বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আচার্য দ্রোণের প্রশিক্ষণে কুরুপাণ্ডবরা অস্ত্রবিদ্যায় কুশলী হয়ে উঠলেন। আচার্যের শিক্ষা সার্থক কিনা, এ বিষয়ে এবার পরীক্ষা আবশ্যক। মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানালেন দ্রোণাচার্য। রাজন্! সম্প্রাপ্তবিদ্যাস্তে কুমারাঃ কুরুসত্তম!। তে দর্শয়েয়ুঃ স্বাং শিক্ষাং রাজন্ননুমতে তব।। শিক্ষালাভ সমাপ্তপ্রায়। হে কুরুশ্রেষ্ঠ, আপনার অনুমতিক্রমে কুমাররা এবার তাঁদের নিজেদের অস্ত্রবিদ্যাকসরতের মহরা দিতে চায়।

জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র শৌর্যশালী কুমারদের অস্ত্রবিদ্যাকৌশল দেখতে আগ্রহী। তাঁর মনে তাই দুঃখ। তিনি বিদুরকে এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করলেন। ন হীদৃশং প্রিয়ং মন্যে ভবিতা ধর্ম্মবৎসল। কারণ একাধারে সুন্দর ও আনন্দের অনুষ্ঠান এমনটি আর হবে না। রঙ্গমঞ্চ নির্মিত হল। দর্শকদের আহ্বান জানানো হল।

রাজা ও নারীদের জন্যে প্রেক্ষাগৃহ নির্মিত হল। দেশীয় মানুষজন বৃহৎ ও উচ্চতর মঞ্চে উপবিষ্ট হবেন। নারীরা কুমারদের অস্ত্রকৌশলের প্রদর্শনী দেখতে আসবেন ডুলিতে চড়ে। সেই মতো সবকিছুর ব্যবস্থা হল। নির্দিষ্ট দিনে কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র, প্রতিযোগীদের পিতামহ ভীষ্ম, অপর অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য প্রভৃতি সম্মানীয় দর্শকবৃন্দের সঙ্গে বহুমূল্য, স্বর্ণময়, মুক্তাখচিত, দর্শকগৃহে আসন গ্রহণ করলেন। দুইমাতা, শতপুত্রবতী গান্ধারী ও পঞ্চপান্ডব মাতা কুন্তী ও রাজপুরীর অন্যান্য রমণীগণ, দাসীগণ পরিবৃত হয়ে মঞ্চে অধিষ্ঠিতা হলেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চারবর্ণের উৎসাহী দর্শনার্থীরা ভিড় জমালেন সেখানে। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে বহু দর্শনার্থীরা,কুমারদের চমকপ্রদ অস্ত্রকৌশল দর্শনেচ্ছায় অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে উপস্থিত হলেন রঙ্গভূমিতে। সবশেষে এলেন শুভ্রবসনে সজ্জিত, শুক্লশ্মশ্রু ও কেশবিশিষ্ট, শ্বেত উপবীতে শোভিত, শুভ্রমাল্য ও অনুলেপনধারী কুমারদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য।

পূজনীয় দ্রোণাচার্যের ইষ্টদেবতার পূজা সমাপনান্তে মাঙ্গলিক স্বস্তিবচন উচ্চারণ করলেন ব্রাহ্মণরা। রাজা ধৃতরাষ্ট্র, দুই অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে, বহুমূল্য রত্ন ও বস্ত্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করলেন।

