বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল (চিত্রকলা: সংগৃহীত)

 

ভাগ- ১

ষোলোতলার ওপরে ফ্ল্যাটের সুন্দর বারান্দা— অনেক দূর থেকে আসা শহরের ব্যস্ততার আবহ। লেখক অপু ল্যাপটপে অমলকান্তিকে নিয়ে কবিতা লিখছে — আবহে তার ভাবনা কথা হয়ে শোনা যায়। নাটকের বিভিন্ন অংশে এই কবিতাটা তৈরি হতে থাকবে।

লেখক (আবহ): অমলকান্তি আমার বন্ধু/ ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। /রোজ দেরি করে ক্লাসে আসত, পড়া পারত না…

লেখকের মোবাইল বেজে ওঠে, পথের পাঁচালীর সেই মন কেমন করা বাঁশি।

লেখক: হ্যালো— হ্যাঁ বলছি, বলুন! …না ভাই আমি আসতে পারব না আমার অন্য কাজ রয়েছে । …নানা! আপনারা অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ করে নিন, রাখি!!

লেখক ফোন রেখে ল্যাপটপের দিকে তাকায়। মনে মনে পড়ে, আবহে তা কথা হয়ে শোনা যায়।

লেখক (আবহ): অমলকান্তি আমার বন্ধু/ ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। /রোজ দেরি করে ক্লাসে আসত, পড়া পারত না…

লেখক গালে আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে ভাবে। তারপর আবার ল্যাপটপে টাইপ করতে থাকে। মাঝে অস্পষ্ট একটা ডোরবেলের শব্দ। লেখক একবার লেখা থামিয়ে উইংসের দিকে অর্থাৎ ফ্ল্যাটের দিকে তাকায় — আবার লিখতে থাকে।

লেখক (আবহ): শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে, / এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকত যে, মনে মনে বাকি লেখাটা পড়ে আবহে তার সংলাপ হয়ে শোনাযায় —

লেখক: শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে, / এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকত যে, … তাকিয়ে থাকত যে,

লেখক কথা খুঁজতে খুঁজতে ভাবে — বাইরে থেকে নাতনি মিনির গলায় ‘দাদান’ শুনে তাকায় – ১৪/১৫র নাতনি মিনির প্রবেশ ছাপোষা চেহারার অমলকান্তিকে নিয়ে- এলোমেলো চুলদাড়ি চশমার আড়ালে উজ্জ্বল দুটো চোখ । কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ‘৭০এর বিদ্রোহী তবে আজ যেন হাস্যকর —

মিনি: দাদান—দ্যাখো তোমার বাডি! অমলকান্তি!

অমলকান্তিকে দেখা মাত্র শব্দ গুলো মাথায় এসে যায়, আবহে শোনা যায় তার ভাবনা

লেখক (আবহ): দেখে ভারি কষ্ট হতো আমাদের ।
অমলকান্তি: কী ভাবছো? কী খুঁজছো অপু! সাহিত্যের সুতো, কবিতার হারানো শব্দ? নাকি সুরের মিটারে মাপা আলটপকা গানের লাইন! তোমার লেখা গানের আজকাল খুব ডিমান্ড!

অপু অমলকান্তির কথায় অন্যমনস্ক হয়ে যায়

মিনি: প্লিজ স্যর! (বসতে অনুরোধ করে) দাদান আমি রেণুদিকে চা পাঠাতে বলছি- আমি আসি মাম্মা এখুনি স্কাইপে আসবে। আজ আমাকে ওদের আল ওলাইয়ার নতুন আপার্টমেন্টটা দেখাবে।

অমলকান্তি: তুমি কোথায় পড় মিনি?

মিনি: ইউ মিন স্কুলিং? বালিগঞ্জ ‘সিক্সাস্যাডন’। (প্রস্থান)

অমলকান্তি: (স্বগতঃ) শিক্ষাটা রিক্সার মতো শোনালো! অপু! অপু!!

লেখক: উঁ!

অমলকান্তি: অপু!! তোমার ছেলে কাজল এখন কোথায় আছে? মিনি নামটা কী বললো??

লেখক: আল ওলাইয়া! রিয়াধের খুব পশ এলাকা।

অমলকান্তি: সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াধ! মেয়েকে নিয়ে যায়নি।

লেখক: হ্যাঁ- কাজল চাইল স্কুলিংটা কলকাতায় হোক! আর আমি তো একা একাই- থাকি!

