মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রামচন্দ্র পিতাকে জানালেন, তিনি আর এক মুহূর্তের জন্যেও অযোধ্যায় থাকতে রাজি নন। বনগমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রামচন্দ্রের সিদ্ধান্তে, ব্যাকুল হয়ে উঠলেন রাজা দশরথ ও তাঁর পারিপার্শ্বিকের সকলে। রাজা দশরথের পরম হিতৈষী সারথি সুমন্ত্র রানি কৈকেয়ীর প্রতি প্রবল ক্ষোভ ব্যক্ত করলেন। তাঁর চোখদুটি ক্রোধে রক্তিম, ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন সুমন্ত্র। বারবার হাত দুটি নিষ্পেষণ করে, দাঁতে কটকট শব্দ করতে করতে তাঁর ক্রোধ ব্যক্ত করলেন তিনি।

রানি কৈকেয়ী, সমগ্র পৃথিবীর প্রতিপালক স্বামী দশরথকে পরিত্যাগ করেছেন, যাবতীয় কুকর্ম রানির দ্বারা সম্ভব। রানি নিজেকে স্বামীর প্রাণহরণকারিণী এবং কুলটারূপে প্রমাণ করেছেন। তিনি রাজা দশরথকে মর্মাঘাত করেছেন। রাজা দশরথ ইন্দ্রতুল্য অপরাজেয়, পর্বততুল্য তাঁর স্থৈর্য, আর সমুদ্রের ন্যায় সমাহিত। ক্ষোভ ও দুঃখে অবিচল তিনি। কৈকেয়ীর এই নির্মম কাজ তাঁকে আহত করেছে। এমন কাঙ্খিত বরদাতা, ভরণকর্তা স্বামীর অবমাননা করা উচিত নয়। স্ত্রীলোকেদের পুত্রের পক্ষপাতিত্য থেকেও স্বামীর পক্ষাবলম্বন শ্রেয়। ইক্ষ্বাকুকুলের পরম্পরানুসারে জ্যেষ্ঠপুত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে। রানি, স্বামীর জীবদ্দশায় সেই নিয়ম লঙ্ঘন করছেন। হোক, তোমার পুত্র ভরত, রাজা। করুক সে, এই পৃথিবী শাসন। আমরা সেখানেই যাব, যেখানে রাম যাবেন। রাজা ভবতু তে পুত্র ভরতঃ শাস্তু মেদিনীম্। বয়ং তত্র গমিষ্যামো যত্র রামো গমিষ্যতি।। অযোধ্যা আর কোনও ব্রাহ্মণের বাসযোগ্য থাকল না।

এ সব নিন্দিত অমর্যাদার কাজ করে চলেছেন কৈকেয়ী। স্বজনবন্ধু, ব্রাহ্মণ, সজ্জন আমরা সকলে রামের পথ অনুসরণ করব। পরিত্যক্ত নগরী হবে অযোধ্যা। রানি কোন আনন্দ খুঁজে পাবেন সেখানে? এটিই আশ্চর্যের কথা—রানির এ সব কুকার্যের ভার বহন করেও ধরণীর বুক বিদীর্ণ হচ্ছে না কেন? মহর্ষিরা ক্রোধে জ্বলে উঠছেন না? তাঁরা বাক্যের দণ্ডাঘাতের দ্বারা রামের নির্বাসনে উদ্যতা কৈকেয়ীর প্রতি কঠোর হচ্ছেন না কেন?
কেউ কী আমগাছ কেটে ফেলে নিমগাছের যত্ন নেয়? সেই নিমগাছ দুধ দ্বারা সিক্ত করলে কি মধুর হয়? সুমন্ত্রের বিবেচনায় কৈকেয়ীর আভিজাত্য তাঁর মায়ের অনুরূপ। নিমগাছ কি কখনও মধুক্ষরা হয়? এ বচন যে লোকপ্রসিদ্ধ। কৈকেয়ীর মায়ের দুরভিসন্ধি বিষয়ে যা শুনেছেন সেটি তিনি জানালেন। কৈকেয়ীর পিতা কেকয়াধিপতিকে এক ব্রাহ্মণ এক অনন্য বরদান করেছিলেন। সেই বরের প্রভাবে তিনি সকল পশুর বচন বুঝতে পারতেন। একদা কেকয়রাজ, শয্যায় শয়ন করে, জৃম্ভপাখীর কাকলি শুনে, তার অর্থ অনুধাবন করে, আপনমনে হেসে উঠলেন। তখন সেখানে উপস্থিত তাঁর পত্নী, কৈকেয়ীমাতা তাঁর হাসির কারণ জানতে চাইলেন। না জানালে আত্মহত্যা করবেন রানি।