জ্যেষ্ঠত্বের ক্রমানুসারে যুধিষ্ঠির প্রভৃতি কুমাররা তাঁদের নামাঙ্কিত বাণদ্বারা লক্ষ্যবিদ্ধ করতে লাগলেন। দর্শকবৃন্দ বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে কুমারদের সাধু সাধু ধ্বনিতে উৎসাহিত করতে থাকলেন। দর্শকরা অভিভূত হয়ে কী দেখলেন? কেউ বাণনিক্ষেপের নানান কৌশলে পারদর্শী, কেউ বা রথসঞ্চালনায় তুখর, কোন কুমার আবার অশ্ব ও গজারোহণে দক্ষ, বাহুযুদ্ধের নানা প্রণালীতে রপ্ত কেউ, কেউ বা অসিচালনার নৈপুণ্যে মুগ্ধ করলেন দর্শকদের। সবমিলিয়ে দর্শনার্থীরা, বিমুগ্ধতায় দেখে চললেন কুমারদের অসিচালনার দ্রুততা, নৈপুণ্য, দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য, স্থৈর্য, মুষ্টিবদ্ধহাতে তরোয়ালকে বশে রাখবার কৃতিত্ব। লাঘবং সৌষ্ঠবং শোভাং স্থিরতাং দৃঢ়মুষ্টিতাম্। দদৃশুস্তত্র সর্ব্বেষাং প্রয়োগং খড়্গচর্ম্মণোঃ।।
সবশেষে রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করলেন পরস্পর বিদ্বেষভাবাপন্ন, দুই পুরুষাকারের প্রতীক, কুরু ও পাণ্ডব ভ্রাতৃদ্বয়, দুর্যোধন ও ভীম। মদমত্ত হাতির মতো দুই বীর রঙ্গভূমি জুড়ে কখনও দক্ষিণে কখনও বা বামদিকে বিচরণ করতে লাগলেন। প্রদর্শনীর শুরু থেকেই মাননীয় বিদুর ধৃতরাষ্ট্র, কুন্তী ও গান্ধারীকে কুমারগণের অস্ত্রনৈপুণ্যপ্রদর্শনের ধারাবিবরণী পেশ করেছিলেন।
দর্শকবৃন্দ দুর্যোধন ও ভীম এই দুই বীরের সমর্থনে দ্বিধাবিভক্ত হল। তাঁদের উৎসাহসূচক চিৎকারে মহা কোলাহল সৃষ্টি হল। গুরু দ্রোণাচার্য, পুত্র অশ্বত্থামাকে নির্দেশ দিলেন, সুশিক্ষিত দুই বীরের আচরণ যেন সংযত হয়। তাঁদের দুইজনের অসংযত আচরণের ফলে যেন সাধারণ মানুষ ক্রোধন্বিত না হন। বারয়ৈতৌ মহাবীর্য্যৌ কৃতযোগ্যাবুভাবপি। মাভূদ্রঙ্গে প্রকোপোঽয়ং ভীমদুর্য্যোধনোদ্ভবঃ।। গুরুপুত্র অশ্বত্থামা প্রলয়কালে প্রবলবায়ুবেগে স্ফীত দুই বিশাল তরঙ্গের মতো উদ্ধত ও উদ্যত দুই বীরকে গুরুর নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে দিলেন।

এরপরে দ্রোণাচার্য ঘোষণা করলেন, পুত্র অপেক্ষা প্রিয়তর, সর্বশস্ত্রবিদ, বিষ্ণুতুল্য শৌর্যবান, ইন্দ্রপুত্র অর্জুনের অস্ত্রপ্রয়োগকৌশল প্রদর্শনের পালা এবার। আপনারা দেখুন। যো মে পুত্রাৎ প্রিয়তরঃ সর্ব্বশস্ত্রবিশারদঃ। ঐন্দ্রিরিন্দ্রানুজসমঃ স পার্থো দৃশ্যতামিতি।। অস্ত্রশস্ত্রেসজ্জিত অর্জুন রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হলেন। উপস্থিত দর্শকবৃন্দ অর্জুনের অস্ত্রনৈপুণ্য দর্শনের আশায় ব্যাকুল হয়ে শঙ্খ এবং বিভিন্ন বাদ্যধ্বনিতে তাঁকে উৎসাহিত করতে লাগলেন। গুরু তাঁর প্রিয়শিষ্যের পরিচয় দিয়ে বললেন, এষ কুন্তীসুতঃ শ্রীমান্ এষ মধ্যমপাণ্ডবঃ। এষ পুত্রো মহেন্দ্রস্য কুরূণামেষ রক্ষিতা।। এই শ্রীমান মধ্যম কুন্তীপুত্র, পাণ্ডুপুত্র অর্জুন, দেবরাজের ঔরসজাত ইনি কুরুবংশের রক্ষক। এষোঽস্ত্রবিদুষাং শ্রেষ্ঠ এষ ধর্ম্মভৃতাং বরঃ। এষ শীলবতাঞ্চাপি শীলজ্ঞাননিধিঃ পরঃ।। ইনি অস্ত্রবিদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, ধার্মিকদের মধ্যে সর্বোত্তম, চরিত্রবানদের মধ্যে অন্যতম এবং অন্যদের স্বভাব বুঝতেও এর জুড়ি মেলা ভার।

