শনিবার ৫ অক্টোবর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

দেবী কুন্তী-সহ পঞ্চপাণ্ডবের নিরুদ্দেশযাত্রার কেন্দ্রীয় শক্তি ছিলেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন। যুধিষ্ঠির স্থৈর্য, অর্জুন শৌর্য, ভীমসেন যেন গতিময়তার প্রতীক। তিনি যাত্রাপথের চলমান ছন্দ ধরে রেখেছেন। মা কুন্তীসহ চার ভাই পথশ্রমের ক্লান্তিতে নিদ্রিত। অদূরে শালগাছের উপরে হিড়িম্ব নামে এক রাক্ষসের আশ্রয়। কেমন শক্তিমত্তা সেই রাক্ষসের? স্বভাবটিও বা কেমন? মহাভারতকথক বৈশম্পায়নের বর্ণনায়, সে রাক্ষস ভারি হিংস্র, নরমাংসভোজী, ভয়ানক শৌর্যবান ও পরাক্রমশালী। বর্ষার ঘনঘোর শ্যামবরণ তার, পিঙ্গলনয়ন, দুর্ধর্ষ আকৃতিকে আরও ভয়ানক করে তুলেছে করাল দন্তপঙক্তিযুক্ত মুখমণ্ডল। মাংসলোলুপ রাক্ষসটির দীর্ঘ ঊরুদেশ, লম্বা উদর, রক্তিম চুল ও দাড়ি, গলা ও কাঁধ যেন মহীরুহতুল্য,তার কান শঙ্কু আকৃতির, যেন ভগবানের ইচ্ছায় সে পাণ্ডবদের দেখতে পেল।

যদৃচ্ছয়া তানপশ্যৎ পাণ্ডুপুত্রান্ মহারথান্। মানুষের গন্ধে তার ক্ষুধা আরও প্রকট হল। বিকটরূপ, পিঙ্গলনয়ন, ভয়ঙ্কর সেই রাক্ষস, উদ্দেশ্যবিহীনভাবে তাকিয়েই সম্মুখে পাণ্ডবদের দেখতে পেল। সে রুক্ষ চুলগুলি ঊর্দ্ধমুখী আঙ্গুল দিয়ে আঁচড়ে নিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, বার বার পাণ্ডবদের নিরীক্ষণ করতে করতে, বিশাল মুখগহ্বর প্রসারিত করল। নরমাংসের আঘ্রাণ নিয়ে, পরম সন্তুষ্ট, বিশালাকৃতি, মহাবলী সেই রাক্ষস ভগ্নীকে বলল, দীর্ঘপ্রতীক্ষার পরে মনের মতো খাদ্য পাওয়া গেছে। নরমাংসের গন্ধে আমার জিভে জল ঝরছে। আহা, বহুকাল পরে প্রথম কামড়ে অতি দুঃসহ তীক্ষ্ণ আটটি দাঁত, নরম পেলব মাংসল মানবদেহে প্রবেশ করাব আমি।