অমলকান্তি ডেকচেয়ার ছেড়ে উঠে দর্শকের দিকে এগিয়ে গিয়ে ইষৎ ঝুঁকে অনেক নীচে কলকাতাকে দেখে দেখার চেষ্টা করে – লেখক তাকে দেখে

অমলকান্তি: অপর্ণা তোমার এই ষোলোতলার মেঘ বারান্দা, সুপার ডুপার গোল্ডেন জুবিলি লাইফ, তোমার ছেলে কাজলের আরব্য উপন্যাসের সাক্সেস কিছুই দেখে যেতে পারল না অপু! (দর্শক এরপর অমলকান্তির ঠোঁট নাড়া দেখে। আবহে কবিতাটা ভেসে ওঠে)

লেখক (আবহ): আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল/ অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি।/সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
অমলকান্তি: তুমি কিন্তু আজ আমার একটা কথাও শুনছোনা অপু! আজ বরং…

লেখক: আরে আরে সে কী কথা? (ল্যাপটপ বন্ধ করে) এই দিলাম ছাপাখানা বন্ধ করে। বসো।

অমলকান্তি: (ল্যাপটপে হাত বোলায়) কী যন্ত্রই এল— চেহারায় ছোট্ট, ক্ষমতায় অসীম। পারমাণবিক বোমার মতোই ভয়ঙ্কর খিদে – ছাপাখানার লোহালক্কড়ময় পেল্লায় যন্ত্র টন টন কাগজ রাশিরাশি কালি ভারীভারী ক্যামেরা হাজারহাজার ক্যান বোঝাই ফিল্মের প্রিন্ট, সব গিলে খেলো। রেডিওর অনুরোধের আসর মহালয়া, সেতার সারেঙ্গি চেলো, ঢাঊস প্রজেক্টর মেশিন- মোটা মোটা ডিক্সনারি, কালো কালো অজস্র রেকর্ড ক্যাসেট মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সব! সব খেয়ে ফেললো এই ক্ষুদে দানব।

কাজের মাসি রেণুদি চা নিয়ে আসে —

লেখক: রাখো। রেণুদি আজ কিন্তু অমলকান্তি এখান থেকে খেয়ে যাবে।

অমলকান্তি: না না — নীতা রান্না করে বসে থাকবে।
লেখক: আরে জানে তো আমার কাছে এসেছো। তুমি দুপুরেরটা রাতে গিয়ে খেয়ে নেবে।

অমলকান্তি: আমাদের ওসব ঠান্ডাযন্ত্রের যন্ত্রণা নেই। আপনি বরং আমাদের আবার একটু চা খাওয়াবেন রেনুদি।

কাজের মাসি চলে যান—
অমলকান্তি একটু ঘোরাঘুরি করে –জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়— কান পেতে শোনার চেষ্টা করে – হালকা গাড়িঘোড়ার শব্দ—

লেখক: তুমি তো আগেও এসেছো!!
আরও পড়ুন:

হোমিওপ্যাথি: হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে চান? তাহলে এগুলি অবশ্যই মেনে চলুন

ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৬: বসুন্ধরা এবং…

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৮: দশরথের অভিলাষ-রামের রাজ্যাভিষেক সংকল্প

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-২৪: জাপানি-কুকুর পুষেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ

অমলকান্তি: এসেছি কিন্তু — আমাদের কেষ্টপুর খালের পাশে ক্যানাল ইস্ট রোডের একতলায় খুব একটা আলো হাওয়া নেই। চারদিকে চেঁচামেচি খালের ওপারে অনবরত ট্রেন মালগাড়ির শব্দ শুনতে শুনতে তোমার এই ষোলোতলার মজাটা ভুলে যাই। এলে আবার মনে পড়ে যায়।

লেখক: আমি তো একাই! থাকো না কদিন আমার সঙ্গে!

অমলকান্তি: উহুঁ!!

লেখক: না কেন!

অমলকান্তি: খেয়ে ঢেঁকুর উঠবে না! নীতা পিঠ চুলকে না দিলে রাতে ঘুম হবে না। সকালে ফাটা কাপে গুঁড়ো দুধের চা না খেলে ইয়ে হবে না, মানে সে অনেক সমস্যা। তার চেয়ে সিনেমা দেখার মতো আসা একটু উঁকি মেরে সুখ ভোগ করা, এই বেশ ভালো। আচ্ছা পাখির ডাক শুনতে পাও? কাক? চড়ুই? আসে তোমার ষোলোতলার বারান্দায়?

লেখক: খেয়াল করিনি তো!!

অমলকান্তি: না, এখানে কাকেরা দঙ্গল পাকাবার সাহস পাবে না!

লেখক: কেন?

অমলকান্তি: এটা চিলেদের চিলে কোঠা!! আচ্ছা রোদ্দুর অনেক পাও না? অ-নে-ক রোদ্দুর!!

লেখক চশমাখুলে তাকায় — অমলকান্তি হাত পা নেড়ে অনেক কথা বলে তার কথা শোনা যায় না — লেখকের কথা আবহে শোনা যেতে থাকে।

মুখ ও মুখোশ। (চিত্রকলা: সংগৃহীত)

লেখক (আবহ): আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল, অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায় নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!