রাজা পত্নীকে বললেন, তাঁর হাসির কারণ জানালে তৎক্ষণাৎ রাজার মৃত্যু অবধারিত। নৃপশ্চোবাচ তাং দেবীং হাসং শংসামি তে যদি। ততো মে মরণং সদ্যো ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ।। রানি নাছোড়বান্দা, *শংস মে জীব বা মা বা ন মাং ত্বং প্রহসিষ্যতি।* বাঁচ বা মর, আমাকে হাসির কারণ বলতেই হবে। রাজা বলেই ফেললেন কারণটি। বরদাতা সাধুপুরুষের কানে গেল সেকথা, রাজা জানালেন তাঁকে। সাধু বিধান দিলেন, স্ত্রীর মরণ হোক বা তিনি ধ্বংস হন, কখনও তাঁর বচনানুসারে কোন কাজ নয়। কেকয়রাজ স্ত্রীকে অগ্রাহ্য করে মুক্তমনে কুবেরের ন্যায় ভ্রমণ করে বেড়াতে লাগলেন। সুমন্ত্রের মতে,ঠিক মায়ের স্বভাবটিই পেয়েছেন দশরথপত্নী কৈকেয়ী।

রানি কৈকেয়ী মোহবশত নিজের অসৎপথে চালিত করছেন রাজাকে। সুমন্ত্রের বিবেচনায়, প্রচলিত প্রবাদানুসারে ছেলেরা পিতার এবং মেয়েরা মায়ের স্বভাব অনুসরণ করে থাকে। এই প্রবাদ, সত্যে পরিণত হল আজ। সুমন্ত্রের উপদেশ, কৈকেয়ী তেমন না হয়ে রাজা দশরথের মতটি মেনে নিন। স্বামীর ইচ্ছাকে মান্যতা দিয়ে সকল লোকের উদ্ধারের কারণ হন। সুমন্ত্রের অনুরোধ —অসৎপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে ইন্দ্রতুল্য প্রভাবশালী লোকপাল, স্বামী দশরথকে অধর্মাচারী করে তুলবেন না। মা ত্বং প্রোৎসাহিতা পাপৈর্দেবরাজসমপ্রভম্। ভর্ত্তারং লোককর্ত্তারমসদ্ধর্ম্মমুপাদধ।। রাজা দশরথের প্রতিজ্ঞা যেন বিফল না হয়। রাম, রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র, উদার, কর্মকুশল, নিজধর্ম-রক্ষক, জীবলোকের রক্ষাকারী এবং বলশালী। তিনিই অভিষিক্ত হন। জ্যেষ্ঠো বদান্যঃ কর্ম্মণ্যঃ স্বধর্ম্মস্যাপি রক্ষিতা।রক্ষিতা জীবলোকস্য বলী রামোঽভিষিচ্যতাম্।। রাম যদি পিতাকে ছেড়ে বনে গমন করেন,তবে রানি কৈকেয়ীর ভয়ানক অপবাদ পৃথিবীতে রটে যাবে।রাম স্বরাজ্য উপভোগ করুন। কৈকেয়ীর উদ্বেগ দূর হোক। রাম বিনা এই পুরী বসবাসের অযোগ্য। রাম যুবরাজপদে অভিষিক্ত হলে, ধর্মসঙ্গতভাবে পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, রাজা দশরথ অরণ্যে গমন করবেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৩: ক্রোধ ও ক্ষমা, কোনটির প্রভাব বেশি? হিংসা ও প্রতিহিংসার ফল কী সুদূরপ্রসারী?

