সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পুত্রবৎসল, পত্নীর অনুগত,প্রজাসহায়, পরাক্রমী, বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, রাজা দশরথ আজ দ্বন্দ্বদীর্ণ। তিনি এক নারীর কৃপাপ্রার্থী হয়েছেন,যে নারী তার অতি প্রিয়পত্নী। তাঁর দুটি পা ধরে কাতর প্রার্থনা তাঁর, অন্যায় আবদারটি যেন রানি ফিরিয়ে নেন।

এক শিকারী নেকড়ের সামনে অসহায় শিকার অযোধ্যারাজ দশরথ। তিনি নিজের প্রতিশ্রুতিজালে আবদ্ধ। অসহায় হিংস্র নখরের সম্মুখে কম্পিতদেহে, করজোরে অনুগ্রহপ্রার্থী, সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর রাজা দশরথ। তাঁকে যুক্তিজালে ছিন্নভিন্ন করতে উদ্যত রানি কৈকেয়ী। তাঁর আয়ত্তাধীন শাণিত যুক্তির নখ আর দাঁত। কেন বরদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাজা আজ সেই কারণে অনুতপ্ত? তিনি কি সত্যিই ধার্মিক? রাজার জীবন এখন রানি কৈকেয়ীর হাতে।একদা রাজাকে যে জীবন দান করেছিলেন রানি, যাঁর অনুগ্রহে রাজা দশরথ আজ জীবিত সেই রানিকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই কথা বলবেন রাজা?

যস্যাঃ প্রসাদে জীবামি যা চ মামভ্যপালয়ৎ। তস্যাঃ কৃতা ময়া মিথ্যা কৈকেয্যা ইতি বক্ষ্যসি।। অন্যান্য রাজর্ষিদের প্রশ্নের উত্তরে রাজা দশরথ বোধ হয় এই ভাবেই তার অধার্মিক আচরণের স্বপক্ষে গলাবাজি করবেন নিশ্চয়ই। রানির ভাড়ারে অনেক যুক্তি প্রস্তুত। রাজা শৈব্য, তার প্রতীজ্ঞারক্ষার জন্যে নিজ দেহের মাংস দান করেছিলেন, রাজা অলর্ক এক ব্রাহ্মণের প্রতিশ্রুতিরক্ষার্থে চোখ দুটি দান করেছিলেন। আর সাগর? সেতো তীরের সীমা লঙ্ঘন করবে না- এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে, তীর পর্যন্ত ঢেউ ভেঙ্গেই চলেছে এখনও পর্যন্ত। রানি, হুঁশিয়ারি দিলেন রাজাকে, এইসব অনুসরণযোগ্য বিখ্যাত প্রতিজ্ঞাবৃত্তান্ত স্মরণ করে আপনি প্রতিজ্ঞার শর্ত, মিথ্যা প্রতিপন্ন করবেন না। সাগরঃ সময়ং কৃত্বা ন বেলামতিবর্ত্ততে। সময়ং নানৃতং কার্ষীঃ পূর্ব্ববৃত্তমনুস্মরন্।।
রানি কৈকেয়ীর দৃষ্টি ভবিষ্যতে অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত। রাজা কী মনে করেছেন? রাজা রামকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করে রানি কৌশল্যার সঙ্গে সম্ভোগে সময় কাটাবেন? তাঁর রানিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, ধর্ম বা অধর্ম, সত্য বা মিথ্যা, যাই-ই হোক, তা যেন অন্যথা না হয়।
ভবত্বধর্ম্মো বা ধর্ম্মো বা সত্যং বা যদি বাঽনৃতম্।যত্ত্বয়া সংশ্রুতং মহ্যং তস্য নাস্তি ব্যতিক্রমঃ।। রানির শেষ সমাধান যদি রাম অভিষিক্ত হন তাহলে তিনি বিষ পান করবেন। সপত্নীর প্রতি বিদ্বেষজ্বালা প্রকাশ করে রানি কৈকেয়ী বললেন, একদিনের জন্যেও রামমাতার সম্মুখে যদি সকলে জোড়হাত করে তবে রানি কৈকেয়ীর, নিশ্চিত মরণই শ্রেয়। একাহমপি পশ্যেয়ং যদ্যহং রামমাতরম্। অঞ্জলিং প্রতিগৃহ্ণন্তীং শ্রেয়ো ননু মৃতির্ম্মম।। তিনি নিজে এবং প্রাণপ্রিয় ভরতের হয়ে শপথ করছেন, রামের নির্বাসন ছাড়া তিনি কিছুতেই তুষ্ট নন। ভরতেনাত্মনা চাহং শপে তে মনুজাধিপ। যথা নান্যেন তুষ্যেয়মৃতে রামবিবাসনাৎ।। এই ভাবে রানি কৈকেয়ী শেষ তাস ছুড়ে দিলেন রাজার দিকে। হয় রামের বনবাসের প্রতিজ্ঞারক্ষা, না হলে রানির জীবন—এই দুটির কোনটি রাজা দশরথের অভিপ্রেত? মৌন হলেন রানি। রাজা দশরথ, সিংহাসনে ভরতের রাজ্যাভিষেক এবং রামের নির্বাসন এই দুটি প্রস্তাবে স্তম্ভিত হলেন।বাকরুদ্ধ হল, রোরুদ্যমান রাজার।রানি কিন্তু নিশ্চুপ। রাজা দশরথ নির্নিমেষে চেয়ে রইলেন রানির পানে। রানির বজ্রের মতো বাক্যে হৃদয় বিদীর্ণ হল রাজার। তিনি রানির দুষ্ট অভিসন্ধি এবং নিজের শপথ বিষয়ে চিন্তা করে ‘হায় রাম’ এই আর্তচিৎকারে সমূলে উৎপাটিত তরুর মতো লুণ্ঠিত হলেন।