নাতনি মিনির গলায় ‘দাদান!!’ শুনে লেখকের সম্বিত ফেরে—

মিনি: আর ইউ ডে ড্রিমিং?

লেখক: নো মাই ডিয়ার।

মিনি: তাহলে ফেসবুকে যাও! আমার নতুন প্রোফাইলে লাইক দাও কমেন্টস দাও!। মা বাপি অলরেডী লাইক দিয়েছে— লাইক্স বাড়লে তবে না ফ্রেণ্ডস-রা কমেন্টস করবে! যাও! (চলে যায়)

লেখক: হ্যাঁ হ্যাঁ। (ফোন নেয়। এটাসেটা টেপাটেপি করে তারপর নাতনির ছবি দেখে যেন মুখে হাসি ফোটে) (নাতনির উদ্দেশ্যে) হয়ে গিয়েছে!

মিনি (নেপথ্যে): থ্যাঙ্ক ইউ!

অমলকান্তি অবাক হয়ে দেখে লেখককে — লাইক দেওয়ার পর লেখক তাকিয়ে বোকাবোকা হাসি এনে বলে।

লেখক: বলো!

অমলকান্তি: বলবো কি?

লেখক: তুমিই তো বলছিলে আমি শুনছিলাম!

অমলকান্তি: আমি তো বলেই যাই বলেই যাই– তোমরা কখনো শোনো — কখনও শোনো না। আচ্ছা এই মিনি এসে আবদারটা কি করলো?

লেখক: তুমি তো মোবাইল কম্পিউটার ফেসবুক হোয়াটসআপ ইন্সটাগ্রাম এসব।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-১৬: পরিচালকের কথা শুনে মেকআপ ছেড়ে সুচিত্রা বললেন, যে কাউ ‘দেবাশিস’ করলে আমি কাজ করব না

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: ধীরে চলো ‘ওরে যাত্রী’ [০২/০২/১৯৫১]

ষাট পেরিয়ে, পর্ব-১৫: এখন থেকেই যত্ন নিন কিডনির, গুরুত্ব দিন এ সব বিষয়ে

মহালয়া কি শুধুই পিতৃপক্ষের অবসান

অমলকান্তি: না আমি যে একেবারে আধুনিক সভ্যতার কোনও খবর রাখিনা তা নয়— নীতার কাছে একটা বোতাম ফোন আছে। আমাকে বলেছিল কিন্তু আমি বাউণ্ডুলে লোক কোথায় ফেলে আসবো। তারপর আমাদের একটা বোকাবাক্স মানে সাদাকালো বাক্সই আছে। তাতে তোমার এই আধুনিক সভ্যতার অসভ্য খবর থাকে শতকরা সাতাশি ভাগ — এটা আন্দাজ!

লেখক: তাহলে তো জানই যে এখন এসবই সামজিক সংযোগ – মিনি তার নতুন সেলফি ফেসবুকে দিয়েছে বন্ধু আত্মীয়েরা পছন্দ করলে তার ছবিটা আর সকলে দেখবে। ছেলেমানুষী আর কি?

অমলকান্তি: অনেক বুড়োবুড়িরাও তো সমান তালে এই ছেলেমানুষীটা করছে!

লেখক: যুগের হাওয়া!

অমলকান্তি: শুধু হাওয়া, নাকি ঝড়! অপরকে টপকে যাওয়ার একটা অদ্ভুত লড়াই – একটা চাপা হিংস্রতা নয়? তোমার প্রশান্তকে মনে আছে? আমাদের সঙ্গে পড়তো।

লেখক: মোটা প্রশান্ত!

অমলকান্তি: হ্যাঁ – বড়সড় ডাক্তার। গাইনি!

লেখক: হ্যাঁ- ওর একটা কোন কেস—

অমলকান্তি: অবৈধ গর্ভপাত – রোগীর মৃত্যু –রগরগে ব্যাপার! গিয়েছিলাম ওর নার্সিং হোমে। এখন আর ওসব ঝামেলা রাখেনি, তবে—
(আলো নেভে) — চলবে

[বহুরূপী ব্যতীত আর কোনও নাট্যদলকে এ নাটকের মঞ্চাভিনয়ের অনুমতি দেওয়া হয়নি। নাটকটি ভারত সরকারের রেজিস্ট্রার অফ কপিরাইটস-এ দ্বারা আইনত রেজিস্ট্রিকৃত (L-76713/2018) নাটকের পূর্ণ বা আংশিক মঞ্চ, শ্রুতি বা চিত্রাভিনয় বা কোনপ্রকার অনুবাদ আইনত দণ্ডনীয়]

Skip to content