বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছোটবেলায় একটা মজার ধাঁধার সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। একটি সরলরেখা টেনে বলা হত না কেটে না মুছে একবার মাত্র পেনসিল ব্যবহার করে এই রেখাটাকে ছোট করা যাবে কী করে? যারা ছোটবেলা থেকেই খুব বুদ্ধিমান তারা পট করে উত্তরটা করে ফেলত। আর আমার মতো যারা অতি সাধারণ মেধার তারা মাথা চুলকে ডান দিকে তাকাত। বাঁ দিকে তাকাত। তারপর প্রশ্নকর্তা চট করে সেই মজার উত্তরটা দেখিয়ে দিতেন। ছোট লাইনের পাশে একবার মাত্র পেনসিল দিয়ে আরও একটা বড় লাইন করলে আগের লাইনটা ছোট হয়ে যাবে।

এই ধাঁধাটার সঙ্গে একটা খুব বড় শিক্ষা ছোটবেলাতে দেওয়া হয়ে থাকে। অপরের কৃতিত্বকে মুছে না ফেলে কলঙ্কিত না করে ছোট না করে আরও মহান কিছু করতে পারলেই অন্যের থেকে এগিয়ে থাকা যায়। বড় হওয়া যায়। অবশ্য ছোটবেলার অনেক শিক্ষাই ভুলে গেলে তবে বড় হওয়া যায়। এই শিক্ষার মতো আরও অনেক কিছু আমরা ভুলে গিয়েছি। আর এটা আজকের দোষ নয়। মানব জীবনের বহু বহু বছরের দোষ।

মাদুরাই থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নাম্বি নারায়ণনের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল। নাম্বি নারাযণন ১৯৬৬ সালে ইসরোতে টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে ইসরো থেকে তাঁকে আমেরিকার নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে পৃথিবীখ্যাত অ্যারোডিনামিক্স ও রকেটের তরল জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক পুরোধা পুরুষ ইতালিয় ল্যুইগি ক্রোক্কো’র ছাত্র হিসেবে নাম্বি নারায়ণনের এ বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি করার সুযোগ ঘটে।

নাম্বি নারায়ণনের আগে ইসরোতে প্রথাগত জ্বালানি (সলিড প্রোপালশন)-এর প্রচলন ছিল। নাম্বি প্রথম রকেট প্রক্ষেপণে কম খরচায় তরল জ্বালানি ব্যবহার করেন। এই নাম্বি নারায়ণনকে নিয়ে এক অসাধারণ জীবনীধর্মী ছবি করেছেন প্রখ্যাত দক্ষিণী অভিনেতা রঙ্গনাথন মাধবন বা আর মাধবন।
৫২ বছর বয়সী দক্ষিণী ছবির সফল অভিনেতা আর মাধবনকে সর্বভারতীয় দর্শক ‘রং দে বাসন্তী’র মতো অনেক সফল ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ছোট চরিত্রে দেখেছেন। তবে প্রথম আলাদা করে নজরে এলেন মণি রত্নমের ‘গুরু’ ছবিতে সাংবাদিক শ্যাম সাক্সেনা’র চরিত্রে। এরপর তাঁকে দর্শক ভালোবেসে ফেললেন চিত্রপরিচালক রাজকুমার হিরানির সাড়াজাগানো সমকালীন কমেডি ‘থ্রি ইডিয়টস’-র অন্যতম চরিত্রে। এরপর কঙ্গনা রানাওয়াতের সঙ্গে ‘তনু ওয়েডস মনু’ ও ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’-সহ আরও অনেক ছবি এবং ময়াঙ্ক শর্মা পরিচালিত “ব্রিদ’ ওয়েব সিরিজে অসাধারণ অভিনয় করেছেন মাধবন।

পুণে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট-এর বর্তমান সভাপতি আর মাধবন আরও একটি কারণে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে এসেছিলেন। একমাত্র পুত্র বেদান্ত মাধবনের গৌরবে গৌরবান্বিত এক পিতা। ১৮ বছর বয়সী এই সাঁতারু সম্প্রতি দেশের হয়ে মালয়েশিয়ান ওপেনে পাঁচটি সোনা জিতেছিলেন। এর আগে ২০২২ সালে জাতীয় সাঁতারে চারটি সোনা তিনটি রুপো এবং ড্যানিশ ওপেনে সোনা জিতেছিলেন বেদান্ত মাধবন।

