বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

অযোধ্যারাজ দশরথ নিজের বয়সের কথা চিন্তা করে অনুপম গুণান্বিত জ্যেষ্ঠপুত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে ইচ্ছুক হলেন। প্রজাসাধারণের প্রতি করুণাধারাবর্ষণে, লোকপ্রিয়ত্বে, তিনি পিতাকেও অতিক্রম করতে চলেছেন। শৌর্যে ইন্দ্র এবং যমতুল্য অপ্রতিরোধ্য, বৃহস্পতিতুল্য জ্ঞানে, পর্বতের ন্যায় ধৈর্যশালী রামচন্দ্র। বৃদ্ধিকামো হি লোকস্য সর্ব্বভূতানুকম্পকঃ। মত্তঃ প্রিয়তরো লোকে পর্জ্জন্য ইব বৃষ্টিমান্।। যমশক্রসমো বীর্য্যে বৃহস্পতিসমো মতৌ। মহীধরসমো ধৃত্যাং মত্তশ্চ গুণবত্তরঃ।। রাজা দশরথের আন্তরিক কামনা স্বর্গলাভের পূর্বে জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রকে যুবরাজরূপে স্বীকৃতিদান।

রামচন্দ্র একাধারে রাজগণের দুর্লভ গুণাবলীর আধার আবার লৌকিক প্রসিদ্ধ গুণেও অতুলনীয়। পিতা রাজা দশরথ মন্ত্রীগণের কাছে রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠিত করবার অভিলাষ ব্যক্ত করলেন। মন্ত্রীগণ রাজার প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। বিশিষ্ট জনসমক্ষে এ সিদ্ধান্ত জ্ঞাপনে তৎপর হলেন। রাজা দশরথের রাজ্যাধীন নগর ও জনপদবাসী রাজাদের আমন্ত্রণ জানানো হল। শুধু কেকয়রাজ এবং বিদেহপতি জনককে সত্বর জানানো সম্ভব হল না। তাঁদের পরে এই প্রিয়বার্তা শ্রবণ করাবেন মনস্থ করলেন রাজা দশরথ। ন কেকয়রাজানং জনকং বা নরাধিপঃ। ত্বরয়া চানয়ামাস পশ্চাত্তৌ শ্রোষ্যতঃ প্রিয়ম্।।
অতিথিসমাগমের পরে সভাস্থ সমস্ত বিশিষ্ট জনকে সম্মানপূর্বক সম্বোধন করে জলদগম্ভীর অথচ সুমিষ্ট স্বরে চতুর্দিক প্রফুল্লতায় ভরিয়ে দিয়ে রাজা দশরথ ঘোষণা করলেন, ইক্ষ্বাকুবংশের পরম্পরাগত রাজ্যশাসনের মহান ঐতিহ্য এতকাল তিনিই বহন করেছেন। কিন্তু কালক্রমে জরাজীর্ন এই দেহ এখন এই ভারবহনে অক্ষম। তাই সন্নিহিত শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের অনুমতিক্রমে, প্রজাকল্যাণে, এই গুরুভার, সুযোগ্য গুণবান জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রকে সমর্পণ করে ভারমুক্ত অবসর বিনোদনে অবশিষ্ট জীবৎকাল অতিবাহিত করতে চান। সোঽহং বিশ্রামমিচ্ছামি পুত্রং কৃত্বা প্রজাহিতে। সন্নিকৃষ্টানিমান্ সর্ব্বাননুমান্য দ্বিজর্ষভান্।।

