ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
পুরবাসীরা সানন্দে দশরথপুত্র রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যে অভিষেকের প্রস্তাবে অকুন্ঠিতচিত্তে সম্মতি জানালেন। অযোধ্যারাজ দশরথ, তাঁর মনোগত অভিপ্রায়ের সমর্থনে, প্রজারা সহমত জেনে, মন্ত্রীদের পরামর্শক্রমে, সিদ্ধান্তটি বাস্তবে রূপায়ণে মনোযোগী হলেন। মন্ত্রয়িত্বা ততশ্চক্রে নিশ্চয়জ্ঞঃ স নিশ্চয়ম্। স্থির হল, পরদিন প্রভাতকালেই পুষ্যানক্ষত্রযোগের পুণ্যলগ্নে পদ্মনেত্র রামচন্দ্রের অভিষেক সম্পন্ন হবে। শ্ব এবং পুষ্যো ভবিতা স্বোঽভিষেচ্যস্তু মে সুতঃ।রামো রাজীবপত্রাক্ষো যুবরাজ ইতি প্রভুঃ।। রাজা দশরথ, সারথি সুমন্ত্রকে, রামচন্দ্রকে পুনরায় আনয়নের নির্দেশ দিলেন।
রামচন্দ্রের মনে আশঙ্কার কালো মেঘ। কেন এই তলব? সুমন্ত্র জানালেন, পুত্রদর্শনেচ্ছু রাজা দশরথ। তমুবাচ ততঃ সূতো রাজা ত্বাং দ্রষ্টুমিচ্ছতি।* রাম সত্বর উপস্থিত হলেন পিতার নিকটে। পিতা দশরথ, পুত্রের কাছে, প্রিয় সংবাদটি নিজমুখে প্রকাশ করতে চাইলেন, এতটাই প্রীতি তাঁর প্রিয় রামের প্রতি। রাজা তাঁর নিজের বার্ধক্যের উল্লেখ করে বললেন তিনি তাঁর দীর্ঘজীবনে নানা সদুপায় অবলম্বনে অতিবাহিত করেছেন।তিনি নিজে, অতুলনীয় পুত্রের ভাগ্যবান পিতা। সেই কারণে তিনি দেব, ঋষি, বিপ্র, পিতৃবর্গ ও আত্মার ঋণমুক্ত হয়েছেন।
দেবর্ষিপিতৃবিপ্রাণামনৃণোঽস্মি তথাত্মনঃ প্রজাদের ঐকান্তিক ইচ্ছা, তুমি রাজা হও। তাই হে পুত্র, আমি তোমাকে যুবরাজপদে অভিষিক্ত করতে চাই। অদ্য প্রকৃতয়ঃ সর্ব্বাস্ত্বামিচ্ছন্তি নরাধিপম্। অতস্ত্বাং যুবরাজানমভিষেক্ষ্যামি পুত্রক।। রাজা জ্যোতিষবিজ্ঞানানুসারে গ্রহ, নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাসী। তিনি দৈবজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস করেন। দৈবজ্ঞরা বলেছেন রাজার ভাগ্য রাহুকবলিত। রাজা চিন্তিত, তিনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন। সেই স্বপ্নে মহাশব্দে উল্কাপাত যেন কোনও অশুভ সংকেতের দ্যোতক। রাজার প্রাণসংশয়ের সচনা? তাই বুদ্ধিবিভ্রম হওয়ার পূর্বেই রাজা দশরথ অবিলম্বে আসন্ন পুষ্যানক্ষত্রযোগের পুণ্যতিথিতে রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রামচন্দ্রের মনে আশঙ্কার কালো মেঘ। কেন এই তলব? সুমন্ত্র জানালেন, পুত্রদর্শনেচ্ছু রাজা দশরথ। তমুবাচ ততঃ সূতো রাজা ত্বাং দ্রষ্টুমিচ্ছতি।* রাম সত্বর উপস্থিত হলেন পিতার নিকটে। পিতা দশরথ, পুত্রের কাছে, প্রিয় সংবাদটি নিজমুখে প্রকাশ করতে চাইলেন, এতটাই প্রীতি তাঁর প্রিয় রামের প্রতি। রাজা তাঁর নিজের বার্ধক্যের উল্লেখ করে বললেন তিনি তাঁর দীর্ঘজীবনে নানা সদুপায় অবলম্বনে অতিবাহিত করেছেন।তিনি নিজে, অতুলনীয় পুত্রের ভাগ্যবান পিতা। সেই কারণে তিনি দেব, ঋষি, বিপ্র, পিতৃবর্গ ও আত্মার ঋণমুক্ত হয়েছেন।
