রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে গঙ্গার সম্পর্ক কী? অযোধ্যার সঙ্গে যে আত্মিক সম্বন্ধ গঙ্গার। পরস্পরের সেই যোগসূত্রটি ঠিক কোথায়?

অযোধ্যার রাজা সগরের দুই পত্নী একজন কেশিনী তিনি বিদর্ভরাজনন্দিনী, অপরজন কশ্যপপুত্রী এবং সুপর্ণর অর্থাৎ গরুড়ের ভগ্নী সুমতি। সন্তানকামনায় সপত্নীক রাজা সগর, তপস্যায় মহর্ষি ভৃগুকে তুষ্ট করে পুত্রলাভের আশীর্বাদ লাভ করলেন।

কিছুদিন পরে স্বেচ্ছানুসারে দু’ জন রাজমহিষীই, যথাক্রমে কেশিনী অসমঞ্জ নামে একটি পুত্র এবং সুমতি তুঙ্গ ফলের মতো পিণ্ডের থেকে ষাট হাজার সন্তানের জন্ম দিলেন। কেশিনীপুত্র অসমঞ্জ নিষ্ঠুর প্রকৃতির। বৈমাত্রেয় ভাইদের সরযূনদীর জলে নিক্ষেপ করে কৌতুক অনুভব করতেন। এছাড়াও স্বজনদের বিঘ্ন এবং পুরোবাসীদের কাজের ক্ষতি করাতেই তার আনন্দ। পিতা, রাজা সগর, অসমঞ্জকে নির্বাসিত করলেন। অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান কিন্তু পিতার বিপরীত। অংশুমান শৌর্যশালী লোকপ্রিয় এবং প্রিয়বাদী ছিলেন।

একদা রাজা সগর যজ্ঞ করবেন মনস্থ করলেন। অসীম আগ্রহে রামচন্দ্র তার পূর্বপুরুষের যজ্ঞের বিবরণ জানতে উৎসাহী।

পূর্ব্বজো মে কথং ব্রহ্মন্ যজ্ঞং বৈ সমুপাহরৎ। বিশ্বামিত্র সেই যজ্ঞের অনুপুঙ্খ বৃত্তান্ত শুরু করলেন।

হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যবর্তী আর্য্যাবর্ত্ত। এটি যজ্ঞানুষ্ঠানের পক্ষে প্রশস্ত স্থান বিবেচনা করে, সেখানেই যজ্ঞ করবেন স্থির করলেন অযোধ্যারাজ সগর। যজ্ঞাশ্বটিকে অনুসরণের দায়িত্ব দিলেন অসমঞ্জপুত্র অংশুমানকে। দেবরাজ ইন্দ্র সর্বদাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, এই বুঝি যজ্ঞের বলে বলশালী কোন পার্থিব রাজা তাঁর সাধের সুরলোক ছিনিয়ে নেয়। তাই তিনি যজ্ঞ পন্ড করতে উৎসাহী হলেন। এ বিষয়ে দেবেন্দ্র ওস্তাদ।দেবরাজ রাক্ষসবেশে যজ্ঞীয় অশ্বটি অপহরণ করলেন। হৈ চৈ পড়ে গেল রাজগৃহে। উপাধ্যায়রা রাজাকে পরামর্শ দিলেন অবিলম্বে এই অশুভ লক্ষণ দূর করবার জন্যে, অপহারকসহ অশ্বটিকে খুঁজে আনা প্রয়োজন। সগররাজা ষাট সহস্র পুত্রকে আদেশ দিলেন, রাক্ষসদের প্রবেশ দুঃসাধ্য এই অশ্বমেধ মহাযজ্ঞে। এ নিশ্চয়ই কোন দেবতার কাজ। সারা পৃথিবী জুড়ে অনুসন্ধানেও অশ্বটিকে না পাওয়া গেলে, প্রয়োজনে পৃথিবীপৃষ্ঠে এক যোজন বিস্তৃত ভূভাগ খনন করে, এমন কি রসাতলে পৌঁছেও অশ্বটি আছে কিনা দেখ।