কেন জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রকে এই দায়িত্বভার অর্পণে রাজার এই আগ্রহ? কারণ রামচন্দ্র একজন সুযোগ্য উত্তরাধিকারী। অনুরূপঃ স বো নাথো লক্ষ্মীবান্ লক্ষ্মণাগ্রজঃ। ত্রৈলোক্যমপি নাথেন যেন স্যান্নাথবত্তরম্।। লক্ষ্মীমন্ত, জ্যেষ্ঠ, লক্ষ্মণভ্রাতা শুধু আপনাদের রক্ষক হবেন তা নয়, তিনি হবেন ত্রিলোকবাসীরও রক্ষক। তাই রাজা দশরথ পুরুষশ্রেষ্ঠ রামচন্দ্রকে সত্বর প্রাতঃকালেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে চান। যৌবরাজ্যে নিযোক্তাস্মি প্রাতঃ পুরুষপুঙ্গবম্। রাজা দশরথ আরও জানালেন, তাঁর এই প্রস্তাব যদি সঠিক এবং মঙ্গলজনকরূপে গৃহীত হয় তাহলে তা সভার অনুমোদনযোগ্য বিবেচিত হবে। যদিদং মেঽনুরূপার্থং ময়া সাধু সুমন্ত্রিতম্। ভবন্তো মে অনুমন্যন্তাং কথং বা করবাণ্যহম্।। আর যদি তা আমার একক প্রীতিপ্রদ সিদ্ধান্ত মনে হয় তবে তাও বিবেচনার যোগ্য। কারণ মধ্যস্থতার মাধ্যমে পূর্বাপর বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত, প্রকৃত কল্যাণ সাধন করে থাকে। যদ্যপ্যেষা মম প্রীতির্হিতমন্যদ্বিচিন্ত্যতাম্।অন্যা মধ্যস্থচিন্তা তু বিমর্দ্দাভ্যধিকোদয়া।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২৭: মহর্ষি ভৃগু এবং অগ্নির শাপমুক্তি—কাহিনিতে তাত্ত্বিক দিকের অনুসন্ধান

যে উপদেশ গিয়েছি ভুলে…/২

সমবেত রাজারা মেঘদর্শনে উল্লাসিত ময়ূরের মতো পুলকিত হয়ে উঠলেন। জনগণ, রাজার সমর্থনে মধুর হর্ষোল্লাস প্রকাশ করলেন। এরপরে ব্রাহ্মণগণ, সেনাধ্যক্ষরা, পুরবাসী ও জনপদবাসীগণ, ধর্মার্থতত্ত্বজ্ঞ রাজা দশরথের মনোগত অভিপ্রায় অনুধাবন করে রাজা দশরথকে আশ্বস্ত করে বললেন—রাজা বয়োবৃদ্ধ হয়েছেন, তিনি রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করুন।আমরাও গজারূঢ় রাজচ্ছত্রে সুশোভিত রামচন্দ্রকে দেখতে ইচ্ছুক। অনেকবর্ষসাহস্রো বৃদ্ধস্ত্বমসি পার্থিব। স রামং যুবরাজানমভিষিঞ্চস্ব পার্থিবম্।। ইচ্ছামো হি মহাবাহুং রঘুবীরং মহাবলম্। গজেন মহতা যান্তং রামং ছত্রাবৃতাননম্।। রাজা দশরথ কিন্তু আরও স্পষ্ট সম্মতি প্রত্যাশা করেন। তাঁদের মনোভাব তিনি আরও পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে চান। সমবেত রাজারা শুধুমাত্র রাজা দশরথের ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে রামচন্দ্রকে ভাবি রাজা মনোনীত করেছেন নাতো?কারণ ধার্মিক রাজা দশরথ, চিরকাল ধর্মানুসারেই রাজত্ব করেছেন, তাহলে, তাঁর স্থানে যুবরাজরূপে রামচন্দ্রকে চাইছেন কেন? কথন্নু ময়ি ধর্ম্মেণ পৃথিবীমনুশাসতি। ভবন্তো দ্রষ্টুমিচ্ছন্তি যুবরাজং মহাবলম্।।

