মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ভাষা: হিন্দি
কাহিনি: সঞ্জয় সিং
বিন্যাস: হনশল মেহতা
চিত্রনাট্য: করণ ভ্যাস, কিরণ যজ্ঞোপবীত, কেদার পাটানকর
পরিচালনা: তুষার হীরানন্দানি
অভিনয়: গগন দেব রিয়ার, সানা আমিন শেখ, মুকেশ তিওয়ারি, তালাত আজিজ প্রমুখ
ওটিটি রিলিজ: সোনি লিভ
পর্ব: ১০
রেটিং: ৭.৫/১০


মোটামুটি ২১ বছর আগে, ২০০৩ সালে প্রথম স্ট্যাম্প পেপারও যে নকল হতে পারে সেটা নজরে এল। জানা গেল, ১৯৯২ সাল থেকে এই ভয়ংকর জোচ্চুরির গোড়াপত্তন। আর এর সঙ্গে যে নামটি আসমুদ্র হিমাচলে ছড়িয়ে পড়ল তা হল ‘তেল্গি’, পুরো নাম আব্দুল করিম তেলগি। কর্ণাটকের বেলগাঁও অঞ্চলে খানাপুরে জন্ম। রেলওয়ে কর্মী বাবার মৃত্যু ছোটবেলাতে।

খানাপুরের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সর্বোদয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে ট্রেনে ফল বিক্রি করতো স্কুলের সময়ের আগে পরে কিশোর আব্দুল। পরে বেলগাঁওয়ের গোগটে কলেজ অফ কমার্সে বিকম পাস করেন তেলগি। এরপর বম্বে আসা। আরব দুনিয়ায় গালফে যাওয়া এবং ফিরে আসার পর জালিয়াতি পেশার শুরু। প্রথমে জাল পাসপোর্টের ব্যবসা। নানান জাল নথি তৈরিতে হাত পাকানোর পর জাল স্ট্যাম্প পেপারের ভয়ংকর ব্যবসা শুরু করে এই আব্দুল করিম তেলগি। শেষমেশ ২০০৩ সালে এসে জানা গেল, টাকার অঙ্কে স্ট্যাম্প পেপার জালিয়াতির সর্বমোট পরিমাণ মোটামুটি তিরিশ হাজার কোটি টাকা। এই সুবিশাল আর্থিক কেলেঙ্কারির একটা বিপুল অংশ তেল্গি ব্যয় করেছিলেন সরকারি আমলা পুলিশের বড়কর্তা এবং রাজনৈতিক নেতাদের ঘুষ দিয়ে।
এই জালিয়াতি নজরে আসতে ১৯৯২ থেকে ২০০৩, এই প্রায় ১২ বছর সময় লেগে যাওয়ার মূল কারণ স্ট্যাম্প পেপার কিন্তু নোট নয়। নোট সর্বক্ষণ মানুষের হাতে হাতে চলে ব্যাংকে যায়, তাই সহজ না হলেও আসল ও নকলের তফাৎ ধরা পড়ে যায়। কিন্তু স্ট্যাম্প পেপারের ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। লাইসেন্সপ্রাপ্ত ভেন্ডারের থেকেই তা কেনা যায়। আর কেনার পরে তাতে দলিল টাইপ বা লেখা হয়। এরপর তা রেজিস্ট্রির সময় তাতে লাল কালো-নীল নানান ছাপ দেওয়া হয়, আর সকলেই সেই ছাপ ঠিকঠাক পড়েছে কিনা আর দলিলে কী কী লেখা আছে সেটার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী হন। তারপর সেই দলিল ফাইলে লকারে কিংবা সিন্দুকে বা আলমারির মধ্যে সযত্নে গচ্ছিত থাকে বছরের পর বছর। বহুবছর পরে সেই দলিল নিয়ে নাড়াঘাঁটা হলে আবার তাতে কী কী লেখা ছিল, কবে দলিল হয়েছিল সেগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দলিল আসল কি নকল সে নিয়ে কেউ ভাবেই না। আর অত্যন্ত ধুরন্ধর আব্দুল করিম তেলগি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই সামাজিক রীতির দুর্বলতাকে ব্যবহার করেই এই দুর্ধর্ষ জালিয়াতি করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: ছায়াছবির মায়া কাটানো বাস্তবের ছবি কুমার সাহানির মায়া দর্পণ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

অন্ধকার জগতে তেল্গির এই চমকপ্রদ উত্থান এবং পতনের আকর্ষণীয় কাহিনি নিয়ে ২০০৯ সালে তৈরি হয়েছিল ‘মুদ্রাঙ্ক’ নামে একটি হিন্দি ছবি। এরপর ‘পেপার’ নামে ২০২০ সালে একটি ওয়েব সিরিজ তৈরি হয়। ‘মানি মাফিয়া’ নামের এক তথ্যচিত্রের সিরিজের প্রথম পর্ব ‘ফেক স্ট্যাম্প পেপারস’ এই একই কাহিনির ভিত্তিতে তৈরি। কিন্তু নামগুলি পড়তে গিয়ে এর একটিও আপনার পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না কারণ এগুলোর কোনওটিই ব্যবসায়িক সাফল্য বা জনপ্রিয়তা পায়নি।

