মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণ মহর্ষি বিশ্বামিত্রের সঙ্গে উপনীত হলেন রাজা জনকের যজ্ঞস্থলে। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের আগমন সংবাদ শ্রবণমাত্র মিথিলাধিপতি জনক, পুরোহিত ঋষি গৌতমের পুত্র শতানন্দ এবং আন্যান্য ঋত্বিকগণকে সামনে রেখে মাননীয় ঋষি বিশ্বামিত্রকে অর্ঘ্যদানে সম্মানিত করলেন। মহামুনি বিশ্বামিত্রের আগমনে ধন্য হলেন বিদেহরাজ জনক। রাজা, মহর্ষির কাছে বিনীতভাবে জানতে চাইলেন তাঁর সঙ্গে সমাগত শৌর্যশালী, দেবতুল্য পরাক্রমী, সুপুরুষ, নবীন, কুমারদ্বয়ের পরিচয়। এঁদের পিতা কে? এই দু’ জন যেন আকাশের শোভা চন্দ্রসূর্যের মতোই এই স্থানটির শোভা বৃদ্ধি করেছেন। বরায়ুধধরৌ বীরৌ কস্য পুত্রৌ মহামুনে। ভূষয়স্তাবিমং দেশং চন্দ্রসূর্য্যাবিবাম্বরম্।।

এরা রাজা দশরথের অনুপম দুই পুত্র— দুই ভাই রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণের পরিচয় জানালেন মহর্ষি। নিবেদয়দমেয়াত্মা পুত্রৌ দশরথস্য তৌ প্রসঙ্গক্রমে সিদ্ধাশ্রমে রাক্ষসবধের বৃত্তান্ত, বিশালা নগরীতে আগমন, অহল্যার সঙ্গে সাক্ষাৎকার এবং ঋষি গৌতমের সঙ্গে মিলন — এই সমস্ত বিবরণ জনকরাজাকে অবহিত করলেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র।

রামচন্দ্রের আগমনমাত্র মাতা অহল্যার শাপমুক্তি এবং পিতামাতার মিলনবৃত্তান্ত শুনে, এই ঘটনার মূল আয়োজক মহর্ষি বিশ্বামিত্রের প্রতি পরম কৃতজ্ঞতায় অহল্যাপুত্র মিথিলাধিপতির পুরোহিত শতানন্দ, রামচন্দ্রের কাছে ঋষি বিশ্বামিত্রের বংশপঞ্জী এবং ক্ষত্রিয় থেকে ব্রহ্মর্ষিপদে উত্তরণের কাহিনি বর্ণনা করলেন। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হলেন রাজা জনক। মহর্ষি বিশ্বামিত্র, যথোচিত মর্যাদায় সম্মানপ্রাপ্তিতে প্রীত হয়ে রামলক্ষ্মণকে নিয়ে নির্দিষ্ট আবাসে গমন করলেন।

নির্মল প্রভাতবেলায় রাজা জনক নিত্যকর্ম সেরে নিয়ে রামলক্ষ্মণসহ মুনিবর বিশ্বামিত্রকে যথোচিত মর্যাদা দিয়ে সম্বর্ধিত করলেন। তিনি জানতে চাইলেন মহর্ষির অভীপ্সা কী? তাঁর জন্যে রাজা কি করতে পারেন। ভগবন্ স্বাগতং তেঽস্তু কিং করোমি তবানঘ। আপনার সেই বিখ্যাত প্রদর্শনযোগ্য ধনুকটি দেখান। ওটির দর্শনহেতুই দশরথপুত্রদ্বয়ের এখানে আগমন।