রাজগণ,পুরবাসী ও জনপদবাসীগণ একমত হয়ে জানালেন, রামচন্দ্রের গুণের কোন শেষ নেই।প্রজাকল্যাণকর গুণের আধার দেবতুল্য গুণবান, ধীমান, শ্রীরামচন্দ্র। এই কারণেই তিনি জনপ্রিয়, প্রজাদের আনন্দের উৎসই তিনি। কেন? নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে তাঁরা বললেন, রামচন্দ্রের সেইসব গুণ বর্ণনা করছি, শ্রবণ করুন গুণান্ গুণবতো দেব দেবকল্পস্য ধীমতঃ। প্রিয়ানানন্দনান্ কৃৎস্নান্ প্রবক্ষ্যামোঽদ্য তান্ শৃণু।। রামচন্দ্র সত্যবাদী ও সত্যনিষ্ঠ। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজাদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ। তিনি ধর্ম ও অর্থের সামঞ্জস্য বিধান করে চলেন। প্রজাদের আনন্দদানে রামচন্দ্র চন্দ্রতুল্য। ক্ষমাগুণে পৃথিবীর ন্যায় সহিষ্ণু তিনি। বুদ্ধিতে তিনি বৃহস্পতি। শৌর্যে প্রকাশে তিনি ইন্দ্রের মতো বীর্যবান। শুধু তাই নয় রামচন্দ্র ধর্মজ্ঞ, সত্যসন্ধ, সচ্চরিত্র, ক্ষমাশীল, সংযতেন্দ্রিয়, কৃতজ্ঞ, প্রিয়দর্শন, দ্বেষহীন। তিনি শিষ্ট, প্রিয়ভাষী, সত্যদ্রষ্টা, দৃঢ়চেতা, কৃতজ্ঞ, কখনও ব্যাকুলচিত্ত নন তিনি।বহুশ্রুত ব্রাহ্মণদের সেবাপরায়ণ রামচন্দ্র তাই তিনি অক্ষয় যশ ও কীর্তির অধিকারী।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicle

পরিযায়ী মন: নীলনদের দেশে পিরামিড মানে অপার বিস্ময়

রামচন্দ্র সর্বশাস্ত্রবিদ, সঙ্গীতবিদ্যাতেও তিনি পারদর্শী।ক্ষোভ সত্ত্বেও স্থিতধী, ধর্ম ও অর্থশাস্ত্রবিষয়ে তিনি পারঙ্গম। সংগ্রামে সর্বদাই লক্ষ্মণসহ রামচন্দ্রের জয় সুনিশ্চিত। যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনকালে পুরবাসীদের কুশলসংবাদ জেনে নেন। এমনটাই সংবেদনশীল তাঁর হৃদয়।ব্রাহ্মণরা শিষ্যদের দ্বারা যথাবিহিত সেবিত হচ্ছেন কিনা সেটিও তাঁর জিজ্ঞাস্যবিষয়। প্রজাদের দুঃখে দুঃখী এবং তাঁদের অভ্যুদয়ে পিতার ন্যায় পরিতুষ্ট হন তিনি। রামচন্দ্র যুক্তিপূর্ণ তর্কে বিশ্বাসী, অযথা কলহ পরিহার করেন তিনি। প্রজাপালনে তাঁর যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। শুধু পৃথিবী নয় ত্রিলোক শাসনের সামর্থ্য তাঁর আছে। অবধ্যজন তাঁর ক্রোধের বিষয় নয়, শুধুমাত্র বধ্যদেরই তিনি দণ্ডাদেশ দান করে থাকেন। রামচন্দ্রের ক্রোধ ও সন্তোষ কখনও নিষ্ফল হয় না।

