যে ভারতীয় সংগীত বেদ সম্ভূত হয়ে ক্রমশ মার্গ ও দেশি সংগীতের রূপ ধারণ করে, তার প্রাচীনতম ও আধুনিকতম রূপের সার্থক মেলবন্ধনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ হিসেবে আমরা যাঁর নাম সর্বাগ্রে করতে পারি, তিনি আর কেউ নন তিনি স্বর্গীয় পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে যেমন সংগীত জগতে তেমন সাধারণ মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দেশজ বাদ্যযন্ত্র সন্তুরকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের উপযুক্ত উপকরণ হিসেবে তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেন। নামেই যাঁর শিব অর্থাৎ মঙ্গলের অবস্থান তাঁর সুরের মূর্ছনা সহৃদয় থেকে সাধারণ সামাজিকের সার্বিক আনন্দের কারণ হবে তা বলাই বাহুল্য, আর তার সঙ্গে মিশেছিল তাঁর সাধনা। সেই সাধনার জন্ম ১৩ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে জম্মুতে। পাঁচ বছর বয়সে পিতা শ্রী উমা দত্ত শর্মার কাছে তাঁর শাস্ত্রীয় সংগীতের হাতেখড়ি। পিতা তাঁর বেনারস ঘরানার উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পী তথা তবলা ও পখাবাজ বাদক ছিলেন। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি জম্মুর স্থানীয় রেডিও স্টেশনে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গায়ক ও তবলাবাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ঠিক তেরো বছর বয়সে পিতা তাঁকে কাশ্মীর প্রদেশের লোকজ বাদ্যযন্ত্র সন্তুরের সঙ্গে পরিচয় ঘটান, যা তখনও হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীতে অব্যবহৃত ছিল।
মূলত পিতার উৎসাহে তিনি সন্তুরের নিবিষ্ট সাধক হয়ে ওঠেন আর এই বাদ্যযন্ত্রকে শাস্ত্রীয় সংগীতে ব্যবহারের অভিপ্রায় পোষণ করেন যা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ছিল কষ্টকল্পনা। এমতাবস্থায় ১৯৫৫ সালে তিনি সন্তুরকে মাধ্যম করে প্রথম শাস্ত্রীয় সংগীতের লোকানুষ্ঠান করেন, সেখানে প্রগতিপন্থীরা তাঁর প্রশংসা করলেও ঐতিহ্যবাদীরা তাঁর বিরূপ সমালোচনা করেন এই বলে যে সন্তুরের মতো নিয়ন্ত্রিত স্বরক্ষেপের বাদ্যযন্ত্র কখনও উচ্চাঙ্গ সংগীতের মাধ্যম হতে পারে না। আর এই সমালোচনা তাঁকে প্রবুদ্ধ করে সেই লোকজ অবহেলিত মাধ্যমকে মানুষ-কণ্ঠস্বরের পুনরুপযোগী করে তুলতে। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ক্রমশ সার্থক রূপ নেয় যখন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অনুপ্রবিষ্ট হয় উত্তর হিমালয়ের পাদদেশের সেই অনালোচিত যন্ত্র।
শিবকুমারের হাত ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লোকজ সংগীতের সঙ্গে ব্যবহৃত সন্তুর ভারতবর্ষের উচ্চাঙ্গ তথা সাধারণ গণমাধ্যমের সংগীতের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়। জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্র সিলসিলা, চাঁদনী, লমহে, ডরে তাঁর সুরারোপ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি ১৯৫৬ সালে ভি. শান্তারামের ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’তে একটি দৃশ্যের আবহসংগীত সৃষ্টি করেন। ১৯৬০ সালে তাঁর প্রথম একক কাজ রেকর্ড করা হয়। ১৯৬৭ সালে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় বিখ্যাত কাজ ‘কল অফ দ্য ভ্যালি’ নামে মুক্তি পায়। তাঁদের জুটি শিব-হরি নামে প্রসিদ্ধ হয়। তাঁর কিছু বিখ্যাত কাজ হল জাকির হোসেনের সঙ্গে হোয়েন টাইম স্টুড স্টিল (১৯৮২), হিপনোটিক সন্তুর (১৯৮৮), এ সাবলাইম ট্রান্স (১৯৯১), দ্য গ্লোরি অফ স্ট্রিং (১৯৯১), হান্ড্রেড স্টিংস্ অফ সন্তুর (১৯৯৩), আ মর্নিং রাগা গুর্জরী তোড়ি (১৯৯৪), যুগলবন্দী উইথ হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া (১৯৯৬), রসধারা (১৯৯৯), স্যটারডে নাইট ইন বম্বে-রিমেমবার শক্তি (২০০১), দ্য ফ্লো অফ টাইম (২০০২), ভাইব্রেন্ট মিউজিক ফর রেইকি (২০০৩), সিমপাটিকো (২০০৪), দ্য ইনর প্যাথ (২০০৪), এসেনসিয়াল ইভনিং চ্যান্টস্ (২০০৭)। দেশে-বিদেশে অনেক সম্মানে ভূষিত হন তিনি। ১৯৮৬-তে সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, ১৯৯১-এ পদ্মশ্রী, ২০০১-এ পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হন। এহেন দিকপাল শিল্পী আজ হঠাৎ হৃদরোগজনিত কারণে শোকসন্তপ্ত স্ত্রী ও পুত্রদের ছেড়ে অমৃতলোকে গমন করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৪। পুত্র রাহুল শর্মা তাঁর শিষ্য ও স্বক্ষেত্রে বিখ্যাত। তাঁর মতো প্রবাদপ্রতিম শিল্পী, গুরু, গবেষক, চিন্তক এবং সর্বোপরি সহৃদয় ব্যক্তির মৃত্যুতে দেশ আজ শোকস্তব্ধ। তাঁর মৃত্যুতে যেন ভারতীয় সংগীত জগতের একটা যুগের সমাপ্তি ঘটল।