সমুদ্রমালিনীং সর্ব্বাং পৃথিবীমনুগচ্ছথ।একৈকং যোজনং পুত্রা বিস্তারমভিগচ্ছথ।।
যাবত্তুরগসন্দর্শস্তাবৎ খনত মেদিনীম্।তমেব হয়হর্ত্তারং মার্গমাণা মমাজ্ঞয়া।।
সগররাজা সিদ্ধান্ত নিলেন, পুত্রদের সফল প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় যজ্ঞকর্তা তিনি এবং পৌত্র অংশুমান সেখানেই অবস্থান করবেন। অশ্ব অনুসন্ধানে যাত্রা শুরু করলেন সগরপুত্ররা। সমস্ত পৃথিবীতে অশ্বটিকে না পেয়ে এক যোজন বিস্তীর্ণ ভূভাগ খনন করতে শুরু করলেন তাঁরা। সমস্ত প্রাণীবৃন্দ আতঙ্কিত ও বিপন্ন বোধ করলেন। মনে হয় তারা ভয় পেল এই ভেবে যে, পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হতে চলেছে। ব্রহ্মার শরণাপন্ন হল তারা। ব্রহ্মা তাদের আশ্বস্ত করলেন, সগরতনয়রা কপিলরূপী বিষ্ণুর কোপানলে শীঘ্রই ভস্মে পরিণত হতে চলেছেন সগরপুত্ররা।

এদিকে সগরতনয়রা পৃথিবী বিদরণের নিষ্ফল প্রচেষ্টার কথা জানালেন পিতাকে। রাজা সগর আদেশ দিলেন, আবারও একইভাবে ভূপৃষ্ঠ খনন করে অশ্ব অনুসন্ধান অভিযান শুরু করা হোক। পিতার আদেশে আবারও বসুধা খনন করতে করতে প্রথমে বিরূপাক্ষ নামে দিগ্গজের সামনে উপস্থিত হলেন ষাট সহস্র সগরপুত্র। সেই দিগ্গজ পৃথিবীকে মাথায় করে ধরে রেখেছে। ক্লান্ত হয়ে যেই সে মাথা দোলায় তখনই ভূপৃষ্ঠ আন্দোলিত হয়ে ভূকম্পন শুরু হয়। দিগ্গজকে সম্মান প্রদর্শন করে সগরপুত্রেরা পূর্ব দিক ভেদ করে দক্ষিণ দিকে মহাপদ্ম, এরপর যথাক্রমে পশ্চিম দিকে সৌমনস এবং উত্তর দিকে ভদ্র নামে দিগ্গজেদের সম্মুখীন হলেন। পূর্বোত্তর দিকে খনন করতে করতে তাঁরা কপিলমুনির সাক্ষাৎ পেলেন। যজ্ঞীয় অশ্বটিকেও দেখতে পেলেন। সগরপুত্ররা কোদাল, লাঙ্গল, গাছ, পাথর নিয়ে ঋষি কপিলকে আক্রমণ করে বললেন, তস্কর, যজ্ঞাশ্ব অপহরণকারী, দুষ্ট, তোমাকে জানাই, আমরা সগরপুত্র।

অস্মাকং ত্বং হি তুরগং যজ্ঞিয়ং হৃতবানসি।দুর্মেধস্ত্বং হি সম্প্রাপ্তান্ বিদ্ধি নঃ সগরাত্মজান্।

তাঁদের এই কথায় রোষে চিৎকার করে উঠলেন মহর্ষি কপিল। তাঁর ক্রোধে ভস্মে পরিণত হলেন সগরপুত্রেরা।