দেবর্ষিপিতৃবিপ্রাণামনৃণোঽস্মি তথাত্মনঃ প্রজাদের ঐকান্তিক ইচ্ছা, তুমি রাজা হও। তাই হে পুত্র, আমি তোমাকে যুবরাজপদে অভিষিক্ত করতে চাই। অদ্য প্রকৃতয়ঃ সর্ব্বাস্ত্বামিচ্ছন্তি নরাধিপম্। অতস্ত্বাং যুবরাজানমভিষেক্ষ্যামি পুত্রক।। রাজা জ্যোতিষবিজ্ঞানানুসারে গ্রহ, নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাসী। তিনি দৈবজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস করেন। দৈবজ্ঞরা বলেছেন রাজার ভাগ্য রাহুকবলিত। রাজা চিন্তিত, তিনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন। সেই স্বপ্নে মহাশব্দে উল্কাপাত যেন কোনও অশুভ সংকেতের দ্যোতক। রাজার প্রাণসংশয়ের সচনা? তাই বুদ্ধিবিভ্রম হওয়ার পূর্বেই রাজা দশরথ অবিলম্বে আসন্ন পুষ্যানক্ষত্রযোগের পুণ্যতিথিতে রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
অভিষেকের প্রাথমিক নিয়মানুসারে রাজা দশরথ সপত্নী রামচন্দ্রকে কুশশয্যায় শয়নের নির্দেশ দিলেন। রামচন্দ্রের বিশ্বস্ত বন্ধুবর্গ যেন স্থিরচিত্তে তাঁর রক্ষণকার্যে নির্বিঘ্নে অবস্থান করেন। রাজার মনে কী আশঙ্কার কালো মেঘ? তাঁর দুর্ভাবনার মূলে কে? জ্যেষ্ঠের আজ্ঞানুবর্তী, সংবেদনশীল ভরত? তিনি বর্তমানে মাতুলালয়ে। তাঁর অনুপস্থিতিতে জ্যেষ্ঠর অভিষেক সমীচিন মনে করেন রাজা। কেন? এর যৌক্তিকতা কোথায়? কিন্তু চিত্তং মনুষ্যাণামনিত্যমিতি মে মতম্। সত্যঞ্চ ধর্ম্মনিত্যানাং কৃতশোভি চ রাঘব।। তাঁর বিশ্বাস মানুষের হৃদয় স্থিতিশীল নয়, হে রাঘব সতত ধার্মিক ব্যক্তিরাও সত্য থেকে বিচ্যুত হন। এ কী রাজার সত্যস্খলনের অঙ্গুলিসঙ্কেত? ভার্যা সীতাকে পিতার আদেশ জানানোর জন্যে রাম উদগ্রীব, কিন্তু সীতার সাক্ষাৎ পেলেন না। মাতা কৌশল্যার ভবনে তিনি তাঁকে রাজ্যলক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনারতা অবস্থায় দেখতে পেলেন।
ইতিমধ্যে কনিষ্ঠা মাতা সুমিত্রা ও লক্ষ্মণভাই কৌশল্যাকে সুসংবাদটি জানিয়েছেন। দেবী কৌশল্যা প্রাণায়ামপূর্বক মুদ্রিতনয়নে বিষ্ণুর ধ্যানে নিমগ্না। সেখানে উপস্থিত সীতা, লক্ষ্মণ ও সুমিত্রা। রামচন্দ্র মধুরস্বরে সুসংবাদটি মাকে জানালেন, অম্ব পিত্রা নিযুক্তোঽস্মি প্রজাপালনকর্ম্মণি মা, পিতা আমায় প্রজাপালনকার্যে নিযুক্ত করেছেন। আগামীকালই সেই শুভদিন। পিতার আদেশানুসারে তিনি ও সীতা উপবাসরত অবস্থায় রাত্রি যাপন করবেন। মায়ের কাছে তাঁর আব্দার, তিনি যেন পুত্র ও পুত্রবধূ বৈদেহীর মঙ্গলার্থে যা করণীয় তা সম্পন্ন করেন। কৌশল্যার প্রাণভরা আশীর্বাদে ধন্য হলেন রামচন্দ্র। হাসিকান্না ভরা কণ্ঠে কৌশল্যা আবেগস্ফুরিত হয়ে বললেন অমোঘং বত মে ক্ষান্তং পুরুষে পুষ্করেক্ষণে। যেয়মিক্ষ্বাকুরাজ্যশ্রীঃ পুত্র ত্বাং সংশ্রয়িষ্যতি।। হে পুত্র, নিষ্কাম হয়ে, আমার কমলনয়ন বিষ্ণুর উপাসনা, আজ সার্থক হল। ইক্ষ্বাকুরাজ্যলক্ষ্মী এবার তোমার আশ্রয় লাভ করবেন।
