বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


মহাভারতের পিতামহ দুজন। একজন — দ্রষ্টা, স্রষ্টা, ধর্মোপদেষ্টা, কবি, ক্রান্তদর্শী, তিনি হলেন মহর্ষি বেদব্যাস। আর একজন প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, যিনি গৃহী হয়েও ষড়রিপুর অন্যতম কামকে জয় করে সংযতেন্দ্রিয় তিনি পিতামহ ভীষ্ম। তিনি আজীবন ভরতবংশীয়দের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করে এসেছেন পক্ষপাতিত্বহীন ভাবে। যিনি আমৃত্যু পিতৃহীন পঞ্চপাণ্ডবদের জীবনে পিতৃস্নেহের বিকল্প হয়ে এসেছেন আর নুনের দাম মিটিয়েছেন মাতৃভূমির অধিকারী দুর্বিনীত পৌত্রদের প্রতি দায়বদ্ধতায়। তাদের শুধরে দিতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন যখন, তখন স্নেহের ফল্গুস্রোতকে রুদ্ধ করে নিজেকে দায়িত্বশীল রাজপুরুষ হিসেবে প্রমাণ করতে তৎপর হয়েছেন। ‘মা’ গঙ্গার স্নেহছায়ায় অতীত শৈশব হয়তো তাঁর স্নেহ, মায়া মমতার পেলব, কোমল আবরণটির মূলে রয়েছে। গঙ্গার স্বচ্ছতা, ছুটে চলা, ভাবোচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে কূলপ্লাবী হয়ে ওঠা—এ সবকিছুই হয়তো ভীষ্মের নিজের কুলের প্রতি স্নেহ, মায়া, করুণার উদ্ভাস এনে দিয়েছে।

শিষ্য বৈশম্পায়নকে নিজের জন্ম বৃত্তান্ত অকপটে বর্ণনা করতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হননি ব্যাসদেব। এখন প্রসঙ্গ — কুরুপাণ্ডবদের অতি শ্রদ্ধেয় পিতামহ গাঙ্গেয় ভীষ্ম। হস্তিনাপুরের রাজা প্রতীপের পুত্র শান্তনু, ভীষ্মের পিতা। রাজা শান্তনু বিবাহ করেছিলেন গঙ্গাকে। কে এই গঙ্গা? মহাভারতকার একটি বিশেষণে বুঝিয়ে দিয়েছেন ইনি হলেন ভাগীরথী গঙ্গা।

শান্তনুঃ খলু গঙ্গাং ভাগীরথীমুপযেমে।

কীভাবে এমন হল? নদীশ্রেষ্ঠা দেবী গঙ্গার একটি অতীত কাহিনি ছিল। একদা ব্রহ্মাসমক্ষে অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে হাজির হলেন রাজর্ষিরা। এদের মধ্যে ছিলেন ইক্ষ্বাকুবংশীয়, ধার্মিক, সত্যবাদী, শৌর্যশালী রাজা মহাভিষ। নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গাও সেখানে উপস্থিত। হঠাৎ সেটা বায়ুরই কোন কারসাজি কিনা জানা নেই, বায়ুর প্রভাবে সর্বসমক্ষে গঙ্গার চাঁদের প্রভার মতো বসনটি গুপ্ত অঙ্গ থেকে খসে পড়ল। দেবতারা নতমুখ হলেন। শুধু রাজা মহাভিষ নিঃসংকোচে চেয়ে রইলেন গঙ্গার দিকে। হয়তো গঙ্গার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তাঁর চোখ আর সরছিল না। বিরক্ত ব্রহ্মা, রাজা মহাভিষকে মর্ত্তবাসের অভিশাপ দিলেন। মহাভিষ ভীষ্মের পিতা শান্তনুর পিতা রাজা প্রতীপকে পিতারূপে বেছে নিলেন। নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গাও মহাভিষ রাজার কথা ভাবতে ভাবতে ফিরছেন যখন, তখন পথে সুরলোকের বসু দেবতাদের সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দেখতে পেলেন। কেন তাদের এই অবস্থা? সেখানেও এক মর্মান্তিক কাহিনি। ক্রুদ্ধ মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপেই তাদের এই দশা।

