শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রাম, স্বামীর আসন্ন বিচ্ছেদবেদনায় সাশ্রুলোচনা স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে, বনবাসজীবনের দুঃখদায়ক কষ্টকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। সীতাকে বনবাসের সিদ্ধান্ত থেকে নিবৃত্ত করাই তাঁর লক্ষ্য। রামের বিবেচনায়, প্রাসাদে অবস্থান করে ধর্মাচরণ, সীতার পক্ষে হিতকর এবং শ্রেয়। এই আচরণ সীতার বংশের আভিজাত্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। রাম মনে করেন,বহুদোষের চারণভূমি অরণ্য। কাজেই সীতা বনবাস গমনের চিন্তামুক্ত হন। বনে দোষা হি বহবো বসতস্তান্নিবোধ মে। সীতে বিমুচ্যতামেষা বনবাসকৃতা মতিঃ।। রাম জানালেন, মহাত্মাদের, বনবাসজীবনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয় মোটেই। বরং সেই রুক্ষ, কর্কশ অরণ্যযাপন কষ্টকর এবং দুঃখদায়ক বলে তাঁরা মনে করেন। গিরিগুহায় গর্জনকারী সিংহের হুঙ্কার, তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়েছে উদ্দাম পার্বত্য ঝর্ণার ঝঙ্কার, এই প্রবল শব্দ, একেবারেই শ্রুতিসুখকর নয়। বনে স্বাধীনভাবে শঙ্কাবিহীন ক্রীড়ারত পশুরা, সেখানে উপস্থিত মানুষদের দেখামাত্র হত্যা করতে প্রবৃত্ত হয়। সীতে দুঃখমতো বনম্। হে সীতা সেই কারণেও বন দুঃখদায়ক।অরণ্যে পঙ্কিল,হিংস্র জলচরপ্রাণীদের আশ্রয়, পারাপারে দুষ্কর, অনেক নদী আছে।

কাঁটালতায় ভরা অরণ্যপথ, জলাশয় যেখানে দুর্লভ। বনমোরগের তীব্র চিৎকারে মুখর বনে পথচলাই ক্লেশদায়ক। তস্মাৎ দুঃখতরং বনম্। সেইজন্যেই বনবাসযাপন কষ্টকর। গাছ থেকে স্খলিত পর্ণশয্যায় সুখনিদ্রা দুর্লভ। বনে আহার্যসংগ্রহে রয়েছে শুধু বন্য ফল আহরণ। অরণ্যবাসে, গার্হস্থ্যধর্মের অঙ্গ হল — পঞ্চমহাযজ্ঞানুষ্ঠান, দেব-পিতৃ-অতিথিপূজা, জটাভারবহন, বল্কলধারণ, সকাল-সন্ধ্যায়, সময়ে অসময়ে অবগাহনস্নান — এগুলিতো আছেই। সেখানের যাপনচিত্রে সুখ কোথায়? স্বয়ং পুষ্পচয়ন, বেদিতে অর্ঘ্যপ্রদান, নিত্য বন্যফলাহারে পরিতৃপ্তি খুঁজে নেওয়ায় —সুখকর কিছু আছে কী? অন্ধকারাচ্ছন্ন অরণ্য, সেখানে প্রবলবেগে বয়ে যায় বায়ু। তার ওপরে আছে অপরিসীম জঠরজ্বালা। এ ভীতিপ্রদ অভিজ্ঞতাগুলি যে ভাবতেই, ভীষণ কষ্ট। তাই এগুলি অতি দুঃখের। বনপথে দর্পভরে বিচরণ করছে নানা আকৃতির সরীসৃপ নাগেরা। তারা আবার আঁকাবাকা নদীর মতোই মানুষের চলার পথ জুড়ে শুয়ে থাকে।