রামচন্দ্র সম্মুখে উপস্থিত বিনয়াবনত লক্ষ্মণের উদ্দেশে স্মিত হেসে বললেন, হে লক্ষ্মণ,তুমি যে আমার দ্বিতীয় সত্তা। এই রাজ্যলক্ষ্মী এখন তোমারও আশ্রিতা। তুমি আমার সঙ্গে একত্রে এই পৃথিবী শাসন কর। হে সুমিত্রানন্দন, তুমি অভীপ্সিত রাজ্যলাভের সুফল ভোগ কর।তোমার জন্যে আমি জীবন ও রাজ্য দুইটিই কামনা করি। লক্ষ্মণেমাং ময়া সার্দ্ধং প্রশাধি ত্বং বসুন্ধরাম্। দ্বিতীয়ং মেঽন্তরাত্মানং ত্বামিয়ং শ্রীরুপস্থিতা।। সৌমিত্রে ভুঙ্ক্ষ্ব ভোগাংস্ত্বমিষ্টান্ রাজ্যফলানি চ। জীবিতঞ্চাপি রাজ্যঞ্চ ত্বমর্থমভিকাময়ে।। রাজা দশরথ কুলগুরু সর্বোত্তম বেদবিদ ঋষি বসিষ্ঠকে অনুরোধ জানালেন, সপত্নী রামচন্দ্র যেন উপবাসপালনে যথাযথভাবে ব্রতী হন—এই বিষয়টি কার্যে পরিণত করুন। গচ্ছোপবাসং কাকুৎস্থং কারয়াদ্য তপোধন ব্রাহ্মণের আরোহণযোগ্য সেরা অশ্বযুক্ত রথে চড়ে বসিষ্ঠ ঋষি দ্রুত ছুটলেন রামচন্দ্রের বাসভবনে।
ইতিমধ্যে কনিষ্ঠা মাতা সুমিত্রা ও লক্ষ্মণভাই কৌশল্যাকে সুসংবাদটি জানিয়েছেন। দেবী কৌশল্যা প্রাণায়ামপূর্বক মুদ্রিতনয়নে বিষ্ণুর ধ্যানে নিমগ্না। সেখানে উপস্থিত সীতা, লক্ষ্মণ ও সুমিত্রা। রামচন্দ্র মধুরস্বরে সুসংবাদটি মাকে জানালেন, অম্ব পিত্রা নিযুক্তোঽস্মি প্রজাপালনকর্ম্মণি মা, পিতা আমায় প্রজাপালনকার্যে নিযুক্ত করেছেন। আগামীকালই সেই শুভদিন। পিতার আদেশানুসারে তিনি ও সীতা উপবাসরত অবস্থায় রাত্রি যাপন করবেন। মায়ের কাছে তাঁর আব্দার, তিনি যেন পুত্র ও পুত্রবধূ বৈদেহীর মঙ্গলার্থে যা করণীয় তা সম্পন্ন করেন। কৌশল্যার প্রাণভরা আশীর্বাদে ধন্য হলেন রামচন্দ্র। হাসিকান্না ভরা কণ্ঠে কৌশল্যা আবেগস্ফুরিত হয়ে বললেন অমোঘং বত মে ক্ষান্তং পুরুষে পুষ্করেক্ষণে। যেয়মিক্ষ্বাকুরাজ্যশ্রীঃ পুত্র ত্বাং সংশ্রয়িষ্যতি।। হে পুত্র, নিষ্কাম হয়ে, আমার কমলনয়ন বিষ্ণুর উপাসনা, আজ সার্থক হল। ইক্ষ্বাকুরাজ্যলক্ষ্মী এবার তোমার আশ্রয় লাভ করবেন।
রামচন্দ্র সম্মুখে উপস্থিত বিনয়াবনত লক্ষ্মণের উদ্দেশে স্মিত হেসে বললেন, হে লক্ষ্মণ,তুমি যে আমার দ্বিতীয় সত্তা। এই রাজ্যলক্ষ্মী এখন তোমারও আশ্রিতা। তুমি আমার সঙ্গে একত্রে এই পৃথিবী শাসন কর। হে সুমিত্রানন্দন, তুমি অভীপ্সিত রাজ্যলাভের সুফল ভোগ কর।তোমার জন্যে আমি জীবন ও রাজ্য দুইটিই কামনা করি। লক্ষ্মণেমাং ময়া সার্দ্ধং প্রশাধি ত্বং বসুন্ধরাম্। দ্বিতীয়ং মেঽন্তরাত্মানং ত্বামিয়ং শ্রীরুপস্থিতা।। সৌমিত্রে ভুঙ্ক্ষ্ব ভোগাংস্ত্বমিষ্টান্ রাজ্যফলানি চ। জীবিতঞ্চাপি রাজ্যঞ্চ ত্বমর্থমভিকাময়ে।। রাজা দশরথ কুলগুরু সর্বোত্তম বেদবিদ ঋষি বসিষ্ঠকে অনুরোধ জানালেন, সপত্নী রামচন্দ্র যেন উপবাসপালনে যথাযথভাবে ব্রতী হন—এই বিষয়টি কার্যে পরিণত করুন। গচ্ছোপবাসং কাকুৎস্থং কারয়াদ্য তপোধন ব্রাহ্মণের আরোহণযোগ্য সেরা অশ্বযুক্ত রথে চড়ে বসিষ্ঠ ঋষি দ্রুত ছুটলেন রামচন্দ্রের বাসভবনে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২৯: কুরুপাণ্ডবকুমারদের অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনী কি কোনও বিদ্বেষের উৎস?
