‘পোন্নিয়িন সেলভান’-এর দ্বিতীয় ভাগে ঐশ্বর্যা রাই ও বিক্রম। ছবি: সংগৃহীত।
রিভিউ: পোন্নিয়িন সেলভান ২
পরিচালনা: মণি রত্নম
অভিনয়: বিক্রম, জয়রাম, কার্তিক, ঐশ্বর্য রাই বচ্চন (দ্বৈত চরিত্রে), তৃষা, প্রকাশ রাজ
ভাষা: তামিল, তেলেগু, মালায়লাম, হিন্দি
রেটিং: ৭/১০
ছবির শুরুতেই খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দীর দক্ষিণ ভারতের (মূলত তাঞ্জোর অঞ্চল) পথ, প্রান্তর, নদী, পর্বত আর তার মধ্যে কৈশোর, যৌবনের সন্ধিক্ষণে নিজেদের ভালোবাসা নিয়ে উপস্থিত দুজন। একজন রাজা সুন্দর চোলের জ্যেষ্ঠপুত্র আদিত্য কারিকালান (বিক্রম), অন্যজন আদিত্যের হৃদয়সর্বস্ব প্রায় অনাথ নন্দিনী (ঐশ্বর্য রাই বচ্চন)। কিশোর আদিত্যের নন্দিনীকে নিজের মাতা ও ভগিনী কুন্দবাই (তৃষা) এর সামনে ভবিষ্যত রাজমহিষী হিসেবে ঘোষণা নন্দিনীর জীবনে সংকট সৃষ্টি করে। রাজ্য থেকে উচ্ছেদ হয় তাঁর। কারিকালানের ছোটবেলার ভালোবাসা, না পাওয়া ভালোবাসা কল্কি কৃষ্ণমূর্তির ১৯৫৪ সালের পাঁচ খণ্ডের উপন্যাস ‘পোন্নিয়িন সেলভান’ এ তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হাহাকারের কারণ হয়। মৃত্যুতেই শান্তি। তিনি যে নন্দিনীর পালক পিতার হত্যাকারী ছিলেন। কারিকালান শোনেননি সেদিন তাঁর অনুনয় বিনয়, তাঁর তরবারি নেমেছিল রক্তাক্ত, শয্যাশায়ী, বৃদ্ধ, বীরপাণ্ডিয়নের (নাসের) বুকে। নন্দিনীর শোক ষড়যন্ত্রে পরিবর্তিত হয়। চোল সাম্রাজ্যের ধ্বংসই তাঁর কাছে প্রধান হয়। পর্বতেশ্বরকে বিবাহ ছিল তাঁর লক্ষ্যপূরণের মাধ্যম।
পরিচালক মণি রত্নম অসামান্য দক্ষতায় কল্কির বিখ্যাত উপন্যাসের দুই পর্বে যথাযথ চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন। প্রথম পর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বও সমান উপভোগ্য। চরিত্র চিত্রণ যথাযথ। উপন্যাসের চরিত্রেরা অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। সেই ইতিহাসে দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ পাণ্ড্য এবং চোলেদের মধ্যে এসে পড়ে মন্দাকিনী (বোবা রানি), যিনি নন্দিনীর মা এবং নন্দিনী স্বয়ং। মন্দাকিনী সুন্দরচোলের কনিষ্ঠ পুত্র অরুণমোজিকে (জয়রাম রবি) নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। অথচ নিজের ভালোবাসা সুন্দর চোলকে দেখতে এসে শত্রুপক্ষের তীর বিদ্ধ হয়ে সুন্দরের বাহুতে মারা যান। মাতা পুত্রীর তীব্র ভালোবাসা অজান্তে চোল রাজা এবং তাঁর বংশজের প্রতি প্রবাহিত হয়েছিল, যে কারণে কুন্দবাই নন্দিনীকে একসময় তাঁদের বৈমাত্রেয় ভগিনী ভেবে বসেন।
আরও পড়ুন:
ফিল্ম রিভিউ: শাকুন্তলম্: প্রেমের পরবশ থেকে মাতৃত্বের উত্তরণ
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪: একজন জ্ঞানী পণ্ডিত এবং ব্যবসায়ীর মধ্যে রাজা কাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন?
অজানার সন্ধানে: মিথ্যার সঙ্গে আপোষ না করে ছাড়েন চাকরি, দিন কাটে অনাহারে, কে এই ভারতের ফেভিকল ম্যান?
