বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

অনমনীয়া দশরথমহিষী কৈকেয়ী নিজের উদ্দেশ্য সাধনে অটল। তিনি সন্তানস্নেহবশত পুত্র ভরতের অনিষ্ঠ আশঙ্কায় সন্দিহান, সন্ত্রস্ত। ভাবি রাজা রামচন্দ্রকে, তাঁর ভয়। সংজ্ঞাহীন, ভূমিশয্যায় শায়িত, রাজার দীনদশা রানির মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করল না। এ মানসিক দ্বন্দ্ব দু’জনেরই। রাজা ও রানির, সন্তানস্নেহের টানাপোড়েনের সংঘাত। বাৎসল্যরসের আধিক্যে রানি কৈকেয়ী হিতাহিতজ্ঞানশূন্যা। তিনি নিজের গর্ভজাত সন্তান ভরতের সিংহাসনের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার সংকল্পে অটল। রাজা দশরথ, সর্বসম্মতসিদ্ধান্তে আস্থাশীল। জ্যেষ্ঠপুত্র রামকে যৌবরাজ্যে অভিষেকের অনুষ্ঠানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি। রামচন্দ্রের গুণে আপ্লুত দশরথের মন। পিতৃস্নেহের অবিরত বিগলিতধারায় রাজার হৃদয় সর্বদাই দ্রবীভূত।

রানি অপবাদেরও পরোয়াও করেন না। তিনি যেন ইক্ষ্বাকুবংশের মূর্তিমতী অনিষ্টের ভূমিকায় অবতীর্ণা। তাঁর মনে পাপবোধ নেই,নেই কোন অনুশোচনা। যুক্তিহীন জেদে, স্থূলমস্তিষ্কের নির্দেশে, বিচারবুদ্ধিহীন অদম্য জেদে বললেন, ত্বং কত্থসে মহারাজ সত্যবাদী দৃঢ়ব্রতঃ। মম চেদং বরং কর্ম্মাদ্বিধারয়িতুমিচ্ছসি।। নিজেকে সত্যনিষ্ঠ বলে এত যে বড়াই আপনার, তাহলে আমায় বরদানে এত অসম্মতি কেন? এক মুহূর্ত স্তম্ভিত থেকে রাজা দশরথ তার ক্রোধ উজার করে দিলেন। প্রিয়পুত্রকে বনবাসদান, রাজার নিজের নিশ্চিত মৃত্যুস্বরূপ। স্বর্গে দেবতাদের কাছেও তাঁকে এই অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্তের জন্য জবাবদিহি করতে হবে যে। হ্যাঁ, রানির মনোবাসনা পূর্ণ হবে তাতে, কিন্তু স্বর্গেও দেবতাদের দ্বারা রাজা তিরস্কৃত হবেন। সেখানেও শান্তি নেই তাঁর।
রাজা দশরথের, মরণোত্তর গ্লানিবোধ থেকেও নিষ্কৃতি নেই। একদা পুত্রহীন ছিলেন রাজা। বৃদ্ধাবস্থায় যজ্ঞের পুণ্যফলরূপ, অতি কষ্টের ধন, এই রামচন্দ্র। উদারহৃদয়, তেজস্বী, বিদ্বান, জিতেন্দ্রিয়, ক্ষমাশীল, সর্বগুণান্বিত, পুত্রকে কি করে ত্যাগ করবেন রাজা? সেই একই প্রশ্ন, একই দ্বন্দ্বে, ক্ষতবিক্ষত বৃদ্ধ রাজা। অপুত্রেণ ময়া পুত্রঃ শ্রমেণ মহতা মহান্। রামো লব্ধো মহাতেজাঃ স কথং ত্যজ্যতে ময়া।। শূরশ্চ কৃতবিদ্যশ্চ জিতক্রোধঃ ক্ষমাপরঃ। কথং কমলপত্রাক্ষো ময়া রামো বিবাস্যতে।। রাম যে সুখের জীবনে অভ্যস্ত। তাঁকে দুঃখদান যে একেবারেই অনুচিত। এই বুদ্ধিমান রামের কেন এই দুর্ভোগ? রামের দুঃখের জন্য দায়ী হবেন পিতা? বরং লোকান্তরিত হওয়াতেই রাজার সুখ। আমার প্রিয় রামকে বনবাসরূপ এই অপ্রিয়জীবনে যুক্ত করছেন কেন রানি কৈকেয়ী? কিং বিপ্রিয়েণ কৈকেয়ি প্রিয়ং যোজয়সে মম