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৭: ‘কর্ণ’nicles
পরম পূজ্য মনীষী বসিষ্ঠ, রামচন্দ্রকে, অভিষেকপূর্বদিনে নিয়মপূর্বক ব্রতপালনরত অবস্থায় দেখে, পত্নী বৈদেহীসহ উপবাসে প্রবৃত্ত করলেন। যথাযোগ্যভাবে সম্মানিত বসিষ্ঠমুনি বিদায় নিলেন। রাজভবন রামানুরাগী নরনারীদের ভিড়ে পরিপূর্ণ। রাজপথ লোকে লোকারণ্য।অভিষেকদর্শনেচ্ছু জনতার কারণে পথচলাই দায়। চারিদিক আনন্দোচ্ছ্বাসের কোলাহলে মুখর।সকলেই সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছেন। অযোধ্যার প্রজাদের আবাসগুলি পতাকাশোভিত,দ্বারদেশ ফুলমালায় সজ্জিত। প্রত্যেক রাজপথ জলসিক্ত,আর্দ্র, পরিষ্কার।মাননীয় ঋষি বসিষ্ঠ গমনাগমনে বিঘ্নসৃষ্টিকারী কৌতূহলী জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনলেন।রাজভবনে প্রবেশ করলেন তিনি। সসম্মানে উঠে দাঁড়ালন রাজা দশরথ। কার্যোদ্ধারের খবরাখবর নিয়ে ঋষি বসিষ্ঠের অনুমতিক্রমে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন, সিংহ যেমন গিরিগুহায় প্রবেশ করে ঠিক সেইরকম।
রাত্রি প্রভাত হল, উদীয়মান সূর্য, পুষ্যনক্ষত্রযোগের সেই মুহূর্ত সমাগতপ্রায়। বসিষ্ঠমুনি শিষ্যপরিবৃত হয়ে অভিষেক সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হলেন। অযোধ্যা নগরী তখন অগরুচন্দনের সুগন্ধে আমোদিত। জলসিক্ত রাজপথের বিপণিগুলো অভিষেক উপলক্ষ্যে সমৃদ্ধ, পতাকাশোভিত পথঘাট, জনগণের জনজোয়ারের কোলাহলমুখর। ইন্দ্রপুরীর মতো সুশোভিত রাজভবনের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন মহামুনি বসিষ্ঠ। সেখানে পুরবাসী, জনপদবাসীদের জমায়েত, ব্রাহ্মণগণ সেই অন্তঃপুরের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন যেন, পরম পূজ্য বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের উপস্থিতি পূর্ণতা এনেছে সেখানে।
রাজপুরীর তৃতীয় কক্ষ হতে সারথি সুমন্ত্রকে বহির্গত হতে দেখা গেল। বসিষ্ঠমুনি, সূতপুত্র সুমন্ত্রকে, রাজা দশরথের অবগতির জন্যে জানালেন যে, রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের যাবতীয় পবিত্রসামগ্রী—সিংহাসন, ব্যাঘ্রচর্ম, যজ্ঞাগ্নির সমিধকাঠ,অগ্নি ছাড়াও আটজন সুতনুকা কন্যা, আভরণসজ্জিতা বিবাহিতা নারী ও নৃত্যগীতে নিপুণা অনেক বারাঙ্গনা আনা হয়েছে।সেখানে মুখ্য আচার্য, ব্রাহ্মণ, গাভী, পক্ষী, পুরমুখ্যরা, জানপদপ্রধানগণ, রাজাগণ ও স্বজনসহ বণিকরা এবং প্রিয়ভাষী অনেক শুভাকাঙ্খী ব্যক্তি অভিষেকদর্শনের নিমিত্ত প্রফুল্লচিত্তে অবস্থান করছেন।