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১০: কিশোর কণ্ঠের উপর যেন এক অলিখিত দাবি ছিল পঞ্চমের
ছবির প্রথম পর্ব অরুণমোজি অথবা পোন্নিয়িন সেলভানের সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুর খবর প্রচারের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। কিন্তু তিনি মারা যাননি, বৃদ্ধ বোবা রানি যাঁকে দেখতে অবিকল নন্দিনীর মতো তিনি অরুণমোজিকে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচান। তারপর বল্লভারায়ণ (কার্তিক) ও সমুদ্রকুমারীর (ঐশ্বর্য লক্ষ্মী) চেষ্টায় অত্যন্ত অসুস্থ, প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত অরুণমোজিকে তাঁরা চূড়াপট্টনমের বৌদ্ধবিহারে নিয়ে আসেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের চিকিৎসা ও প্রার্থনায় পোন্নিয়িন সম্পূর্ণ সুস্থ হন। বৌদ্ধ বিহারে কুন্দবাই এবং কারিকালান তাঁদের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে আবেগ তাড়িত হয়ে একে অপরের ভালোবাসায় সিক্ত হন। দিগ্বিজয়ী বীররাও স্নেহ ভালোবাসার কাছে অসহায় প্রমাণিত হন, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা অরুণমোজিকে গুপ্ত ঘাতকদের থেকে রক্ষা করেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯: কৌরবদের জন্ম এবং কুরুপাণ্ডবদের ছেলেবেলার শত্রুতা
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৩: আচমকা রাতের পার্টিতে হাজির পুলিশ
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৮: গৃহ-সহায়িকার পাঁচালি এবং আমাদের ভদ্র সমাজ
সুন্দর চোলের ভ্রাতুষ্পুত্র মধুরান্তক চোলকে (রহমান) সিংহাসনে বসানোর যে প্রচেষ্টা প্রথম পর্বে দেখা গিয়েছিল তা এই পর্বেও সমান কার্যকর। চোলপাণ্ড্যদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অরুণমোজি জ্যেষ্ঠ হিসেবে তাঁকেই সিংহাসনে বসান। মধুরান্তকের মৃত্যুর পর পোন্নিয়িন চোল সিংহাসনে বসেন এবং রাজরাজ চোল হিসেবে খ্যাত হন। তাঁর সুদক্ষ, বিশাল নৌসেনা আজও উপমহাদেশের পরিশীলিত সাংগঠনিক ও গাণিতিক বুদ্ধির পরিচয় দেয়। কারিকালানের রাজধর্ম রক্ষা প্রেয়সীর নিদারুণ অনুরোধের থেকে বড় হয়। সেই পাপ মুক্তির জন্য নন্দিনীর হাতে মৃত্যুই তাঁর কাছে শ্রেয় মনে হয়। নন্দিনীও পরজন্মের আশায় মৃত্যুবরণ করেন।
পরিচালক যখন মণিরত্নম তখন কল্কির উপন্যাসের যে যথাযথ চিত্রায়ণ হবে বলাই বাহুল্য। হয়েছেও তাই। প্রথম পর্বের মতো এই পর্বেও পরিচালকের দেখানোর ভঙ্গি মূল গল্পের সময়কালকে আরও পাঁচশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। শৈব সম্প্রদায়ের অবস্থান এখানে প্রকট। তাঁরা সরাসরি মধুরান্তকের সাহায্যে এগিয়ে আসে। মাঝে মাঝে বেদমন্ত্রোচ্চারণ আবহসঙ্গীতের কাজ করে। প্রথম পর্বের মতো এই পর্বেও অস্ত্রশস্ত্র, সেই অস্ত্রের চালনা, যুদ্ধবিদ্যার প্রয়োগকৌশল সময়ানুগ ও যথাযথ। গ্রাফিক্সের বাড়াবাড়ি নেই। যুদ্ধের দৃশ্যে আশি-নব্বইয়ের দশকের সাধারণ ভাব বজায় থেকেছে। তীর ধনুক, বর্শা, কুঠার, তলোয়ার, আগুনের গোলার ব্যবহার করে যুদ্ধকৌশল দেখানো হয়েছে। মনগড়া ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ কোথাও নেই। যুদ্ধের দৃশ্য সন্তোষ শিবনের ছবি ‘অশোকে’র স্মরণ করায়।
আরও পড়ুন:
গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১: জলের তলায় তার শরীরের কোনও অস্তিত্ব নেই!
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৮: শুঁটকি মাছে কি আদৌ কোনও পুষ্টিগুণ আছে?
স্বাদে-আহ্লাদে: আম দিয়ে তৈরি এই লোভনীয় স্বাদের আচার খেয়েছেন?
কেল্লা, প্রাসাদ, মন্দির, নগর জীবনের দৃশ্যায়নে আসল আর সেটের পার্থক্য করা যায় না। পোষাক পরিচ্ছদ যথাযথ। রবি বর্মনের ক্যামেরার কাজ অনবদ্য এবং মণি রত্নম ও এলাঙ্গো কুমারভেলের চিত্রনাট্য আসল কাজ করে দেখিয়েছে। চরিত্রদের মধ্যে কথোপকথন গল্পের গতিকে এগিয়ে দিয়েছে, সঠিক পরিণতি দিয়েছে। সঙ্গীত পরিচালক এ.আর. রহমান নানা আবহ সৃষ্টির পাশাপাশি এবার অরিজিৎ সিং ও শিল্পা রাও গানের মাধ্যমে জাদু ছড়িয়েছেন। যে স্বপ্ন মণি রত্নম ১৯৮৯ সালে প্রথম দেখেছিলেন, ১৯৯৪ সালে প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন সেই স্বপ্নের সঠিক রূপায়ণ তিনি করলেন ২০২২ ও ২০২৩ সালে যথাক্রমে পিএস ১ এবং পিএস ২ এর মাধ্যমে। দেশের ইতিহাসধর্মী ছবির ক্ষেত্রে এই ছবি তাই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
* চলচ্চিত্র সমালোচনা (Film Review) : ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।