পুত্রৌ দশরথস্যেমৌ ক্ষত্রিয়ৌ লোকবিশ্রুতৌ। দ্রষ্টুকামৌ ধনুঃ শ্রেষ্ঠং যদেতত্ত্বয়ি তিষ্ঠতি।। রাজা জনক তখন ধনুটির শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? সেই তথ্য উপস্থাপিত করলেন।
মিথিলারাজের পূর্মবসূরী মহারাজ নিমির জ্যেষ্ঠপুত্র, দেবরাতের কাছে, ন্যাস অর্থাৎ গচ্ছিত ধন হিসেবে ন্যস্ত ছিল ধনুকটি। পুরাকালে দক্ষযজ্ঞধ্বংসের সময়ে মহাবল মহেশ্বর দেবগণের ওপর ক্রোধান্বিত হলেন। কারণটি হল যজ্ঞের ভাগার্থী হলেও মহাদেবকে বঞ্চিত করেছেন দেবগণ। তাই ধনুদ্বারা দেবতাদের মস্তক ছেদনে উদ্যত হলেন দেবাদিদেব। দেবতারা বিষণ্ণ মনে নানা স্তুতিদ্বারা মহেশ্বরকে তুষ্ট করলেন। সন্তুষ্টচিত্তে মহাদেব ধনুকটি দান করলেন। সেই মহেশ্বরপ্রদত্ত ধনুকটি জনকরাজার পূর্বপুরুষের হাতে ন্যাসরূপে গচ্ছিত ছিল।
তদেতদ্দেবদেবস্য ধনুরত্নং মহাত্মনঃ। ন্যাসভূতং তদা ন্যস্তমস্মাকং পূর্ব্বজে বিভৌ

জনকরাজা আরও জানালেন হলকর্ষণের ফলে ক্ষেত্রে উত্থিতা অযোনিজা কন্যাটিকে তিনি তাঁকেই সম্প্রদান করবেন যিনি সেই হরধনুটিতে জ্যা আরোপ করতে পারবেন। বিবাহযোগ্যা কন্যাটির পাণিপ্রার্থী হয়ে অনেকেই এসেছেন, এ পর্যন্ত কেউ মহাধনুটি উত্তোলন করতেই পারেননি। সেই অসফল রাজাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অবরুদ্ধ দুর্গে অবস্থান করে অবরোধ ব্যর্থ করতে সচেষ্ট হয়েছেন বিদেহরাজ জনক। তখন দেবানুগ্রহে চতুরঙ্গ সেনা লাভ করেছেন তিনি। সেই সেনাবলে আক্রমণকারী রাজাদের পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। মিথিলাধিপতি জনক প্রস্তাব রাখলেন—সেই ধনুকটিতে রামচন্দ্র যদি জ্যাসংযোগ করতে পারেন তবে তিনি দাশরথি রামচন্দ্রকেই কন্যা সম্প্রদান করবেন। রামলক্ষ্মণয়োশ্চাপি দর্শয়িষ্যামি সুব্রত। যদ্যস্য ধনুষো রামঃ কুর্য্যাদারোপণং মুনে।। সুতামযোনিজাং সীতাং দদ্যাং দাশরথেরহম্।

জনকের আদেশে অমাত্যরা পুরোভাগে অষ্টচক্রযুক্ত শকটে একটি লৌহমঞ্জুষায় ধনুকটি নিয়ে উপস্থিত হলেন। পাঁচসহস্র দীর্ঘ বলিষ্ঠ পুরুষ অতিকষ্টে সেটি বহন করে আনলেন। রাজা জনক ঘোষণা করলেন,এই সেই মহাধনু, যেটি দেবতা, অসুর, রাক্ষস, যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর ও উরগগণ কেউই আকর্ষণ বা উত্তোলন এবং জ্যা আরোপণ ও শরযোজনা করতে পারেননি। আপনার অনুমতিক্রমে আনীত এই ধনুকটি, রাজকুমারদ্বয় প্রত্যক্ষ করুন। নৈতৎ সুরগণাঃ সর্ব্বে নাসুরা ন চ রাক্ষসাঃ। গন্ধর্ব্বযক্ষপ্রবরাঃ সকিন্নরমহোরগাঃ।। ক্ব গতির্ম্মানুষাণাঞ্চ ধনুষোঽস্য প্রপূরণে। আরোপণে সমাযোগে বেপনে তোলনে তথা।। তদেতদ্ধনুষাং শ্রেষ্ঠমানীতং মুনিপুঙ্গব। দর্শয়ৈতন্মহাভাগ অনয়ো রাজপুত্রয়োঃ।। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের অনুরোধে রাঘব রামচন্দ্র মঞ্জুষা উন্মুক্ত করে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করলেন, ইদং ধনুর্ব্বরং দিব্যং সংস্পৃশামীহ পাণিনা। যত্নবাংশ্চ ভবিষ্যামি তোলনে পূরণে২পি‌ বা।। আমি এই শ্রেষ্ঠ অলৌকিক ধনুক হাতে দিয়ে স্পর্শ করছি। এর উত্তোলনে এবং জ্যা আকর্ষণে যত্নবান হব।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২১: শিষ্য যখন গুরু হয়ে ওঠেন, তাঁর পরিবর্তিত মানসিকতা কী আরও উন্নত করে তোলে শিষ্যকে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫: চন্দ্রমণির বধূবরণ