অপরাধ? বরুনদেবের পুত্র আপব নামে খ্যাত বশিষ্ঠ। তাঁর সুরভি নামে এক গাভী আছে। সেই গাভীর কন্যা নন্দিনী, সমস্ত অভীষ্টবস্তুদানে সক্ষম এমনই তাঁর খ্যাতি। একদা এই অষ্টবসুর মধ্যে একজন, ‘দ্যু’ নামে এক বসুর পত্নী গাভীটিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে আবদার করলেন স্বামীর কাছে, তার বান্ধবী উশীনর রাজার কন্যা জিতবতীকে সকন্যা গাভীটিকে তিনি উপহার দিতে চান। প্রিয়ার মন রাখতে দ্যুবসু গাভীটিকে অপহরণ করলেন। ধ্যানযোগে এই অপহরণবৃত্তান্ত জানতে পেরে আটজন বসুকেই মানবজন্মের অভিশাপ দিলেন বশিষ্ঠ।শুধু দ্যুবসুর অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে তাকে দীর্ঘ মনুষ্যজন্মলাভের কঠোর দণ্ড দিলেন। তবে অশেষ অনুগ্রহ তাঁর,বললেন—জনিষ্যতি ন চাপ্যেবং মানুষেষু মহামনাঃ।। নবজন্মে মানবগণের মধ্যে তাঁর মতো মহান কেউ হবেন না। তিনি আরও বললেন, দ্যুবসু জন্মান্তরে হবেন—

ভবিষ্যতি চ ধর্মাত্মা সর্বশাস্ত্রবিশারদঃ। পিতুঃ প্রিয়হিতে যুক্তঃ স্ত্রীভোগান্ বর্জ্জয়িষ্যতি।।
ধার্মিক, সর্বশাস্ত্রজ্ঞ, পিতার প্রিয়কল্যাণকামী। তবে তিনি স্ত্রীসম্ভোগ সর্বদাই বর্জন করবেন।
বসুদেবগণ দেবী গঙ্গাকে অনুরোধ করলেন—

ত্বমস্মান্ মানুষী ভূত্বা সূষ্ব পুত্রান্ বসূন্ ভুবি।

পৃথিবীলোকে আপনি মানবী হয়ে আমাদেরকে পুত্ররূপে প্রসব করুন। গঙ্গা বললেন,তথেতি বেশ তাই হবে। কিন্তু হে শ্রেষ্ঠপুরুষগণ, মর্তলোকে তোমাদের পিতা হবেন কে?

মর্ত্ত্যেষু পুরুষব্যাঘ্রাঃ কো বঃ কর্ত্তা ভবিষ্যতি

বসুদেবরা বললেন, পৃথিবীলোকে প্রতীপরাজার শান্তনু নামে বিখ্যাত পুত্রটি হবেন আমাদের পিতা।

প্রতীপস্য সুতো রাজা শান্তনুর্লোকবিশ্রুতঃ। ভবিতা মানুষে লোকে স নঃ কর্ত্তা ভবিষ্যতি।।

আমাদের জন্মমাত্রই জীবন থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাই। তাই জন্মমাত্রই পুত্র সন্তানগুলিকে জলে ফেলে দেবেন আপনি।

জাতান্ কুমারান্ স্বানপ্সু প্রক্ষেপ্তুং বৈ ত্বমর্হসি। যথা ন চিরকালান্নো নিষ্কৃতিঃ স্যাত্ত্রিলোকগে!।।