কি কষ্টের এই বনবাস। বন— কুশ, কাশ আর কাঁটালতাগুল্মে ভরা। এছাড়াও মহামহীরুহের শাখার ডগাগুলি সর্বদাই যেন কাঁপছে। অরণ্যে — কীট, পতঙ্গ, মশা, দংশনকারী কীটের নিয়ত উপদ্রব। অরণ্যবাসীদের এসব দুঃখের অভিজ্ঞতা রয়েছে সততই। কারণ, অরণ্যবাসীরা ক্রোধ ও লোভ জয় করে, তপস্যার বলে অধ্যবসায়দ্বারা ভয়কে জয় করে থাকেন। তাই রামের অভিমত, এই বহুদোষের পীঠস্থান অরণ্যবাস, সীতার পক্ষে হিতকর নয় এবং সমীচিনও নয় বলেই তাঁর মনে হয়স। তদলং তে বনং গত্বা ক্ষেমং ন হি বনং তব। বিমৃশন্নিব পশ্যামি বহুদোষকরং বনম্।। অতএব রাম, সীতাকে বনে নিয়ে যেতে অপারগ।
সীতার মুখ অশ্রুজলে প্লাবিত হল। ভারাক্রান্ত মনে তিনি হাল ছেড়ে দিলেন না। অনমনীয়া সীতা জানালেন, প্রিয় রামের বনবাসের কষ্টকর দোষগুলোই যেন তাঁর বিবেচনায় গুণ বলে মনে হচ্ছে। ওই সিংহ, বাঘ, হাতী, এইসব বন্যপ্রাণীরা রামের বীর আকৃতিদর্শনে ত্রস্ত হয়ে পলায়নপর হবে। কারণ, রামের উপস্থিতি সকল প্রাণীরই উদ্বেগজনক। তাই গুরুজনদের অনুমতি নিয়ে সীতা রামের সঙ্গ নেবেন। তাঁর পক্ষে অসহনীয়, রামের বিচ্ছেদ। রাম পাশে থাকলে দেবরাজ পর্যন্ত সীতাকে নিগৃহীত করতে সাহসী হবেন না। পিতৃগৃহে ব্রাহ্মণেরা সীতার উদ্দেশ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে সীতার কপালে বনবাস নির্দিষ্ট রয়েছে। তখন থেকেই সীতার বনবাসজীবনের জন্যে মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। কৃতাদেশা ভবিষ্যামি গমিষ্যামি ত্বয়া সহ। সেই আদেশবলে বনবাসে যাবই আমি। কালশ্চায়ং সমুৎপন্নঃ সত্যবাগ্ ভবতু দ্বিজঃ।

সেই সময় উপস্থিত হয়েছে, ব্রাহ্মণদের বচন সত্য হোক আজ। প্রবল আত্মপ্রত্যয়ে সীতা জানালেন, যাঁদের অন্তর শুদ্ধ নয় তাঁরাই বনবাসজীবনে কষ্ট ভোগ করে থাকেন। কুমারীবেলায়, পিত্রালয়ে, ভিক্ষুণীর কাছে, বনবাস যাপনের সুখদুঃখের অভিজ্ঞতা তিনি শুনেছেন। সীতার চির অভীপ্সিত স্বামীসাহচর্যে বনবাসযাপন। এর আগেও তিনি রামের সহযাত্রিণী হতে চেয়েছেন। স্বামীর পরিচর্যারত অবস্থায় বনবাসের দিনগুলি মধুময় করে তুলতে আগ্রহী সীতা। তাই ভালবেসে, নিষ্পাপ মনে, তিনি রামের সহযাত্রিণী হতে ইচ্ছুক।

এমন কি পরলোকেও রামের সহযাত্রায় সুখদুঃখের অংশ নিতে আগ্রহী সীতা। কারণ পরম্পরাগতভাবে তিনি জেনেছেন, পিতামাতা যাঁর হাতে দেন তিনিই ইহলোকে ও পরলোকের সঙ্গী হয়ে থাকেন। সেই সুখদুঃখে সমমনস্কা সহধর্মচারিণী স্ত্রী, সীতাকে কেন বনবাসে নিয়ে যেতে অনিচ্ছুক হয়েছেন রাম? স্বামীর প্রতি সীতার শেষ সতর্কবাণী—এই নিতান্ত দুঃখিনী সীতাকে যদি রাম বনবাসে না নিয়ে যান, তাহলে সীতা বিষপান করে কিংবা অগ্নিতে প্রবেশ করে, বা জলে ডুবে আত্মহননে প্রবৃত্ত হবেন। যদি মাং দুঃখিতামেবং বনং নেতুং নেচ্ছসি। বিষমগ্নিং জলং বাহমাস্থাস্যে মৃত্যুকারণাৎ।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