বিদেহরাজ জনক এবং মহর্ষি বিশ্বামিত্রের অনুমতিক্রমে রামচন্দ্র অক্লেশে ধনুর মধ্যভাগে গুণ সংযুক্ত করলেন এবং টঙ্কার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করলেন ধনুকটি। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন সহস্র সংখ্যক রাজমণ্ডলী। হরধনুর দ্বিখণ্ডিত হওয়ার কারণে ভয়ঙ্কর নির্ঘোষজনিত শব্দ উত্থিত হল। পর্বত বিদীর্ণ হলে যেমন ভূকম্পন সৃষ্টি হয় তেমনই সেই স্থানে ভূকম্পনে রাজা জনক, মহর্ষি বিশ্বামিত্র এবং রামলক্ষ্মণ ছাড়া উপস্থিত সকলে অচেতন হয়ে পড়লেন।

রামের বীর্যবত্তায় বিস্মিত, অভিভূত রাজা জনক মহর্ষি বিশ্বামিত্রেকে বললেন, মম সত্যপ্রতিজ্ঞা সা বীর্য্যশুল্কেতি কৌশিক। সীতা প্রাণৈর্ব্বহুমতা দেয়া রামায় মে সুতা।। হে কৌশিক, আমার কন্যা বীর্যশুল্কা—এই প্রতিজ্ঞা আজ সত্য হল। সীতা আমার প্রাণপ্রিয়া তনয়া তাকে রামকে সম্প্রদান করা আমার কর্ত্তব্য। এই আনন্দবার্তা এবং বিশ্বামিত্রের অভিভাবকত্বে কুমারদ্বয় সুরক্ষিত আছেন—এই সংবাদদুটি অবিলম্বে রাজা দশরথকে জানিয়ে তাঁকে মিথিলায় শীঘ্র আনয়ন করবার নির্দেশ দিলেন মিথিলারাজ জনক। রাজা দশরথ, ঋষি বশিষ্ঠ, বামদেব ও মন্ত্রীদের সম্মতি নিয়ে প্রভাতে বিবিধ রত্নধন,চতুরঙ্গ সেনা এবং উত্তম যানবাহনাদি নিয়ে মিথিলা অভিমুখে যাত্রা করলেন।

এই বরযাত্রীদের সম্মুখে থাকলেন পূজনীয় ও সম্মানীয় দ্বিজশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠ,বামদেব,জাবালি, কশ্যপ, দীর্ঘায়ু, মার্কণ্ডেয় কাত্যায়ন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বগণ। চারদিনের পথ অতিক্রম করে তাঁরা বিদেহনগরীতে উপস্থিত হলেন।পরম প্রীত মিথিলাধিপতি সানন্দে তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন‌। স্থির হল আগামী প্রভাতে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে। বিনয়ী রাজা দশরথ গ্রহীতার ভূমিকায় নয়,প্রতিগ্রহ (দানগ্রহণ) দাতার আয়ত্তাধীন মনে করেন। তিনি কন্যাদাতা ধর্মজ্ঞ জনকের প্রস্তাবে সম্মত হলেন। প্রতিগ্রহো দাতৃবশঃ শ্রুতমেতন্ময়া পুরা। যথা বক্ষ্যসি ধর্মজ্ঞ তৎ করিষ্যামহে বয়ম্।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৪: রাজ পরিবারের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক ও ব্রাহ্মবাদ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি

প্রভাতবেলায় জনকরাজার আমন্ত্রণে, ইক্ষুমতী নদীতীরে সাঙ্কাশ্যানগরবাসী ভ্রাতা কুশধ্বজ যজ্ঞরক্ষক হিসেবে এবং আনন্দোৎসবে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হলেন। কুলগুরু বশিষ্ঠ ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজাদের কুলপঞ্জী বর্ণনা করে সেই সত্যবাদী,ধার্মিক পরম্পরার অধিকারী কুমারদের নিমিত্ত কন্যাদ্বয় প্রার্থনা করলেন‌, হে নরোত্তম, সমানমর্যাদার দুই বংশই। আত্মীয়তার সম্পর্কস্থাপনে কন্যাদানের উপযুক্ত ইক্ষ্বাকুকুল। সদৃশাভ্যাং নরশ্রেষ্ঠ সদৃশে দাতুমর্হসি। রাজা জনক অনুরূপ বিনয়ে বংশপরিচয় প্রদান করলেন। তিনি তাঁর ভ্রাতার পরিচয়সূত্রে জানালেন, একদা সাঙ্কাশ্যপুরের রাজা সুধন্বা হরধনু ও বীর্য্যশুল্কা সীতাকে অধিকারের লক্ষ্যে মিথিলা নগরী অবরোধ করলে পর রাজা জনক তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত ও হত্যা করে সাঙ্কাশ্যানগরীতে অভিষিক্ত করেন ভ্রাতা কুশধ্বজকে।