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২: রাজমালা অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, তিনিই ধর্ম মাণিক্য

সুমন্ত্র, কৃতাঞ্জলি হয়ে, একাধারে তীক্ষ্ণ কঠোর এবং মৃদু কোমল কথায় রানি কৈকেয়ীকে ক্ষুব্ধ, ব্যথিত করবার চেষ্টা করলেন।রানি কিন্তু একটুও দুঃখিত হলেন না। তাঁর মুখে বিবর্ণতার কোনও ছায়াই নেই।

বেদনার্ত রাজা দশরথ নিজের প্রতিজ্ঞার জালে জড়িয়ে পরেছেন। শোকার্ত রাজা, সুমন্ত্রকে নির্দেশ দিলেন, রামচন্দ্রের অনুগমনরত, চতুরঙ্গ সেনা যেন প্রস্তুত থাকে। রূপোপজীবিনী গণিকারা, ধনাঢ্য বণিকরা যেন সেই সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যাত্রায় অংশ নেন। যাঁরা জীবিকানির্বাহবিষয়ে রামের ওপরে নির্ভরশীল এবং রাম যাঁদের সঙ্গে শক্তিচর্চায় আনন্দ লাভ করেন তাঁদের অর্থদান করে ওই সৈন্যদলে যুক্ত করবার জন্য যেন প্রস্তুত রাখা হয়।

অরণ্যপথের দিশারী ব্যাধেরা অস্ত্রশস্ত্র যানবাহন-সহ রামের অনুসরণরত হোক।রাম বনপথে হাতী, বন্যপ্রাণী প্রভৃতি শিকার করবেন, বিবিধ নদনদী দর্শনে, বনফুলের মধু পানজনিত আনন্দে, রাজ্যপরিত্যাগের কষ্ট অনুভব করবেন না। বিজনবনবাসী রামের সঙ্গে যায় যেন সঞ্চিত ধান, কোষাগারের ধন। রাম, ঋষিদের সঙ্গে মিলিতভাবে পবিত্রভূমিতে যজ্ঞ করবেন, উদার মনে দক্ষিণা দান করবেন, ঋষিদের সঙ্গে আনন্দে দিন অতিবাহিত হবে তাঁর। মহাবাহু ভরত অযোধ্যা প্রতিপালন করুক, লক্ষ্মীমন্ত রামের কাম্যবস্তুর প্রাচুর্য যেন বজায় থাকে। রাজা দশরথের এই প্রস্তাবে ভীত হলেন রানি কৈকেয়ী। কণ্ঠ রুদ্ধ হল তাঁর, মুখখানি শুকিয়ে গেল।

সন্ত্রস্তা, বিষণ্ণা কৈকেয়ী বললেন, রাজ্যং গতবনং সাধো পীতমণ্ডাং সুরামিব। নিরাস্বাদ্যতমং শূন্যং ভরতো নাভিপৎস্যতে।। পীতসার সুরাতুল্য অনুপভোগ্য ধনহীন অন্তঃসারশূন্য রাজ্যের প্রয়োজন নেই ভরতের। রাজা বিরক্তি প্রকাশ করলেন। একেতো শপথের দুর্বহ ভার আরোপ করেছেন রানি, তার ওপরে রাজাকে এই মর্মভেদী আঘাত, কেন? রাজার প্রারব্ধকাজ সম্বন্ধে পূর্বে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও রানি বাধা দিচ্ছেন কেন? রাজার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে দ্বিগুণ ক্রোধে জ্বলে উঠলেন, রানি। পূর্বপুরুষের দৃষ্টান্ত স্মরণ করিয়ে দিলেন রাজাকে। আক্রমণাত্মক রানি— তবৈব বংশে সগরো জ্যেষ্ঠং পুত্রমুপারুধৎ। অসমঞ্জ ইতি খ্যাতং তথায়ং গন্তুমর্হতি।। তোমার বংশের রাজা সগর, অসমঞ্জ নামে খ্যাত জ্যেষ্ঠপুত্রকে নির্বাসিত করেছিলেন। রাজার আদেশে রামের বনবাস, সেই রকমই। রাজা অস্ফুটস্বরে শুধু ধিক্কার উচ্চারণ করলেন। সমবেত সকলে লজ্জিত হলেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৯: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-ইতিহাস