ত্বরয়স্ব মহারাজং সমুদিতেঽহনি। পুষ্যে নক্ষত্রযোগে চ রামো রাজ্যমবাপ্নুয়াৎ।। রাজাকে সত্বর জানাও আজ রামের যৌবরাজ্যাভিষেকের পুষ্যানক্ষত্রযোগে নির্ধারিত দিন। রাজান্তঃপুরে বৃদ্ধ সারথি সুমন্ত্রর অবারিতদ্বার।কী দেখলেন তিনি? রাজার দর্শনার্থী সুমন্ত্র শোকে, দুঃখে বিধ্বস্ত রাজা দশরথকে দেখে, অবাকবিস্ময়ে, হয়তো রাজার মনে প্রসন্নতা সৃষ্টির জন্যে মনোহরণ স্তুতি শুরু করলেন। সুন্দর বচনে রাজাকে উজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন।
রাত্রি প্রভাত হল, উদীয়মান সূর্য, পুষ্যনক্ষত্রযোগের সেই মুহূর্ত সমাগতপ্রায়। বসিষ্ঠমুনি শিষ্যপরিবৃত হয়ে অভিষেক সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হলেন। অযোধ্যা নগরী তখন অগরুচন্দনের সুগন্ধে আমোদিত। জলসিক্ত রাজপথের বিপণিগুলো অভিষেক উপলক্ষ্যে সমৃদ্ধ, পতাকাশোভিত পথঘাট, জনগণের জনজোয়ারের কোলাহলমুখর। ইন্দ্রপুরীর মতো সুশোভিত রাজভবনের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন মহামুনি বসিষ্ঠ। সেখানে পুরবাসী, জনপদবাসীদের জমায়েত, ব্রাহ্মণগণ সেই অন্তঃপুরের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন যেন, পরম পূজ্য বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের উপস্থিতি পূর্ণতা এনেছে সেখানে।
রাজপুরীর তৃতীয় কক্ষ হতে সারথি সুমন্ত্রকে বহির্গত হতে দেখা গেল। বসিষ্ঠমুনি, সূতপুত্র সুমন্ত্রকে, রাজা দশরথের অবগতির জন্যে জানালেন যে, রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের যাবতীয় পবিত্রসামগ্রী—সিংহাসন, ব্যাঘ্রচর্ম, যজ্ঞাগ্নির সমিধকাঠ,অগ্নি ছাড়াও আটজন সুতনুকা কন্যা, আভরণসজ্জিতা বিবাহিতা নারী ও নৃত্যগীতে নিপুণা অনেক বারাঙ্গনা আনা হয়েছে।সেখানে মুখ্য আচার্য, ব্রাহ্মণ, গাভী, পক্ষী, পুরমুখ্যরা, জানপদপ্রধানগণ, রাজাগণ ও স্বজনসহ বণিকরা এবং প্রিয়ভাষী অনেক শুভাকাঙ্খী ব্যক্তি অভিষেকদর্শনের নিমিত্ত প্রফুল্লচিত্তে অবস্থান করছেন।
ত্বরয়স্ব মহারাজং সমুদিতেঽহনি। পুষ্যে নক্ষত্রযোগে চ রামো রাজ্যমবাপ্নুয়াৎ।। রাজাকে সত্বর জানাও আজ রামের যৌবরাজ্যাভিষেকের পুষ্যানক্ষত্রযোগে নির্ধারিত দিন। রাজান্তঃপুরে বৃদ্ধ সারথি সুমন্ত্রর অবারিতদ্বার।কী দেখলেন তিনি? রাজার দর্শনার্থী সুমন্ত্র শোকে, দুঃখে বিধ্বস্ত রাজা দশরথকে দেখে, অবাকবিস্ময়ে, হয়তো রাজার মনে প্রসন্নতা সৃষ্টির জন্যে মনোহরণ স্তুতি শুরু করলেন। সুন্দর বচনে রাজাকে উজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হলেন।
আরও পড়ুন:
পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৪: এখন আরএএস পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত জলাধার বা ট্যাঙ্কে সহজেই আরও বেশি ঘনত্বে মাছচাষ সম্ভব
