কখনও তাঁদের ঘরানার (রামপুর-সহসওয়ান) বন্দিশ গাইতে গিয়ে দীর্ঘ আলাপের মধ্যে আবেগের সিঞ্চন, কখনও ভালোবেসে ঘাড় ধাক্কা খাওয়া, সব কিছুর মধ্যে থেকেও কিছুর মধ্যে না থাকা মেয়ের দিনযাপনে ইরশাদ কামিলের কথায় ‘আওগে যব তুম হো সজনা’, আবার কখনও স্বয়ং বিশ্বকবির চরিত্র স্ফুরণে উদাত্ত কণ্ঠে বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ কিংবা হাল আমলের প্রজন্মের জন্য সেলিম—সুলেমান জুটির সঙ্গে ‘ছিনা রে মোরা চ্যান’ গাওয়া উস্তাদ রাশিদ খানের জাদুকণ্ঠের ছোঁয়া পায়নি এমন ঘরানা এবং উপমহাদেশীয় স্টাইলের গায়কি কমই আছে।
সব উপস্থাপনাতেই সমান স্বাচ্ছন্দ্য, সমান চলন। বৈঠকী আড্ডায় কিশোর কুমার তো শাস্ত্রীয় পরিবেশনে পণ্ডিত ভীমসেন জোশী, গানে গানে তাঁর শ্রদ্ধা পায়নি এমন যোগ্য, প্রবাদপ্রতিম পূর্বসূরি কমই আছেন, অথচ সরস্বতীর এই বরপুত্রই একসময় সঙ্গীতের শিক্ষাগুরু এবং দাদামশায় উস্তাদ নিসার হুসেন খান সাহেবকে রেওয়াজে ফাঁকি দিতে হেঁশেলে গিয়ে শিখে নিতেন কোরমা, কাবাব, বিরিয়ানির চলন।
আরও পড়ুন:
সেদিন ‘খণ্ডরে’র পুনঃপ্রদর্শন আনন্দ দিয়েছিল বিশ্বের তাবড় সিনেমাপ্রেমী থেকে বরেণ্য সেই পরিচালককে
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৫: প্রতিযোগিতা সর্বদা স্বাস্থ্যকর নয়, কদ্রুবিনতার শত্রুতায় কি তারই ইঙ্গিত?
ষাটের দশকে জন্মানো মাতৃহারা ছেলের তখন আশ্রয় সেই দাদামশায়। উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁ-তে তখন রামপুর-সহসওয়ান ঘরানা জুড়ে কিংবদন্তি শিল্পীদের ভিড়। ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা মেহবুব খান ও তাঁর পুত্র ইনায়েত হুসেন খান। পরবর্তী দুই প্রজন্মের উজ্জ্বল দুই নক্ষত্র উস্তাদ নিসার হুসেন খান এবং উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খান। তাঁদের কাছেই রাশিদজির স্বরে, সুরে, রাগে, তালে হাতেখড়ি। আর তারপর ব্রহ্ম থেকে প্রত্যুষ হয়ে প্রদোষ না গড়ানো পর্যন্ত শুধুই চর্চা আর চর্যা।
সেই চর্চাই সম্বল হয় ১৯৭৮ সালে দিল্লিতে আইটিসি-র সম্মেলনে প্রথম গাইতে যাওয়ার, আবার ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে বঁদায়ূ থেকে পাকাপাকি ভাবে দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খান সাহেবের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসার। কলকাতায় সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। রাশিদজির শুরুর দিনগুলিতে সেই অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা, কর্ণধার পণ্ডিত বিজয় কুমার কিচলু তাঁর সঙ্গী-সাথী নিয়ে অ্যাকাডেমিতে নিত্য উপস্থিত থাকতেন। লক্ষ্য করতেন অনুশাসনে বাঁধা যেত না ‘ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের এই ভবিষ্যত’কে। তাঁরা ছোট রাশিদকে কিছু গাইতে বললেই তিনি গেয়ে উঠতেন পুরোনো হিন্দি ছবির রাগনির্ভর মহম্মদ রফি, মান্না দে, তালাত মাহমুদের বিখ্যাত গানগুলি। এমন নানান মজার মধ্যে কখনও থামেনি তাঁর নিজস্ব সাধনা, সাফল্যের সিঁড়ি চড়া।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৮: শুরু হল কঠিন জীবনচর্যা
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৭: কী করে তোকে বলব!