আক্রান্ত মানুষের টুটি টিপে ধরে, শিরা ছিন্ন করে গরম, নতুন, সদ্য ফেনাযুক্ত রক্ত, প্রচুর পরিমাণে পান করব, যা জেনে আয়, এই বনে আশ্রয় নিয়েছে যারা, নিদ্রাতুর, এরা কারা? এই তীব্র মানুষের গন্ধ কি দারুণ নাসিকার তৃপ্তিদায়ক। গচ্ছ জানীহি কে বৈতে শেরতে বনমাশ্রিতাঃ। মানুষ্যো বলবান্ গন্ধো ঘ্রাণং তর্পয়তীব মে।। রাক্ষস ভগ্নীকে আরও আদেশ করলেন, সবকটাকে হত্যা করে আমার কাছে নিয়ে আয়। আমাদের অধিকৃত জায়গায় ওরা নিদ্রিত। তোর ভয় কিসের? হত্বৈতান্ মানুষান্ সর্ব্বানানয়স্ব মমান্তিকম্। অস্মদ্বিষয়সুপ্তেভ্যো নৈতেভ্যো ভয়মস্তি তে।। রাক্ষস স্থির করলেন, দুই ভাইবোনে মিলে বেশ আশ মিটিয়ে এই মানুষগুলির মাংস খাবে। সেইমতো আদেশ দিলেন, কুরু তূর্ণং বচো মে। তাড়াতাড়ি যা,আমার আদেশ পালন কর।
রাক্ষস পরমানন্দে বলে উঠলেন, দুটিতে মিলে মাংস খেয়ে, তাল দিতে দিতে অনেক নাচ নাচব। নৃত্যাবঃ সহিতাবাবাং দত্ততালাবনেকশঃ। ভায়ের আদেশে, রাক্ষসী হিড়িম্বা, এক গাছ থেকে অপর গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুমন্ত পাণ্ডবদের কাছে উপস্থিত হল। পৃথা কুন্তী নিদ্রিতা, সঙ্গে চার পাণ্ডবভাই ঘুমিয়ে আছেন। শুধু জেগে আছেন, অপরাজিত ভীমসেন। বলিষ্ঠ ভীমসেনের কাছে পরাজিতা নিদ্রাদেবী। টিকাকার অপরাজিত শব্দের অর্থ করেছেন ‘বলিষ্ঠাকারশালিত্বাদিতি’ বলিষ্ঠাকৃতি। বলিষ্ঠ ভীমসেনের অফুরন্ত উৎসাহের কাছে হার মেনেছে ঘুম। কিন্তু বিধি বাম। হিড়িম্বা, সেই শালগাছের মতো উন্নত সুঠামদেহ, পৃথিবীতে অতুলনীয় পুরুষাকারের প্রতীক ভীমসেনের রূপ দেখে কামার্তা হয়ে, ভাবল, অয়ং শ্যামো মহাবাহুঃ সিংহস্কন্ধো মহাদ্যুতিঃ কম্বুগ্রীবঃ পুষ্করাক্ষো ভর্ত্তা যুক্তো ভবেন্মম।। শ্যামলবরণ, দীর্ঘবাহু, সিংহের মতো যার কাঁধ, যিনি কান্তিমান, শাঁখের মতো যাঁর গলদেশ, কমলনয়ন, ইনিই আমার যোগ্য স্বামী হতে পারেন। হিড়িম্বা স্থির করল, ভায়ের নৃশংস আদেশ সে মানবে না।

তার যুক্তি হল, তুলনায়, ভ্রাতৃস্নেহ থেকে স্বামীর প্রীতি অধিক প্রবল। এঁনাদেরকে বধ করে এক নিমেষের জন্যে ভোজনে তৃপ্তি বোধ করব আমরা ভাইবোন দুজনে।আর হত্যা না করলে, দীর্ঘদিন ধরে আনন্দ উদযাপন করা যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। হিড়িম্বা কামরূপিণী, স্বেচ্ছানুসারে রূপধারণে সক্ষম। সে উত্তম মানবীমূর্তিতে, ধীরে, মহাবাহু ভীমসেনের কাছে উপস্থিত হল। রাক্ষসী তখন লজ্জাবনতা, অলৌকিক আভরণে সজ্জিতা। স্মিতহেসে ভীমসেনকে জিজ্ঞাসা করল, কুতস্ত্বমসি সম্প্রাপ্তঃ কশ্চাসি পুরুষর্ষভ!। ক ইমে শেরতে চেহ পুরুষা দেবরূপিণঃ।।