এতসব ভীতিপ্রদ সতর্কবার্তাতেও বিচলিত হলেন না রাম। তিনি সেই নির্জনবনে সীতার গমনেচ্ছা মেনে নিলেন না বরং এই ইচ্ছা ত্যাগ করবার পক্ষেই সওয়াল করতে লাগলেন। গভীর চিন্তায় সীতার চোখ অশ্রুজলে ভেসে গেল। এখন তাঁর অস্ত্র—পরিহাস এবং ব্যঙ্গ। প্রবল ক্ষোভে বলে উঠলেন পিতা জনক যে রামকে জামাতারূপে বরণ করেছিলেন, সেই রাম যে পুরুষচিহ্নধারী এক মহিলা, সেটা কী বিদেহপতি জনকের জানা আছে? সূর্যের কিরণ তাঁর নিজস্ব তেমন শৌর্যরূপ নিজস্ব প্রভায় আলোকিত রাম।

এখন এই অপবাদের প্রভায় রামকে যদি সাধারণ মানুষ, বীর্যহীন মনে করে, তবে মানুষের এই অজ্ঞতা যে ভীষণ দুঃখের বিষয় হয়ে উঠবে। এই অছিলায় সীতাকে পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক কী রামচন্দ্র? তবে রাম জেনে রাখুন, দ্যুমৎসেনের পুত্রবধূ সাবিত্রী যেমন স্বামী সত্যবানের অনুগামিনী হয়েছিলেন তেমনই, স্বামী রামের অনুগামিনী হবেন সীতা। কুলটা স্ত্রীলোক নন সীতা। পরপুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করেন না তিনি। ন ত্বহং মনসা ত্বন্যৎ দ্রষ্টাস্মি ত্বদৃতে অনঘ।ত্বয়া রাঘব গচ্ছেয়ং যথান্যা কুলপাংশনী।। হে নিষ্পাপ,রাঘব রাম,আমি কুলটা নারীর মতো মনে মনেও অন্যপুরুষকে স্থান দিই না। আমি তোমার সঙ্গে যাবই।

অযোধ্যার আদরিণী জ্যেষ্ঠা কুলবধূ সীতা, রামপ্রিয়া বৈদেহী একেবারে ক্ষোভে, দুঃখে প্রতিবাদিনী ভাবমূ্র্তি নিয়ে যেন আধুনিকার মতোই বলে উঠলেন, একদম নাটক নয়। সেই কুমারী মেয়েবেলায় বিবাহিতা, বহুকাল যাঁর সঙ্গে ঘর করলেন সেই স্ত্রীকে অন্যের হেফাজতে দিতে চান? স্বয়ং তু ভার্য্যাং কৌমারীং চিরমধ্যুষিতাং সতীম্। শৈলুষ ইব মাং রাম পরেভ্যো দাতুমিচ্ছসি।। অভিমানিনী সীতার প্রস্তাব, যে ভরতের কারণে রাম যুবরাজপদ হারালেন তিনি বরং সেই ভরতের আজ্ঞাধীন থাকুন। তপশ্চর্যায়, স্বর্গবাসে বা অরণ্যবাসে সবকিছুতেই রামের সাহচর্য সীতার অভিপ্রেত। তাই সীতাবিনা রাম অরণ্যবাসে যেতে পারবেন না। স মামনাদায় বনং ন ত্বং প্রস্থাতুমর্হসি।

রামের সঙ্গে সীতার কঠোর বিহারশয্যায় শয়নে আপত্তি নেই। কুশ, কাশ, শর, ঈষিকা, কাঁটাবন, লতা, মহীরুহের কঠিন পরশও যেন তুলো আর মৃগচর্মের সুখের পরশ বলেই সীতার মনে হয়, যদি প্রিয় রাম তাঁর পাশে থাকেন। ঝড়ের অভিঘাতে ফুলের রেণু তাঁর অঙ্গ জড়িয়ে ধরলে, সীতার মনে হবে, সারা শরীরে যেন চন্দনের অনুলেপন। রামের দৃষ্টির সম্মুখে তৃণশয্যার আশ্রয়, এর থেকে সুখকর আর কিই বা হতে পারে? শাদ্বলেষু যথা শিষ্যে বনান্তে বনগোচরা। কুশাস্তরণযুক্তেষু কিং স্যাৎ সুখতরং ততঃ।। বনবাসে, রামের সংগৃহীত ফলমূল তাঁর কাছে অমৃততুল্য। সীতা বনবাসজীবনে গ্রীষ্মকালীন ফুলফল উপভোগ করবেন যখন তাঁর মনেই পড়বেনা, মা, বাবা আর অযোধ্যার স্মৃতি। অশন, বসনবিষয়ে,রামের কাছে সীতার কোনও চাহিদা নেই। শুধু রামের সাহচর্যে সীতার স্বর্গসুখ, রামের সঙ্গহীন জীবন নরকবাসের সমান তাঁর কাছে।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৮: দুরন্ত ঘূর্ণি

