শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


পরিচালক অরবিন্দন ও তাঁর আঁকা কার্টুন চিত্র।

কাহিনি বৈশিষ্ট্য: অন্যধারার ছবি (১৯৭৫)
ভাষা: মালয়ালম
প্রযোজনা: পাত্তাতুভিলা করুণাকরণ
কাহিনি: থিক্কোডিয়ান
চিত্রনাট্য সংলাপও নির্দেশনা: জি অরবিন্দন
অভিনয়: ড. মোহনদাস কুঞ্জু, বালন কে নায়ার, আদুর ভাসি, সুকুমারণ প্রমুখ
সময়সীমা: ১১৮ মিনিট
দেখা যাবে: ইউ টিউবে


অন্য ধারার ছবির ক্ষেত্রে পরিচালক অভিনেতা কলাকুশলীদের সঙ্গে প্রযোজকের নামটিও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত। সেভাবে চলচ্চিত্রে এখনও পরিচিত হননি এমন কারও ছবির জন্য অর্থলগ্নি করাটা শুধু সাহসিকতা নয়, ভালো সিনেমার প্রতি তাঁর বা তাঁদের গভীর দায়বদ্ধতাও বটে।

১৯৭৪ সালে তৈরি হয়েছিল মালায়ালাম চিত্রপরিচালক জি অরবিন্দের ছবি উত্তরায়ণম। এই ছবিতে স্বাধীনতা উত্তর ৬০-এর দশক এবং স্বাধীনতা-পূর্ব চল্লিশের দশক তুলনামূলকভাবে বারবার ফিরে এসেছে। বারবার স্পষ্ট হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আদর্শ আত্মবিশ্বাস এবং তীব্র মূল্যবোধের কী ভয়ঙ্কর অধঃপতন ঘটেছে ষাটের দশকে।
জি অরবিন্দনের প্রথম ছবি উত্তরায়ণম। স্বাভাবিকভাবেই তার পূর্বসূরী ভারতীয় চলচ্চিত্রের দুই মহীরূহ সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘কলকাতা ৭১’ ছবি দুটির প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে উত্তরায়ণম ছবিতে। সাদাকালো এই ছবিটি সরাসরি আঘাত করেছে সমাজ জীবনে নিঃশব্দে ঘটে যাওয়া নেতিবাচক পরিবর্তনকে। একসময়ের স্বাধীনতা সংগ্রামীর নতুন স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা তার মেকি দেশাত্মবোধ ও হিপোক্রেসিকে নগ্ন করেছে গোবিন্দন অরবিন্দনের প্রথম ছবি।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: মিথ না মিথ্যা? কোনটা বেশি সিরিয়াস? প্রশ্ন তুলল নওয়াজউদ্দিনের ‘সিরিয়াস মেন’

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩২: ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোয় গঙ্গাসাগর মেলা

ছবির মূলচরিত্র এমএ পাশ বেকার যুবক রবি। সত্যজিতের প্রতিদ্বন্দ্বীর সিদ্ধার্থ বা মৃণাল সেনের ইন্টারভিউয়ের রঞ্জিতের মতোই চাকরি খুঁজছে। যোগ্যতা আছে, কিন্তু সুযোগ হচ্ছে না। তাদের চোখে দেখা আশপাশের বদলে যাওয়া দুনিয়া নিয়েই এই ছবিগুলি আবর্তিত হয়েছে। উত্তরায়ণের রবির চোখে দেখা মানুষজনের কাপট্যের পাশাপাশি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের কথা এসেছে। গান্ধীজির অসহযোগ ও সশস্ত্র বিপ্লবের পটভূমি এসেছে। রবির গান্ধীবাদী দাদুকে দেখে সে বড় হয়েছে। কিন্তু তার বাবা নেতাজি সুভাস শহিদ ভগৎ সিংয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত। সশস্ত্র বিপ্লবে প্রাণ দিয়েছেন। আজকের রবির আদর্শ মাস্টারমশাই কুমারন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৯: নিরুপমা দেবী— তাঁকে নিয়েই গল্প হোক!

কুমারন একসময় তার বাবার সঙ্গেই সশস্ত্র বিপ্লবী ছিলেন। এখন বইপত্র পড়াশোনা নিয়ে থাকেন, মুখোশ আঁকেন। বৃদ্ধা ঠাকুমা বিধবা মা সকলেই রবির একটা চাকরির অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির নায়ক সিদ্ধার্থের প্রেমিকা কেয়া বা উত্তরায়ণমের রবির প্রেমিকা রাধাও অপেক্ষায় থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্র সিদ্ধার্থ বা আশীষ বর্মণের লেখা কলকাতা ৭১ ছবির রঞ্জিত চরিত্রটি কিংবা দক্ষিণের থিক্কোডিয়ান রচিত উত্তরায়ণম ছবির রবি—এদের সকলকেই একইভাবে সামাজিক হতাশা গ্রাস করতে থাকে। অরবিন্দনের ছবির শেষে রবি সামাজিক কপটতার প্রতীক তার হাতের মুখোশটাকে এক আদিবাসী মহিলার পাতা জ্বালানো আগুনে বিসর্জন দেয়। ঠিক যেভাবে ইন্টারভিউ-এর রঞ্জিত ঝকঝকে দোকানের সাজানো কোট প্যান্ট পরা পুতুলকে ছুঁড়ে দেওয়া পাথরের আঘাতে চুরমার করে দিতে চায়।

ছবির একটি বিশেষ দৃশ্য।

আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩০: গিরীশচন্দ্রের মা সারদা

১৯৭৪ সালে উত্তরায়ণম ছবিটি একসঙ্গে ছটি কেরালা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। শ্রেষ্ঠ ছবি (প্রযোজক পাত্তাতুভিলা করুণাকরণ ও পরিচালক জি অরবিন্দন), শ্রেষ্ঠ নির্দেশক জি অরবিন্দন, শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য থিক্কোডিয়ান ও জি অরবিন্দন, শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক মানকাড়া রবি ভার্মা, শ্রেষ্ঠ-সহ অভিনেতা বালান কে নায়ার, শ্রেষ্ঠ আর্ট ডাইরেকশন নাম্বুদ্রি। জাতীয় পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত পুরস্কার দুটি। ভারতের স্বাধীনতার ২৫তম বর্ষপূর্তিতে সেরা ছবি এবং মালালাম ভাষার সেরা কাহিনি চিত্র। ১৯৯১ সালের ১৫ মার্চ মাত্র ৫৬ বছর বয়সে জি অরবিন্দের দেহাবসান ঘটে। ‘৭৪ থেকে ‘৯১ — এই ১৭ বছরব্যাপী চলচ্চিত্র জীবনে জি অরবিন্দন সর্বমোট ১০টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র, পাঁচটি তথ্যচিত্র, দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি এবং একটি টেলিভিশনের জন্য নির্মিত ছবি তৈরি করেছেন।
* মুভি রিভিউ: জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’। বসুন্ধরা এবং… ১ম খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে এই উপন্যাসের ২য় খণ্ড শেষ করে এখন লিখছেন তৃতীয় খণ্ড।

Skip to content