প্রতাপবিহীন রাজা জ্ঞানহীন উন্মত্তের মতো, বিকারগ্রস্ত রোগীর তুল্য,মন্ত্রে সম্মোহিত নির্বিষ সাপ যেন। নষ্টচিত্তো যথোন্মত্তো বিপরীতো যথাতুরঃ। হৃততেজা যথা সর্পো বভূব জগতীপতিঃ।। রাজা গভীর দৈন্যে, আর্তকণ্ঠে, অভিযোগের সুরে, রানিকে বলে চললেন, কে এই আপাতন্যায্য উপদেশে রানির বিশ্বাস উৎপাদন করেছেন যে, ভূতে পাওয়া নারীর মতো তিনি রাজার কাছে ওই অন্যায্য প্রস্তাবেও লজ্জিত নন? যৌবনে রানীর স্বভাবের নীচতা রাজার জানা ছিল না। এখন রানির স্বভাব বিপরীতমুখী। কেন রাম হতে তাঁর এত ভয়? রাজা দশরথের অনুরোধ তুমি যদি ভরতের, আমার, লোকের, ভাল চাও তাহলে এই মিথ্যাচার ত্যাগ কর। বিরমৈতেন ভাবেন ত্বমেতেনানৃতেন চ। যদি ভর্ত্তুঃ প্রিয়ং কার্য্যং লোকস্য ভরতস্য চ।। রাজার গভীর ক্ষোভ, রানির এই নৃশংস সঙ্কল্প, নীচ দুষ্কর্মের মানসিকতা কেন? রাম এবং দশরথের, পিতাপুত্রের কী অপরাধ? মিথ্যা দুঃখসম্ভাবনায় রাম এবং রাজার প্রতি রানির এই বিরূপ মনোভাব। আর ভরত?ভরত রামবিনা রাজাসন গ্রহণ করবেন না। রাজা দশরথের বিবেচনায়, রামের অপেক্ষা ভরতের ধর্মবোধ যে প্রবল। ন কথঞ্চিদৃতে রামাদ্ভরতো রাজ্যমাবসেৎ। রামাদপি হি তং মন্যে ধর্ম্মতো বলবত্তরম্।। গভীর দুঃখ প্রকাশ করলেন রাজা দশরথ। বনগমনের আদেশের ফলে, রামের বিবর্ণমুখ তিনি দেখবেন কী করে? সুহৃদ্বর্গের নির্ধারিত সিদ্ধান্তের পরিণাম, ঠিক শত্রুসৈন্যদ্বারা পরাজিত সৈনিকের অবস্থা যেন। সেই সিদ্ধান্তটি রানির মতো নারীর দ্বারা প্রতিহত হতে দেখছেন, রাজা দশরথ। সমবেত রাজাদের কাছে, নিজের দীর্ঘদিন সিংহাসনে অধিষ্ঠানের কারণে সমালোচিত হবেন তিনি। তাদের বিদ্রূপের ভাষা হবে বালো বতায়মৈক্ষ্বাকশ্চিরং রাজ্যমকারয়ৎ। রাজা দশরথ যেন বালকমাত্র। এই বালক, এত দীর্ঘদিন রাজ্য শাসন করে চলেছেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩৫: কুরুবংশগতিরক্ষা এবং মুনি অণীমাণ্ডব্যের কাহিনিতে প্রাচীন ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৮: ইষ্টদর্শন