আদিত্যঃ সহ চন্দ্রেণ যথা ভূতধরাং শুভাম্। বোধয়ত্যদ্য পৃথিবীং তথা ত্বাং বোধয়াম্যহম্।। চন্দ্র ও সূর্য পৃথিবীর সুপ্ত বোধের জাগরণ ঘটায় তেমনই আমার স্তবে আপনার শুভবোধের উদ্বোধন হোক। তিনি মনে করিয়ে দিলেন প্রিয় রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যাভিষেকের আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। মহর্ষি বসিষ্ঠসহ আমন্ত্রিত ব্যক্তিত্বরা অপেক্ষমান, আপনি অভিষেকের নিমিত্ত আদেশ দান করুন। ক্ষিপ্রমাজ্ঞাপ্যতাং রাজন্ রাঘবস্যাভিষেচনম্ কারণ পালক বিনা পশু, সেনাধিনায়ক ব্যতীত সৈন্যদল, চন্দ্রবিহীন রাত্রি, বৃক্ষহীন গাভীরা যেমন শূন্যতায় ভোগে সেইরূপ রাজার অদর্শনে রাজ্যেরও সেই দশা হয়।
যথা হ্যপালাঃ পশবো যথা সেনা হ্যনায়কাঃ।যথা চন্দ্রং বিনা রাত্রির্যথা গাবো বিনা বৃষম্।।এবং হি ভবিতা রাষ্ট্রং যত্র রাজা ন দৃশ্যতে। সুমন্ত্রের কথার গুরুত্ব অনুধাবন করে শোকাকুল রাজা যেন বেদনার্ত হয়ে ভেঙ্গে পরলেন।
বাক্যৈস্তু খলু মর্ম্মাণি মম ভূয়ো নিকৃন্তসি তোমার বচন যে অন্তঃস্থলে বিদ্ধ করছে আমায়। তিনি বাক্যালাপের শক্তিও হারিয়ে ফেললেন যেন।রাজা নিরুত্তর।হতচকিত সুমন্ত্রকে, সেখানে উপস্থিত মন্ত্রণায় অভিজ্ঞা, রাণী কৈকেয়ী, বললেন— হে সুমন্ত্র, রাজা, রামের অভিষেকজনিত আনন্দে ও উত্তেজনায় বিনিদ্র রজনীযাপনে ক্লান্ত তাই নিদ্রাভিভূত।আপনি দ্রুত সেই যশস্বী রাজপুত্র রামচন্দ্রকে এখানে আনয়ন করুন। সুমন্ত্র রাজা রজনীং রামহর্ষসমুৎসুকঃ। প্রজাগরপরিশ্রান্তো নিদ্রাবশমুপাগতঃ।। এই নিয়ে আর কোন বিচার করবেন না।
তদ্ গচ্ছ ত্বরিতং সূত রাজপুত্রং যশস্বিনম্। রামমানয় ভদ্রং তে নাত্র কার্যা বিচারণা।। বিচক্ষণ সুমন্ত্র, অশ্রুত্বা রাজবচনং কথং গচ্ছামি ভামিনি। রাজার আদেশ বিনা, অনড় তাঁর অবস্থান। মহাশয়া, রাজার আদেশ ছাড়া প্রস্থান করি কীভাবে? অনন্তর রাজা আদেশ করলেন সুমন্ত্রকে—
সুমন্ত্র রামং দ্রক্ষ্যামি শীঘ্রমানয় সুন্দরম্ ওহে সুমন্ত্র আমি প্রিয়দর্শন রামকে দেখতে চাই, শীঘ্র তাঁকে আনয়ন কর।
রাজার আদেশে আনন্দিত সুমন্ত্র বিদায় নিলেও মনে তাঁর চিন্তাস্রোত। এত তাড়াহুড়ো কেন? যুক্তিনিষ্ঠতায় ভাবলেন ধার্মিক রাজা নিশ্চয়ই অবিলম্বে রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যাভিষেক কার্যকর করবার উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই কারণেই হয়তো তাঁর শীঘ্রই রামচন্দ্রকে আনয়নের এই সিদ্ধান্ত।
যথা হ্যপালাঃ পশবো যথা সেনা হ্যনায়কাঃ।যথা চন্দ্রং বিনা রাত্রির্যথা গাবো বিনা বৃষম্।।এবং হি ভবিতা রাষ্ট্রং যত্র রাজা ন দৃশ্যতে। সুমন্ত্রের কথার গুরুত্ব অনুধাবন করে শোকাকুল রাজা যেন বেদনার্ত হয়ে ভেঙ্গে পরলেন।
বাক্যৈস্তু খলু মর্ম্মাণি মম ভূয়ো নিকৃন্তসি তোমার বচন যে অন্তঃস্থলে বিদ্ধ করছে আমায়। তিনি বাক্যালাপের শক্তিও হারিয়ে ফেললেন যেন।রাজা নিরুত্তর।হতচকিত সুমন্ত্রকে, সেখানে উপস্থিত মন্ত্রণায় অভিজ্ঞা, রাণী কৈকেয়ী, বললেন— হে সুমন্ত্র, রাজা, রামের অভিষেকজনিত আনন্দে ও উত্তেজনায় বিনিদ্র রজনীযাপনে ক্লান্ত তাই নিদ্রাভিভূত।আপনি দ্রুত সেই যশস্বী রাজপুত্র রামচন্দ্রকে এখানে আনয়ন করুন। সুমন্ত্র রাজা রজনীং রামহর্ষসমুৎসুকঃ। প্রজাগরপরিশ্রান্তো নিদ্রাবশমুপাগতঃ।। এই নিয়ে আর কোন বিচার করবেন না।