হে উত্তম পুরুষ, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? কে আপনি? যাঁরা এখানে শুয়ে আছেন, দেবরূপী এই পুরুষেরাই বা কে? তার আরও প্রশ্ন—এই যে বনটিকে স্বগৃহ মনে করে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন উচ্চ শ্যামবর্ণা, সুন্দরী, মহিলাটি, তিনিই বা কে? হিড়িম্বা সতর্কবার্তায় জানালেন, এই গহন বনে যে রাক্ষসদের নিবাস। পাপী হিড়িম্বরাক্ষস বাস করে এখানে। এটাও জানা নেই? সরলমনে হিড়িম্বা সত্য উদ্ঘাটন করলেন। দেবতুল্য এই সব মানুষদের মাংস ভোজনে ইচ্ছুক, দুষ্ট মতলববাজ ভাইটি তাকে পাঠিয়েছে। সত্যের নামে শপথ করে বললেন, দেবগর্ভজাতপুত্রতুল্য রূপবান আপনাকে দেখেছি। আমি আর কাউকে স্বামীরূপে কামনা করিনা। সাহং ত্বামভিপ্রেক্ষ্য দেবগর্ভসমপ্রভম্। নান্যং ভর্ত্তারমিচ্ছামি সত্যমেতদ্ ব্রবীমি তে।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩২: সরকারবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে শ্রীমার বুড়ি-বুড়ি খেলা

নির্দ্বিধায় রাক্ষসীর প্রণয়নিবেদন, কামোপহতচিত্তাঙ্গীং ভজমানাং ভজস্ব মে। কামনার আগুনে জ্বলছে আমার মন, প্রাণ, অঙ্গ। আমি আপনাকে কামনা করি, গ্রহণ করুন আমায়। হিড়িম্বার প্রস্তাব— নরমাংসভোজী রাক্ষসদের কবলমুক্ত করে সে পাণ্ডবদের নিয়ে যাবে দুর্গম পার্বত্য প্রদেশে,তার শুধু একটাই প্রার্থনা ভর্ত্তা ভব মমানঘ!। হে নিষ্পাপ তরুণ,আপনি আমার পতিত্ব স্বীকার করুন। রাক্ষসী আকাশচারিণী। সে ভীমকে প্রলুব্ধ করবার জন্যে বলল, স্বেচ্ছায় সর্বত্রচারিণী রাক্ষসী সে। তার সঙ্গে সর্বত্র ভ্রমণের অপরিমিত আনন্দ লাভ করতে পারবেন ভীম।

ভীমসেন দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন, নিজের সামর্থ্যে যিনি আত্মরক্ষায় এবং অন্যদের রক্ষাকার্যে সক্ষম, এমন ব্যক্তি কেউ আছেন কী? যিনি মা এবং জ্যেষ্ঠ থেকে কনিষ্ঠ সব ভাইদের পরিত্যাগ করে চলে যান? তাঁর মতো কোন ব্যক্তি, ঘুমন্ত মা ও ভাইদের রাক্ষসদের ভোজ্য হিসেবে রেখে, কামনার বশবর্তী হয়ে স্থান ত্যাগ করে চলে যেতে পারে কী? রাক্ষসী হিড়িম্বার লক্ষ্য হল, দয়িত ভীমসেনকে স্বামিত্বে বরণ। সে স্থিরলক্ষ্যে বলল,ভীমের কাঙ্খিতকাজটি সে নিজে সাধন করবে। রাক্ষসদের কবলমুক্ত করবে পাণ্ডবদের। শিগগির ভাইদের নিদ্রাভঙ্গ করুন। যত্তে প্রিয়ং তৎ করিষ্যে সর্ব্বানেতান্ প্রবোধয়। আত্মবিশ্বাসী ভীমসেন, রাক্ষসীর দুরাত্মা ভাইটির কারণে, সুখনিদ্রায় শায়িত মা ও ভায়েদের জাগরণে অনিচ্ছুক। নির্ভীক ভীমসেন জানালেন, হে ভীতা রাক্ষসি,রাক্ষসতো কোন ছাড়? হে সুনয়না, মানুষ, গন্ধর্ব, যক্ষ সকলেই আমার শৌর্য সহ্য করতে অক্ষম। ন হি মে রাক্ষসা ভীরু!সোঢ়ুং শক্তাঃ পরাক্রমম্। ন মনুষ্যা ন গন্ধর্বা ন যক্ষাশ্চারুলোচনে।। হে সুতনু, তুমি মানেমানে থাক বা চলে যাও যা ইচ্ছে তোমার। তুমি বরং তোমার ওই নরখাদক ভাইটাকে পাঠিয়ে দাও। গচ্ছ বা তিষ্ঠ বা ভদ্রে! যদ্বাপীচ্ছসি তৎ কুরু। তং বা প্রেষয় তন্বঙ্গি!ভ্রাতরং পুরুষাদকম্।।