এইসব প্রশংসা উক্তি শুনে মা কুন্তীর চোখে আনন্দাশ্রু। অর্জুনের আগমনহেতু, উচ্ছ্বসিত কোলাহলের কারণ জানতে উৎসুক, প্রীত রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে, বিদুর জানালেন, পাণ্ডুপুত্র অর্জুনের রঙ্গভূমিতে প্রবেশই, এই গুরুতর কোলাহলের কারণ। ধৃতরাষ্ট্র আনন্দিতচিত্তে বললেন, হে মহামতি বিদুর, কুন্তী যেন যজ্ঞাগ্নি উৎপাদনের অরণি অর্থাৎ কাঠ যা থেকে উৎপন্ন হয়েছেন তিনজন অগ্নিতুল্য পাণ্ডব, যাঁদের আবির্ভাবে আমি ধন্য, কৃতার্থ এবং রক্ষিত বোধ করছি। ধন্যোঽনুগৃহীতোঽস্মি রক্ষিতোঽস্মি মহামতে। পৃথারণিসমুদ্ভূতৈস্ত্রিভিঃ পাণ্ডববহ্নিভিঃ।।

অর্জুন তাঁর অস্ত্রপ্রয়োগনৈপুণ্যে চমৎকৃত করে তুললেন সকলকে।তাঁর আগ্নেয়াস্ত্র সৃষ্টি করল আগুন, বারুণাস্ত্রে উদ্ভূত হল জল, বায়ব্যাস্ত্রে বায়ু সৃষ্টি হল, পার্জ্জন্য অস্ত্র দ্বারা জন্ম নিল মেঘ। আগ্নেয়েনাসৃজদ্বহ্নিং বারুণেনাসৃজৎ পয়ঃ। বায়ব্যেনাসৃজদ্বায়ু্‍ং পার্জ্জন্যেনাসৃজদ্ ঘনান্।। ভৌম অস্ত্রের প্রয়োগে ভূতলে প্রবেশ করলেন অর্জুন। তাঁর প্রযুক্ত পার্ব্বত অস্ত্রটি পর্বত সৃষ্টি করল।অন্তর্ধান অস্ত্রবলে অন্তর্হিত হলেন তিনি। মুহূর্তে দীর্ঘাকৃতি, ক্ষণকালেই খর্বাকৃতি, পলকে সারথির ভূমিকায়, এক লহমায় ভূতলে অবতরণ ― এগুলি ছিল অর্জুন প্রদর্শিত নানা অস্ত্রকৌশল।

গুরুর উপস্থিতিতে, প্রিয় শিষ্য, লক্ষ্যভেদের নৈপুণ্যে, যথাযোগ্য শরদ্বারা নির্ধারিত কোমল, সূক্ষ্ম, কঠিন বস্তু বিদ্ধ করতে লাগলেন। বিচরণরত লৌহনির্মিত শূকরের মুখগহ্বরে নিক্ষেপ করলেন পৃথক পাঁচটি বাণ। গাছে ঝুলন্ত গাভীর শৃঙ্গে একুশটি শর প্রবেশ করালেন।অর্জুন ধনুর্বিদ্যা ও অসিচালনায় সমান দক্ষতা প্রদর্শন করলেন। শেষে গদাযুদ্ধে পারদর্শিতা দেখানোর লক্ষ্যে মণ্ডলাকার রঙ্গভূমি পরিক্রমণ শুরু করলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২৮: শ্রীরামচন্দ্রের যৌবরাজ্যাভিষেক —প্রাচীন ভারতের রাজতন্ত্রে উদার মুক্তচিন্তার আবহ? না রাজাদের স্বেচ্ছাচার?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৩: সব জলাধারকে মাছ চাষের আওতায় আনলে মাছের ফলন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো সম্ভব