তদ্ গচ্ছ ত্বরিতং সূত রাজপুত্রং যশস্বিনম্। রামমানয় ভদ্রং তে নাত্র কার্যা বিচারণা।। বিচক্ষণ সুমন্ত্র, অশ্রুত্বা রাজবচনং কথং গচ্ছামি ভামিনি। রাজার আদেশ বিনা, অনড় তাঁর অবস্থান। মহাশয়া, রাজার আদেশ ছাড়া প্রস্থান করি কীভাবে? অনন্তর রাজা আদেশ করলেন সুমন্ত্রকে—
সুমন্ত্র রামং দ্রক্ষ্যামি শীঘ্রমানয় সুন্দরম্ ওহে সুমন্ত্র আমি প্রিয়দর্শন রামকে দেখতে চাই, শীঘ্র তাঁকে আনয়ন কর।
রাজার আদেশে আনন্দিত সুমন্ত্র বিদায় নিলেও মনে তাঁর চিন্তাস্রোত। এত তাড়াহুড়ো কেন? যুক্তিনিষ্ঠতায় ভাবলেন ধার্মিক রাজা নিশ্চয়ই অবিলম্বে রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যাভিষেক কার্যকর করবার উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই কারণেই হয়তো তাঁর শীঘ্রই রামচন্দ্রকে আনয়নের এই সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১২: স্বপ্নাদেশের দেবী ভবানী
প্রথম আলো, পর্ব-৭: বিশ্বে মার্শাল আর্ট কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল?
রাজা দশরথের ইচ্ছাকে সম্মান করেছেন প্রজাবর্গ। রামচন্দ্রের যুবরাজরূপে নির্বাচন তাঁর একক সিদ্ধান্ত নয়। মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে রাজার সিদ্ধান্তের এক সামগ্রিক অনুমোদন যেন। রামচন্দ্র প্রজাদের অতিপ্রিয় কুমার। তাই অন্য কোন বিকল্প চিন্তা তাঁদের মনে ঠাঁই পায়নি। রাজা তাঁর সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করতে আগ্রহী হয়েছেন। তাঁর দুঃস্বপ্নের উল্কাপাত যেন পৃথিবীর অযোধ্যাভূমিতে নক্ষত্রপতনের ইঙ্গিত। রাজার আশঙ্কা, তাঁর বুদ্ধিবিভ্রম হতে পারে। তাঁর তাড়া সেই কারণে। কেন এই আশঙ্কা? তিনি কোন সত্য গোপন করছেন নাতো?রাজা দশরথের দ্বিতীয় পুত্র ভরত। যিনি আছেন মাতুলালয়ে। সে জ্যেষ্ঠ রামের অনুগত। তাঁর অনুপস্থিতিতে জ্যেষ্ঠর এই রকম আড়ম্বরপূর্ণ রাজ্যাভিষেকের আয়োজন। কেন? পিতা দশরথ কী তাঁকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন? এ সন্দেহ হয়তো অমূলক নয়। একজন আদর্শ রাজা,তিনি বংশপরম্পরায় একটি বিখ্যাত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, যিনি ধার্মিক, তিনি এতটাই ক্ষণভঙ্গুর ব্যক্তিত্বের অধিকারী? রাজা দশরথের এই দোলাচলচিত্ততায় সাধারণ মানুষের ছায়া যেন? তিনি যৌবরাজ্যে অভিষেকের আয়োজন করছেন বিখ্যাত ইক্ষ্বাকুবংশের একজন ভাবি উত্তরসূরী রাজার। তাঁর সিদ্ধান্তের সপক্ষে বিরাট জনসমর্থন রয়েছে, সেক্ষেত্রে তাঁর এই অস্বচ্ছ ব্যবহারে যেন কোন অশুভ ইঙ্গিত?