গঙ্গা রাজি হলেন, শুধু একটি ইচ্ছে তাঁর। রাজা শান্তনুর সঙ্গে তাঁর মিলন যেন ব্যর্থ না হয়। তাই একটি পুত্রকে তিনি জীবিত রাখতে চান। বসুরা সম্মত হলেন। তাঁরা গঙ্গাদেবীকে বললেন, আমাদের তেজের এক এক অংশ আমরা সেই জীবিত পুত্রটিকে দান করব।
তু্রীয়ার্দ্ধং প্রদাস্যামো বীর্য্যস্যৈকৈকশো বয়ম্ তার ফলে সেই পুত্রটি অতি বীর্যবান হবেন।

তস্মাদ্ পুত্রস্তে ভবিষ্যতি স বীর্য্যবান্। তার কিন্তু কোনও সন্তান হবে না।

ন সম্পৎস্যতি মর্ত্ত্যেষু পুনস্তস্য তু সন্ততিঃ।

চুক্তি হয়ে গেল। খুশি মনে সেটি কার্যকর করবার লক্ষ্যে বসুদেবগণ প্রস্থান করলেন। গঙ্গার মনে রয়েছেন কিন্তু শাপভ্রষ্ট রাজা প্রতীপরূপী মহাভিষ। মহাভিষের রূপগুণে মুগ্ধা গঙ্গা একদিন তাঁর তীরে অবস্থানরত রাজা প্রতীপের শালগাছের মতো দক্ষিণ ঊরুতে গিয়ে বসলেন। রমণীরূপে গঙ্গা সরাসরি রাজাকে প্রেম নিবেদন করলেন। জানালেন তিনি রাজাকে চান। আর কামুকী নারীকে ফিরিয়ে দেওয়া সজ্জনের কাজ নয়। চরিত্রবান প্রতীপ জানালেন তিনি কামনার তাগিদে পরস্ত্রীগমন করেন না, অসবর্ণানারীতে তো নয়ই। এই সংকল্পই তাঁর ধর্ম। গঙ্গা অনমনীয়া। তিনি নিজের গুণ গাইলেন। প্রেমিকার কণ্ঠ তাঁর আত্মনিবেদনে—

ভজন্তীং ভজ মাং রাজন্। দিব্যাং কন্যাং বরস্ত্রিয়ম্।

আমি আপনার অনুরক্তা। আমার মতো দিব্যা এবং শ্রেষ্ঠা রমনীকে গ্রহণ করুন। রাজা প্রতীপ জানালেন, আমি ওই জীবন থেকে সরে এসেছি আমার ধর্ম এখন ভিন্ন, আমি ধর্মচ্যুত হতে চাই না। আর দক্ষিণ ঊরু যে সন্তানসম পুত্রবধূর স্থান। বাম ঊরুতে স্ত্রীর স্থান। তাই তোমার সঙ্গে কামাচরণ নয়। পুত্রের জন্যে পুত্রবধূরূপে তোমাকে বরণ করছি। হে কল্যাণি, তুমি আমার পুত্রবধূ হও।

স্নুষা মে ভব কল্যাণি! পুত্রার্থং ত্বাং বৃণোম্যহম্।

গঙ্গা ‘তাই হোক’ বলে অন্তর্হিতা হলেন। বৃদ্ধ রাজা রানিকে নিয়ে সুতস্যার্থে পুত্রের জন্য তপস্যায় বসলেন। সেই অভিশপ্ত রাজা মহাভিষ বৃদ্ধ রাজা ও রাণীর পুত্র হয়ে জন্ম নিলেন। শমগুণযুক্ত পিতার পুত্রের নাম হল শান্তনু। তরুণ শান্তনুকে পিতা সেই অজ্ঞাতনামা, পরমা সুন্দরী, কামার্তা কন্যার কথা জানালেন। বললেন, সে যদি তোমার কাছে আসে তার পরিচয় জানতে চেও না। তার কোনও কাজের বিষয়ে প্রশ্ন করবে না। সে যা চায় তাকে সেটাই দিও। গঙ্গার সঙ্গে এমনটাই কথা হয়েছিল রাজা প্রতীপের। সেই অনুসারেই পুত্রকে তার এই উপদেশদান।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১২: সিদ্ধাশ্রমে সাফল্য, বিশ্বামিত্রের বংশবর্ণনা এবং নদীকথায় কীসের ইঙ্গিত?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭: ঝুঁকি না নিলে জীবনে বড় কিছুই অর্জন করা যায় না