এর ফলে, রাজা বিপুল এবং সীমাহীন অপবাদে কলঙ্কিত হবেন। অকীর্তিরতুলা লোকে ধ্রুবং পরিভবিষ্যতি। অবিরাম বিলাপে বিনিদ্র রজনী যাপন করলেন রাজা দশরথ।অসুখী রাজার কাছে, এ যেন অমানিশার আঁধারে ঢাকা চন্দ্রালোকিত রাত্রি। রাজা সেই নিবিড় তিমিরাবৃতরাতকে বিদায় জানাতে চান না। করজোড়ে তাঁর একান্ত মিনতি, নক্ষত্রখচিত রাতের অবসানে প্রভাত যেন না হয় অথবা দীর্ঘরজনীর দ্রুত অবসান হয় যেন। আমি এই নৃশংসনারীর সঙ্গ হতে মুক্তি চাই। ন প্রভাতং ত্বয়েচ্ছামি নিশে নক্ষত্রভূষিতে।। ক্রিয়তাং মে দয়া ভদ্রে ময়ায়ং রচিতোঽঞ্জলি:। অথবা গম্যতাং শীঘ্রং নাহমিচ্ছামি নির্ঘৃণাম্।। রাজা দশরথ একদা প্রিয়, অধুনা নির্মম পত্নী কৈকেয়ীর সান্নিধ্য থেকে মুক্ত হতে ইচ্ছুক।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩৭: ঈর্ষার বিষময় পরিণতি, বিচ্ছিন্নতাবোধ, ধ্বংস, এখনও রাজনীতিতে অব্যাহতগতিতে প্রবহমান, নয় কী?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২১: শ্রীমার ঠাকুরের প্রতি যত্ন

রাজা দশরথের অন্তরে ঘৃণা,তবুও নৃশংসা,নির্দয়া রানিকে প্রসন্ন করবার লক্ষ্যে অক্লান্ত তাঁর প্রচেষ্টা। সৎ, ন্যায়পরায়ণ রাজা, দশরথ, হাতজোড় করে মিনতি করলেন। তিনি নিজে দুঃখভারাক্রান্ত আর্ত, রানির একান্ত অনুগত তিনি, তাঁর আয়ু নিঃশেষিতপ্রায়, তাই রাজার আকুল আর্তি—হে দেবি,তুমি প্রসন্ন হও।রাজা রাজসভায় সর্বসমক্ষে যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, সেটির অন্যথা যেন না হয়। তাহলে যে সকলের হাস্যাস্পদ হবেন রাজা। রানির অনুগ্রহে রাজ্য লাভ করুন রাম। রানির এ সিদ্ধান্ত, পৃথিবী লোক, বসিষ্ঠ প্রভৃতি গুরুগণের, রাজার নিজের, রাম, ভরত সকলের প্রিয় হবে। রানি কৈকেয়ী রাজা দশরথের কাকুতিতে বিন্দুমাত্র কান দিলেন না।স্বা মীর করুণ বিলাপ, রানির নির্মম হৃদয় একটুও স্পর্শ করল না। রাজার বিরোধিতায়, রামের নির্বাসনের সিদ্ধান্তে, রানি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়লেন না। রানি কৈকেয়ী এখন দুর্দমনীয়া। রাজার প্রতি তাঁর বিষোদ্গার অব্যাহত রইল। প্রিয় রামের নির্বাসন অমোঘ ও অবশ্যম্ভাবী মনে করলেন রাজা। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসে, দুঃখভারাক্রান্ত বিষণ্ণ রাজার হৃদয় বিদীর্ণ হল। এইভাবে রাত্রি অবসান হল। রাজার আদেশে, চারণদের স্তুতিগীতি নিষিদ্ধ হল।