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৪: নারী দিবস ও শিবরাত্রি

শুধু রানির চৈতন্যোদয় হল না। তখন সিদ্ধার্থ নামে রাজা দশরথের প্রিয়, পূতচরিত্র মন্ত্রী, কৈকেয়ীর যুক্তির বিপক্ষে বললেন, দুষ্ট অসমঞ্জ পথে ক্রীড়ারত শিশুদের সরযূনদীতে নিক্ষেপ করতেন।সেটাই ছিল তাঁর আনন্দ। প্রজারা অভিযোগ জানালেন রাজাকে। হে রাষ্ট্রকল্যাণকারী রাজন্, অসমঞ্জং বৃণীথৈকস্মান্ বা রাষ্ট্রবর্দ্ধন। হয় একা অসমঞ্জকে রাখুন না হয় আমাদেরকে। রাজা অসমঞ্জের দুষ্কর্মের বিবরণ শুনলেন। তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র অসমঞ্জকে নির্বাসনদণ্ড দিলেন। পিতার আদেশানুসারে, অসমঞ্জ, জীবিকানির্বাহের জন্য একটি কুঠার ও পরিচ্ছদ সঙ্গে নিয়ে সস্ত্রীক বনে গমন করলেন। সেখানে পাপী অসমঞ্জ, অতিকষ্টে এক অনিশ্চিত ভ্রাম্যমানজীবন যাপন করতে লাগলেন। রাজা সগরের পুত্রনির্বাসনের সিদ্ধান্ত ছিল প্রজাসুরক্ষার কারণে। রাম কী ক্ষতিকারক পাপকাজ করেছেন যে তাঁকে আপনি নির্বাসিত করবার অনুরোধ জানাচ্ছেন? রামঃ কিমকরোৎ পাপং যেনৈবমুপরুধ্যতে। রামের কোনও দোষ খুঁজে পাওয়া যায়না। কলঙ্কহীন চন্দ্রতুল্য নিষ্কলুষ রামচন্দ্র। রানি কৈকেয়ী কী রামের কোন দোষ দেখেছেন? যে কারণে তাঁকে নির্বাসিত করা যায়?

রামের বনগমনে সিদ্ধান্ত—এক মুহূর্ত আর অযোধ্যায় নয়। পিতার ব্যাকুল আকুতি তাঁর মন বিচলিত করলনা। একটা স্থির সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করে তুলবার দৃঢ়, কঠোর মানসিকতা তাঁর ছিল। রামের জীবনের পূর্ণযৌবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিনিয়ে নিলেন রানি। নাহমর্থপরো দেবি লোকমাবস্তুমুৎসহে। স্বার্থনিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীতে বাস করা রামের অভিপ্রেত নয়। বিমাতার মৃত্যুতুল্য বেদনাদায়ক প্রস্তাবে অকম্পিত থেকে, তিনি দ্বর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন, এবমস্তু গমিষ্যামি বনং বস্তুমহং ত্বিতঃ জটাচীরধরো রাজ্ঞঃ প্রতিজ্ঞামনুপালয়ন্।। সেটাই হবে। তিনি রাজার শপথরক্ষার্থে জটা ও চিরধারণ করে সেখান হতেই বনে গমন করবেন। পিতার সত্যনিষ্ঠার সার্থক রূপায়ণ, তাঁর নিষ্ঠাপূর্ণ কাজে প্রতিফলিত হয়েছে।ক্ষণিকের হৃদয়দৌর্বল্যকে প্রাধান্য দিতে তিনি রাজি নন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৯: বিপরীত পরিস্থিতিতে পালিয়ে যাওয়াটাও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে টিকে থাকার উপায়