আস্তে আস্তে কোলাহল ও বাদ্যে মুখর রঙ্গভূমিতে সমবেত উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে দ্বারদেশে মহা গুরুগম্ভীর বজ্রপাততুল্য বাহবাধ্বনি বিস্ফোরণের মতো শ্রুত হল। দ্বারদেশে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল দর্শকদের। অবাক বিস্মিত দৌবারিকদের প্রদর্শিত পথে রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করলেন কর্ণ।কে তিনি? তাঁর অঙ্গে ছিল দেবদত্ত কবচ ও কর্ণে কুণ্ডলদ্বয়। তিনি দেবী কুন্তীর কুমারী অবস্থার পুত্র। কর্ণ, সূর্যের ঔরসজাত। পৃথা কুন্তীপুত্র কর্ণ, ধনু ও তরবারিধারী পাদচারী পর্বতের মতো, তিনি চলেছেন রঙ্গভূমিতে। যশস্বী কর্ণ স্বনামে খ্যাত, শত্রুদমনে সক্ষম, সূর্যতুল্য দীপ্তিমান, সৌন্দর্যে চন্দ্রতুল্য, অগ্নির মতো তাঁর ঔজ্জ্বল্য। স্বর্ণময় তালবৃক্ষের মতো উন্নত, পশুরাজের মতো দৃঢ়, বলিষ্ঠ শারীরিক গঠন তাঁর।

এই সুন্দর যুবকটি কৃপাচার্য ও দ্রোণাচার্য এই গুরুদ্বয়কে প্রণাম জানালেন। রঙ্গভূমির প্রত্যেকে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভায় নিশ্চল হয়ে,তাঁর প্রতি স্থির নিবদ্ধ দৃষ্টিতে, প্রবল কৌতূহলে, উদ্বেলচিত্তে, ভাবলেন, কোঽয়মিত্যাগতক্ষোভঃ কৌতূহলপরোঽভবৎ। জন্মসূত্রে অর্জুনের প্রকৃত ভ্রাতৃপরিচয় কর্ণের অজ্ঞাত। তিনি প্রতিযোগীসুলভ প্রতিস্পর্ধায় অর্জুনকে বললেন, পার্থ! যত্তে কৃতং কর্ম্ম বিশেষবদহং ততঃ। করিষ্যে পশ্যতাং নৃণাং মাত্মনা বিস্ময়ং গমঃ।। হে পৃথাসুত অর্জুন, তুমি যা কৃতিত্ব দেখিয়েছ তার থেকেও বিশেষ কিছু আমি দেখাব। কাজেই নিজের কৃতিত্বেই শুধু আশ্চর্য হয়োনা। অর্জুন ক্রুদ্ধ ও লজ্জিত হলেন। গুরু দ্রোণাচার্যের অনুমতিক্রমে কর্ণ, অর্জুনকৃত যত অস্ত্রকৌশল প্রয়োগ করে দেখালেন। দুর্যোধন মহানন্দে কর্ণকে আলিঙ্গনে বদ্ধ করে অভিনন্দন জানালেন। স্বাগতং তে মহাবাহো! দিষ্ট্যা প্রাপ্তোঽসি মানদ!। হে মহাবাহু, তোমায় স্বাগতসম্ভাষণ জানাই। হে মানদানকারী সৌভাগ্যক্রমে তোমায় পেয়েছি। অহঞ্চ কুরুরাজ্যঞ্চ যথেষ্টমুপভুজ্যতাম্।। আমার সঙ্গ ও এই কুরুরাজ্য যথেচ্ছভাবে ভোগ কর। কর্ণ, দুর্যোধনের বন্ধুত্ব স্বীকার করে নিলেন। জানালেন, অর্জুনের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে তিনি আগ্রহী। দ্বন্দ্বযুদ্ধঞ্চ পার্থেন কর্ত্তুমিচ্ছাম্যহং প্রভো! ক্রুদ্ধ অর্জুন, অনাহূত কর্ণের রণ আহ্বানের উত্তরে তাঁকে বধ করবেন বলে হুঙ্কার দিলেন।কর্ণ জানালেন, বৃথা তোমার এ যুক্তি, হে ফাল্গুন অর্জুন, রঙ্গভূমিতে সকলের সমান অধিকার। রঙ্গোঽয়ং সর্ব্বসামান্যঃ কিমত্র তব ফাল্গুন! প্রবল শৌর্যশালী ধার্মিক রাজারাও বলের অনুসরণ করে থাকেন।