আর মাধবন কিন্তু তাঁর নির্দেশিত প্রথম ছবিতেই সাড়া ফেলে দিয়েছেন। ‘রকেট্রি: দ্য নাম্বি এফেক্ট’ সেরা ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছে। পরিচালক হিসেবে এই ছবিকে তিনি কেন বেছে নিলেন? জি টিভির এক সাক্ষাৎকারে মাধবন জানিয়েছেন, ২০১৭-এর আগে অনেকের মতো তিনিও নাম্বি নারায়ণনের নাম শোনেননি। প্রথম এই বিষয় নিয়ে ছবি তৈরির কথা ভাবেন প্রখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক অনন্ত মহাদেবন ও সাংবাদিক সিপি সুরেন্দ্রন। মূল চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল মালয়ালম অভিনেতা মোহনলালের। কিন্তু যেকোনও কারণেই হোক এই ছবির প্রস্তাব সফল হয়নি।

পরে অভিনেতা আর মাধবনকে অনন্ত মহাদেবন এই বিষয়ে তাঁর ছবির ভাবনার কথা বলেন। তাঁর কাছে সেই প্রথম মাধবন শুনলেন ইসরোতে এক সুদর্শন বৈজ্ঞানিকের নাম নাম্বি নারায়ণন। যাঁর সঙ্গে মালদ্বীপের এক সুন্দরীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল বলে অভিযোগ। সেই সুন্দরী মারফত তিনি ইসরোর রকেট গবেষণার গোপন তথ্য পাকিস্তানকে দিয়েছিলেন। এই অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরে এই মানুষটিকে জেলে থাকতে হয়েছে। অমানবিক পুলিশি অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। অপমানিত হতে হয়েছে।
আরও পড়ুন:

রিভিউ: জুটির প্রত্যাবর্তন, মনের জটিলতা নিয়ে সহজ প্রেমের গল্প কিয়ারা-কার্তিকের ‘সত্যপ্রেম কি কথা’

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

শেষমেষ বহু বছর অমানুষিক সামাজিক অত্যাচার ও পারিবারিক ক্ষয়ক্ষতির পর মূলত সিবিআই-এর তৎপরতায় আসল তথ্য উদঘাটন হয়। জানা যায়, এই মানুষটি সম্পূর্ণ নির্দোষ। নাম্বি নারায়ণন সম্বন্ধে এই ঘটনা জানার পর মাধবনের মনে হয়েছিল এই কাহিনি গরিব মানুষের জেমস বন্ডের একটা স্পাই থ্রিলার-এর মতো লাগছে। ছবি করলে মন্দ হয় না। আরও একটু বিশদে জানার জন্যে মাধবন সেই প্রথম নাম্বি নারায়ণনের মুখোমুখি হলেন।

নাম্বি নারায়ণের কাছে তাঁর জীবনকাহিনি শোনার পর মাধবন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এতদিনে এটা প্রমাণ হয়েছে যে, তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। দেশের তথ্য পাকিস্তানের কাছে দিয়ে দেননি এবং ওই মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি গভীর চক্রান্ত করে সাজানো কুৎসা। দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি এটা প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু তিনি দেশের জন্যে ঠিক কী কী করেছেন সেটা তো কেউ জানেন না।

২০১৮ থেকে মাধবন রিসার্চ শুরু করেন এবং প্রথমে গল্প ও চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলেন। কাহিনি ও চিত্রনাট্য নির্মাণে নাম্বি নারায়ণনের আত্মজীবনী মালায়লম ভাষায় ‘ওরমাকালুদেভ্রমনাপদম’ বা এর ইংরেজি অনুবাদ “দ্য অরবিট অফ মেমোরিজ’ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। এই ছবির জন্য গানও লিখেছেন মাধবন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে ছবি পরিচালনা করার কোনও ইচ্ছা তাঁর ছিল না। ছবির শুটিং শুরু হওয়ার মাত্র ২৫ দিন আগে যাঁর ছবি পরিচালনা করার কথা ছিল তিনি সরে দাঁড়ালে মাধবনকে ছবির দায়িত্ব নিতে হয়।

সাক্ষাৎকারে মাধবন জানিয়েছেন, যে কোনও সৃষ্টিতেই একটা পাগলামি লাগে। সেই পাগলামিটা ভয়ঙ্কর পর্যায়ে না পৌঁছলে সৃষ্টি কখনও সার্থক হয় না। তাঁর প্রথম ছবি ‘রকেট্রি: দ্য নাম্বি এফেক্ট’-এর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে। মাধাবনের কথায়, এই ছবিতে কোনও প্রসথেটিক মেকআপ, নকল চুল দাড়ি বা শরীরে প্যাডেড পোশাক খুলে বা পরিয়ে চরিত্রকে রোগা বা মোটা করা হয়নি। ছবির অভিনেতা অভিনেত্রী এবং কলাকুশলীরা মাধবনের এই ছবির প্রতি বিশেষ ভালোবাসাকে বিশ্বাস করেছেন। তাই এমন একটি অসাধারণ ছবি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১০: পর্ব-১০: কী উপহার সাজিয়ে দিলে…

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৭: অ্যাঁ, বলো কী নন্দলাল…!