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

সীতার প্রগাঢ় ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে রাম তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চলুন। এর ব্যতিক্রম হলে, এই শত্রুতার বিষেবাষ্পে ভরা পরিবেশে সীতা থাকবেন না। রামের পরিত্যক্ত স্ত্রী সীতা, বিষপানে আত্মহত্যা করবেন। কারণ তাহলে তিনি রামের বিচ্ছেদবেদনামুক্ত হবেন। এক নিমেষকাল রামের বিরহ তাঁর কাছে অসহনীয়, চোদ্দ বছর কীভাবে সময় অতিবাহিত হবে তাঁর? স্বামীকে বাহুবন্ধনে বেঁধে, চোখের জলে উথালপাথাল হয়ে, সীতার এমন নানা প্রলাপের অন্ত নেই। তাঁর চোখদুটি যেন সদ্যতোলা জল ঝরে পড়া পদ্মের মতো, অশ্রুবিন্দু যেন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ নিরমল। ক্রমাগত অশ্রুবর্ষণের ফলে, পূর্ণ চাঁদের মতো তাঁর উজ্জ্বল আয়ত চোখদুটি, আস্তে আস্তে শুকিয়ে নিষ্প্রভ হল, যেন তারা দীর্ঘদিন আগে জল থেকে উদ্ধৃত কান্তিহীন পদ্মদুটি।

হার মানলেন রাম। স্ত্রীকে গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে বললেন, নিয়তির এটিই অভিলাষ, তিনি বেশ বুঝতে পারছেন।সীতার মনে দুঃখ দিয়ে রামের স্বর্গবাসও অভিপ্রেত নয়। ন দেবি তব দুঃখেন স্বর্গমপ্যভিরোচয়ে। কোনও প্রাণীর ভয়েই ভীত নন তিনি। অরণ্যেও সীতাকে রক্ষা করবার সামর্থ্য তাঁর আছে।সীতার মনের অভিপ্রায় না জেনে নিয়ে তিনি কোন ভিত্তিতে তাঁকে অরণ্যবাসে বাধ্য করবেন? তিনি জানলেন — সীতার, স্বামীর সঙ্গে অরণ্যবাসিনী হওয়াই, বিধাতাপুরুষের অভিলাষ। যেমন, আত্মসংযমী ব্যক্তি তাঁর স্বভাবজাত ভালবাসাকে অস্বীকার করতে পারেন না তেমনই, হে মৈথিলি, আমি মূর্তিময়ী আনন্দরূপিনী ভার্যা সীতাকে পরিত্যাগ করতে পারি না। সীতার ভবিতব্যই যে,আমার সঙ্গে বনবাসযাপন। যৎ সৃষ্টাসি ময়া সার্দ্ধং বনবাসায় মৈথিলি। ন বিহাতুং ময়া শক্যা প্রীতিরাত্মবতা যথা।।