কর্ণ বাণদ্বারা প্রত্যুত্তর প্রত্যাশা করেন, শরৈঃ কথয় ভারত! তিনি গুরুর সম্মুখে অর্জুনের শিরশ্ছেদ করবেন। গুরোঃ সমক্ষং যাবত্তে হরাম্যদ্য শিরঃ শরৈঃ। গুরুর নির্দেশে অর্জুন, ভ্রাতাদের সঙ্গে কর্ণের সম্মুখে এগিয়ে গেলেন। কর্ণও যুদ্ধে প্রস্তুত। ভ্রাতাদের সঙ্গে নিয়ে দুর্যোধন আছেন,তাঁর সমর্থনে। ভীষ্ম এবং গুরুদ্বয় রয়েছেন অর্জুনের পক্ষে। রঙ্গভূমির দর্শকবৃন্দ দুই বীরের সমর্থনে দ্বিধাবিভক্ত। দেবী কুন্তী পুত্র কর্ণকে চিনতে পারলেন, সংজ্ঞা হারালেন তিনি। চেতনা ফিরে পেয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ দুই পুত্রকে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেন। দ্বন্দ্বযুদ্ধের নিয়মাবলীতে অভিজ্ঞ, ধার্মিক কৃপাচার্য অর্জুনের যথাযোগ্য পরিচয় জানিয়ে প্রতিযোদ্ধা কর্ণের পরিচয় জানতে চাইলেন। কারণ রাজকুমাররা নিকৃষ্টবংশের এবং হীন আচরণ যাঁদের সেইসব মানুষদের সঙ্গে যুদ্ধ করেননা। বৃথাকুলসমাচারৈর্ন যুধ্যন্তে নৃপাত্মজাঃ। কর্ণ লজ্জায় ম্রিয়মাণ হলেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৫: আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে / খুঁজে পেতে আনি খেতে-নয় বড় সিধে সে!…

দুর্যোধন কর্ণের সপক্ষে ক্ষত্রিয়ত্বলাভের তিনটি কারণ উপস্থাপিত করলেন, *তৎকুলীনশ্চ শূরাশ্চ যশ্চ সেনাং প্রকর্ষতি। রাজকুল, বীরত্ব এবং বুদ্ধিবলে সেনাপরিচালনার ক্ষমতা — এই তিনটি ক্ষত্রিয়ত্বের কারণ। অর্জুনের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে কর্ণকে যোগ্য প্রতিপক্ষ করে তুলবার লক্ষ্যে তিনি তৎক্ষণাৎ কর্ণকে অঙ্গরাজ্যের রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। এই অভাবনীয় সম্মানপ্রাপ্তিতে অভিভূত কর্ণ, আপ্লুত হয়ে দুর্যোধনকে প্রত্যুত্তরে বললেন, অস্য রাজ্যপ্রদানস্য সদৃশং কিং দদানি তে। এই রাজ্যদানের সদৃশ কীই বা আমি দিতে পারি তোমায়? দুর্যোধন জানালেন তিনি কেবলমাত্র বন্ধুত্বের প্রত্যাশী। অত্যন্তং সখ্যমিচ্ছামীত্যাহ তং স সুযোধনঃ কর্ণ কথা দিলেন তাই হবে। এবমুক্তস্ততঃ কর্ণস্তথেতি প্রত্যুবাচ তম্। উভয়ে প্রীতি আলিঙ্গনে বদ্ধ হলেন।