রাজা সগর অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পৌত্র অর্থাৎ অসমঞ্জের পুত্র অংশুমানকে আদেশ দিলেন অবিলম্বে পিতৃণাং গতিমন্বিচ্ছ যেন চাশ্বোঽপবিহিতঃ। পিতৃব্যদের এবং অশ্বাপহারককে সন্ধান কর। পিতৃব্যদের তৈরি পাতালের খাত ধরেই অংশুমান রওনা দিলেন। যথারীতি দিগ্গজদের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। তাঁদের সম্মান ও অভিবাদন জানিয়ে পিতৃব্যদের সংবাদ জানতে চাইলেন অংশুমান।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৫: কুরুপাণ্ডবদের পিতামহ প্রাজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস, সর্বত্যাগীর কেন এই মায়াবন্ধন?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬০: গ্রাম বাংলায় আমুর কার্প মাছের বীজ উৎপাদন করে ভালো রোজগার করা সম্ভব

প্রতিদিকেই দিগ্গজেরা বললেন, অংশুমানের কাজে নিশ্চিত সাফল্য, উদ্দেশ্যপূরণ নিশ্চিত। আসমঞ্জ কৃতার্থস্ত্বং সহাশ্বঃ শীঘ্রমেষ্যসি। হে অসমঞ্জপুত্র শীঘ্রই তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে, তুমি সেই যজ্ঞাশ্বটি ফিরিয়ে আনতে পারবে। শেষে অসমঞ্জনন্দন অংশুমান পৌছলেন উদ্দিষ্টস্থানে। সগরনন্দনদের ভস্মাবশেষ দেখে শোকার্ত হয়ে পড়লেন। অদূরেই দৃশ্যমান সেই যজ্ঞের অশ্বটি। শোকাবিভূত অংশুমান পিতৃব্যদের তর্পণের জল খুঁজে পেলেন না কোথাও। সেই সময় ভস্মীভূত ষাটসহস্র পিতৃব্যের মাতুল সুপর্ণ অর্থাৎ গরুড় তাঁকে উপদেশ দিলেন যে হিমালয়কন্যা গঙ্গার পবিত্র স্রোত অপ্রতিম তেজবিশিষ্ট কপিল মুনির প্রভাবে দগ্ধ পিতৃব্যদের ভস্মাবশেষের ওপর প্রবাহিত হলে তবেই তাঁদের মুক্তি সম্ভব।

ভস্মরাশীকৃতানেতান্ প্লাবয়েল্লোকপাবনী। তয়া ক্লিন্নমিদং ভস্ম গঙ্গয়া লোককান্তয়া।। ষষ্ঠীং পুত্রসহস্রাণি স্বর্গলোকং গমিষ্যসি।

অংশুমান যজ্ঞাশ্বসহ ফিরে গিয়ে সগররাজাকে পিতৃব্যদের মর্মান্তিক পরিণতি এবং গরুড় উপদিষ্ট অন্তিম সংস্কারের উপায় জানালেন।রাজা সগর, যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন, কিন্তু দেবীগঙ্গাকে পৃথিবীতে প্রবাহিত করবার উপায় খুঁজে পেলেন না। যথাকালে তিনি দেহ রাখলেন।

এরপর যথাক্রমে রাজা অংশুমান এবং অংশুমানের পুত্র দিলীপ ক্রমান্বয়ে গঙ্গাকে পৃথিবীতে আনবার উপায় চিন্তা করে ব্যর্থ হলেন। দিলীপের মৃত্যুর পরে দিলীপপুত্র পরম ধার্মিক ভগীরথ এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলেন। ভগীরথ নিঃসন্তান ছিলেন। পূর্বপুরুষদের মুক্তি দান এবং সন্তান লাভের আশায় কঠোরতম তপস্যায় সচেষ্ট হলেন ভগীরথ। সে এক ভীষণ লক্ষ্য পূরণের সাধনা। অভূতপূর্ব কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে দিয়ে কখনও ঊর্দ্ধবাহু হয়ে,কখনও বা পঞ্চাগ্নির মধ্যে অবস্থান করে, আবার কখনও মাসান্তে একবার আহার করে ঘোর তপস্যা শুরু হল। তাঁর গভীর অধ্যবসায়ে তুষ্ট হলেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মা গঙ্গার জলধারা ভগীরথের পূর্বপুরুষদের ভস্মরাশির ওপরে প্রবাহিত করবার এবং ইক্ষ্বাকুবংশধারার গতি অব্যাহত রাখবার প্রার্থনায় সায় দিলেন। তবে হিমালয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা গঙ্গার প্রবল উচ্ছ্বাসে অবতরণের পতনবেগ পৃথিবী সইতে পারবেন না হয়তো। সেই প্রবল বেগে ধারণের ক্ষমতা মহাদেব ব্যতীত অন্য কারও নেই।