রাজা শান্তনু একদিন মৃগয়ারত ভ্রাম্যমান অবস্থায় গঙ্গার তীর ধরে বিচরণ করছিলেন। সেখানে এক পরমা সুন্দরী কন্যা উপস্থিত হলেন। তার দেহকান্তিতে চারিদিক উজ্জ্বল করে দ্বিতীয়া লক্ষ্মীরূপে যেন আবির্ভূত হলেন তিনি। নিখুঁত সেই সৌন্দর্য—পরিধানে সূক্ষ্ম বস্ত্র, দেহকান্তি পদ্মকলির মতো। চোখে বিস্ময় নিয়ে রোমাঞ্চিত রাজা।তাঁর চোখে পলক পড়ে না আর। রাজার রূপে মুগ্ধ হলেন এই অপরূপাও। দুয়ে দুয়ে চার। রাজা মুগ্ধতায় প্রশ্ন করলেন—

দেবী বা দানবী বা ত্বং গন্ধর্বী চাথবাপ্সরাঃ। যক্ষী বা পন্নগী বাপি মানুষী বা সুমধ্যমে!। যাচে ত্বাং সুরগর্ভাভে! ভার্য্যা মে ভব শোভনে।।

আপনি দেবী, দানবী, গন্ধর্বী, অপ্সরা, যক্ষী, সর্পী, মানুষী, কে আপনি? সুরবালিকা আপনাকে আমি চাই। হে সুন্দরী আপনি আমার ভার্য্যা হন। বসুদেবতাদের দেওয়া শপথ মনে করলেন গঙ্গা, তাঁদের সন্তানরূপে মুক্তিপ্রার্থনা স্মরণে এল তাঁর। রাজার সহস্র মৃদুমধুর প্রশ্নে শর্ত আরোপ করলেন।

ভবিষ্যামি মহীপাল! মহিষী তে বশানুগা। যত্তু কুর্য্যামহং রাজন্! শুভং বা যদি বাশুভম্। ন তদ্বারয়িতব্যাস্মি ন বক্তব্যা তথাঽপ্রিয়ম্।।

হে পৃথিবীপতি আমি আপনার অনুগত স্ত্রী হতে সম্মত। কিন্তু হে রাজন্, আমি ভালো মন্দ যা করি না কেন আপনি তাতে আপত্তি করতে পারবেন না। এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন বা কোনও অপ্রিয় বাক্য চলবে না। আর এর অন্যথায়—

বারিতা বিপ্রিয়ঞ্চোক্তা ত্যজেয়ং ত্বামসংশয়ম্।

যদি বারণ করেন বা কোনও অপ্রিয় কথা বলেন তবে আমি তৎক্ষণাৎ আপনাকে নিঃসংকোচে পরিত্যাগ করব। রাজা বললেন, “তথেতি তাই হোক। কোনও বিষয়ে প্রশ্ন নয়— এই নিয়ম মেনে, রাজা দাম্পত্য জীবনে নিশ্চুপ রইলেন। গঙ্গার স্বভাবে, ব্যবহারে, রূপে, উদারতায়, নির্জনে পরিচর্যায় পরিতুষ্ট হলেন শান্তনু। গঙ্গা দেবীর ত্রিপথগারূপ এখন আর নেই। গঙ্গা মানবীরূপ ধারণ করে সঙ্গিনী-পত্নীর ভূমিকায়। শ্রেষ্ঠ রাজা শান্তনুর সতত কামনাপূরণে শৃঙ্গারে, নৃত্যে, সম্ভোগে, অনুরাগে, রমণীর নানা কৌশলে রাজাকে মোহিত করে রাখলেন তিনি। এইভাবে কত মুহূর্ত,কত কাল,কত বছর,ঋতু,অতিবাহিত হল- হিসেব নেই তার। কালক্রমে সাতটি পুত্র জন্ম নিল গঙ্গার, আমি তোমাকে তুষ্ট করছি প্রীণামি ত্বামহম্ এই বলে প্রত্যেক পুত্রকে জলে নিক্ষেপ করে স্রোতে ভাসিয়ে দিতেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: পিকনিক দল থেকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু: তাঁর লেন্সের বিস্তৃতি ছিল বিস্ময়কর