ঠিক এই সময়ে যষ্টিহাতে রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করলেন, ঘর্মাবৃত, কম্পমানশরীরে কর্ণের পালক পিতা অধিরথ। কর্ণ তাঁকে দেখে, ধনু পরিত্যাগ করে, অবনতমস্তকে, প্রণাম নিবেদন করলেন। স্নেহাপ্লুত পিতা অধিরথ,অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত কর্ণকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে অভিনন্দিত করলেন। অশ্রুজলে সিক্ত হল তাঁর দুই চোখ। দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম, কর্ণের পরিচয় জেনে প্রবল বিদ্রূপে, তীর্যক উক্তিতে বিদ্ধ করলেন কর্ণকে। ন ত্বমর্হসি পার্থেন সূতপুত্র! রণে বধম্। কুলস্য সদৃশস্তূর্ণং প্রতোদো গৃহ্যতাং ত্বয়া।। যুদ্ধে পার্থকে হত্যা করবার যোগ্যতা তোমার নেই। তুমি বরং তোমার কুলবৃত্তি অশ্বচালনার চাবুকটি গ্রহণ কর। অঙ্গরাজ্যঞ্চ নার্হস্ত্বমুপভোক্তুং নরাধম! হে নরাধম, অঙ্গরাজ্যভোগের যোগ্যও তুমি নও। ক্রোধে কর্ণের ওষ্ঠ কম্পিত হল। তাঁর হয়ে উত্তর দিলেন বন্ধু দুর্যোধন, ক্ষত্রিয়াণাং বলং জ্যেষ্ঠং যোদ্ধব্যং ক্ষত্রবন্ধুনা। শূরাণাঞ্চ নদীনাং দুর্বিদাঃ প্রভবাঃ কিল।। ক্ষত্রিয়দের বলই শ্রেষ্ঠ। ক্ষত্রিয়ের বন্ধুর সঙ্গেও যুদ্ধ হতে পারে।আর,নদী ও রাজা উভয়ের উৎস জানা দুষ্কর। বহু পৌরাণিক দৃষ্টান্ত এবং দুই গুরু দ্রোণ এবং কৃপের জন্মের অদ্ভুত উৎসের নজির তুলে ধরলেন তিনি। কর্ণের জন্ম পরিচয় অজ্ঞাত।

এই কবচকুণ্ডলযুক্ত, সুলক্ষণান্বিত, সূর্যের ন্যায় তেজস্বী, ব্যাঘ্রতুল্য কর্ণকে হরিণীর মতো কোনও সধারণ নারী কী করে জন্ম দিতে পারেন? সকুণ্ডলং সকবচং সর্ব্বলক্ষণলক্ষিতম্। কথমাদিত্যসদৃশং মৃগী ব্যাঘ্রং জনিষ্যতি।। কর্ণের যোগ্যতা বিষয়ে সকলকে আশ্বস্ত করে দুর্যোধন ঘোষণা করলেন, পৃথিবীরাজ্যমর্হোঽয়ং নাঙ্গরাজ্যং নরেশ্বরঃ। এই নরেন্দ্র কর্ণ, শুধু অঙ্গরাজ্য নয়, পৃথিবীজোড়া রাজ্যভোগের যোগ্য। রঙ্গভূমিতে তাঁর ক্ষত্রিয়োচিত তেজের প্রকাশে কেউ সাধুবাদ জানালেন, কেউ আসন্ন শত্রুতার বিপদসম্ভাবনায় হাহাকার করে উঠলেন।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৬: অ্যালেন, দেখলেন, খেলেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

ইতিমধ্যে সূর্য অস্তাচলে গমন করেছেন। দুর্যোধন সদ্যবন্ধুত্বের সম্মানে কর্ণের হাত ধরে প্রস্থান করলেন, বিদায় নিলেন পাণ্ডবগণ, কুরুমুখ্যরা এবং গুরুদ্বয়। এই অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনীর রঙ্গভূমির তিন কেন্দ্রীয় চরিত্র অর্জুন, কর্ণ এবং দুর্যোধন – দর্শকবৃন্দের আলোচনার বিষয় হলেন।কী প্রতিক্রিয়া হল তাঁদের? জনতা তিন যোদ্ধার প্রশংসায় একমত হতে পারলেন না।পাণ্ডবমাতা কুন্তী লক্ষণ দেখে, হারানো পুত্রকে খুঁজে পেলেন। সেই পুত্র, কর্ণের, অঙ্গরাজ্যপ্রাপ্তিতে আনন্দিত হলেন তিনি। কর্ণপ্রাপ্তিতে, দুর্যোধন প্রতিপক্ষ অর্জুনের প্রতিরোধ বিষয়ে,নিশ্চিন্ত হলেন। তাঁর অর্জুনজনিত ভয় অন্তর্হিত হল। অস্ত্রবিদ্যাবিদ কর্ণ, নতুন বন্ধু দুর্যোধনের সঙ্গে প্রিয়বাক্যে আলাপচারিতায় রত হলেন। শুধু যুধিষ্ঠিরের ধারণা হল, পৃথিবীতে কর্ণতুল্য প্রকৃত ধনুর্ধর বীর আর নেই। যুধিষ্ঠিরস্যাপ্যভবত্তদা মতির্ন কর্ণতুল্যোঽস্তি ধনুর্দ্ধরঃ ক্ষিতৌ।