তাই তাঁর পূর্বপুরুষ রাজর্ষিবৃন্দের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে রামও সস্ত্রীক বানপ্রস্থে গমন করবেন। যেমন সূর্যবর্চ্চসা দেবী, রামচন্দ্রের সূর্যবংশের, পূর্বপুরুষ সূর্যদেবকে অনুসরণ করেছিলেন তেমনই সীতাও বনপথে রামকেই অনুসরণ করবেন। পিতৃসত্যপালনের সিদ্ধান্ত থেকে কোনমতেই রাম সরে আসবেন না। পিতামাতার আজ্ঞাপালন পুত্রের চিরন্তন ধর্ম,সেটি লঙ্ঘন করবার উপায় নেই। নিজের আয়ত্তাধীন মা বাবা গুরুতুল্য, তাঁদের সেবারূপ প্রত্যক্ষ ধর্মকে অস্বীকার করে অনায়ত্ত পরোক্ষ দৈবের নানাভাবে আরাধনা কেন? পিতামাতাকে সম্মানের ফল ধর্ম, অর্থ, কামনা এই ত্রিবর্গফললাভ। পিতার সেবাতেই পরলোকে সুখলাভ হয়। সত্য, দান, মান, যজ্ঞানুষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ দক্ষিণাদানে সেটি হয় না। পিতৃসেবায় স্বর্গ, অর্থ, শস্য, জ্ঞান, পুত্র ও সুখলাভ সুলভ হয়। সত্যধর্মাশ্রয়ী পিতার আদেশপালন, পুত্রের চিরন্তন ধর্ম। তাই সত্যধর্মনিষ্ঠ পিতার আজ্ঞাপালন করে,রাম সত্যের পথ অবলম্বন করবেন। হে সীতা, তুমি বন যাব বলে দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছ, তোমায় দণ্ডকারণ্যে সঙ্গে নিয়ে যেতে আমি সম্মত হয়েছি। মম সন্নাহমতিঃ সীতে নেতুং ত্বাং দণ্ডকাবনম্।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৫: রাজা সবকিছু হাতে করে প্রজার মুখে তুলে দেবেন এমনটা ভাবার আর সময় নেই

অবশেষে রামচন্দ্র স্ত্রীকে। বনবাসগমনের অনুমতি দিলেন। অনুগচ্ছ মাং ভীরু সহধর্ম্মচরী ভব। হে ভীরু, আমায় অনুসরণ কর। আমার সঙ্গে বানপ্রস্থধর্ম পালন কর। সীতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন রাম। স্বামীর সঙ্গে বনবাসগমনের সিদ্ধান্ত, সীতার ব্যক্তিত্ব এবং রামের রঘুকুলের যথাযোগ্য বংশমর্যাদার ঐতিহ্যবাহী শোভনসুন্দর সিদ্ধান্ত। সর্ব্বথা সদৃশং সীতে মম স্বস্য কুলস্য চ। ব্যবসায়মনুক্রান্তা কান্তে ত্বমতিশোভনম্।। তাহলে আর দেরী নয়। রামচন্দ্র, বনবাসোদ্দেশ্যে দানধ্যানে উৎসাহিত করলেন সীতাকে। এখন রামের মনে হচ্ছে, সীতাবিনা, স্বর্গেও যেতে পারবেন না তিনি। নেদানীং ত্বদৃতে সীতে স্বর্গোঽপি মম রোচতে।

ব্রাহ্মণদের ধনদান, ভিক্ষুকদের ভোজ্যদানে সত্বর উদ্যোগী হন সীতা। রামচন্দ্র ঘোষণা করলেন,ব্রাহ্মণদের দানের পরে, তাঁর বহুমূল্য বসনভূষণ, সুন্দর ক্রীড়াসামগ্রী, শয্যা, বাহন প্রভৃতি ব্যবহার্য যা কিছু সবকিছু, ভৃত্যবর্গের প্রাপ্য। শয়নীয়ানি যানানি মম চান্যানি যানি চ। দেহি স্বভৃত্যবর্গস্য ব্রাহ্মণানামনন্তরম্।। নিজের মনোবাঞ্ছাপূরণ হওয়ায়, দেবী সীতা আনন্দে আটখানা হয়ে তখনই স্বামীর ইচ্ছা পূরণ করলেন। আনন্দিতচিত্তে দ্রুত দানধর্মের উদ্যোগ নিলেন দেবী সীতা।

বনবাস গমনের সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার তবে কী এইভাবেই ভাবিজীবনের অগ্নিপরীক্ষার সূচনা হল? সীতা, সরলমনে স্বামীর বনবাসযাপনে সঙ্গিনী হতে চেয়েছেন, শুধু স্বামীর সাহচর্য, সঙ্গসুখ তাঁর এই প্রেমের যাত্রাপথের পাথেয়,আর কিছু নয়। তাঁর আবেগ, শাস্ত্রনিষ্ঠ যুক্তি, কাকুতি মিনতি সবই ব্যর্থ হয়েছে। আপাতকঠিন, কঠোর রামের মানসিকতায় আবেগের, হৃদয়দৌর্বল্যের কোনও স্থান নেই হয়তো। এটি মনে হতেই পারে। বনবাসের কঠিন, কঠোর, রূঢ়, রুক্ষ, বাস্তবকে তিনি তুলে ধরেছেন সীতার মর্মচক্ষুর সামনে।