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৩: ‘ওই দেখ, রাহুল দেব বর্মণের বাবা হেঁটে যাচ্ছেন’

পিতার প্রাণ,শান্তনু অষ্টম পুত্রের সময়ে আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। মনে ভয় ছিল এতদিন, গঙ্গা তাকে পরিত্যাগ করে চলে যাবে‌,এবার আর নয়,প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন। অষ্টম পুত্রটিকে রক্ষা করবার ইচ্ছায় গঙ্গাকে তিরস্কার করে বললেন—

মা বধীঃ কাসি কস্যাসি কিঞ্চ হংসি সুতানিতি। পুত্রঘ্নি। সুমহৎ পাপং সম্প্রাপ্তং তে বিগর্হিতম্।‌

আর বধ করো না। কে তুমি? কার তুমি? কেন তুমি সন্তানগুলিকে মেরে ফেলছ? পুত্র হত্যাকারিনী, তুমি যে বিরাট নিন্দিত পাপ কাজ করে চলেছ। গঙ্গা উত্তর দিলেন, হে পুত্রবৎসল পিতা, তোমার সন্তানকে আর বধ করব না।শর্ত অনুযায়ী তোমার সঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়।

পুত্রকাম! ন তে হন্মি পুত্রং পুত্রবতাং বর!। জীর্ণোঽস্তু মম বাসোঽয়ং যথা স সময়ঃ কৃতঃ।। ‌

আত্মপরিচয় দিলেন গঙ্গা, আমি জহ্নুমুনির কন্যা। মহর্ষিরা আমার সেবা করে থাকেন। দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য আপনার সঙ্গে এতদিন বসবাস করলাম। বসুদেবদের বৃত্তান্ত জানালেন। বসুদেবরা শাপমুক্ত হয়েছেন। আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে, স্বস্তি তেঽস্তু আপনার মঙ্গল হোক।

বসুগণকে শাপমুক্ত করতে তাদের জন্মান্তরে শিশু অবস্থাতেই এই নির্মম আচরণ গঙ্গার। শুধু দ্যুবসু জন্মান্তরে শান্তনুর অষ্টম পুত্র হয়ে জন্মেছেন। এই বলে অন্তর্হিতা হলেন গঙ্গা। ক্ষুন্ন মনে ফিরে এলেন রাজধানীতে ভগ্নহৃদয়ে রাজা শান্তনু।

