বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


কাহিনি বৈশিষ্ট্য: সামাজিক প্রহসন (২০২০)
ভাষা: হিন্দি
প্রযোজনা: সুধীর মিশ্র, ভাবেশ মান্ডালিয়া, সেজল শাহ
কাহিনি: মনু জোসেফ
চিত্রনাট্য ও সংলাপ: ভাবেশ মান্ডালিয়া, অভিজিৎ খুমান, নীরেন ভট্ট, নিখিল নায়ার, সুধীর মিশ্র, শিবা বাজপেয়ী
নির্দেশনা: সুধীর মিশ্র
অভিনয়ে: নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, অক্ষত দাস, ইন্দিরা তিওয়ারি, শ্বেতা বসু প্রসাদ, নাসারপ্রমুখ
সময়সীমা: ১১৪ মিনিট
দেখা যাবে: নেটফ্লিক্সে
রেটিং: ৬.৫ / ১০


বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। সাল তারিখ অত খেয়াল নেই, একটি ১০-১২ বছরের মেয়ে হঠাৎ করেই কলকাতায় কাগজের শিরোনামে এসেছিল। সে অক্লেশে এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল যেটা তার জানার কথাই নয়। তখন দূরদর্শন ছাড়া প্রাইভেট চ্যানেল অত ছিল না। থাকলেও তারা সিরিয়াল সিনেমা এ সবেই সীমাবদ্ধ ছিল। টেলিভিশন খবরের এতো সীমাহীন রমরমা হয়নি। তাই টিআরপি নিয়ে দড়ি টানাটানি ছিল না। টিআরপি শুধু সিরিয়ালের বিজ্ঞাপন জোগাড়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। খবরের কাগজে তখন মুখরোচক প্রতিবেদন বের হতো, আর পাঠকেরা হামলে পড়ে সেসব পড়তেন। এ ভাবেই সে মেয়েটি বিখ্যাত হল।

একটি এনজিও নানা ধরনের কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন করত। তারা ঠিক করল, মেয়েটির পরীক্ষা নেবেন। প্রথমবারের পরীক্ষায় মেয়েটি সসম্মানে উত্তীর্ণ। কিন্তু সংস্থার শীর্ষ স্থানীয়দের কোথাও একটা সন্দেহ হয়েছিল। তাঁরা দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করতে চাইলেন। এ বার মেয়েটি ডাহা ফেল। আসলে তার বাবা তাকে উত্তরগুলো কণ্ঠস্থ করিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের একটা ফন্দি করেছিলেন। এত পর্যন্ত পড়ে অনেকের হয়তো সেই ব্যাপারটা খেয়াল হচ্ছে। আমার আজকের প্রতিবেদনের সঙ্গে এই ঘটনার একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে।
অনেক আগে বেঙ্গালুরুর খবর মুম্বইয়ে জানা যেত না। হুগলির খবর হুবলির মানুষ জানতে পারতেন না। সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান বেড়েছে। আর আমি যে গল্পটি নিয়ে এখন আলোচনা করব সেই ‘সিরিয়াস মেন’ উপন্যাসটি প্রায় এই ধরনের একটি কাহিনীর ভিত্তিতেই লেখা। লেখক পেশায় সাংবাদিক মনু জোসেফ। ২০১০ সালে ইংরেজি ভাষায় লেখা এই উপন্যাসের জন্য কাহিনিকার মনু জোসেফ বহু পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, হিন্দু লিটারারি প্রাইজ, পেন ওপেন বুক অ্যাওয়ার্ড, ম্যান এশিয়ান লিটারারি প্রাইজ ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’, দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্স, দ্য হিন্দু, বা টাইমস ম্যাগাজিনে এই উপন্যাস নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন লেখা হয়েছে।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: আদুরের ‘মাথিলুকাল’ সারা ছবি জুড়ে মামুটির অসামান্য অভিনয় প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

সত্যি ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখা অনেক কাহিনি বিখ্যাত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই লেখক তাঁর দেখা, তাঁর ঋণস্বীকার করেন। বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা এখানে বোম্বের দু’ কামরার খোলিতে থাকা খ্রিস্টান ধর্মালম্বী পিছিয়ে পড়া জনজাতির আয়ান মানি। আর এখানে সেই কিশোরী মেয়ের পরিবর্তে স্কুল যায় পড়ুয়া কিশোর আদি।