বহুশাস্ত্রজ্ঞ, গুণবান ব্রাহ্মণরা, যখন রামের বিষয়ে, প্রশ্ন করবেন, তখন তাঁদের কাছে কি জবাবদিহি করবেন রাজা? তাঁরা যে বিশ্বাস করতে চাইবেন না, রানি কৈকেয়ীর দ্বারা উৎপীড়িত হয়েই রামকে প্রব্রজ্যা অর্থাৎ মুনিবৃত্তি নিয়ে বনবাসে যেতে বাধ্য করেছেন রাজা।এই কৈফিয়ৎ বিশ্বাসযোগ্য হবে তো?সত্যকথাটিই অসত্য হবে যে। কৈকেয্যা ক্লিশ্যমানেন রামঃ প্রব্রাজিতো ময়া। যদি সত্যং ব্রবীম্যেতত্তদসত্যং ভবিষ্যতি।। রামের মা কৌশল্যাকেই বা রাজা কি বলবেন? এই খারাপ কাজটির কী ব্যাখ্যা দেবেন রাজা, শুভাকাঙ্ক্ষিনী স্ত্রীকে? সেই কৌশল্যা দাসীর মতো সেবাপরায়ণা, সঙ্গদানে বান্ধবীতুল্যা, ধর্মাচরণে সহধর্মচারিণী, ভগিনীর মতো কল্যাণকামিনী, ভোজ্যদানে স্নেহময়ী জননী যেন।

রাজা গভীর অনুশোচনার সুরে বললেন—আমার একান্ত হিতাকাঙ্ক্ষিনী, প্রিয়পুত্রের মা, প্রিয়বাদিনী, সৎকাজের প্রতিদানের যোগ্যা, রানি কৌশল্যা, অথচ তোমার কারণে যাঁকে কোন কিছুই আমি প্রতিদান হিসেবে দিতে পারিনি। সততং প্রিয়কামা মে প্রিয়পুত্রা প্রিয়ংবদা। ন ময়া সৎকৃতা দেবী সৎকারার্হা কৃতে তব।। কুপথ্যযুক্ত, অন্নব্যঞ্জন ভোজনের ফলে, পীড়িত ব্যক্তি যেমন বিলম্বে অনুশোচনায় দগ্ধ হয় তেমনই অতীতে তিনি একদা প্রিয় রানির প্রতি যে সদ্ব্যবহার করেছেন তার জন্য তিনি এখন অনুতপ্ত। রাজার এই সিদ্ধান্তের কারণে, রানি সুমিত্রার কাছেও রাজার বিশ্বাসযোগ্যতা বিনষ্ট হবে।

রামপত্নী সীতা, রাজা দশরথের মৃত্যু ও রামের বনবাসের সিদ্ধান্তে প্রিয়বিচ্ছিন্না কিন্নরীর মতো শোকাকুলা অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করবেন। ন হি রামমহং দৃষ্ট্বা প্রবসন্তং মহাবনে। চিরঞ্জীবিতুমাশংসে রুদন্তীঞ্চাপি মৈথিলীম্।। আর রাজা নিজেও, রামের ওই বিজন, মহারণ্যে প্রবাসজীবন এবং সেই কারণে ক্রন্দনরতা মৈথিলী সীতাকে দেখে, আর বাঁচবেন না। রানি কৈকেয়ী বৈধব্য বরণ করে, সপুত্র রাজত্ব করুন। যেমন, প্রথমদর্শনে আকৃষ্ট হয়ে মানুষ মদ্যপানের বিষময়, কুপ্রভাবটি পরে অনুভব করেন তেমনই রানিকে এতদিন আপাতদৃষ্টিতে সতী মনে করলেও রাজার সদ্য অনুভব হল, রানি অসতী।
সংগীতে মোহাবিষ্ট হরিণকে যেমন ব্যাধ হত্যা করে তেমনই প্রিয়সম্ভাষণে,সম্মোহিত রাজা এখন রানির শিকার। মদ্যপায়ী, নিন্দিত, ব্রাহ্মণের মতো রাজা দশরথ, পুত্রবিক্রেতা, অনার্য সম্বোধনে নিন্দিত হবেন।