রানি কৈকেয়ী তাঁর বাক্যের কশাঘাতে যেন অবাধ্য অশ্বরূপ রাজাকে বশে আনছেন, রাজা বিষে জর্জরিত ব্যক্তির মতো কি সব প্রলাপ বকছেন? কাজে অক্লান্ত রামচন্দ্রকে এখানে আনয়ন করুন। আমার ছেলেটি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হোক। রামকে বনে নির্বাসন দিন। তবেই আমাকে আপনি, শত্রুমুক্ত করে, নিজের কর্ত্তব্য সম্পন্ন করবেন। কিমিদং ভাসসে রাজন্ বাক্যং গররুজোপমম্। আনায়য়িতুমক্লিষ্টং পুত্রং রামমিহার্হসি।। স্থাপ্য রাজ্যে মম সুতং কৃত্বা রামং বনেচরম্। নিঃসপত্নাঞ্চ মাং কৃত্বা কৃতকৃত্যো ভবিষ্যসি।। ব্যথিত,বিধ্বস্ত, রাজা দশরথ মনোবল হারিয়ে এখন প্রবল ধর্মসঙ্কটে। তিনি চরম বিপন্ন।কষ্টে বলে উঠলেন, ধর্ম্মবদ্ধেন বদ্ধোঽস্মি নষ্টা চ মম চেতনা। জ্যেষ্ঠং পুত্রং প্রিয়ং রামং দ্রষ্টুমিচ্ছামি ধার্ম্মিকম্।। আমি ধর্মপাশে আবদ্ধ হয়েছি। আমার চেতনা বিলুপ্ত হতে চলেছে। আমার প্রিয়, ধার্মিক, জ্যেষ্ঠপুত্রকে একবার দেখতে চাই।
সূর্য উদীয়মান। রামচন্দ্রের অভিষেকের কাল —সেই পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত,পুণ্য মুহূর্তটি সমাগতপ্রায়। রামচন্দ্রের আসন্ন অভিষেকের আয়োজনে উৎসবমুখর অযোধ্যানগরী। মহর্ষি বসিষ্ঠের পরামর্শ অনুযায়ী, অন্যতম অমাত্য তথা সারথি সুমন্ত্র, রাজা দশরথকে এই শুভক্ষণসম্বন্ধে অবহিত করবার লক্ষ্যে, চললেন রাজভবনে। তিনি অনুমানও করতে পারেননি রাজা দশরথ কি ভীষণ দুর্বিষহ মানসিক অবস্থায় রয়েছেন। বৃদ্ধ সুমন্ত্র স্তুতিগান গেয়ে রাজার মনটি আনন্দে পূর্ণ করে দিতে চাইলেন। রাজাকে অনুরোধ জানালেন, উত্তিষ্ঠ সুমহারাজ কৃতকৌতুকমঙ্গলঃ। বিরাজমানো বপুষা মেরোরিব দিবাকরঃ।। হে মহারাজ, মেরু হতে উদীয়মান সূর্যের মতো আপনি শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে উদ্যোগী হন। শোকে আকুল রাজার কাছে সুমন্ত্রের এই হৃদয়বিদারক অনুরোধ। রাজা দশরথ নিশ্চুপ।