সেই দ্যুবসু জন্মান্তরে গঙ্গাপুত্র হয়ে জন্ম নিলেন।তাঁর নাম হল গাঙ্গেয় এবং দেবব্রত। শান্তনু একদিন গঙ্গা তীরে লক্ষ্য করলেন, নদীজলে প্রবাহ যেন সীমিত। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলেন একজন সুপুরুষ, দীর্ঘদেহ, ইন্দ্রের মতো যুবক দিব্য অস্ত্র প্রয়োগে এবং তীক্ষ্ণ শরজালে গঙ্গাকে আবৃত করে অবস্থান করছেন। পিতাকে মুগ্ধতায় সম্মোহিত করে অন্তর্হিত হল সেই কুমার। তার নিজের আত্মজকে চিনতে ভুল হল না রাজা শান্তনুর। তিনি গঙ্গাকে বললেন, দর্শয়েতি তাকে দেখাও। এবার শুভ্রবসনা গঙ্গা, দৃশ্যমানা হয়ে জানালেন, পরম যত্নে পুত্রটিকে বড় করে তুলেছেন তিনি। বলবান ছেলেটিকে বশিষ্ঠ বেদপারঙ্গম করে তুলেছেন। অস্ত্রবিদ্যায় ধনুর্বিদ্যায় এবং যুদ্ধে সে ইন্দ্রতুল্য। শুধু তাই নয়, ছেলেটি দেবতা ও অসুরদের উভয়ের প্রীতিধন্য। শ্রদ্ধেয় শুক্রাচার্য যে শাস্ত্র জানেন সেইসব শাস্ত্রজ্ঞান এর অধিগত। দেবাসুরের শ্রদ্ধাস্পদ বৃহস্পতির শাস্ত্রজ্ঞান এর আয়ত্তাধীন। অস্ত্রবিদ্যায় ও রাজধর্মে অভিজ্ঞ পুত্রটিকে গৃহে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন গঙ্গা। রাজা, কান্তিমান প্রতিভাধর সূর্যের মতো ভাস্বর পুত্রটিকে গ্রহণ করলেন। হস্তিনাপুরে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হলেন গঙ্গাপুত্র দেবব্রত। নিজগুনে সকলের হৃদয় জয় করলেন সেই পুত্র। এইভাবে চার বৎসর কাল অতিবাহিত হল।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৬: ডিম থেকে বেরনোর পরে বাচ্চাগুলি তিন দিন কিছুই খায় না, এই কদিন দেহলগ্ন কুসুমেই চলে যায়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

এ বার প্রেক্ষাপট আবার এক নদী, যমুনা। একটি সুন্দর গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে রাজা শান্তনু গন্ধের উৎস সন্ধানে উপস্থিত হলেন যমুনাতীরে। সেখানে আবিষ্কার করলেন দীর্ঘনয়না,
কৃষ্ণা, সুন্দরী এক কন্যাকে। প্রশ্নোত্তরে জানলেন সে কন্যাটি ধীবর রাজকন্যা,নাম তার সত্যবতী। কন্যাটির রূপে মজে গেলেন শান্তনু। ধার্মিক রাজার সম্ভোগ ইচ্ছা জাগল। কন্যাটির পিতার কাছে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন রাজা। দাসরাজা বললেন, রাজী আছেন তবে একটি শর্তে। সত্যপরায়ণ রাজা শান্তনুকে একটি শপথ করতে হবে। রাজার অবর্তমানে এই কন্যাটির গর্ভে যে পুত্রের জন্ম হবে, যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হবে সে, অন্য কেউ নয়। নান্যঃ কশ্চন পার্থিব। রাজা শান্তনু প্রবল কামজ্বরে আক্রান্ত। তীব্র দহনজ্বালায় দগ্ধ হয়েও ধীবররাজের বাক্যে সম্মত হতে পারলেন না তিনি। সেই কন্যাটির কথা ভাবতে ভাবতে ভগ্নহৃদয়ে কামনায় চেতনাহীন অবস্থায় হস্তিনাপুরে পৌছলেন রাজা শান্তনু। তাঁর কান্তিহীন, পাণ্ডুবর্ণ বা রুদ্ধবাক, কৃশচেহারা পুত্রের নজর এড়ালো না। পিতার কাছে পুত্র জানতে চাইলেন রোগটা কী? জানলে তবেই তার প্রতিকার ব্যবস্থা নেবেন তিনি। রাজা জানালেন এই বিশাল বংশে তুমি একমাত্র সন্তান। তোমার যদি হঠাৎ কোনও বিপত্তি হয় তাহলে যে বংশই থাকবে না। যদিও তুমি শতপুত্র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কিন্তু বেদবাদীদের মতে— এক পুত্র থাকা আর সন্তানহীনতা সমার্থক। আসল কথাটি অর্থাৎ তিনি যে বিবাহসূত্রে শর্তসাপেক্ষ সন্তানের পিতৃত্ব চাইছেন— একথাটি ভাঙলেন না। একটু দ্বিচারিতা যে আছে তাঁর কথায় এ বিষয়ে বোধ হয় কোন সন্দেহ নেই।