সীতা এ সবই অবগত আছেন —দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন। অধিকাংশ ভারতীয় নারীর আদর্শ সীতা, পরম্পরাক্রমে দৈবনির্দিষ্ট পথরেখার অনুসরণে অভ্যস্ত। তাই অনিবার্য বনবাস তাঁর নিয়তিনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ বলেই তিনি মনে করেন।কোন অভিযোগ নয়, কোনও আক্ষেপ নয়, কোনও কপালে করাঘাত নয়। ভাগ্যের অমোঘ নির্দেশে তিনি বনবাসে যেতে চেয়েছেন। তিনি হয়তো রামকেই তাঁর ভাগ্যদেবতা বা পথনির্দেশক বলে মনে করেন পরম নির্ভরতায়। বনবাসের কঠিন কঠোর বাস্তবকে মধুর সদর্থকচিন্তায় ভরিয়ে তুলেছেন জানকী সীতা। কখনও ভালোবেসে কোমল আভিজাত্যে রামচন্দ্রকে অনুনয় করেছেন, কখনও বা রামচন্দ্রের সম্মুখে প্রবল আত্মপ্রত্যয়ে প্রতিবাদিনী হয়েছেন,পরিহাস ছলে মর্মে আঘাত দিতে চেয়েছেন,কিন্তু পারেননি। স্বামীর প্রতি আঘাতের প্রত্যাঘাতে নিজেই ভেঙ্গে পড়েছেন। জেদ ও দৃঢ়তায় স্বামীর সমকক্ষ তিনি। রামের যোগ্যা সহচরী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন।

সীতা, সংশয়মুক্তমনে, দ্বিধাহীনভাবে, স্বামীকেই জীবনদেবতা মনে করেন, সেখানে অন্য কোন পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই। ভারতীয় পরম্পরায়, প্রতিপালক বাবা মায়ের সিদ্ধান্তেই কন্যার ভাগ্য নির্দিষ্ট হোত। এটি ছিল যুগধর্ম। আজও অনেকক্ষেত্রেই সেই পরম্পরা চলে আসছে। কিন্তু রাম?সীতার মনে দুঃখ দিয়ে স্বর্গবাসও তাঁর রুচিকর নয়—এ শুধু প্রমত্ত যৌবনের প্রলাপমাত্র, আর কিছু নয়। সীতার ক্ষেত্রে পরিণতবুদ্ধি রামের অনেক সিদ্ধান্ত এর বিপরীতে প্রমাণিত হয়েছে। সীতা সত্যিই বনবাসযাপনে ইচ্ছুক কিনা, তাঁর মনের প্রকৃত চিন্তা কী? এটা জেনে নেওয়াই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। অরণ্যবাসে বাধ্য করেননি সীতাকে। সীতার আনন্দময় সঙ্গসুখ তাঁর ঈপ্সিত।

তবে প্রিয় ভার্যাকে এত দুঃখময় ছলনার আশ্রয় নিয়ে ভীতিপ্রদর্শন কেন? এ কী সীতার জীবনে কোনও অশনিসংকেত? সীতা জানেন না,এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তাঁকে, বার বার। সমালোচনার চোরা স্রোতে ভেসে যাবে সুখস্বপ্নের ঘোর, কঠিন কঠোর একাকীত্বের বেদনাবোধে বিদ্ধ হতে হবে তাঁকে, নির্বাসিতার কলঙ্কে কালিমালিপ্ত হবেন তিনি। তবুও ধরে রাখতে হবে স্বাতন্ত্র্য, আত্মসম্মানবোধ, প্রখর যুক্তিবোধে শাণিত করতে হবে বিবেকবোধ, বৌদ্ধিক চেতনা। সীতার বনবাসের সিদ্ধান্তের সপক্ষে, স্বচ্ছ যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তা যেন তাঁর ভাবি জীবনের অগ্নিপরীক্ষার একটা ট্রেলার বা খণ্ডচিত্র, সম্পূর্ণ ছবিখানি এখনও বাকি রয়ে গেল।

সুদূর অতীতেও সীতার মুক্তচিন্তায়, কী আধুনিক ভারতীয় নারীর ভাবনার প্রতিফলন?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content