আধুনিক যুগে, একটি পরীক্ষাকেন্দ্র যেমন অনেক উত্থানপতনের, অনেক অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়, অনেকটা যেন সেইরকমই চিত্রের সূচনা হল কুরুপাণ্ডবদের গুরুদ্বয়ের পরিকল্পিত অস্ত্রবিদ্যাপ্রদর্শনীর রঙ্গভূমিতে। এখানে উদ্যোগটি প্রথমে ছিল সদর্থক, পরে অংশগ্রহণকারীদের অস্ত্রবিদ্যাপ্রদর্শন থেকেও প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ মনোভাবের প্রভাবে এক অশুভ পরিণতির দিকে মোড় নিল ঘটনাক্রম। জাতপাতের বিভেদ, চুলচেরা বিচার, অনেক শত্রুতার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। এখানেও সেটাই হয়েছে। অন্তরালে শত্রুতার চোরাস্রোত চলতেই থাকে। সুযোগসন্ধানী অশুভশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যোগ্যযোদ্ধা কর্ণ, দুর্যোধনের বন্ধুত্বের দাবীতে সাড়া দেন, অশুভ আঁতাত গড়ে ওঠে তাঁদের দুজনের। শিষ্যত্বগ্রহণের সময়ে, গুরু, সূতপুত্ররূপে কর্ণকে, প্রত্যাখ্যান করেননি। পরশুরাম ক্ষত্রিয়বিদ্বেষের কারণে হয়তো কর্ণের পরিচয় জেনে, আংশিকভাবে, শর্তসাপেক্ষ ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা দান করেছিলেন এবং মিথ্যাচারের শাস্তিস্বরূপ তাঁকে আশ্রম থেকে বিদায় দিয়েছিলেন। দ্রোণাচার্যের সম্মুখে, তাঁর অনুমতিক্রমে, কর্ণ, অর্জুনের মতোই যা কিছু প্রদর্শনযোগ্য অস্ত্রবিদ্যার কৌশল পরিবেশন করেছিলেন। কিন্তু পুত্রের থেকেও প্রিয় অর্জুনের পারদর্শিতায় কেউ প্রতিস্পর্ধা দেখাচ্ছেন, সেটি বোধহয় দ্রোণাচার্যের অভিপ্রেত ছিল না। তাই তাঁকে নিরপেক্ষভূমিকায় নিশ্চুপ থাকতেই দেখা যায়। কৃপাচার্য জাতপাতের দোহাই দিয়ে হয়তো দুই বীরের আত্মঘাতী দ্বৈরথে ইতি টানতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া হয়তো আর কোনও উপায় ছিল না তাঁর।

কর্ণ বীর, তাঁর আচরণে প্রথম থেকেই ঔদ্ধত্য ছিল, আর ছিল অর্জুনের প্রতি এক জাতক্রোধ। যদিও অর্জুনের সঙ্গে তখনও তেমন কোন শত্রুতার ঘটনা ঘটেনি। এটিই বোধ হয় তাঁর দুর্বুদ্ধির জন্মদাতা নিয়তি, যিনি আজীবন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন। যোগ্যতার সঙ্গে বিনয় যুক্ত হলে মানুষ সর্বোত্তম হয়ে ওঠে আর এর বিপরীতে যোগ্য ব্যক্তি যদি অযাচিতক্ষমতা লাভ করে, তবে তা দম্ভে পরিণত হয়ে, পতনের সূচনা করে। আজকের জীবনেও জাতপাতের বিভেদ, বহু অশুভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে, ভরতবংশীয়দের সমাজ, তার বিষময় পরিণতি আজও ভোগ করে চলেছে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content