শহর কলকাতা দেখেছে তাঁর বিগত চার দশকের উত্থান। পুরোনো কলকাতার সাধারণ গলির আয়োজন থেকে বিখ্যাত ক্লাসিক্যাল মিউজিক কনফারেন্সে তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে মধ্যম ও ধীর লয়ে ছন্দোময় বন্দিশের পুনরাবৃত্তিতে তা সে ‘ইয়াদ আওত মোহে পি কী বতিয়া’ বা ‘ইয়াদ পিয়া কী আয়ে’ হোক কিংবা ‘শ্যাম নাম পবন জস গঙ্গা’, ‘ব্রজ কে নন্দলালা’, ‘দুখ মে সুমিরন সব করে’, মুগ্ধ হয়েছেন উস্তাদ লতাফত হুসেন খান, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিজা দেবী, দীপালি নাগ, পণ্ডিত ভীমসেন যোশী, উস্তাদ আমজাদ আলি খানের মতো মার্গীয় সঙ্গীতের ঈশ্বরেরা। শেষ জীবনে সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের যেমন আশ্রয় ছিল মহম্মদ রফির ভজন, তেমনই অকালে প্রয়াত রাশিদ খানেরও নিজস্ব পছন্দের তালিকায় ছিল মহম্মদ রফির বিখ্যাত কিছু গান। উস্তাদ আমির খান ও পণ্ডিত ভীমসেন জোশীর গায়নশৈলীরও একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন তিনি।
নিজে এতবড় ঘরানার উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়েও সমান শ্রদ্ধাবোধ রাখতেন অন্য ঘরানার প্রতি। তিনি বলতেন, সব ঘরানার মধ্যে ভালো কিছু আছে, কেউ কতটা গ্রহণ করতে পারবে সেটা তাঁর শিল্পীসত্তার উপর নির্ভর করে। খাঁটি হিন্দুস্তানি সংগীতকে লঘু সঙ্গীতের ঘরানার সঙ্গে মিলিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। যখনই নতুন বন্দিশ (মূলত রাগ ললিত, মেঘ, বেহাগের উপর) রচনা করেছেন সেগুলি গুরু উস্তাদ নিসার হুসেন খান সাহেবকে উৎসর্গ করেছেন। সবসময় মানতেন, ভাল গুরুর সান্নিধ্য পেলে তবেই ভাল শিষ্য হওয়া যায়।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৩: রাজসেবায় পুরস্কার মিলতেও পারে, নাও মিলতে পারে! কিন্তু সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে রাজরোষে মৃত্যু নিশ্চিত
ওদিকে রূপালী দুনিয়ায় ২০০৪ সালে সুরকার ইসমাইল দরবারের ‘কাহে উজড়ি মোরি নীদ’ ও ‘তোরে বিনা মোহে চ্যায়ন নাহি’ দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই জয়যাত্রা সন্দেশ শাণ্ডিল্যর ‘আওগে যব তুম হো সজনা’র মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। আবার ১৯৯৯ থেকে উস্তাদ সুলতান খান, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি এবং শঙ্কর মহাদেবনের ‘অলবেলা সজন’ শুনতে অভ্যস্ত শ্রোতাদের তিনি শোনাতেন তাঁদের ঘরানা অনুযায়ী একই বন্দিশ। নিজে ভালো তবলা বাজাতে জানতেন তাই তাঁর উপস্থাপনায় ছন্দ, লয়, তান, সরগমের পকড় অন্য মাত্রা পেত।
খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা প্রাণখোলা, আমুদে, আড্ডাপ্রিয় আর শিশুর সরলতা নিয়ে বেঁচে থাকা, নামী শিল্পী না হলেও তাঁদের গুণের কদর করা, গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বিশ্বাসী, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতিনিধি হয়েও রবি ঠাকুরের গান গাওয়া মানুষটা গত মঙ্গলবার ৯ জানুয়ারি স্বল্প রোগভোগের পর চলে গেলেন না ফেরার দেশে। রেখে গেলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সেই পরম্পরা যাতে অবগাহনে ভয় করলেও পুণ্যস্নানে শুধুই আনন্দ।
* কৃতজ্ঞতা স্বীকার: গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়
* কৃতজ্ঞতা স্বীকার: গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়
* লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত চৌদ্দ বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ ‘কাব্যবিলাস’। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলি প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জয়শ্রী দাসের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।