মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


 

রিভিউ: শাকুন্তলম্

পরিচালনা: গুণশেখর

অভিনয়: সামান্থা রুথ প্রভু, দেব মোহন, শচীন খেরেকর, অদিতি বালন, আল্লু আরহা, অনন্যা নাগাল্যা, মধু, প্রকাশ রাজ, যিশু সেনগুপ্ত

ভাষা: তেলেগু, তামিল, মালায়লাম, হিন্দি (থ্রিডি)

রেটিং: ৫/১০

স্যর উইলিয়াম জোন্স ১৭৮৯ সালে সর্বপ্রথম মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’-এর ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। অনুবাদের নাম দিলেন ‘সকোন্তলা-দ্য ফ্যাটাল রিং’। তারপর ১৭৯১ সালে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। অনুবাদের দশ বছরের মধ্যেই এই কাজের জন্য উইলিয়াম জোন্স আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর এই কাজের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যান্য ইউরোপীয় লেখকরা ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান ও ড্যানিস ভাষায় ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’-এর অনুবাদ করেন। সেইসময় গোটা ইউরোপ ভারতীয় সাহিত্যের প্রতি আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠে। জোন্স কালিদাসকে ‘ভারতের শেক্সপিয়র’ বলে আখ্যা দেন, কিন্তু কালিদাস নাট্যকারের থেকেও আগে কবি ছিলেন।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ সাতশো বছরের কোনও সময়ে কালিদাসের আবির্ভাব ঘটে বলে পণ্ডিতদের অনুমান। অথচ প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো তাঁর রচনাসম্ভার আজও সমানভাবে পৃথিবী বিখ্যাত। মানবমনীষার অনবদ্য প্রকাশস্বরূপ ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’ কাহিনির পারম্পর্য, ঘটনার বিন্যাস এবং চমৎকৃতিতে কালজয়ী। মহাকবি কালিদাস ‘হঠাৎ কবি’ ছিলেন না। তাঁর প্রতিভা, ব্যুৎপত্তি ও অভ্যাস সর্বজনবিদিত। অতি উচ্চমানের শিক্ষা ও অনলস অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিস্বরূপ আজও পৃথিবীজুড়ে মানুষ তাঁর মূল সংস্কৃত কাব্য, নাটক অথবা অনূদিত সাহিত্যের রসাস্বাদন ও বিভিন্ন উপস্থাপনা করে চলেছেন।
আরও পড়ুন:

মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে: যেমন মা হই না কেন, আমি তো মা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১: রাজার ছেলেদের রাজনীতি-কূটনীতি শেখানোর জন্যই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫১: সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার প্রয়োজন, তবেই বাড়বে মাছ নিয়ে সচেতনতা, উপকৃত হবে আমজনতা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০: তত্ত্বতালাশ

এরই নবতম সংযোজন ২০২৩ এ মুক্তিপ্রাপ্ত দক্ষিণ ভারতীয় পরিচালক গুণশেখরের ‘শাকুন্তলম্’। যদিও ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই প্রচেষ্টা প্রথম নয়। সেলুলয়েডে শকুন্তলার চরিত্রায়ন শুরু হয় ১৯২০ সালেরও আগে থেকে। দক্ষিণ ভারতীয় পরিচালক ইল্লিস আর দুঙ্গনের সাদা-কালো ‘সকুন্তলাই’তে (১৯৪০) বিখ্যাত সঙ্গীতসাধিকা এমএস সুব্বুলক্ষ্মী শকুন্তলার ভূমিকায় অভিনয় করেন, যা তাঁর অভিনয় জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবি ছিল। এরপর ১৯৪৩ সালে এবং ১৯৬১ সালে ভি শান্তারামের মতো বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক এবং অভিনেতা এই কাহিনিকে আশ্রয় করেন। দু’ বারই তিনি মাস্টারপিস সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৬১ সালে প্রখ্যাত অসমিয়া গায়ক ভূপেন হাজারিকা গীতিনাট্যের আদলে শকুন্তলার চলচ্চিত্রায়ন করেন। এই ছবি শ্রেষ্ঠ অসমিয়া ছবি হিসেবে নবম রাষ্ট্রীয় চলচ্চিত্র উৎসবে রাষ্ট্রপতি রৌপ্যপদক পায়। এছাড়া কমলাকর কামেশ্বর রাও, ফতেমা বেগম, জেজে মদন এবং শ্রীনাথ পটঙ্করের মতো পরিচালকেরা বিভিন্ন সময়ে কালিদাসের এই কৃতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩১: মরুভূমির উপল পারে বনতলের ‘হ্রদ’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭: পঞ্চমের কথা মতো ড্রাম ছেড়ে অমরুতের পিঠের উপর স্যাম্পল রিদম বাজাতে শুরু করলেন ফ্রাঙ্কো!

