্রাগ্নিতেজসা। তোমার অস্ত্রের অগ্নিতুল্য তেজে দগ্ধ ভ্রূণের প্রাণরক্ষা করব আমি। কৃষ্ণের অনুগ্রহে ভাবি রাজা পরীক্ষিতের প্রাণরক্ষা হল।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

গুরুপ্রদত্ত দিব্য ব্রহ্মশির অস্ত্রের বিধ্বংসী প্রভাব কত মারাত্মক হতে পারে তার প্রমাণ গুরুর আশীর্বাদধন্য অলৌকিক অস্ত্রধারী দুই বীরের প্রয়োগকৌশল।

যে কোন মারণাস্ত্র বিশ্বকল্যাণের পরিপন্থী। এই অস্ত্র হস্তগত হওয়ার একটিই উদ্দেশ্য, সেটি হল প্রতিপক্ষ এবং পরিমণ্ডলের সকলের ভীতিউৎপাদন। মারণাস্ত্রের প্রাণঘাতী প্রভাব কারুরই অজানা নয়। সদ্য অতীতের আধুনিক পারমাণবিক অস্ত্রের অভিঘাতে এখনও ভয়ে শিহরিত হয় বিশ্ব। ব্রহ্মশির অস্ত্রের অভিঘাতে বিকীর্ণ তেজস্ক্রিয়ায় রুদ্ধশ্বাস পৃথিবীর ত্রাস, যে কোনও মানবিক গুণাধিকারী বীরেরই অন্তর স্পর্শ করবে, যেমন অর্জুন বিবেকবোধে প্রাণিত হয়েছিলেন। ক্রোধে আত্মহারা ব্যক্তি পশুতুল্য। অশ্বত্থামা যেভাবে নিদ্রিত পাণ্ডবশিবিরে নির্বিচারে গণহত্যা করেছিলেন তা পাশবিকতার থেকে কম নয়। যে মানসিকতায় তিনি লোকক্ষয়কারী অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলেন সেটিও গণহত্যার সমতুল।

এমন কি গর্ভস্থ ভ্রূণহত্যাতেও তাঁর হৃদয় কেঁপে ওঠে না। শিষ্যের প্রতি গুরু দ্রোণের উপদেশ ছিল, যুদ্ধে কোন মানুষের প্রতি নয় নিজের প্রাণরক্ষার্থে এই অস্ত্র প্রয়োগ করা যেতে পারে।এক্ষেত্রে চরম বিপন্ন অবস্থায় গুরুর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন অর্জুন।পশুসম অশ্বত্থামার প্রাণহরণের জন্যে নয়,অশ্বত্থামাকে প্রতিহত করবার উদ্দেশ্যে বিশ্বপ্রাণরক্ষার্থে অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। এ যেন অস্ত্রপ্রয়োগে বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় চ এর অনুরণন। মারণাস্ত্রধারণের জন্যে যোগ্যতার সঙ্গে মানসিক সামর্থ্য, বিবেকবোধ প্রয়োজন। এর যোগ্য উত্তরাধিকার ছিল অর্জুনের।আচার্যের স্বপুত্রের সেটি ছিলনা। স্নেহ অতি বিষম বস্তু এই উক্তির যাথার্থ্য বিপরীতভাবে প্রমাণ করলেন দ্রোণাচার্য।

তাঁর অন্যতম দুর্বলতা ছিল পুত্রস্নেহ, যার বিষময় প্রভাবে অযোগ্য পুত্র ক্রমে ক্রমে প্রবল আত্মম্ভরিতায়,আকাশছোঁয়া স্পর্ধায় অজেয় হতে চেয়েছেন। যেটি তাঁকে পশুত্বে অধঃপতিত করেছে, মনুষ্যত্বের এ এক চরম অবক্ষয়। ক্ষমতালিপ্সা, প্রতিহিংসা এ সবকিছুই মানবিকতার পরিপন্থী।অলৌকিক দিব্যাস্ত্রের মতো শক্তিসম্পন্ন অস্ত্রসম্ভারের অভাব নেই এই যুগে। কয়েক দশক পরেও এর প্রয়োগের অভিজ্ঞতা এবং কুপ্রভাবের ফল আজও ভোগ করে চলেছে পৃথিবী,শুধু প্রতিকারের অভাব অপূরণীয় ক্ষতিকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।সমানভাবে প্রাসঙ্গিক মহাভারতীয় দিব্য ব্রহ্মশির অস্ত্রের বিধ্বংসী প্রয়োগবিদ্যার কাহিনি কী আলোড়িত করে তোলেনা আধুনিক মনন?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content