ভগ্নীর বিলম্বহেতু, আরক্তনয়ন, বিশাল হাতদুটি তার, বিরাট মুখমণ্ডল, মেঘের মতো কৃষ্ণবর্ণ, তীক্ষ্ণদাঁতবিশিষ্ট, ভীষণাকৃতি হিড়িম্ব, পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। হিড়িম্বা ভায়ের আগমনাশঙ্কায় ত্রস্ত হয়ে জানালেন, নরখাদক দুরাত্মা ক্রুদ্ধ হিড়িম্ব আসছে। আপতত্যেষ দুষ্টাত্মা সংক্রুদ্ধঃ পুরুষখাদকঃ। স্বেছায় যথেচ্ছচারী হিড়িম্বা ভীম এবং মা ও ভাইদের, আকাশপথে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। সে মা ও ভাইদের নিদ্রাভঙ্গের অনুরোধ জানাল। ভীমসেন তাকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে, শুধু হিড়িম্ব নয়,সমস্ত রাক্ষসকুলকে বধ করবার সামর্থ্য তাঁর আছে। তাঁর নিজের শারীরিক শক্তি বর্ণনা করে বললেন, তাঁর হাতদুটি হাতীর শুঁড়ের মতো সুগোল, ঊরুদুটি পরিঘতুল্য, বক্ষ সংহত ও বিশাল। সুতরাং বিক্রমং মে যথেন্দ্রস্য সাদ্য দ্রক্ষ্যসি শোভনে।। মাবমংস্থাঃ পৃথুশ্রোণি!মত্বা মামিহ মানুষম্।। হে শোভনে, আমার ইন্দ্রতুল্য শৌর্য এবার পরখ করে দেখ। আমাকে সাধারণ মানুষ হিসেবে অবজ্ঞা কোরোনা যেন। হিড়িম্বা দেবতুল্য ভীমসেনের, শক্তিকে হেয় না করে, জানাল, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল, রাক্ষসদের শক্তিও কম নয় মোটেই। ভীমসেনের কথা শুনতে পেল হিড়িম্ব। সে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৪: সুন্দরবনের মৃত ও মৃতপ্রায় নদী

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

সেখানে হিড়িম্বাকে দেখে হিড়িম্ব অবাক। ভগ্নীর মুখটি যেন পূর্ণিমার চাঁদের মতোই সুন্দর। চুলে ফুলহার। সেই সঙ্গে মানানসই হয়েছে দুই ভ্রূ, নাক, চোখদুটি, চুলের বাহার। সবকিছু সাযুজ্যে মনোহর। তাঁর নখ ও ত্বক কোমল। সে সেজে উঠেছে অতি সূক্ষ্ম বসন ও ভূষণে। পুরুষসঙ্গের আসক্তির কারণে নিশ্চয়ই হিড়িম্বার এতো সুন্দরী মানবীরূপ। রাক্ষস হিড়িম্ব ভয়ঙ্কর রাগে, বিস্ফোরিত চোখে ভগিনীকে সতর্ক করে বললেন, হিড়িম্বা মোহগ্রস্ত হয়ে, জ্যেষ্ঠের ভোজনে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছেন। হিড়িম্বের রাগের কারণ হয়েছে সে। রাক্ষসদের বিরুদ্ধাচারণ করেছে হিড়িম্বা। রাক্ষসকুলের কলঙ্ক সে। ভগিনীর বিরোধিতার কারণ যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে হিড়িম্বাকেও বিনাশ করবে সে। পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে ধেয়ে গেল রাক্ষস হিড়িম্ব।