হাহাকারে দীর্ণ, রাজা তাঁর জন্মান্তরের কোন কর্মফলকে দোষারোপ করতে থাকলেন। দুঃখমেবংবিধং প্রাপ্তং পুরাকৃতমিবাশুভম্ পাপিষ্ঠা রানিকে কণ্ঠলগ্ন উদ্বন্ধনের রজ্জু মনে করছেন রাজা। বালক যেমন খেলার ছলে, অজ্ঞতাবশত, নির্জনে কালসাপকে স্পর্শ করে, তেমনই মরণরূপ রানির সঙ্গমার্থী রাজা মৃত্যুর করালগ্রাসের সম্মুখীন হয়েছেন আজ। মানুষ নিন্দামুখর হবে এই আলোচনায় একজন নারীর জন্যে কামুক, নির্বোধ রাজা, এমন সেরা ছেলেটিকে বনে পাঠালেন। কোথায় রামের এখন জীবন উপভোগের সময়। তা না হয়ে, তিনি চলেছেন ব্রত, ব্রহ্মচর্যপালনের জন্যে কৃশকায় দেহে, বনবাসজীবনে। পিতার আদেশে, রাম বনে যাবেন, কিন্তু কখনও প্রতিবাদে মুখ ফুটবে না তাঁর। যদি সে, কেন? এই প্রশ্ন করেন, তবে রাজা খুশী হবেন। কিন্তু রাজা নিশ্চিত, যে রাম তা করবেন না। তিনি যে জানবেনই না, পিতা সত্যিই কী চাইছেন? রামের বনবাসকারণে, নিন্দিত জীবনে, রাজা আর বাঁচতে চান না। এখন রাজার মৃত্যুই পরম কাঙ্ক্ষিত। ভবিষ্যতের চরম বিষাদচিত্র রাজার মানসদৃষ্টিতে দৃশ্যমান। রাজা দশরথের মৃত্যুতে ও রামের বনবাসজনিত দুঃখে স্বামীর অনুগামিনী হবেন দেবী কৌশল্যা। রানি সুমিত্রাও রাম ও সহচর লক্ষ্মণ, এই দুইপুত্রের বিচ্ছেদে কৌশল্যাকে অনুসরণ করবেন। প্রায় সম্পূর্ণ পরিবারেরই দুঃখাবর্তে নিক্ষেপের কারণ, রানি কৈকেয়ী।শান্তি ও দানধর্মের আধিক্যে ইক্ষ্বাকুকুলে কোন অশান্তি ছিল না। রাম ও দশরথহীন এই বিক্ষুব্ধ রঘুবংশ পালন করবেন রানি। রানির শাসনাধীন হবে রঘুকুল। আর রামের বনবাস যদি ভরতের অভিপ্রেত বলে মনে হয়, তবে পিতা দশরথের ইচ্ছা, ভরত যেন পিতার মৃত্যুরপরে, তাঁর অন্তিম সংস্কারে অংশগ্রহণ না করে।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৩: টাকির ভাসানের ব্যথা

