বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ভাষা: হিন্দি
মূল কাহিনি: কিয়োগো হিগাসিনো
চিত্রনাট্য: সুজয় ঘোষ ও রাজ বসন্ত
পরিচালনা: সুজয় ঘোষ
অভিনয়: করিনা কাপুর খান, বিজয় ভার্মা, জয়দীপ আহলোয়াৎপ্রমুখ
ওটিটি রিলিজ: নেটফ্লিক্স
সময়সীমা: ১৩৯মিনিট
রেটিং: ৬.০/১০
কাহানি’র বব বিশ্বাসের মতোই নাড়া দিয়ে যাওয়া ভিলেন চরিত্র হয়ে উঠেছিল ১৯৬৩’র বাঙলায় ‘উত্তর ফাল্গুনী’ বা ১৯৬৬তে নির্মিত হিন্দি ‘মমতা’ ছবিতে কালিপদ চক্রবর্তী অভিনীত রাখাল ভট্টাচার্য চরিত্রটি।’দ্য ডিভোসান অফ সাস্পেক্ট এক্স’নামের এই মূল উপন্যাসের রচয়িতা জাপানি সাহিত্যে বেশ সফল কিয়েগো হিগাসিনো। ১৯৮৬ থেকে হিগাসিনো স্কুলের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে লেখাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। এই উপন্যাসকে অবলম্বন করেই পরিচালক সুজয় ঘোষ গড়ে তুলেছেন রহস্য রোমাঞ্চে ভরা’জানে জাঁ’। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই ছবি’সাস্পেক্ট এক্স’ নামে মুক্তি পেয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল কিয়োগো হিগাসিনো ১৯৬৩ সালের উত্তরফাল্গুনী বা ১৯৬৬ সালের মমতা ছবিটি কবে দেখেছিলেন বা আদৌ দেখেছিলেন কিনা। এ প্রশ্নটা মনে আসার কারণ হল ভিগাসিনোর বহু ভাষায় অনূদিত হওয়া এই উপন্যাস’দ্য ডিভোসান অফ সাস্পেক্ট এক্স’-এর মূল কাঠামোর সঙ্গে উত্তর ফাল্গুনী বা অনেক পরের শ্যামবাজার পাড়ার নাটক ‘পান্নাবাঈ’-এর ভীষণ মিল।
উত্তর ফাল্গুনীর ঔপন্যাসিক ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত পেশায় চিকিৎসক, চর্মবিশেষজ্ঞ হিসেবে বিলেতের ডিগ্রি নিয়ে চিকিৎসাসূত্রে দেশে বা বিদেশের বর্মা বা মিশরেও যেতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর নেশা সাহিত্যরচনা। কালো ভ্রমর ও কিরীটি রায়ের স্রষ্টা নীহাররঞ্জন গুপ্ত প্রায় ২০০র বেশি গল্প উপন্যাস লিখেছেন, ৪৫টির বেশি জনপ্রিয় বাংলা বা হিন্দি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে তাঁর গল্প -উপন্যাসের ভিত্তিতে। উত্তর ফাল্গুনীও হিন্দিতে মমতা(১৯৬৬) তামিলে কাব্য থালাইভি (১৯৭০) মালয়ালাম ভাষায় পুষ্পাঞ্জলি (১৯৭২) নামে পুনঃনির্মান হয়েছে।
আরও পড়ুন:

রিভিউ: বলিউডের চেনা চাকচিক্যের আড়ালের অন্ধকারকে আলোয় এনেছে ‘দ্য ফেম গেম’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২০: সুন্দরবনের বসন্ত রোগ নিরাময়কারী দেবী শীতলা

আরও একটা তথ্য জানতে পেরে ভাল লাগল বুঝতে পারলাম, ফেলে আসা সময়ের শিল্পীরা কোথায় এগিয়ে ছিলেন। সংখ্যার হিসেবে উত্তর ফাল্গুনী উত্তমকুমার প্রযোজিত চারনম্বর ছবি কিন্তু কাহিনির দাবি ও মূলপূরুষ চরিত্রের অবস্থানের কথা মাথায় রেখে উত্তম-সুচিত্রা জুটির নিশ্চিত সাফল্য সত্ত্বেও মণীষের ভূমিকায় বিকাশ রায়কে নির্বাচন করেন। তাঁর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। উত্তরফাল্গুনী ব্লকবাস্টার হিট হয়েছিল। এখনকার গুলিয়ে দেওয়া হিসেব নয় তিনটি হলের চেনে টানা ১৫ সপ্তাহ চলেছিল। আর ১৯৬৪ সালে সেরা বাঙলা ছবি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল এই ছবি।