তিনি আনন্দিতচিত্তে তাঁর পালিতা আদরিণী কন্যা সীতাকে এবং ঔরসজাত কন্যা ঊর্মিলাকে যথাক্রমে রাম ও লক্ষ্মণকে সম্প্রদান করবেন, স্থির করলেন। মুনিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠকে বধূদ্বয় দানই তাঁর পরম সন্তুষ্টির বিষয়। দদামি পরমপ্রীতো বধ্বৌ তে মুনিপুঙ্গব।

উত্তরফাল্গুনীনক্ষত্রে রামসীতার এবং অন্যভ্রাতাদের বিবাহ সম্পন্ন হবে। নৃপতি কুশধ্বজের দুই অতুলনীয়া কন্যা মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্ত্তির সঙ্গে যথাক্রমে ভরত এবং শত্রুঘ্নের বিবাহ স্থির হল। একদিনেই সম্পন্ন হবে রাজা দশরথের চারপুত্রের বিবাহ। বিবাহোৎসবে শাস্ত্রীয় বৈবাহিক হোম সম্পন্ন হলে রাজা জনক সালঙ্কারা সীতাকে নিয়ে এলেন মাঙ্গলিক দ্রব্যে সজ্জিত বিবাহমণ্ডপে। রামচন্দ্রকে কন্যাসম্প্রদানরত পিতা বললেন, ইয়ং সীতা মম সুতা সহধর্ম্মচারী তব। প্রতীচ্ছ চৈনাং ভদ্রং তে পাণিং গৃহীষ্ব পাণিনা। পতিব্রতা মহাভাগাচ্ছায়েবানুগতা সদা।। এই আমার কন্যা সীতা, হে ভদ্র, যিনি তোমার সহধর্মিণী হতে চলেছেন। এর হাতখানি তোমার হাতে গ্রহণ কর। এই মহাভাগ্যবতী পতিব্রতা সর্বদাই ছায়ার মতো তোমার অনুগামিনী হবেন। সমবেত দেব, ঋষিবৃন্দ সাধু সাধু বলে উঠলেন। অনুরূপভাবে লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্নকেও যথাক্রমে ঊর্মিলা, মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্ত্তির পাণিগ্রহণের অনুরোধ জানালেন রাজা জনক। বরকনে অগ্নি, বেদী, রাজা জনক, ঋষিদের প্রদক্ষিণ করলেন। শাস্ত্রানুসারে শুভ পরিণয়জনিত বিবাহকার্য্য সম্পন্ন হল।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫২: আঁধার ঘনালো বুঝি সীতার ভুবনে…

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৮: হৃদয়ে আমার দিয়েছে ঢেউ, ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ

এই পরিণয়ের পরোক্ষ ঘটকমহাশয় হলেনমহর্ষি বিশ্বামিত্র। রামচন্দ্রের যোগ্যা সহধর্মিণীলাভে মহর্ষির অবদান অনস্বীকার্য। তিনি আদিকাব্যের নায়ককে,অযোধ্যার ভাবি রাজাকে,অস্ত্রশিক্ষায় পারদর্শী করে তুলেছেন, প্রতিকূল শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা কীভাবে করা যায়—তা শিখিয়েছেন, নদনদীর উৎস, অরণ্য, প্রকৃতিপাঠে অভ্যস্ত করে তুলেছেন। তিনি তাঁর অপরিসীম দূরদর্শিতায় রামচন্দ্রকে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছেন।যেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে গার্হস্থাশ্রমে প্রবেশের দ্বার ছিল মহর্ষি বিশ্বামিত্রের সঙ্গে অতিবাহিত যাপনকাল। রামায়ণের অন্য কোন কাণ্ডে মহর্ষি বিশ্বামিত্রের উপস্থিতি নেই। রামচন্দ্র সাবালক হয়েছেন মহর্ষি বিশ্বামিত্রের অভিভাবকত্বে। এখানেই হয়তো মহাকাব্যের প্রেক্ষিতে বিশ্বামিত্রের মহত্ত্বের উপস্থাপনা করেছেন আদিকবি।