তাং বৈ ধারয়িতুং রাজন্নান্যং হরস্তত্র নিযুজ্যতাম্।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১: সুন্দরবনের শেকড়ের খোঁজে

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২: রথ দেখো কলা বেচো

অতএব হরই একমাত্র সহায়। ভূপৃষ্ঠে শুধুমাত্র এক অঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ স্পর্শ করে এক বৎসর শিবের উপাসনারত হলেন ভগীরথ। তুষ্ট মহাদেব প্রীত হয়ে গঙ্গার প্রবল বেগ মস্তকে ধারণ করবার অঙ্গীকার করলেন। মহাদেবের মস্তকে পড়লেন গঙ্গা। প্রতিস্পর্ধায় মহাদেবের শক্তি পরীক্ষার ছলে গঙ্গা, স্রোতের দুরন্ত গতিতে, মহাদেবকে নিয়ে পাতালে প্রবেশ করবেন। গঙ্গার গর্বিত মনোভাব বুঝতে পেরে, মহাদেব, জটাজুটে বেঁধে ফেললেন গঙ্গাকে। পথহারা দিকভ্রান্ত গঙ্গা, জটামন্ডলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন উদভ্রান্তের মতো। এই পরিক্রমণ থেকে তাঁর হয়তো আর মুক্তি নেই। রাজা ভগীরথের লক্ষ্য বিঘ্নিত হল। কিন্তু তাঁর আছে অদম্য চেষ্টা। আবার তপস্যায় শিবকে তুষ্ট করলেন তিনি। মহাদেব বিন্দু সরোবরে গঙ্গাকে মুক্ত করলেন। গঙ্গার তিনটি স্রোত হ্লাদিনী পাবনী ও নলিনী পূর্বদিকে এবং অপর তিনটি স্রোত, সুচক্ষু, সীতা ও মহানদী পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হল। পবিত্র জলধারার সপ্তম স্রোতটি ভগীরথকে অনুসরণ করে অগ্রসর হল পৃথিবীর পথে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দিব্যরথে আসীন ভগীরথ, তাঁর অনুগামিনী গঙ্গা।

প্রথমে শঙ্করশিরে তারপর পৃথিবীপৃষ্ঠে অবতীর্ণ হলেন তিনি। ঘোর গর্জনের নিজের অভাবনীয় আবির্ভাব ঘোষণা করলেন গঙ্গা। সঙ্গে নিয়ে এলেন মৎস্য, কচ্ছপ, শিশুমার এইসব পতনোন্মুখ প্রাণীদের। পৃথিবীকে স্বকৃতজ্ঞ উপহার যেন গঙ্গার। দর্শকদের বিমোহিত করে কখনও বিক্ষিপ্ত জলচর প্রাণীদের নিয়ে অপূর্ব শোভা সৃষ্টি করলেন গঙ্গা। তরঙ্গের অভিঘাত যেন শরতের আকাশের বলাকাশোভিত মঘমালা যেন। কখনও দ্রুতবেগে, কখনও আঁকাবাঁকা কুটিল গতিতে, কোথাও প্রসারিত ভাবে, কখনও অধোমুখে, কোথাও ঊর্দ্ধগতিতে কখনও বা স্তিমিত ধীর লয়ে তার আবহমান পথচলা শুরু হল। হিমালয় বিধৌত ধাতুমিশ্রিত সেই জলরাশি মঙ্গলময় শিবশক্তির আধার। ভূপৃষ্ঠের ঋষি ও গন্ধর্বরা সেই পূত জলরাশির স্পর্শ সুখ অনুভব করলেন। অবগাহন স্নানে পরিতুষ্ট হলেন গঙ্গার পবিত্রতায়। গঙ্গাকে অনুসরণ করলেন দেব,ঋষি, নির্বিশেষে দৈত্য, দানব, রাক্ষস, গন্ধর্ব, যক্ষ, কিন্নর, বুকে হেঁটে চলা প্রাণী উরগ, সর্প, অপ্সরা, জলচরপ্রাণীরা সকলে। গঙ্গাপ্রবাহের জীবনদায়ী জলে যে সকলের অধিকার। পথে আবারও বিপর্যয়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৯: পথের প্রান্তে রয়ে গিয়েছে সে হাজার তারার ‘লক্ষহীরা’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৬: ‘ও হানসিনি, মেরি হানসিনি কাঁহা উড় চলি’—কিশোর-পঞ্চম ম্যাজিক চলছেই