শ্রেষ্ঠযোদ্ধা, তেজস্বী ভীমসেন তাকে ভর্ৎসনা করে বলে উঠলেন, ‘তিষ্ঠ তিষ্ঠেতি’ থামো, থামো। প্রবল গর্জনে এদের সুখনিদ্রায়, বিঘ্ন সৃষ্ট করে কী লাভ? হে দুষ্টবুদ্ধি নরখাদক হিড়িম্ব, বরং সজোরে ধর দেখি আমায়। মামাসাদয় দুর্বুদ্ধে! তরসা ত্বং নরাশন!। রাক্ষসের প্রথম লক্ষ্য হবেন ভীমসেন নিজে। কিন্তু রাক্ষসের দ্বারা নারীহত্যা? কিছুতেই নয়। সেই হিড়িম্বা তো কোনও অপকার করেনি। ভীমই রাক্ষসের প্রতি অপকারের কারণ। হিড়িম্বা কামনার বশবর্তিনী হয়েছে, তাই তার এই আচরণ। ভীমের রূপমুগ্ধা রাক্ষসী, সে জ্যেষ্ঠর ভয়ে ভীতা। সে কোনও দোষ করেনি। প্রকৃত দোষী কাম। তাই ভগিনীকে তিরস্কার করা যাবে না। হে দুর্বৃত্ত, আমি থাকতে স্ত্রীহত্যা নিষিদ্ধ। অনঙ্গেন কৃতে দোষে নেমাং গর্হিতুমর্হসি। ময়ি তিষ্ঠতি দুষ্টাত্মন্! ন স্ত্রিয়ং হন্তুমির্হসি।। রাক্ষসকে, একাকী দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানালেন ভীম, যে যুদ্ধে রাক্ষসকে যমের বাড়ি পাঠাবেন তিনি। অহমেকো নয়িষ্যামি ত্বামদ্য যমসদনম্। ভীমসেন কঠোর প্রতিজ্ঞা করলেন, এক নিমেষে এই বন রাক্ষসমুক্ত করবেন তিনি। ক্ষণেনাদ্য করিষ্যেঽহমিদং বনমরাক্ষসম্। ভগিনীর সামনে, সিংহবিক্রমে গজতুল্য রাক্ষসকে আকর্ষণ করলেন ভীম।

রাক্ষস সমানতেজে বললেন,নরসুলভ মুখের আস্ফালনকে,কাজে পরিণত করে তবেই নিজের প্রশংসা করা, মনে হয় ভালো। অযথা বিলম্ব নয়। ভীমের বলের সামর্থ্য কতটা? তার পরীক্ষা আজ। প্রথমে কটুভাষী ভীমের অন্তিম ব্যবস্থা,পরে নিদ্রাতুর অন্যদের এবং পরিশেষে হিড়িম্বাবধ। সিংহ যেমন ক্ষুদ্র হরিণকে বিপুল বিক্রমে টেনে নিয়ে যায় তেমনই ভীম, দুই বাহু প্রসারিত করে তাঁর উদ্দেশ্যে বেগে ধাবমান হিড়িম্বকে বত্রিশ হাত দূরে টেনে নিয়ে চললেন। পীড়িত রাক্ষস, ভীষণ শব্দ করে হাত পা ছুঁড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগল। রাতে,ভাইদের ও মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত যেন না ঘটে —এটাই ছিল ভীমের উদ্দেশ্য। যুযুধান দুই শক্তির মুখোমুখি লড়াইয়ের তুমুল শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল দেবী কুন্তী ও পাণ্ডবভায়েদের। সদ্য ঘুম ভেঙ্গে,তাঁরা সম্মুখে হিড়িম্বাকে দেখতে পেলেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৯: খ ব র দা র