চিত্রপরিচালক সুধীর মিশ্র কাহিনিকার মনু জোসেফ-এর থেকে স্বত্ব নিয়ে এই একই নামে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকিকে ভিত্তি করে এই ছবিটি করেন। ২ অক্টোবর ২০২০ সালে নেট ফিক্সে ছবিটি মুক্তি পায়। এই ছবিটি দেখতে বলেছিল আমার পুত্র। একেবারে নতুন ধরনের গল্প তার খুব ভালো লেগেছে। আশ্চর্যের বিষয়, তার সমবয়সী বা তার থেকে বয়সে যারা কিছুটা বড় তারা বাংলায় ঘটে যাওয়া সেই মেয়েটি আর তার বাবার আসল গল্পটি জানে না। আমার বিশ্বাস, যারা এই কাহিনি নিয়ে এত লেখালেখি করেছেন, পুরস্কার দিয়েছেন তাঁদের কাছেও আসল কাহিনিটি অজানা।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৭: তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথেই যে জন ভাসায়

অতীতে এমন নানা ভাষার অনেক গল্প-উপন্যাস নিয়ে আলোচনা হয়েছে যেটির মূল কাঠামোর সঙ্গে অনেক আগে তৈরি কোন একটি বিদেশি ভাষার ছবির হয়তো বা আশ্চর্য মিল। আমাদের দেশের কপিরাইট আইন এখনও স্রষ্টার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও হয়তো একই রকম মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। হয়তো বাংলায় পরিচিত কোন নাটকের নামধাম বদলে সেটির মূল কাঠামোর ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে কোনও মুভি-মোগলের বিশাল বাজেটে বানানো সর্বভারতীয় ছবি। যাঁরা জানবেন না, তাঁরা পুরস্কার আর অভিনন্দনের বন্যায় ভরিয়ে দেবেন ঝাঁ-চকচকে নতুন সৃষ্টিকে। আইন আর আইনজ্ঞের লড়াইয়ে দীর্ঘমেয়াদি আদালত খরচের বহরে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃত খুঁজে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে। ভেসে যাবে মূলসৃষ্টি বা তার প্রামাণ্য সত্যতা। দশচক্রে ভগবান ভূত হবেন। আইনের সুশাসন পাওয়া আজকাল ভীষণ খরচসাপেক্ষ তো। সবাই কি আর ঘটিবাটি বেচে সম্মান কিনতে পারবেন?
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৭: কবিকন্যার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও কবির সঙ্গে ঘটেনি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৯: আবার পুরী ভ্রমণ

এ বার ছবি প্রসঙ্গে আসি।
সুধীর মিশ্রের নির্দেশনায় পিতাপুত্রের ভূমিকায় নওয়াজউদ্দিন ও কিশোর অভিনেতা অক্ষত দাসের অনবদ্য অভিনয়ের যুগলবন্দিতে গড়ে ওঠা একটি ভালো এবং অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ছবি। যেহেতু আমার এ কাহিনি জানা, তাই সেটা নতুন বলে একবারেও মনে হয়নি। ছবি শুরু থেকেই আমি শেষটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। শেষে তাই ঘটল। স্বভাবতই কাহিনি আমাকে মোটেই মুগ্ধ করেনি। মুগ্ধ করেছে অভিনেতাদের অভিনয়। মুগ্ধ করেছে নির্দেশকের দৃষ্টিকোণ, কিছু কিছু অনবদ্য মুহূর্ত, বুদ্ধিদীপ্ত সম্পাদনা, ক্যামেরা দিয়ে গল্প বলার সুধীর মিশ্রের প্রশংসনীয় নিজস্বতা। ছবিতে নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে শ্রেণিদ্বন্দ্ব। মুম্বইয়ের চাল বা খোলিতে থাকা সমাজজীবনের নিখুঁত চালচিত্র। এই ছবির মধ্যে এক বিশেষ বার্তা আছে, আজকের এবং আগামীর মা-বাবার জন্য। যাঁরা আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পাওয়া থেকে, নিজেদের মনের ভয়ঙ্কর হতাশার কারণে তৈরি হওয়া অসম্ভব চাহিদা যেন তেন প্রকারে সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করার একটা প্রায় অলীক অসম্ভব যুদ্ধে নিজেদের এবং সন্তানদের সামিল করেন, করছেন বা ভবিষ্যতে করবেন, এ ছবি হয়তো তাঁদের সচেতন করবে।

তবে ছবির শেষটা প্রত্যাশাপূরণ করে না। মূল উপন্যাসে কি ছিল জানি না। কিন্তু দৃশ্যত ছবির পরিসমাপ্তি বড় সাদামাটা।
* মুভি রিভিউ: জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। দ্বিতীয় খণ্ড লিখেছেন।

Skip to content