গঙ্গা, যজ্ঞরত জহ্নুমুনির আশ্রম প্লাবিত করায় সক্রোধে মুনি তাঁকে পান করে গঙ্গার গর্বিত ব্যবহারের উচিত শিক্ষা দিলেন। দেব, ঋষি, গন্ধর্বদের পুজোয় ও অনুরোধে জহ্নুমুনি কর্ণকুহর দিয়ে গঙ্গাকে মুক্ত করলেন। জহ্নুমুনির কন্যা হলেন গঙ্গা। সেই থেকে তাঁর নাম হলো জাহ্নবী। গঙ্গা ভগীরথকে অনুসরণ করে সাগরে মিশে গেলেন এবং এরপর পাতালে প্রবেশ করে সগরসন্তানদের প্লাবিত করলেন। পাপমুক্ত হলেন সগরসন্তানেরা।

ব্রহ্মা ভগীরথকে আশীর্বাদ করে বললেন, গঙ্গা তোমার জ্যেষ্ঠাকন্যা তাই তোমার নামানুসারে সে ভাগীরথী নামে ত্রিভুবনে প্রসিদ্ধি লাভ করবে। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল এই তিন পথে ভাগীরথী গঙ্গার আগমন তাই তিনি ত্রিপথগা।

ইয়ঞ্চ দুহিতা জ্যেষ্ঠা তব গঙ্গা ভবিষ্যতি। ত্বৎকৃতেন চ নাম্নাথ লোকে স্থাস্যতি বিশ্রুতা।।
গঙ্গা ত্রিপথগা নাম দিব্যা ভাগীরথীতি চ। ত্রীন্ পথো ভাবয়ন্তীতি তস্মাৎ ত্রিপথগা স্মৃতা।।

গঙ্গার পবিত্র জলে পিতৃপুরুষদের স্মৃতিতর্পণের উপদেশ দিয়ে ব্রহ্মা অন্তর্হিত হলেন। মহর্ষি বিশ্বামিত্র গঙ্গার বিস্তারিত অবতরণমাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন শ্রীরামচন্দ্রের কাছে।