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৩: উইলসন-এ-কথা

প্রিয়ঞ্চেদ্ভরতস্যৈতদ্রামপ্রব্রাজনং ভবেৎ।মাস্ম মে ভরতঃ কার্ষীৎ প্রেতকৃত্যং গতাযুষঃ।। রামের বনগমনের কারণে স্বামীর মৃত্যুতে রানি কৈকেয়ীর বৈধব্যযোগ আসন্ন। বিধবা রানি, সপুত্র, রাজ্য শাসন করবেন। হায়, সকলের অবজ্ঞার পাত্র হলেন রাজা দশরথ। এর জন্যে একমাত্র দায় রানি কৈকেয়ীর। বাছা রাম, রথ, অশ্ব, হস্তীপৃষ্ঠে গমনাগমনে অভ্যস্ত। তিনি বিজনবনে কীভাবে পায়ে হেঁটে বিচরণ করবেন? যাঁর ভোজ্য পরিবেশনের আগ্রহে পাচকরা ব্যতিব্যস্ত হত, সেই রাম বনে কীভাবে কটু, তিক্ত, কষায়, বন্য ফলমূল ভোজ্যে তৃপ্ত হবেন? যে রাম বহুমূল্য বসন ও শয্যায় অভ্যস্ত, তিনি কীভাবে অরণ্য জীবনে কাষায় বসন অঙ্গে ধারণ করবেন? রামের বনবাস, ভরতের রাজ্যাভিষেকের এই নিদারুণ পরামর্শ কার? রাজা ধিক্কার জানালেন সমগ্র নারীজাতিকে। নারীমাত্রই শঠ এবং স্বাথপর ধিগস্তুযোষিতো নাম শঠাঃ স্বার্থপরাযণা:

পরমুহূর্তে রাজা দশরথ ভ্রমসংশোধন করে বললেন, ন ব্রবীমি স্ত্রিযং সর্ব্বা ভরতস্যৈব মাতরম্। না, সব নারী নন, একমাত্র ভরতমাতা সম্বন্ধেই তাঁর এই উক্তি। রাজা দশরথের অভিযোগের শেষ নেই। স্ত্রী কৈকেয়ীকে ভর্তসনা করে শ্রান্ত নন তিনি। রাম এবং রাজাকে কী এমন অপ্রিয়কাজ করতে দেখলেন রানি? বিপন্ন রামকে দেখে সব পিতাই পুত্রদের পরিত্যাগ করবেন, অনুগতা স্ত্রীরা স্বামীত্যাগ করবেন, সমগ্র জগত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবে। রামের দর্শনসুখে পিতা দশরথ উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, যেন বৃদ্ধরাজা যৌবন ফিরে পান। স্নেহবৎসল পিতা, রাজা দশরথের ধারণা, সূর্যালোক ছাড়া লৌকিক জীবন সচল থাকবে, ইন্দ্রদেব বারিবর্ষণ না করলেও জীবলোক বেঁচে থাকবে কিন্তু রামের অনুপস্থিতিতে কেউই জীবিত থাকবে না। নিজের মৃত্যুর পরোয়ানাসহ মূর্তিমতী ধ্বংসরূপিণী, রানি কৈকেয়ীকে প্রাসাদে এনেছিলেন রাজা। নিজের জীবন দিয়ে, সেই মূর্খতার মূল্য দিতে হবে রাজাকে। এক মৃত্যুরূপ, কালসাপিনীকে মোহগ্রস্ত হয়ে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন রাজা। থাকুন রানি কৈকেয়ী স্বামী, দুই পুত্রকে ছেড়ে। শুধু ভরত তার মাকে নিয়ে রাজ্যশাসন করুন।

রানির গর্বিতবচন যেন এই বৃদ্ধরাজাকে প্রহারের তুল্য আচরণ। তাও রানির দন্তপঙক্তি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে খসে পরছেনা কেন? প্রিয়ভাষী রামের ওপরে দোষারোপ করেছেন রানি। রানি কৈকেয়ী কেকয়রাজকুলের কলঙ্ক। তিনি যেভাবেই প্রাণত্যাগ করুন, রাজা কোনমতেই তাঁর নিষ্ঠুর প্রস্তাবে সায় দেবেননা। রাজা, রানির মৃত্যু কামনা করেন। রাজার জীবন এখন অস্তাচলের দিকে ধাবমান। পুত্রবিনা দেহধারী মানুষের সুখ কোথায়? পরিশেষে রানির পদযুগল স্পর্শ করে রাজার কাতর প্রার্থনা,হে দেবি,তুমি আমার অমঙ্গল করো না। আমার প্রতি প্রসন্ন হও তুমি। মমাহিতং দেবি ন কর্ত্তুমর্হসি, স্পৃশামি পাদাবপি তে প্রসীদ মে।
অনাথের মতো রানির চরণ স্পর্শ করতে উদ্যত রাজা, সংজ্ঞা হারালেন।