সোঽহমস্মি সংশয়ামাপন্নস্ত্বয়ি শান্তে কথং ভবেৎ। ইতি তে কারণং তাত। দুঃখস্যোক্তমশেষতঃ।।

আমি যে দ্বিধাগ্রস্ত,তোমার অভাবে কী হবে? এটা ভেবে। এটাই আমার দুঃখের কারণ। পরিণত বয়সী পুত্রের সামনে কিছুটা শঙ্কা, লজ্জা, স্নেহশীল পিতৃহৃদয়ে পুত্রকে বঞ্চিত করবার প্রস্তাবের দ্বন্দ্ব, সবকিছু মিলিয়ে তার যত দ্বিধাদ্বন্দ্ব, দুঃখ,দোলাচলচিত্ততা।

প্রখর বুদ্ধিমান দেবব্রত পিতা শান্তনুর দুঃখের প্রকৃত কারণ জানবার জন্য উপস্থিত হলেন বৃদ্ধ অমাত্যের কাছে। দাস রাজকন্যা সত্যবতীর প্রতি প্রণয়াসক্ত রাজা। দাসরাজার সঙ্গে দেখা করলেন গঙ্গাপুত্র। দেবব্রতকে দাসরাজা জানালেন সত্যবতী একজন ক্ষত্রিয়কন্যা। রাজা উপরিচর তাঁর পিতা। ঘটনাচক্রে ধীবররাজ কন্যাটির পালক পিতা। সবকিছু জেনে নিয়ে দাসরাজাকে সংশয়মুক্ত করে দৃঢ়কণ্ঠে দেবব্রত ঘোষণা করলেন—
যোঽস্যাং জনিষ্যতে পুত্রঃ স নো রাজা ভবিষ্যতি।

এনার (কন্যা সত্যবতীর) যে পুত্র হবে সেই হবে আমাদের রাজা। দাসরাজার মন তবুও সন্দেহমুক্ত নয়। তাঁর প্রশ্ন—

অপত্যং ভবেদ্ যত্তু তত্র নঃ সংশয়ো মহান্

আপনার সন্তানাদির বিষয়ে আমার ঘোর সন্দেহ অর্থাৎ আপনার সন্তানাদি তাদের দাবি ছাড়বে কেন? উদারমনা গঙ্গাপুত্র মহান দেবব্রত উদাত্তকণ্ঠে আবারও এক কঠোর শপথবাক্য উচ্চারণ করলেন—

অদ্য প্রভৃতি মে দাস! ব্রহ্মচর্য্যং ভবিষ্যতি।

ইন্দ্রিয়দ্বার রুদ্ধ করে সেই দিন থেকেই ব্রহ্মচর্য্যব্রত নিলেন শান্তনুপুত্র দেবব্রত। এই দুষ্কর প্রতিজ্ঞায় মুনিগণ ভীত হলেন তাই দেবতারা দেবব্রতের নাম দিলেন ‘ভীষ্ম