অনেক আগে নন্দনে জাপানের বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক আকিরা কুরোশাওয়ার ১৯৬৫-তে করা’রেড বিয়ার্ড’ছবিটি দেখতে বসে বেশ কিছু জায়গায় আরোগ্য-নিকেতনের সঙ্গে ভীষণ মিল পেয়েছিলাম। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলা ছবি আরোগ্য-নিকেতন তৈরি হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। কিন্তু তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিখ্যাত উপন্যাসটি লিখেছিলেন অনেক আগে ১৯৫৩ সালে।
পৃথিবীর দুইপ্রান্তে বসে দু’জন ভিন্ন সৃষ্টিশীল মানুষের একই ঘরানায় একই ধারায় চিন্তাভাবনায় কোন আপত্তি নেই। কিন্তু সুজয় ঘোষের’জানে জাঁ’ দেখতে বসে বারবারই উত্তরফাল্গুনীর রেশ খুঁজে পাচ্ছিলাম। সেই রাখাল ভট্টাচার্যের ক্রমাগত ব্ল্যাকমেল করা। মেয়ের কাছে দেবযানী বা এখানে সোনিয়া মাত্রে ওরফে মায়া ডি সুজার (করিনা কাপুর খান) আসল পরিচয় ফাঁস করে দেবার হুমকি। দেবযানীর স্বামী রাখাল ভট্টাচার্য খুন হয়েছিলেন। সোনিয়ার স্বামীএএসআই অজিত মাত্রেও খুন হলেন। এখানে মাথার পিছনে ইমারসন হিটারের কয়েলের আঘাতে সেখানে পিস্তলের গুলিতে।আরোগ্য নিকেতন বা মমতায় টানটান কোর্টরুম ড্রামা ছিল। এখানে খুনি ধরা পড়ার একটা টেনশন– একটা কি হয় কি হয় ভাব মিশিয়ে থ্রিলারের চেহারা দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৪: কোন সকালে মুক্তির অপেক্ষায় ‘ত্রিযামা’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৪: পানমশলা খেলে ক্যানসার হয়?

ছবিতে রহস্য রোমাঞ্চকে বাড়ানোর অনেকরকম উপকরণ রয়েছে। কিন্তু কেন জানিনা কাহানির পর থেকে সুজয় ঘোষ-এর কোন ছবিতেই সেই উপকরণের মিলমিশটা ঠিক কাহানির মতো হচ্ছে না।

করিনা কাপুর ভালো অভিনয় করার খুব চেষ্টা করেছেন। তবে সেই চেষ্টাটা আলাদা করে বোঝা যাচ্ছিল। একটা ডি-গ্লামারাইজড নো-মেকআপ লুকে ঝকঝকে মেনস্ট্রিম ছবির দামি নায়িকা করিনা কাপুর খানকে মন্দ লাগেনি। কিন্তু ওটিটির সিনেমা খানিকটা টি-টোয়েন্টির মতোসেই বিচারে তাঁর অভিনয় খুব একটা ধারালো মনে হয়নি।
এক একজন অভিনেতা এক একটা বিশেষ ভূমিকায় খুব স্বচ্ছন্দ হন। যেমন বিজয় বর্মা। চরিত্রের মধ্যে একটু ডার্ক শেডস থাকলে বিজয়কে থামানো যায় না। কিন্তু এই ধরনের চরিত্র যেটা ফ্ল্যাট। যে চরিত্রে বিশেষ কিছু ঘটছে না। সেই চরিত্রকে সামলে লোকের মনে দাগকাটা কিন্তু ভীষণ শক্ত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বিজয়ের এই চরিত্রে আরও অনেক কিছু করবার জায়গা ছিল যেটা তিনি করতে পারেননি।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১২: তেত্রিশের ঐতিহ্য

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

২০২০তে পাতাললোক ওয়েবসিরিজের ইন্সপেক্টর হরিরাম চৌধুরীর ভূমিকায় জয়দীপ আহলোয়াৎকে দেখে চমকে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার আগে ২০১২ তে গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর-এ শাহিদ খান, ২০১৭য় শাহরুখ খানের ‘রইস’ ছবিতে নবাব, মেঘনা গুলজার-এর ছবি ‘রাজি’তে খালিদ মীর, দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সন্দীপ আর পিংকি ফারার’ ছবিতে ত্যাগী – বারবার অবাক করেছেন জয়দীপ আহলোয়াৎ। নিউজ মিডিয়ার অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্রিটিশ ধারাবাহিক ‘প্রেস’ অবলম্বনে ২০২২-এর ওয়েবসিরিজ ‘দ্য ব্রোকেন ন্যুজ’-এ দীপঙ্কর স্যান্যাল আর ২০২৩-এ সুজয় ঘোষের ‘জানে জাঁ’ ছবিতে নরেন ভ্যাস। এমন একটা অসাধারণ চরিত্রায়ন করেছেন জয়দীপ যেটার ধারে কাছে বিজয় ভার্মা বা করিনা কাপুর পৌঁছতে পারেননি। যেহেতু থ্রিলার এবং খুনি খুন সবই রয়েছে তাই দর্শকের মনে অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হবে যার সঠিক উত্তর কাহিনি বিন্যাসে হয়তো ঠিক, ঠিক পাওয়া যায় না। তবু এই ছবিটা দেখার কারণ হবে জয়দীপ আহলোয়াৎ-এর অনবদ্য অভিনয়।
* ফিল্ম রিভিউ: জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। দ্বিতীয় খণ্ড লিখেছেন।

Skip to content