রাজা দশরথ তাঁর স্বপ্নভঙ্গের ঘোর কাটিয়ে উঠে যখন রানি কৈকেয়ীর রাজনৈতিক চালটি ধরতে পারলেন, তখন দীর্ঘ রাজনীতির পরিমণ্ডলে অবস্থানের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তাঁর আর প্রতিরোধের উপায় নেই। সত্যরক্ষার প্রতিজ্ঞাপাশে বদ্ধ, রাজা, জালে আবদ্ধ সিংহের মতো ছটফট করতে করতে সংজ্ঞা হারালেন। অজস্র তিরস্কারে বিদ্ধ করলেন রানিকে।রাজার কাছে রামহীন জীবন নিষ্প্রাণ, নিষ্প্রভ। কৈকেয়ীর মতো রামের একজন শুভাকাঙ্খিনীর এমন ভাবমূর্তি পরিবর্তনে রাজা দশরথ বিস্মিত হয়েছেন। স্বার্থচিন্তা মানুষকে এমনটাই ভোল পাল্টাতে বাধ্য করে। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কারণে, এমন উদাহরণ, বর্তমান রাজনীতির চালচিত্রে বিরল নয়। বরং এটিকে অদ্বিতীয় বলা যেতে পারে।

প্রথমে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন স্ত্রীকে।জনপ্রিয় রাম প্রজাদের মন জয় করেছেন নিজগুণে। তাই এই যুবরাজপ্রাপ্তির যোগ্য হলেন রাম। যুক্তিবোধ হার মেনেছে। রানির অশুভ উদ্দেশ্য জয়ী হয়েছে। বৃদ্ধরাজা, দীনহীনের মতো রানীর করুণাপ্রার্থী আজ।রানির মনে রাজার বিষাদ কোন রেখাপাত করতে পারেনি। রানি কৈকেয়ী সত্যরক্ষার দোহাই দিয়ে পৌরাণিক উদাহরণ তুলে ধরেছেন তাঁর বক্তব্যে। তিনি নিজের জেদে অটল। অনমনীয় তাঁর উচ্চাশা।রাজমাতার গৌরবকামনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সপত্নী, রামমাতা কৌশল্যার প্রতি প্রবল ঈর্ষার দহনজ্বালা। ঈর্ষার উচ্চাশা মানুষকে মানবিকবোধশূন্য করে তোলে তার অন্যতম দৃষ্টান্ত কৈকেয়ী। তাঁর স্বামীর পুত্রবিরহে প্রাণবিসর্জনের সম্ভাবনাতেও তিনি অনমনীয়,নিজের দুটি উদ্দেশ্যসাধনে নিজলক্ষ্যে অবিচলিত। ক্ষমতার লোভ, হিংসা, বিদ্বেষবিষের সুদূরপ্রসারী প্রভাব যে কত মারাত্মক হতে পারে রামায়ণে আদিকবি যেন প্রমাণসহযোগে সেটিই বর্ণনা করেছেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২১: একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে/ কী ছিল বিধাতার মনে

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

রাজা দশরথের ক্ষোভ, পত্নীর প্রতি ঘৃণাভাষণ, বিষাদ এ সবই যেন তাঁর আত্মবিশ্লেষণ। তিনি ক্ষত্রিয়পরম্পরা অনুসরণ করে পত্নীদের প্রতি সমদর্শী হতে পারেননি। এটিই ছিল বহুবল্লভ রাজাদের স্বভাব। তার সুযোগ নিয়েছেন রানি কৈকেয়ী। রাজার দুর্বলতাকে স্বার্থসাধনে কাজে লাগিয়েছেন। পুত্রবৎসল পিতা স্ত্রীর প্ররোচনায় সাড়া দেননি। তিনি একটি পারিবারিক পরিমণ্ডলের গৃহকর্তার মতোই, দুষ্টা স্ত্রীকে তিরস্কার করেছেন, সংশোধনের চেষ্টা করেছেন। অপারগ হয়ে, চোখের জলে ভেসেছেন, স্ত্রীর পা ধরে প্রার্থনা জানিয়েছেন তিনি। পারিবারিক উত্তরাধিকারের গৃহযুদ্ধসমাধানে এক অক্ষম গৃহকর্তার ভূমিকায়, এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, রাজা দশরথ। এক রাজবংশের গৃহের কূট রাজনীতির আবহ, যুগের সীমারেখা ছাপিয়ে আধুনিক জাতীয়প্রেক্ষিতের রাজনৈতিক পরিসরে, ভাবতে শেখায়।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content