‘রকেট্রি: দ্য নাম্বি এফেক্ট’ ছবির চিত্রগ্রাহক হলেন বাংলার অত্যন্ত পরিচিত এবং দেশের এক সার্থক ক্যামেরাম্যান শীর্ষ রায়। এই সাক্ষাৎকারে মাধবন জানান, কোনও বাণিজ্যিক সাফল্যের কথা মাথায় রেখে দক্ষিণের সুপারস্টার সূর্য বা শাহরুখকে ছবিতে নেওয়া হয়নি। এই ছবির বিষয়ের সম্বন্ধে ওয়াকিবহল হওয়ার পর তামিল হার্টথ্রব সিংহম, গজনি-সহ সর্বভারতীয় স্তরে সাড়া জাগানো মূল তামিল ছবির সুপার হিরো সর্বানন শিবকুমার ওরফে সূর্য এবং হিন্দি ছবির অবিসংবাদিত বাদশাহ শাহরুখ খান— দু’ জনেই আলাদাভাবে মাধবনকে জানান তাঁরা বিনা পারিশ্রমিকে এই ছবির অংশ হতে চান।

সূর্য এবং শাহরুখ জানিয়েছিলেন, মূল চরিত্র নয় হেঁটে যাওয়া কোনও চরিত্র হলেও তাঁরা করতে রাজি আছেন। মাধবন জানিয়েছেন, এঁদের দু’জনের একজনকেও পারিশ্রমিক দেবার মতো অর্থ তাঁর কাছে ছিল না। তিনি দেনওনি। কিন্তু এঁরা অভিনয় করতে রাজি হতে মূল ছবিটি তিনি যেভাবে ভেবেছিলেন সেই ভাবে প্রায় ৩২ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করতে পেরেছেন। এ পর্যন্ত ছবিটি ব্যবসা করেছে ১০০ কোটি টাকার।

এই ছবির তামিল ভার্সনে অভিনেতা সূর্য এবং হিন্দি ছবিতে শাহরুখ খান নাম্বি নারায়ণনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ছবির শেষ পর্যায়ে এসে বোঝা যায় যে, এই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বলা কথাগুলোই ছবির কাহিনি হয়ে উঠেছে। নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা এই ছবির কাহিনি এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এক অসাধারণ মানবিক ছবি ‘রকেট্রি: দ্য নাম্বি এফেক্ট’। এই ছবিতে পরিচালক নাকি অভিনেতা মাধবান কে বেশি নম্বর পাবেন? সেটা বলা খুব শক্ত।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৮: চোখিধানির জগৎখানি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?

একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। ড. হোমিভাবার অস্বাভাবিকভাবে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল। ড. বিক্রম সারাভাই তাঁর নিজের ঘরে ঘুমের মধ্যে মারা যান। নাম্বি নারায়ণনের ক্ষেত্রে তাঁকে ষড়যন্ত্র করে সামাজিকভাবে শেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় এঁরা তিনজনই ভারতীয় স্পেস রিসার্চ-এর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

হোমি ভাবা ও বিক্রম সারাভাইকে নিয়ে তৈরি ওয়েবসিরিজ ‘রকেট বয়েজ’-এ হোমি ভাবার মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলা হয়েছে। কিন্তু তার কোন তথ্য-প্রমাণ দেখানো হয়নি। বিক্রম সারাভাই এর ক্ষেত্রে মৃত্যুতে শেষ হয়েছে সিরিজ। মাধবন কিন্তু কে বা কারা ভারতীয় পরমাণু গবেষণার সাফল্য চাইছে না, তা বেশ স্পষ্ট করেই দেখিয়েছেন।

এই ছবিটি মন দিয়ে দেখলে সেই সমস্ত অজানা তথ্য স্পষ্ট হয়ে যাবে। নাম্বি নারায়ণনকে চক্রান্ত করে থামিয়ে দিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানে আমাদের দেশকে কেউ বা কারা প্রায় কুড়ি বছর পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। একেবারে হালে ইসরো কমার্শিয়াল রকেট লঞ্চিং-এর যে চুক্তি করেছে তা ছিল কুড়ি বছর আগের স্বপ্ন। অন্য দেশের রকেট মহাকাশে পাঠাতে ইসরো বৈজ্ঞানিক সহায়তা দেবে। আর সেই খাতে সংগৃহীত বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের দেশের মহাকাশ গবেষণায় কাজে লাগবে।

আজ আমরা এক নতুন ভারতের দিকে এগোচ্ছি। তাই আমরা যাঁরা অবিরাম স্বপ্ন দেখার সমালোচনা করি তাঁদের আর স্বপ্ন সত্যি করবে যারা সেই আগামী প্রজন্মের প্রত্যেকের এই ছবিটি দেখা অত্যন্ত জরুরি।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content