পৃথিবী এইরূপ সূর্যকিরণের ন্যায় গুণালোকে সমৃদ্ধ লোকপালতুল্য রামচন্দ্রকে পতিরূপে প্রার্থনা করেছেন। সমবেত রাজারা দশরথকে জানালেন, দেব, দানব, উরগ, মানব, সকলে একযোগে আপনার ভাগ্যবান পুত্রটির শারীরিক বল, আরোগ্য ও আয়ু কামনা করেন। পুরবাসী, রাষ্ট্রবাসী, জনপদবাসী, অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ নির্বিশেষে সকল ব্যক্তি, এমন কি বৃদ্ধা ও যুবতীগণও সকালসন্ধ্যা সমাহিতচিত্তে রামচন্দ্রের নির্বিঘ্ন অভিষেককামনায় দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেন। তাঁদের এই শুভেচ্ছা সার্থক হোক।সকলে জানালেন শত্রুদমনকারী ইন্দীবর শ্যাম রামচন্দ্রকে যুবরাজরূপে দর্শন করতে সকলেই আগ্রহী।আপনি দেবতুল্য, সর্বলোকের কল্যাণকামী,ঔদার্যে মহান পুত্রটিকে আনন্দসহকারে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করে আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৪: মুহূর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে, আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে

রাজা দশরথের সিদ্ধান্তকে সাদরে গ্রহণ করেলেন অভিজাত থেকে আভাজন, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। তাঁরা রামচন্দ্রের ভাবি রাজপদের যোগ্যতাবিষয়ে একমত। আশংসতে জনঃ সর্ব্বো রাষ্ট্রে পুরবরে তথা।আভ্যন্তরশ্চ বাহ্যশ্চ পৌরজানপদো জনঃ।। স্ত্রিয়ো বৃদ্ধাস্তরুণ্যশ্চ সায়ম্প্রাতঃ সমাহিতাঃ। সর্ব্বান্ দেবান্নমস্যন্তি রামস্যার্থে মনস্বিনঃ।। প্রত্যেকে, সমাজের সাধারণ পুরবাসী জনপদবাসী,অন্তরঙ্গজনরা এমন কি বহিরঙ্গের মানুষজন, প্রৌড়া ও যুবতী সকলেই রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যে অভিষেকের কামনায় দেবতাদের কাছে প্রার্থনা জানান। এতটাই তাঁর জনগণের ওপর প্রভাব। সমবেত সভাস্থ রাজন্যবর্গের অকুণ্ঠ সমর্থনে রাজা দশরথ সত্বর অভিষেকায়োজনে মেতে উঠলেন। সেজে উঠল অযোধ্যা নগরী। অতিথিদের সম্মানানুসারে আসনের ব্যবস্থা করা হল। রাজকীয় আড়ম্বর শুরু হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু রামচন্দ্র যখন সভাস্থলে এসে পৌঁছোলেন তখন যেন এক মহোৎসবের সূচনা হল।

পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ দেশের রাজারা, ম্লেচ্ছরাজগণ এবং দূরদেশস্থ রাজবৃন্দ সকলে, সভামধ্যে সমাসীন রাজা দশরথের প্রতি আনুগত্যে, অবনতমস্তকে, পূজ্যরাজাকে সম্মান জানালেন। সভামধ্যে প্রবেশ করলেন প্রিয়দর্শন, রূপবান, ঔদার্যে মহান, যাঁর ব্যক্তিত্বের জনমোহিনী অমোঘ আকর্ষণশক্তি, এমন নয়নাভিরাম রামচন্দ্র। তিনি পিতার কাছে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে উপনীত হয়ে পদবন্দনা করে বললেন, “আমি রাম”। পিতা দশরথ করজোড়ে দণ্ডায়মান রামকে আকর্ষণ করে, আলিঙ্গনপূর্বক মণিসুবর্ণমণ্ডিত আসনে উপবেশনের আদেশ দিলেন। গৃহ্যাঞ্জলৌ সমাকৃষ্য সস্বজে প্রিয়মাত্মজম্। তস্মৈ চাভ্যুদ্যতং সম্যক্ মণিকাঞ্চনভূষিতম্।। নিজের প্রতিচ্ছবি রামচন্দ্রদর্শনে আনন্দোৎফুল্লচিত্তে, অনুরূপ জ্যেষ্ঠভার্যার গর্ভজাত, গুণবান, সুযোগ্য উত্তরাধিকারী, জ্যেষ্ঠপুত্রকে সম্বোধন করে ঘোষণা করলেন, তুমি তোমার নিজগুণে প্রজাপুঞ্জের প্রিয়রূপে যুবরাজপদে মনোনীত হয়েছ। উৎপন্নস্ত্বং গুণৈর্জ্যেষ্ঠো মম রামাত্মজঃ প্রিয়ঃ। ত্বয়া যতঃ প্রজাশ্চেমাঃ স্বগুণৈরনুরঞ্জিতাঃ।। তিনি রাজ্যশাসনবিষয়ে উপদেশ দান করে বললেন, যে রাজা প্রজাপুঞ্জের সহমত হয়ে তাঁদের আনুগত্য লাভ করে রাজ্যপালন করেন, সেই রাজার শুভাকাঙ্খীবৃন্দ, অমৃতলাভে সন্তুষ্ট দেবতাদের মতো, নিঃসংশয়ে রাজ্যসুখ ভোগ করে থাকেন। ইষ্টানুরক্তপ্রকৃতির্যঃ পালয়তি মেদিনীম্। তস্য নন্দন্তি মিত্রাণি লুব্ধামৃতমিবামরাঃ।। পুষ্যানক্ষত্রযোগে অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন হবে স্থির হল।

রামমাতা কৌশল্যার কাছে শুভবার্তা পৌঁছে গেল। পিতাকে অভিবাদন করে রামচন্দ্র প্রস্থান করলেন। প্রজামণ্ডল অভীষ্টসিদ্ধির আনন্দে রাজা দশরথকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে, আনন্দ সহকারে, রামের হিতাকাঙ্খায়, কার্যোদ্ধারের নিমিত্ত আরাধ্যদেবতার অর্চনায় ব্রতী হলেন। তে চাপি পৌরা নৃপতের্বচস্তৎ শ্রুত্বা তদা লাভমিবেষ্টমাশু। নরেন্দ্রমামন্ত্র্য গৃহাণি গত্বা দেবার সমানর্চ্চুরভিপ্রহৃষ্টাঃ।।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

রামচন্দ্র রামায়ণে অশেষ গুণের আধার, যা একজন ভাবি রাজার কাছে কাঙ্খিত, সব গুণগুলিই তাঁর আছে। রাজা দশরথ তাঁকে যুবরাজরূপে ঘোষণা করেছেন শুধুমাত্র নিজের স্নহপূর্ণ হৃদয়বৃত্তির টানে নয়, তাঁর নির্বাচন যে সঠিক তার সপক্ষে সভার সার্বিক সমর্থন গ্রহণ করেছেন। অপরিসীম দূরদর্শিতায় তিনি একক সিদ্ধান্ত নিয়ে রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবার সিদ্ধান্তে উপনীত হননি। রাজতন্ত্রেও যে প্রজানুমোদন প্রয়োজন, তা রামায়ণে রামচন্দ্রের যুবরাজরূপে নির্বাচন প্রমাণ করে। এক উদার, মহান রাজনীতির বাতাবরণ যেন ইক্ষ্বাকুবংশের প্রেক্ষিতে রয়েছে, সেখানে হয়তো রাজার স্বেচ্ছাচারিতার কোনঅ স্থান নেই। এই প্রজাপ্রদত্ত সম্মানের মান রেখেছেন রামচন্দ্র তাঁর প্রবাদপ্রতিম রামরাজ্যে, সেখান প্রজাস্বার্থে পারিবারিক জীবন,নিজের আত্যন্তিক সুখভোগের তাগিদ অনুভব করেননি শ্রীরাম। ভুলেছেন প্রিয়পত্নী সীতাকে, সন্তানের প্রতি স্নেহদৌর্বল্য‌ তাঁকে রাজকর্তব্যে বিচলিত করতে পারেনি।