এক্ষেত্রে পিতার অনুরোধ তাঁর পিছুটান হয়ে ওঠেনি। কর্তব্য ও স্নেহের আকুতির মধ্যে জয়ী হয়েছে, কর্তব্যনিষ্ঠা। রামকে সিংহাসনের অধিকার হতে বঞ্চনার ক্ষোভ, শুধু পিতা দশরথের নয়, রাজার বিশ্বস্ত সারথি ও সচিব সুমন্ত্র, প্রাজ্ঞ মন্ত্রী সিদ্ধার্থ প্রভৃতি রাজা দশরথের পারিপার্শ্বিক বিজ্ঞ জনেদেরও। তাঁরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। সারথি সুমন্ত্র, যিনি রানির সমালোচনায় মুখর তাঁর মর্যাদা কতটা? রাজা দশরথের একান্ত অনুগত, বিশ্বস্ত মন্ত্রী সুমন্ত্র তাঁর আটজন অমাত্যের অন্যতম। এই অমাত্যদের গুণ তস্যামাত্যা গুণৈরাসন্নিক্ষ্বাকোঃ সুমহাত্মনঃ। মন্ত্রজ্ঞাশ্চেঙ্গিতজ্ঞাশ্চ নিত্যং প্রিয়হিতে রতাঃ।।

সেই অমাত্যরা মন্ত্রণায় অভিজ্ঞ এবং ইঙ্গিত (শারীরিক অভিব্যক্তি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ) বুঝতে অভ্যস্ত এবং সর্বদাই রাজার কল্যাণকামী। রাজা দশরথের প্রিয় মন্ত্রী ও সারথি সুমন্ত্র দেখেছেন, যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত রামের জনসম্বর্ধনা, বিপুল জনপ্রিয়তা। অন্তঃপুর থেকে রাজপথ পর্যন্ত, অভিজাত থেকে আভাজনের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দনের উষ্ণতা তিনি অনুভব করেছেন। রামের জন্মলগ্ন থেকে তিনি তাঁকে জানেন, চেনেন। রাজা দশরথের সুখদুঃখের নিত্যসঙ্গী সুমন্ত্র। তাই রামের প্রতি অবিচার তিনি সহ্য করতে পারেননি। তেমনই বৃদ্ধ রাজার অমর্যাদাও তাঁকে বেদনাহত করেছে। আভিজাত্যের গৌরববোধের মর্মে আঘাত করেছেন তিনি। রাজার সম্মুখে, সুমন্ত্র রূঢ়, কর্কশভাষায় রানি কৈকেয়ীকে তিরস্কার করেছেন। রামের গুণমুগ্ধ সুমন্ত্র, রানির ব্যক্তিগত বংশপরম্পরার সূত্র ধরে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন।