রাজার বাকরুদ্ধ দীনদশা দেখে, সুমন্ত্র, হয়তো কিছু অঘটন অনুমান করে আদেশের অপেক্ষায় রইলেন। মন্ত্রণায় অভিজ্ঞা রানি জানালেন, রাজা আনন্দে বিনিদ্র রাত্রিযাপনে ক্লান্ত। সারথিকে তাড়া দিয়ে বললেন, হে সারথি, বেশি চিন্তা নয়, সত্বর কীর্তিমান রামচন্দ্রকে আনয়ন কর। তদ্ গচ্ছ ত্বরিতং সূত রাজপুত্রং যশস্বিনম্। রামমানয় ভদ্রং তে নাত্র কার্য্যা বিচারণা।। রাজার আদেশ বিনা সুমন্ত্র প্রস্থানে অনিচ্ছুক। উপায়ান্তর না দেখে, দশরথ আদেশ দিলেন, সুমন্ত্র রামং দ্রক্ষ্যামি শীঘ্রমানয় সুন্দরম্। সেই সুন্দর রামকে দেখব আমি। শীঘ্র যাও, সুমন্ত্র। রামদর্শনে ব্যাকুল রাজা। রাজার আদেশ পালন করতে উদগ্রীব সুমন্ত্র মনে মনে খুশী হলেন। তিনি ভাবলেন, এটা তো একেবারে পরিষ্কার মনে হচ্ছে যে, রামের অভিষেক সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হয়েছেন ধার্মিক রাজা। রামের দর্শনার্থী, সুমন্ত্র, মনে অপরিসীম আনন্দ নিয়ে কার্যোদ্ধারে রওনা দিলেন।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮১: অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেই রাজ্যের সিংহভাগ মাছের খাবার আসে, তাই খাদ্য উৎপাদন বিকল্প আয়ের পথ হতে পারে

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৫: দিল মেরা বানজারা!

রামের প্রাসাদের পবিত্র অন্তঃপুরে শুভাকাঙ্ক্ষী বৃদ্ধ অন্তঃপুররক্ষককে নিবেদন করলেন সারথি সুমন্ত্র, রাজা দশরথের আদেশে তিনি এসেছেন। রামচন্দ্রের অনুমতি নিয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। রামচন্দ্র,উৎসুক হয়ে সুমন্ত্রকে অনুমতি দিলেন। কক্ষে সুসজ্জিত শয্যায় অলঙ্কৃত, ধনপতি কুবেরসদৃশ, রামচন্দ্র সমাসীন। চন্দনের অনুলেপনে তাঁর দেহ সুবাসিত। তাকে চামর দিয়ে বাতাস করছেন সীতা দেবী। রামচন্দ্র বেশ প্রসন্নমনে বিরাজমান। সুখীগৃহকোণে প্রদীপ্ত সূর্যের মতো তেজস্বী রামের মুখমণ্ডলে গভীর প্রশান্তি। বিনয়ী সুমন্ত্র তাঁর বক্তব্য নিবেদন করলেন, কৌসল্যা সুপ্রজা রাম পিতা ত্বং দ্রষ্টুমিচ্ছতি। মহিষ্যা সহ কৈকেয্যা গম্যতাং তত্র মা চিরম্।। হে দেবিকৌশল্যার সুপুত্র রাম, দেবী কৈকেয়ীসহ, পিতা, তোমার দর্শনে ইচ্ছুক। অবিলম্বে, সেখানে যাও তুমি।

এই হঠাৎ তলবে রামের প্রতিক্রিয়া কি? তিনি সীতাকে খুব আহ্লাদের সঙ্গে জানালেন, রাজা দশরথ ও রানি কৈকেয়ী, দুজনে মিলিতভাবে নিশ্চয়ই আমার অভিষেক বিষয়ে কোনও শুভ চিন্তা করেছেন। বিমাতা কৈকেয়ীসম্বন্ধে রামচন্দ্রর উচ্চ ধারনাটি কেমন? লক্ষয়িত্বা হ্যভিপ্রায়ং প্রিয়কামা সুদক্ষিণা। সঞ্চোদয়তি রাজানং মদর্থমসিতেক্ষণা।। আমার শুভাকাঙ্খিনী জননী, কেকয়রাজকন্যা, যিনি রাজা দশরথের উদ্দেশ্য সাধনে তৎপর, সর্বদাই স্বামীর প্রিয়কার্যে তাঁর অভিলাষ। সেই রাজমহিষী অবশ্যই,রাজার ইচ্ছা অবগত হয়ে আমার অভিষেকবিষয়ে তাঁকে ব্যস্ত করে তুলেছেন। রামের অনুমান, সেই অন্তঃপুরের মন্ত্রণাসভার নির্দেশ অনুযায়ী নিশ্চয়ই দূত এসেছেন।রাজা নিশ্চয়ই আজই আমার যৌবরাজ্যে অভিষেকের আয়োজন করবেন। যাদৃশী পরিষত্তত্র তাদৃশো দূত আগতঃ। ধ্রুবমদ্যৈব মাং রাজা যৌবরাজ্যঽভিষেক্ষ্যতি।।
রামচন্দ্র স্বামীর মঙ্গলকামনায় প্রার্থনারতা স্ত্রী সীতার সম্মতি নিয়ে সুসজ্জিত রথে আরোহণ করলেন, সঙ্গে চললেন চির অনুগামী অনুগত অনুজ বিচিত্রচামরধারী লক্ষ্মণ। সেই শোভাযাত্রাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল, সম্মুখে, চন্দন অগরুর সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে খড়্গ ও চাপকানধারী বীরেরা।জনতার বিপুল জয়ধ্বনি রামচন্দ্রকে অভিনন্দন জানাল। রামচন্দ্রের অনুগমন করল,শত শত পর্বততুল্য হাতি, হাজার হাজার উত্তম ঘোড়া। সালঙ্কারা সুন্দরী পুরললনারা, রামচন্দ্রকে পুষ্পবর্ষণে অভিসিঞ্চিত করল। মহিলারা যুবরাজকে আনন্দ দান করে বললেন, নূনং নন্দতি তে মাতা কৌসল্যা মাতৃনন্দন‌। পশ্যন্তী সিদ্ধযাত্রং ত্বাং পিত্র্যং রাজ্যমুপস্থিতম্।।