ত্রেতাযুগের রামায়ণে রাজা নির্বাচনে রাজা ও প্রজাদের মতৈক্যের সাযুজ্য মুগ্ধ করে। বৈদিক পরম্পরাতেও, সাধারণ যে রাষ্ট্রশক্তির প্রাণ, তা স্বীকার করা হয়েছে। সেই ট্র্যাডিশন রামায়ণেও হয়তো অনুসৃত হয়েছে। আ ত্বাহার্যমন্তরেধি ধ্রুবস্তিষ্ঠাবিচাচলিঃ।বিশ্বসত্বা সর্বা বাঞ্ছন্তু মা ত্বদ্রাষ্ট্রমধি ভ্রশৎ।। (ঋগ্বেদ: ১০/১৭৩/০১) ঋগ্বেদে প্রজাদের ও রাজার সহমতেই, রাজ্যের স্থিরতা ঘোষণা করা হয়েছে, “হে রাজন! তোমাকে রাজপদে অধিরোপিত করলাম। তুমি এ জনপদের মধ্যে প্রভু হও, অটল অবিচলিত এবং স্থির হয়ে থাক।সকল প্রজাগণ তোমাকে বাঞ্ছা করুক। তোমার রাজত্ব যেন নষ্ট না হয়।

রাজ্যের রাজানির্বাচনে প্রজাদের বা আপামর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি চেয়েছেন রাজা দশরথ। তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে দ্বিধাহীন সমর্থন কামনা করেছেন। প্রজাশক্তিতেই যে রাজ্যের পরম কল্যাণ, তাই রাষ্ট্রশক্তিবৃদ্ধিতে প্রজাদের অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রতি আস্থা রেখেছেন ধার্মিক, রাজধর্মে আস্থাশীল, রাজা দশরথ। স্বৈরাচারে নয়, নিজের মতামত বলপূর্বক মানতে বাধ্য করার মধ্যে রাজপদের সার্থকতা নয়, রাজা তাঁর সিদ্ধান্তে ন্যায়সঙ্গত গণসমর্থন প্রার্থনা করেছেন। অনেকটা সেই “রাজা সবারে দেন মান সে মান আপনি ফিরে পান”—এর মতো। প্রাচীন ভারতের ন্যায়পরায়ণ শাসক এবং শাসিতের, উদার মতাদর্শের সমন্বয়ের চিত্র রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যে অভিষেকসূত্রে পাওয়া যায়। দশরথ রামচন্দ্রের যুবরাজপদে মনোনয়নে বিতর্কের অবকাশ রেখেছেন,এর মধ্যে যুক্তিতর্কের অবকাশ ছিল।প্রজারা একবাক্যে রামচন্দ্রের সপক্ষে গুণাবলীর যে অর্ঘ্য সাজিয়েছেন তা তাঁদের নিঃশর্ত, দ্বিধাহীন আনুগত্যের পরিচয়।

এভাবেই ভারতবর্ষের অন্তরাত্মা একজন সুশাসকের প্রতীক্ষায় সর্বদাই প্রহর গোণে। কখনও সেই শাসক প্রত্যাশাপূরণে সক্ষম হন, কখনও বা পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে কালগর্ভে বিলীন হয়ে যান। আবার রামচন্দ্রের মতো কোন শাসক তাঁদের প্রজানুরঞ্জক ভাবমূর্তি নিয়ে, মহাকাব্যে,সাহিত্যে, চিরকালীন সাক্ষর রেখে যান। অবতাররূপের চালচিত্র ছাড়া রামচন্দ্র সুশাসকরূপে কী সত্যিই এক অনন্য দৃষ্টান্ত? এ বিতর্কিত প্রশ্ন তাত্ত্বিকদের হয়তো যুগান্তরেও চুলচেরা বিশ্লেষণের সুযোগ এনে দেয়।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content