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৮: ষাট-বাষট্টি, বড়োজোর সত্তর বছর বাঁচবেন রবীন্দ্রনাথ, বলেছিল এক গণৎকার

যে কোন নিরুদ্দেশযাত্রাই অনিশ্চিত। পথে বিপত্তি, অপ্রত্যাশিত প্রলোভনের ফাঁদ, নৃশংস আক্রমণ এইসব ফাঁকফোকর, আবর্ত, জটিলতা থাকবেই। সেই সঙ্গে পাল্লা দেবে,মানসিক শক্তি, মনোবল,সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করবার মানসিক ও শারীরিক শক্তি। মানুষ সব পারে। পঞ্চপান্ডবের এই অজানা গন্তব্যে যাত্রা, যেন অজানা জীবনপথে অভিযাত্রায়, এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর জলছবি। যাত্রাপথে থাকবে, হিড়িম্বার কামনার হাতছানি, হিড়িম্বর নৃশংসতা, জড়তার ঘুমের ঘোর, সামর্থ্য হারানোর পথশ্রম, শারীরিক ও মানসিক ক্লেদ, শ্রান্তি, গ্লানি। এ সবকিছুই যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ। মনের গভীরে শুধু জেগে থাকে যদি অনমনীয় মনোবল ও বিবেকবোধ, তবে সেটাই হবে, মানবিক চেতনার উৎসমূলের উৎসাহশক্তি। হিড়িম্বারা পথে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করতে তৎপর। ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তন সাধারণ স্বভাবধর্ম। একরূপতা মহান ব্যক্তিত্বের ধর্ম। সকলে মহান নন। ভীম অপরিসীম মনোবলে, প্রাথমিকভাবে রূপজ মোহকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছেন। নৃশংসতার প্রতিরোধেরও মানসিক ও শারীরিক শক্তি তাঁর ছিল।

হিড়িম্বা ভীমের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, রূপজ মোহে। সুন্দরী মনোমোহিনী রূপে, মোহাবিষ্ট করতে চেয়েছেন ভীমকেও।কিন্তু বিবেকবান ভীমের শারীরিক সামর্থ্যের সঙ্গে সাযুজ্য রয়েছে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার। তিনি হিড়িম্বার মোহিনী মায়ায় ভোলেননি, পথভ্রষ্ট হননি, পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। হিড়িম্বা কামনার প্রতীক। হিড়িম্বর ভোজ্য নরমাংস। মানুষের প্রাণহরণে নরমাংস লোভী রাক্ষসের মরিয়া প্রয়াস। যেমন অর্থকরী উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কেউ কেউ চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, জীবনে। নির্মমতায় হিড়িম্বের থেকে কোন অংশে কম নয়, সেই সব মানুষ। প্রতিপক্ষের জীবন সংশয়ের কারণ হয়ে ওঠে তারা। হত্যা শুধু শারীরিক প্রাণহরণ নয় তিল তিল করে প্রতিকূলতার বিষবাষ্পে দগ্ধ করে, মানসিক ক্লেশের চরম অবক্ষয়ে পৌঁছে দেওয়াও হত্যার সমতুল। ধারণার্থক ধর্মবোধ এই দুই প্রতিবন্ধকতাকে বাধা দেয়, মনুষ্যত্বের অবক্ষয় রোধে করে। ভীমের, হিড়িম্বাকে প্রত্যাখ্যান ও হিড়িম্বের প্রতিরোধে দৃঢ়চিত্ততা, সেই চিরন্তন ধর্মের বিজয়ঘোষণা। ধর্ম, অর্থ, কামের ভারসাম্য বজায় রেখে চলাই জীবনবোধের পরম পূর্ণতা। মহাভারতীয় শিক্ষার সম্পূর্ণতা কী তার ব্যাখ্যাগম্য বৈচিত্র্যের গ্রহণযোগ্যতার বিচারে? না, শুধু পৌরাণিক চিন্তার গল্পকথার আধারে? মহাকালের গর্ভেই হয়তো তার উত্তর লেখা আছে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content