কৌশল্যামায়ের আনন্দ বৃদ্ধি করেই চলেছেন এমন ছেলের সাফল্যের লক্ষ্যে এই যাত্রা। তাঁর মহৎ উদ্দেশ্য হল এই পৈত্রিক রাজ্যলাভ, এটি দেখেতো মায়ের আনন্দ হবেই।আর রামের প্রেয়সী সীতা?নারীশ্রেষ্ঠা তিনি রামের মনোমোহিনী। পুরস্ত্রীরা বলাবলি করলেন, তয়া সুচরিতং দেবতা পুরা নূনং মহত্তপঃ। রোহিণীব শশাঙ্কেন রামসংযোগমাপ যা।। সেই সীতা দেবী নিশ্চিত জন্মান্তরে সুমহৎ তপস্যার ফলস্বরূপ রামচন্দ্রকে লাভ করেছেন। তাঁদের দুজনের মিলন যেন রোহিণী ও চন্দ্রের মিলনের মতো। রাজপথে জনতার প্রিয় আলোচনার বিষয় রামচন্দ্র। প্রজারা নিশ্চিন্ত।কারণ, রঘুনন্দন রাম, চিরকালের জন্যে পিতৃদত্ত রাজ্য লাভ করতে চলেছেন এর ফলে তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে আজ। শাসকপদের অধিষ্ঠিত হবেন তিনি। রামের রাজ্যলাভে সকলেই লাভবান হবেন।কারণ আর অপ্রিয় কিছু ঘটবেনা, প্রজারা দুঃখের মুখ দেখবেন না কখনও।
লাভো জনস্যাস্য যদেষ সর্ব্বং
প্রপৎস্যতে রাষ্ট্রমিদং চিরায়ুঃ।
নহ্যপ্রিয়ং কিঞ্চিন জাতু কশ্চিৎ
পশ্যেন্ন দুঃখং মনুজাধিপেঽস্মিন্।।


পুলকিত জনতার এইসব প্রিয়ভাষণ রামচন্দ্রের কানে পৌঁছল।স্তুতিবন্দনা শুনতে শুনতে হাতি ও ঘোড়ার নাদে মুখরিত, জনাকীর্ণ,রত্ন ও পণ্যসম্ভারে সুসমৃদ্ধ অযোধ্যানগরীর রাজপথে এগিয়ে চললেন রাম। গন্তব্য— পিতৃভবন, রাজা দশরথের রাজপ্রাসাদ। সেখানে তাঁর জন্যে কী অপেক্ষা করছে?রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকার? না উপেক্ষার বনবাসজীবন?
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-১: টি-হাউসের সামনের পাহাড়ের শৃঙ্গ-রা যেন রঙের উৎসবে মেতে উঠেছে

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৪: মুশকিল ঘরে, মুশকিল বাইরে, মুশকিল বিশ্বময়!