টিকাকারের মতে—
ঈদৃশদুষ্করপ্রতিজ্ঞায়াং মুনিগণোঽপি বিভেত্যস্মাদিতি ব্যুৎপত্তেঃ।
দাসরাজ বিবাহে সম্মতি দিলেন।সত্যবতীকে রথে তুলে নিয়ে হস্তিনাপুরে পিতার কাছে হাজির হলেন ভীষ্ম। সন্তুষ্ট রাজা শান্তনু পুত্রকে ইচ্ছামৃত্যুর বরদান করলেন। পিতামহ ভীষ্মের উপস্থিতি কুরুপাণ্ডবদের জীবনে বটবৃক্ষের ছায়ার মতো।অকৃতদার পিতামহ ভীষ্ম প্রতিজ্ঞায় অনড়,তাঁর অন্তঃস্থলে কোমলতার, মায়ার, জলছলছল গঙ্গার স্নেহধারার স্রোত বাইরে রাজা শান্তনুর থেকে পাওয়া কঠোর রাজোচিত নিষ্ঠার আবরণ।

মহাকাব্য কথায় কেন নদী ফিরে ফিরে আসে? নদীর প্রবহমানতা, গতিময়তা, প্রাণোচ্ছ্বাস, আনন্দে আবেগে কোন বৃহৎ কোনও মহতে মিলিত হবার প্রয়াসে মানুষ খুঁজে পায় কী জীবনধর্মিতার সাযুজ্য? আর্ষ মহাকাব্যের ঋষিকবিরা মুগ্ধতায় আত্মহারা হয়েছেন নদীদর্শনে,তাঁর প্রবাহে গা ভাসিয়ে জীবনবীক্ষণে তন্ময় হয়েছেন। নদী তাই প্রাণময়ী হয়ে কখনও যৌবনবতী রমনী, কখনও বা অভিপ্রেত প্রার্থিতার মিলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। গঙ্গার ব্যাপ্তিতে, তার চলার পথের সঙ্গী হয়েছেন ভারতবংশের বিখ্যাত রাজারা।কখনও জীবনের যাত্রাপথে আনন্দগান হয়ে তিনি সঙ্গ দিয়েছেন রাজাদের কখনও বা আন্তরিকপ্রেমে ভরতবংশের উৎসমূলের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে ভারত ইতিহাসের শরিক হয়ে উঠেছেন। গঙ্গা তার সৃজনবিভঙ্গে কত মোহময়ী হয়ে উঠে আত্মজকে পৃথিবীতে আনেন, নতুন সৃষ্টি যে সন্তানের মতো। আবার হঠাৎ ধেয়ে আসা খেয়ালী ঝড়ের মতো কোনও অজানা উন্মাদনায় আপনস্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যান নির্মোহ বৈরাগ্যে, কোন বাঁধনে তিনি ধরা দেন না। রাজার গভীর ভালবাসার বাঁধনে ক্ষণিক স্থিতি, তারপর চরম অবহেলায় সব ছেড়ে চলে যান অনেক বড় মুক্তির সন্ধানে। সমুদ্র তাঁর গন্তব্য। উর্বরতার স্মৃতিচিহ্ন পলিমাটি ফেলে রেখে যান,রেখে যান কোন মহান ভীষ্মকে,যে নিজেকে উজার করে দেয় প্রাপ্তির আশা না রেখে, শুধু মানবজমিন প্রকৃত মানুষে অধ্যুষিত শ্যামলতার প্রাচুর্য লাভ করুক — এটাই যেন তার একমাত্র চাওয়া।

নদী গঙ্গা যে মহাভারতে মিশে যেতে চাইলেন – ভারতস্রোতে নিজের ঐশ্বর্য বিকীর্ণ করে মহতী কীর্তির অধিকারিণী হওয়াই ছিল বোধকরি তার অভিপ্রায় অথবা ভবিতব্য।কোন সুদূর কাল থেকে আকাশগঙ্গা হতে ভরতাধিকৃত ভূমিতে তাঁর আবহমান প্রবাহ।এ যে নদীর অধিকার। গঙ্গা-যমুনা, হিমালয়, কৈলাশশিখর—এ সবকিছুই ভরতবংশীয়দের রাজ্যের অনুষঙ্গ। এদের বর্জন করে ভারতেতিহাস কীভাবে সম্ভব?—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content