কৈকেয়ীপুত্র ভরতের শাসিত অযোধ্যাবাস তাঁর অভীপ্সিত নয়, যেমন রাজা দশরথের আপামর প্রজাকুল রামের সহযাত্রী হতে চেয়েছেন ব্যাকুল আবেগে, যে আবেগ বাস্তবকে উপেক্ষা করে, শুধু একজন পরম প্রিয়কে কাছে পেতে চায় সেই একই বাস্তবসম্মত আবেগে তিনি রামের নির্বাসন রোধ করতে চেয়েছেন। কৈকেয়ীর মা কেকয়রাজের জীবন উপেক্ষা করে নিজের লঘু জেদরক্ষার সিদ্ধান্তে, অনমনীয়া ছিলেন। সুমন্ত্র কৈকেয়ীর মায়ের অপবাদের বৃত্তান্ত উল্লেখ করে রানিকে চূড়ান্ত অসম্মান করছেন। রানি কিন্তু একটুও ব্যথিত হননি। ক্ষোভতো দূরের কথা, মুখের অভিব্যক্তিতে অবমাননার কোনও ছাপ নেই তাঁর। এমনটাই হয়, মানুষ নিজের দুরভিসন্ধি কার্যকর করবার লক্ষ্যে একরোখা হয়ে ওঠে যখন, তখন কোনও শুভবোধ কাজ করেনা মনে। কৈকেয়ীর প্রতিশ্রুত বরলাভ, প্রজাস্বার্থবিরোধী, রাষ্ট্রকল্যাণের পরিপন্থী।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

বিজ্ঞ মন্ত্রী সুমন্ত্র হয়তো রাজ্যে সুযোগ্য রাজার অভাবে অচলাবস্থা চিন্তা করেছেন। রাজকীয় পরিমণ্ডলে রানির সমালোচনাপ্রসঙ্গে, রানির পিতৃকুলের উল্লেখ করেছেন। এটি হয়তো আভিজাত্যবিরোধী ব্যক্তিগত আক্রমণ। কিন্তু ঘটনার অভিঘাতে মন্ত্রীর এই প্রতিক্রিয়া হয়তো অপ্রত্যাশিত নয়।

স্নেহশীল পিতা দশরথ, পুত্রের স্বাচ্ছন্দ্য চিন্তা করে সারথি সুমন্ত্রকে, রাজকীয় ব্যবস্থাপনার আদেশ দিয়েছেন। রানি কৈকেয়ী, নিজের সন্তানের অস্তিত্বরক্ষায় চিন্তান্বিত হয়ে রাজার এই উদ্যোগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, কুযুক্তির অবতারণা করেছেন। রামের পূর্বপুরুষ পিতাসগরকর্ত্তৃক ইক্ষ্বাকুকুলের কুসন্তান অসমঞ্জের নির্বাসনের সঙ্গে রামের বনে নির্বাসনসিদ্ধান্তের তুলনা করেছেন। প্রজাদের সুরক্ষার কারণে প্রজাস্বার্থরক্ষার্থে অসমঞ্জের নির্বাসন আর প্রজাদের জনমতকে অগ্রাহ্য করে তাঁদের অভীপ্সিত যুবরাজ নিরপরাধ রামকে নির্বাসন? দুটির মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য যে। ক্ষমতার লিপ্সা এভাবেই বিচারবুদ্ধিকে বিভ্রান্ত করে, ঘটনার অপব্যাখ্যা করে,কুযুক্তিবোধে প্ররোচিত করে।

কৈকেয়ীর বিবেকবোধের ওপরে কালো আবরণ। মন্ত্রী, শুভানুধ্যায়ীদের অকপট সমালোচনা, এ সবই চিরকাল ভারতীয় রাজনীতির বাতাবরণ। রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র দুটি ক্ষেত্রেই, ধর্মবোধের কণ্ঠরোধ করে, জনমতকে অগ্রাহ্য করে, আত্মপ্রতিষ্ঠার ঔদ্ধত্য শুধু রাজনীতিতেই সম্ভব। প্রাচীনভারতে রামের নির্বাসনে তেমনই এক ক্ষমতার দম্ভের নির্ঘোষ শোনা যায়। সেখানে নেই কোনও নৈতিকতা, নেই রাষ্ট্রের মঙ্গলচিন্তা, আছে শুধু স্বার্থসিদ্ধির কটু দুর্গন্ধ।রাজনীতিতে স্বচ্ছতা কোন যুগে ছিল কী? এ প্রশ্ন হয়তো থেকেই যায়।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content