রানি কৈকেয়ী রাজা দশরথের রাজমহিষী এবং কেকয়রাজকন্যা। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক চালচিত্র তাঁর জীবনের প্রেক্ষাপট। জটিল মানসিকতার এক দাসী, রানির এই রাজসিক গরিমা, আভিজাত্যকে, সাধারণ জটিলা কুটিলা স্বার্থনিষ্ঠ এক নারীর পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বস্তুত আমরা সকলেই অশুভচিন্তার দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ হই। সেই স্বার্থনিষ্ঠবোধের কাছে নতমস্তক হই,হা রিয়ে ফেলি মনুষ্যত্ববোধ, সূক্ষ্ম মানসিকবৃত্তি, মানবিকতার গৌরববোধ। মানুষের কাছে জীবনের দাবি বোধ হয় রাজসিক।যেমন যুবরাজ ভাবি রাজা রামের কাছে সাধারণের আশা— কোনও অপ্রিয় কাজ নয়, শুধুমাত্র দুঃখবিহীন সুদিন।তবে মানুষের দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলচিত্ততায় পাল্লা ভারি হয় স্বার্থচিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ক্ষতিকর মানবিক অবক্ষয়ে। প্রশাসকের কাছে কিন্তু প্রত্যাশা অনেক বেশি দেশের, সমাজের, সাধারণের।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রাজা দশরথ রানি কৈকেয়ীকে তাঁর দায়বদ্ধতার গুরুত্ব হয়তো বোঝাতে পারেননি। তাঁর হৃদয়াবেগ, প্রশাসকের দক্ষতাকে ছাপিয়ে উঠেছে। তিনি চোখের জল ফেলেছেন রামের ভাবি দুর্গতির কথা ভেবে। একদিকে সুযোগসন্ধানী প্রিয় রানির প্রতিশ্রুতিরক্ষার দায়বদ্ধতা, অপরদিকে প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে প্রজাসাধারণের স্বীকৃত জনপ্রিয় প্রতিনিধিকে রাজা হিসেবে অস্বীকার এবং তাঁকে অন্যায়ভাবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে নির্বাসনদান – এই দুয়ের টানাপোড়েনের চাপে পিষ্ট হয়েছেন রাজা দশরথ।তাঁর বুক ফেটেছে কিন্তু যুক্তিপূর্ণ মুখটি ফোটেনি। মৃত্যুচিন্তা তাঁকে গ্রাস করেছে।রাজার রাজনৈতিক চেতনার মৃত্যু, হয়তো দশরথের স্থূল দৈহিক উপস্থিতির মৃত্যুরই সূচনা।

আদিকাব্যের সূচনায় মহর্ষি বাল্মীকির অভিশাপ ছিল, ব্যাধকৃত নৃশংসতার দূষণের প্রতি। সেই মানসিক দূষণ ব্যাপ্ত হল রামচন্দ্রের অভিষেকের শুভক্ষণে,অযোধ্যানগরীতে।একটি দেশের, রাজপরিবারের, ব্যক্তিজীবনে, রামচন্দ্রের জীবনের প্রতিষ্ঠা, স্থিতি, নষ্ট হল। ক্রৌঞ্চ হত হয়েছিল নিষাদের বিষাক্ত শরসন্ধানে, ঠিক একইভাবে মন্থরাপ্রভাবিত কৈকেয়ীর বিষাক্ত মানসিকতা দূষিত করল অযোধ্যার সামগ্রিক বাতাবরণ। রামচন্দ্রের জীবন এই অতর্কিত আক্রমণের শিকার হল। ঘটনা সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে অনবহিত হয়েও তাঁকে কামের ছলাকলায় মোহিত, দায়িত্বজ্ঞানহীন, অবিমৃষ্যকারী, পিতার ভুল সিদ্ধান্তের ফল ভোগ করতে হল প্রায় জীবনভর। কামনার মায়াজালে বিমুগ্ধচিত্ত রাজা দশরথ মূল্য দিতে চলেছেন নিজের জীবন দিয়ে — ভাবিকাল তাঁর প্রমাণ।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content