রামসীতার বিবাহ সমপর্যায়ের সমান মর্যাদাসম্পন্ন কুলে সম্পন্ন হয়েছিল। ইক্ষ্বাকুবংশ এবং বিদেহরাজ বংশ দুই প্রখ্যাত রাজবংশ, বংশাবলীর দীর্ঘ ধারাবিবরণী সেটাই প্রমাণ করে। সীতা, লাঙ্গলের ফলায় যে রেখা। সেই নামানুসারেই সীতার নামকরণ হয়েছিল। বসুন্ধরা কন্যা সীতা, ক্ষত্রিয়রাজার অতি আদরের পালিতা নন্দিনী। তাঁর কন্যাপণ ধার্য করেছিলেন রাজা জনক।সেই পণটি ছিল শুধুমাত্র শৌর্য। তাই সীতা ছিলেন বীর্যশুল্কা। রাজা জনক কী তাঁর কন্যাটির রক্ষণাবেক্ষণে একটি সুরক্ষাবলয় চেয়েছিলেন? না শুধুমাত্র ক্ষত্রিয়সুলভ বীর্যবত্তার প্রতি গভীর আস্থায় তাঁর এই বিবেচনা? জানা নেই। জানা নেই কতটা ফলপ্রসূ হয়েছিল এই বীর্য্যশুল্কার শৌর্যপ্রমাণের দ্বারা পতিলাভ। সমপর্যায়ের কোন ক্ষত্রিয় রাজাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাননি রামচন্দ্র। সীতাকে কেন্দ্র করে তাঁর যুদ্ধ ছিল রাক্ষসরাজ রাবণের বিরুদ্ধে। অরণ্যবাসে, রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে, অযোধ্যা বা শ্বশুরালয়ের রাজোচিত সামরিক সাহায্য তিনি পাননি বা চাননি। বনবাসের অনুষঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁদের সাহায্যই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। হয়তো হরধনুভঙ্গের শৌর্যমহিমা তাঁকে অপরিসীম আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। সেই একার যুদ্ধজয়ে তাঁর বিরামহীন প্রচেষ্টা এবং বিজয়ের ফল হল, যুগান্তরেও তিনি জাতীয় নায়ক, অধুনা খানিকটা ভারতভাগ্যবিধাতার ভূমিকায়তো বটেই।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

সীতা হল ভূমিতে হলরেখা। জনককন্যা সার্থকনামা হয়েছেন, ভারতভূমির মনের মাটিতে স্থান করে নিয়েছেন নিজের গরিমায়, সেখানে তাঁর অতীতের বিদেহবংশগরিমার কোনও স্থান নেই। মাটি যে সাধারণকে ধরে রাখে,ধরে রাখে অসাধারণকেও।মাটিতে পা রেখে না চললে পতন অনিবার্য। ভূমিসুতা সীতাকে রামচন্দ্র ধরে রাখতে পারেননি। ক্ষত্রধর্ম পালনের অন্যতম শর্ত প্রজাপালন। সেটি তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন সত্যিই, কিন্তু তার জন্যে হারিয়েছেন মাটির কন্যা, জননী বসুন্ধরা যাঁর সেই সীতাকে। তাঁর এই পতন মানসিক। চিত্তবেদনায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন নিরন্তর। নিঃসন্দেহে আদর্শ রাজা হিসেবে তথাকথিত ‘রামরাজ্য’ নামে ‘মিথে’র স্রষ্টা হয়েছেন তিনি। তাঁর সম্মোহনী ক্যারিশ্মায় আচ্ছন্ন রেখেছেন আপামর ভারতবাসীকে। তাঁর জীবন থেকে বঞ্চিতা, নির্বাসিতা, পুত্রবতী সীতা,শুধুমাত্র রামচন্দ্রের স্ত্রী হিসেবে নয়,তিনি কিন্তু ত্যাগে, তিতিক্ষায়, আনুগত্যে রামচন্দ্রের সমান মহত্ত্বের আসনে অধিষ্ঠিতা, সে কথা সময় বলে দেয়।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content