রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


“আজ বিকাল পর্যন্ত ‘খণ্ডর’ সম্পর্কে সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু আপনারা আবার মনে করিয়ে দিলেন”— (মৃণাল সেন, ১৫ মে ২০১০, কান চলচ্চিত্র উৎসব, কান)

সুভাষ (নাসিরুদ্দিন শাহ) শহুরে এক ফটোগ্রাফার তাঁর বন্ধু দীপুর (পঙ্কজ কাপুর) জোরাজুরিতে সপ্তাহান্তে তাঁদের পরিত্যক্ত, ভগ্নপ্রায়, প্রাসাদোপম বাড়িতে ছুটি কাটাতে যায়। সেই বাড়িরই এক কোণে দীপুর অন্ধ, শয্যাশায়ী কাকিমা (গীতা সেন) আর অবিবাহিত বোন যামিনী (শাবানা আজমি) থাকে। বেশ কিছু বছর আগে তাঁদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় নিরঞ্জনের সঙ্গে যামিনীর বিয়ের কথা হলেও নিরঞ্জন ইতিমধ্যেই অন্যত্র বিয়ে করে প্রায় উধাও হয়। ওদিকে যামিনীর অপেক্ষারত, অন্ধ মা সুভাষকে নিরঞ্জন বলে ধরে নেয়। গল্প নিজস্ব গতিতে এগোয়।
একা, শয্যাশায়ী মায়ের মেয়ের জন্য চিন্তা, অনুচ্চারিত হাহাকার, অন্তহীন অপেক্ষা আর যামিনীর গতিহীন আবেগ, না বলা কথা, আত্মসম্মানবোধ, শুকনো মুখের দৃশ্যায়ন দেশকালের গন্ডি অতিক্রম করে ২০১০ সালের মে মাসে ৮৭ বছরের বৃদ্ধ, বরেণ্য পরিচালক মৃণাল সেনের উপস্থিতিতে তাঁরই ১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘খণ্ডর’ (The Ruins) কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘ক্ল্যাসিকস’ বিভাগে প্রর্দশিত হয়। ছবির গল্প প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্প ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ অনুসারী ছিল।
আরও পড়ুন:

আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা

২০১৭ সাল থেকে অস্কার অ্যাকাডেমির অন্তর্বর্তী সদস্য মৃণাল সেনের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘রাত-ভোর’ (১৯৫৫) মুক্তি পেলেও সাফল্য আসেনি। সাফল্য এসেছিল ‘নীল আকাশের নীচে’ এবং ‘বাইশে শ্রাবণে’র মধ্য দিয়ে। ‘বাইশে শ্রাবণ’ শুধু সাফল্য নয়, পরিচালককে আন্তর্জাতিক পরিচিতিও দিয়েছিল। কান চলচ্চিত্র উৎসবে কোনওদিনই তিনি বহিরাগত ছিলেন না। ১৯৮২ থেকে তিনি এই উৎসবের অন্যতম প্রধান জুরি নির্বাচিত হন। তাঁর বহু ছবি কানে প্রর্দশিত ও পুরস্কৃত হয়েছিল।

পরিচালকের সঙ্গে শাবানা আজমি।

২০০৯ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ মৃণাল সেনের বিখ্যাত কলকাতা ট্রিলোজি অর্থাৎ ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ (১৯৭২) এবং পদাতিক (১৯৭৩) নিয়ে ছোট রেট্রোস্পেকটিভ করার কথা ভাবলেও ছবিগুলোর নেগেটিভ অনেকাংশে খারাপ হয়ে যাওয়ায় সেই চেষ্টা বিফলে যায়। তবে ২০১০ সালে তাঁদের চেষ্টা বিফলে যায়নি। ওই বছর মে মাসের ১৫ তারিখে স্যালে বুনুয়েলের মতো ঐতিহ্যপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ‘খণ্ডরে’র পুনঃপ্রদর্শন এবং পরিচালকের উপস্থিতির কথা নিশ্চিত করেছিলেন ইলিয়েন স্টুটারহেম, যিনি ওই সময় প্রযুক্তিগতভাবে পুনরুদ্ধার হওয়া ছবিটির উপস্থাপক ছিলেন। এই পুনরুদ্ধারের কাজটি করেছিল পুণের ন্যাশেনাল ফিল্ম আর্কাইভের সহায়তায় রিলায়েন্স মিডিয়া ওয়ার্ক। ছবির ভাষা ছিল হিন্দি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন

ইলিয়েন মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এই ছবির প্রতি সমালোচক পিটার কোয়ির (Peter Cowie) শ্রদ্ধাঞ্জলি—মৃণাল সেনের এই সুচারু নির্মাণ, পারিবারিক আবহ, সম্পর্ক ও দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটিকে তুলে ধরে যেমন নাট্য উপাদানের তেমন সর্বকালের সিনেমা নির্মাণের চিন্তা-চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছিল। কোয়ি আরও বলেছিলেন, “The Ruins is directed with masterly understatement by Sen. The dialogue is sparse, and the space between the sentences pregnant with longing and disappointment. The environment not only reflects the failure of the old mother’s life, it is also integrated into mise-en-scene with no trace of ostentatiousness. The Ruins is depressing, yet to experience and to feel it is a rare delight.”

সঙ্গে নাসিরুদ্দিন শাহ।

রিলিজের প্রায় ২৬ বছর পর পৃথিবীর অন্যতম আলোচিত চলচ্চিত্র উৎসবের এক বিশেষ দিন মুখর হয়েছিল এই ছবিকে ঘিরে। প্রদর্শনের শেষে বিদেশি দর্শকদের করতালি সেদিন অনেকক্ষণ স্থায়ী হয়েছিল, উদ্ভাসিত হয়েছিল অশীতিপর পরিচালকের মুখ। জীবন সায়াহ্নে এসে নিজের সৃষ্টির এমন উদযাপন নিশ্চয় অপার শান্তি দিয়েছিল তাঁকে!

ছবি: সংগৃহীত
* লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত পনেরো বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ ‘কাব্যবিলাস’। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলি প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জয়শ্রী দাসের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।

Skip to content