হিমালয়ের তুষারাবৃত শৃঙ্গগুলিই যেন এক একটি মহাদেবের সমুন্নত শিখররূপ শির। আকাশঙ্গা অনন্ত আকাশ। বাষ্পের আধার সেই আকাশগঙ্গার বাষ্পকণা দ্রবীভূত হল পর্বতশিখরে। প্রবল জলধারা অসংখ্য শাখা প্রশাখায পথ হারাল পার্বত্যপথে। কবিকল্পনায় মহাদেবের জটাজালে পথহারা বিভ্রান্ত গঙ্গা। অবশেষে অলকানন্দা, মন্দাকিনী পথ খুঁজে পেল মূলস্রোতে, এক নিরন্তর যাত্রার সূচনা। পার্থিবযাত্রায় আছে বিঘ্ন, রয়েছে প্রতিবন্ধকতা, জহ্নুমুনির আশ্রমে অজানা, অচেনা দিকভ্রান্তি, তাতে ব্যাকুল হলে চলবে না। মানুষ ভগীরথেরা আছেন, যাঁদের নিরলস প্রচেষ্টায়, অতিলৌকিক উত্তরণ ঘটে সমভূমির প্রবাহিত জীবনালেখ্যে। তেমনই এক বিজয়যাত্রা গঙ্গার। এক সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণু ধ্বংসাবশেষের ওপরে গড়ে ওঠে আর এক নতুন কোনও সাম্রাজ্যের ভিত। গাঙ্গেয় উপকূল কত উত্থান, পতনের প্রত্যক্ষদর্শী, ইতিহাস সে কথা বলে। কপিলমুনির কোপানলে দগ্ধ সগররাজার মৃতপুত্রদের ভস্মরাশির ওপর প্রবাহিত গঙ্গাস্রোত, সে যেন ভগীরথকীর্তির যুগান্তরের ঐতিহাসিক উড়ান। ভগীরথরা যুগান্তরেও নিরলস প্রচেষ্টায় অসাধ্য সাধন করে চলেছেন। মানবশক্তির জয়ধ্বজা ওড়ে প্রাকৃতিক শক্তির ওপরে। ভগীরথরা আছেন, থাকবেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৪: মাথায় চোট মানেই কি ইন্টারনাল হেমারেজ?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৯: কেস জন্ডিস

নদীমাতৃক দেশে ― নদী, রুটি, রুজিরোজগার, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মিশে রয়েছে। নদীর যে “আলোর পানে প্রাণের চলা’। তাই নদী সর্বদাই এক বৃহৎ, কোন মহৎ লক্ষ্যে, সর্বদাই ধাবমান। এই কারণেই হয়তো মহাকাব্যের কবিরা নদী নিয়ে মিথ বা অতিকথার বিস্তারে মেতে উঠেছেন। গঙ্গার অবতরণ, কবিকল্পনার মানসলোক সেই আকাশগঙ্গা থেকে,দেবাদিদেবের শক্ত মস্তকটিতে। কারণ মঙ্গল, কল্যাণের অভিমুখে তাঁর অভিযাত্রা। এই আশ্চর্য অবতরণক্ষেত্রটি মঙ্গলময় শিবশক্তি ছাড়া কীই বা হতে পারে? প্রবল জলোচ্ছ্বাসকে ধারণ করে মানবকল্যাণে তাকে চালিত করে যে, সে যে কল্যাণমুখী শক্তি। কিন্তু শিবশক্তিকে ধুয়ে মুছে পতনের গভীরে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টাকরে যে, সে নিজেই হারিয়ে যায় জটিলতার বেষ্টনে। মহাদেবের জটাজুটের গোলকধাঁধায় গঙ্গার পথহারাবার কাহিনির বিন্যাসে,যেন তারই ইঙ্গিত। ভগীরথের অপরিসীম প্রচেষ্টায় গঙ্গা এসেছেন অববাহিকার সমতলে মর্তভূমির বিচিত্র পার্থিবলোকে। এক একটি সভ্যতার বিনির্মাণ ও লয়ে তাঁর বিজয়িনী জয়যাত্রা। পূর্বপুরুষের ব্যর্থতার ভস্মরাশি ধুয়ে মুছে, পূর্বপুরুষের পিতৃঋণ শোধ করে নতুন সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে তোলায় অনন্যা দেবী গঙ্গা। উজ্জ্বলতার দ্যোতনায় তাঁর দেবীরূপের মহত্ত্ব। তাঁর উজ্জ্বল উদ্ধার হল, নতুন নতুন সভ্যতার সৃজন। উর্বরতার পলি পেছনে ফেলে রেখে তিনি এগিয়ে যান। সেই উর্বরতার মাতৃস্নেহেধারায় পরিপুষ্ট হয় মাটি, প্রসব করে জীবনের রসদ শস্যশ্যামলা বসুন্ধরা। দেবী গঙ্গা স্নিগ্ধ মায়ার বাঁধনে আনত কৃতজ্ঞতায়, শ্রদ্ধায়, ভারতভূমিতে হয়ে যান ‘মা’গঙ্গা।—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content