১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সোনি লিভ নিয়ে এলো ‘স্ক্যাম ২০০৩: দ্য তেলগি স্টোরি” ভলিউম ওয়ান। মোট ১০ পর্বের প্রথম ৫টি পর্ব ছিল ভলিউম ওয়ানে। ৩ নভেম্বর ২০২৩ সালে মুক্তি পেল বাকি পাঁচ পর্ব। আদিত্য বিড়লা গ্রুপের এপ্লস এন্টারটেইনমেন্ট ছবির থেকে বোধহয় ওয়েব সিরিজে বেশি সফল। এ পর্যন্ত পাঁচটি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে অমিতাভ বচ্চন ও রানি মুখোপাধ্যায়ের অসাধারণ অভিনয়ধন্য সঞ্জয় লীলা বনশালির ‘ব্ল্যাক’ সেই অর্থে জনপ্রিয়তা ও ব্যবসায়িক নিরিখে সফল চলচ্চিত্র। কিন্তু ওয়েব সিরিজের ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য সীমাহীন। ক্রিমিনাল জাস্টিস ১ এবং ২, হাঁসমুখ, অবরোধ ১ এবং ২, স্ক্যাম ১৯৯২ (হর্ষদ মেহতা), তাজ ১ এবং ২ , কফস এবং আলোচ্য স্ক্যাম ২০০৩।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১: রাজমালা ও ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৩: ক্রোধ ও ক্ষমা, কোনটির প্রভাব বেশি? হিংসা ও প্রতিহিংসার ফল কী সুদূরপ্রসারী?

এই সিরিজের রুদ্ধশ্বাস চিত্রনাট্য ও অনবদ্য সংলাপ অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি ও টানটান সম্পাদনার সঙ্গেই রয়েছে চমকপ্রদ পরিচালনা। কিন্তু এই সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছেন যিনি বা বলা ভালো যাঁর জন্য এই সব কিছু এত আকর্ষণীয় ও প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে, তিনি হলেন ছবির মূল চরিত্রাভিনেতা আব্দুল করিম তেল্গির ভূমিকায় গগন দেব রিয়ার। না আপনি সেভাবে এঁকে চেনেন না।

আমার পূর্ববর্তী কোনও একটা লেখায় আমি উল্লেখ করেছিলাম যে ওয়েব সিরিজ হল খোলা বাজারে যোগ্যতা ও প্রতিভার প্রকৃত লড়াই। নামী-অনামী সুপারহিট সুপারস্টার মেগাস্টার অভিনেতা অভিনেত্রী নায়ক নায়িকা পরিচালক চিত্রনাট্যকার কারও পুরনো বায়োডেটার কোন মূল্য নেই এখানে। অতীতে আপনি কী করেছিলেন, কতবার ১০০ কোটি বা ২০০ কোটি ক্লাবে আপনার ছবিকে নিয়ে গিয়েছিলেন বানেবার জন্য কোনও কোনও ব্যবসায়িক কলকাঠি নেড়েছিলেন সেগুলো একেবারেই বিচার্য নয়। আনকোরা নতুন অচেনা-অজানা প্রতিভার সঙ্গে সুবিখ্যাত দুর্ধর্ষ জনপ্রিয় মনোরঞ্জক নায়ক নায়িকা পরিচালকের সত্যিকারের প্রতিভার লড়াইয়ের ময়দান হল ওয়েব সিরিজ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান

সেই লড়াইয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন দিল্লিতে জন্ম নেওয়া থিয়েটারঅভিনেতা গগনদেব। এর আগে অভিষেক চৌবে পরিচালিত সুশান্ত সিং রাজপুত মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত ‘সোনচিড়িয়া’ ছবিতে খলিফার ভূমিকায় বা বিক্রম শেঠ রচিত বিখ্যাত উপন্যাস ও মীরা নাইয়ার শীমিত আমিন পরিচালিত ‘দ্য স্যুটেবল বয়’ ওয়েব সিরিজে প্রাণ কাপুরের মতো বহু চরিত্রের ভিড়ে মিশে থাকা সীমিত অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু গগন দেব হেরে যাননি। দাঁতে দাঁত দিয়ে অপেক্ষা করেছেন নিজেকে প্রমাণ করার সঠিক সুযোগের জন্য। আর আব্দুল করিম তেলগির ভূমিকায় অসামান্য অভিনয়ের ঝোড়ো ইনিংসের পরে প্রমাণ করে দিয়েছেন, গগনদেবের ব্যাট অনেকটা চওড়া।

হিন্দি ছবিতে পারিবারিক প্রভাব প্রতিপত্তিশালী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সামনে তিনি একটি উল্লেখযোগ্য নাম। এই সিরিজের শেষে আসল আব্দুল করিম তেলগির সাক্ষাৎকার রয়েছে গগনদেব তেলগির চরিত্রের ঠিক কতটা সফল সেটা জানবার জন্য এই সাক্ষাৎকার অংশটি বারবার দেখা অত্যন্ত জরুরি। স্ট্যাম্প পেপারের মতোই আসল ও পর্দার তেলগিকে আলাদা করতে পারবেন না।গগনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তেলগির স্ত্রী নাফিসার ভূমিকায় সানা আমিন শেখ।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content