পিতার অনুগত রামচন্দ্র পিতার আদেশপালনে বশংবদ। জ্যেষ্ঠ রাম যেভাবে অনুগত ভাই লক্ষ্মণকে নির্দ্বিধায় সমানভাবে রাজ্যলক্ষ্মী ভোগের প্রস্তাব দিয়েছেন। হয়তো ভরতভাই উপস্থিত থাকলে তিনিও রামচন্দ্রের এই উদার মহানুভবতায় ধন্য হতেন। রামচন্দ্রের প্রতি প্রজাদের বাচিক শংসাপত্রেই রামের সমদর্শিতা প্রমাণিত হয়েছে। অভিজাত থেকে আভাজন প্রত্যেকে রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের আনন্দে শরিক হয়েছেন। অন্তঃপুরে প্রবেশের পর রাজা দশরথ যে রাজপুরীর অন্দরমহলের রাজনীতির শিকার হয়েছেন এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই কোথাও। প্রভাতবেলায় বৃদ্ধ বিচক্ষণ সুমন্ত্র আবিষ্কার করলেন দুঃখী, শোকে কাতর, ভেঙ্গে পরা রাজা দশরথকে। একটি সাম্রাজ্যের ভিত প্রশাসককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। সেখানে হৃদয়াবেগের, মানসিক দুর্বলতার কোন স্থান নেই। সেই ভিত শক্ত না হলে, প্রশাসনে যে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়, তার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। রাজা দশরথের, তখন, বড় প্রয়োজন, জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রকে। রাজার উত্তরাধিকারী নির্বাচনে, তাঁর নিজের মনের প্রচ্ছন্ন অস্বচ্ছতার মাশুল দিতে হয়েছে অচিরেই, রামায়ণের ঘটনা পরম্পরা তার প্রমাণ।
রাজা দশরথ রামচন্দ্রকে যুবরাজপদে অধিষ্ঠিত করে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শান্তির আশ্বাস পেয়েছিলেন। একজন সুপ্রশাসকের দায়বদ্ধতা পালনের অঙ্গীকার হল, ভাবি প্রজন্মকে একজন সুশাসক উপহার প্রদান। রাজতন্ত্রের শর্তকে মান্যতা দিয়ে সেটাই করতে চেয়েছেন রাজা দশরথ। রামের যৌবরাজ্যাভিষেকে অভিজাত থেকে আপামর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে রাজার ইচ্ছা সম্মানিত হয়েছে। রাজতন্ত্রে শুধুমাত্র নয়, আধুনিক গণতন্ত্রেও একই পারিবারে প্রশাসনক্ষমতা সীমাবদ্ধ রাখবার প্রবণতার রকমফের দেখা যায়। অন্তঃপুরের অন্তরালে কত কি যে পালাবদলের কাহিনি লুকিয়ে থাকে, ইতিহাস তার প্রমাণ।—চলবে।
পিতার অনুগত রামচন্দ্র পিতার আদেশপালনে বশংবদ। জ্যেষ্ঠ রাম যেভাবে অনুগত ভাই লক্ষ্মণকে নির্দ্বিধায় সমানভাবে রাজ্যলক্ষ্মী ভোগের প্রস্তাব দিয়েছেন। হয়তো ভরতভাই উপস্থিত থাকলে তিনিও রামচন্দ্রের এই উদার মহানুভবতায় ধন্য হতেন। রামচন্দ্রের প্রতি প্রজাদের বাচিক শংসাপত্রেই রামের সমদর্শিতা প্রমাণিত হয়েছে। অভিজাত থেকে আভাজন প্রত্যেকে রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের আনন্দে শরিক হয়েছেন। অন্তঃপুরে প্রবেশের পর রাজা দশরথ যে রাজপুরীর অন্দরমহলের রাজনীতির শিকার হয়েছেন এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই কোথাও। প্রভাতবেলায় বৃদ্ধ বিচক্ষণ সুমন্ত্র আবিষ্কার করলেন দুঃখী, শোকে কাতর, ভেঙ্গে পরা রাজা দশরথকে। একটি সাম্রাজ্যের ভিত প্রশাসককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। সেখানে হৃদয়াবেগের, মানসিক দুর্বলতার কোন স্থান নেই। সেই ভিত শক্ত না হলে, প্রশাসনে যে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়, তার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। রাজা দশরথের, তখন, বড় প্রয়োজন, জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রকে। রাজার উত্তরাধিকারী নির্বাচনে, তাঁর নিজের মনের প্রচ্ছন্ন অস্বচ্ছতার মাশুল দিতে হয়েছে অচিরেই, রামায়ণের ঘটনা পরম্পরা তার প্রমাণ।
রাজা দশরথ রামচন্দ্রকে যুবরাজপদে অধিষ্ঠিত করে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শান্তির আশ্বাস পেয়েছিলেন। একজন সুপ্রশাসকের দায়বদ্ধতা পালনের অঙ্গীকার হল, ভাবি প্রজন্মকে একজন সুশাসক উপহার প্রদান। রাজতন্ত্রের শর্তকে মান্যতা দিয়ে সেটাই করতে চেয়েছেন রাজা দশরথ। রামের যৌবরাজ্যাভিষেকে অভিজাত থেকে আপামর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে রাজার ইচ্ছা সম্মানিত হয়েছে। রাজতন্ত্রে শুধুমাত্র নয়, আধুনিক গণতন্ত্রেও একই পারিবারে প্রশাসনক্ষমতা সীমাবদ্ধ রাখবার প্রবণতার রকমফের দেখা যায়। অন্তঃপুরের অন্তরালে কত কি যে পালাবদলের কাহিনি লুকিয়ে থাকে, ইতিহাস তার প্রমাণ।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।