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৫: সারদা দাদার থেকে চিল্পিঘাটি

মূল কাহিনি নানা উৎস থেকে সকলের জানা। মেনকা-বিশ্বামিত্রের কন্যা শকুন্তলা জন্মাবধি তপস্বী, মুনিবালক ও কন্যাদের সঙ্গে লালিত, অথচ তাঁর জীবনে হঠাৎ এসে পড়ে রাজাধিরাজ, ধর্মবেত্তা, বিনয়ী, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিভূ দুষ্যন্ত। রমণীমোহন, ‘নবমধুপানে’ কৃতার্থস্বভাব দুষ্যন্তের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ শকুন্তলা অস্বীকার করতে পারেননি। গুরুজনদের অনুমতি, আশীর্বাদ ছাড়াই তাঁদের গান্ধর্ববিবাহ, রাজার নিজের রাজ্যে প্রত্যাবর্তন, দুর্বাসা মুনির অভিশাপে দুষ্যন্তের শকুন্তলার স্মৃতিলোপ, ভরা সভায় গর্ভবতী শকুন্তলার চূড়ান্ত অপমান, লাঞ্ছনা; ভগবান মারীচের আশ্রমে শকুন্তলার পুত্র সর্বদমনের প্রতিপালন এবং ঘটনাপরম্পরায় তাঁর সপুত্র রাজার সঙ্গে পুনর্মিলন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৫: শরীর ফিট রাখতে রোজ ভিটামিন টনিক খাচ্ছেন?

স্বাদে-গন্ধে: মিষ্টি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? বাড়িতে ঝটপট বানিয়ে ফেলুন জিভে জল আনা ক্ষীর মাধুরী

ডায়েট ফটাফট: ডায়াবিটিসে ভুগছেন? সুস্থ থাকতে কী কী ফল খাবেন, আর কোনগুলি এড়িয়ে চলবেন?

এমন প্রাপ্তবয়স্কদের কাহিনিকে পরিচালক গুণশেখর পারিবারিক ড্রামা বানানোর যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন। থ্রিডিতে প্রাচীন ভারতীয় তপোবন দেখাতে গিয়ে ডিজনির ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো হয়ে গিয়েছে। এর থেকে দেশের নির্জন পথেপ্রান্তরে, বনেজঙ্গলে, গিরিখাতে ক্যামেরা বসালে দর্শকদের চোখের আরাম হতো। ছবিতে অতিরিক্ত ভিএফএক্সের ব্যবহার এখন দক্ষিণ ভারতীয় পরিচালকদের ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়ে ফিরে আসছে। এই ছবির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সিনেমাটোগ্রাফার শেখর ভি জোসেফের কাজটাই বোঝা গেল না। পশুপাখিরাও কম্পিউটার জেনারেটেড, মূল গল্পের তুলনায় ছবিতে তাদের যোগদান কম। ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’ নাটকের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল পাত্রপাত্রীদের হৃদয়স্পর্শী কথোপকথন, কিন্তু ছবিতে সেই অভাব স্পষ্ট।
সামান্থা প্রভু ও দেব মোহন শকুন্তলা-দুষ্যন্তের চরিত্রে ভালো অভিনয় করলেও একে তাঁদের সেরা কাজ বলা যাবে না। নীতা লুল্লার আড়ম্বরপূর্ণ পোষাক ও সাজসজ্জায় মেনকার চরিত্রে মধু (রোজা খ্যাত), ইন্দ্রের চরিত্রে যিশু সেনগুপ্ত, কণ্বের চরিত্রে শচীন খেরেকর, দুর্বাসার চরিত্রে মোহন বাবু নিজস্বতা হারিয়েছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ‘পুষ্পা’ খ্যাত আল্লু অর্জুনের কন্যা আল্লু আরহা যে সর্বদমনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর পর্দায় উপস্থিতি, মিষ্টিভাব, গুছিয়ে কথা বলা দর্শকদের মধ্যে স্বস্তি এনেছে। সঙ্গীত পরিচালক মণি শর্মা ছবিতে আলাদা কোনও মাত্রা যোগ করতে পারেননি। পরিচালক গুণশেখর মণিরত্নম কিংবা এসএস রাজমৌলি নন, তাই প্রাচীন ভারতীয় এমন কালজয়ী সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়নের ক্ষেত্রে তাঁর উচিত ছিল গিরিশ কারনাড, পিটার ব্রুক এবং বিআর চোপড়ার পুরোনো কাজগুলো লক্ষ্য করা।
* চলচ্চিত্র সমালোচনা (Film Review) : ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

Skip to content