বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবির মূল চরিত্রে অভিনেতা অমিত সাহা

পরিচালক সত্রাবিত পালের প্রথম ছবি ‘নিতান্তই সহজ সরল’ কবে আসতে চলেছে কলকাতায়? প্রান্তিক জীবন থেকে শুরু করে বাংলা চলচ্চিত্রে কলকাতাকেন্দ্রিকতা এবং নিতান্তই সহজ, সরল নিয়ে ‘সময় আপডেটস’-এর মুখোমুখি পরিচালক সত্রাবিত পাল

‘নিতান্তই সহজ সরল’ যথার্থই সহজ, সরল ছবি।
পরিচালক সত্রাবিত পালের প্রথম ছবি ‘নিতান্তই সহজ সরল’ কী বলবে নিজের প্রথম ছবি নিয়ে?
●● এই ছবিটা যে গল্পটা নিয়ে তৈরি করা সেই গল্পটা লেখা হয়েছিল ২০১৫-১৬ সাল নাগাদ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র ছিল আমারই বন্ধু কমলেশ। বিষয়বস্তুটার প্রথম আউটলাইনটা আমি ওর কাছ থেকেই পাই। ‘নিতান্তই সহজ সরল’ আসলে আমাদের ছোটবেলার সময়কার সেই কাঠি আইসক্রিমওয়ালার গল্প। আমার বাড়ি কোচবিহার জেলার হলদিবাড়িতে। হলদিবাড়ি মূলত এক প্রান্তিক মফস্বল এলাকা। ওপারে বাংলাদেশ। আমার বেড়ে ওঠা এই মফস্বলেই৷ আসলে আমার ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র এই মফস্বলেরই এক আইসক্রিমওয়ালা৷ যে সাইকেলের পেছনে একটা কাঠের বাক্সে কাঠি আইসক্রিম বিক্রি করে বেড়ায়, মফস্বল থেকে আরও ইন্টিরিয়রের গ্রামগুলোতে। কিন্তু নিজের পেশা নিয়ে তার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, এক অদ্ভুত আয়েশে সে চলে। চলাটাই তার একমাত্র লক্ষ্য। এভাবে কাটাতে কাটাতেই সে এক মেলার খবর পায় এবং মেলায় যাবার জন্য বেরিয়েও পড়ে কিন্তু তার গন্তব্যে সে আর পৌঁছতে পারে না। ওই পথের যাত্রাটুকুই তার থেকে যায়। আসলে একটা পথের গল্পই, একটা শেষ না-হওয়া জার্নিই আমার ছবির মূল চরিত্রকে নির্মাণ করেছে।
এই যে একটা শেষ না হওয়া জার্নি, এটা কেন?
●● এটার একটা কারণ হল আমি আমার ছবির মূল চরিত্রকে আমার নিজের ভাবনার একটা প্রতিরূপ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় যে আমার জীবনে একটা গন্তব্য বা লক্ষ্য থাকলেও সেই লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য যে যাত্রাটা ওই যাত্রাটুকুই আমার জীবনের মূল নির্যাস। আমার ছবির চরিত্রেরও যাওয়ার পথে অজস্র মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। প্রতিটি মানুষেরই আলাদা আলাদা গল্প। গল্পের ভিতরে গড়ে ওঠা গল্প যে স্মৃতির কোলাজ তৈরি করে সেই কোলাজ নিয়েই এই ছবি। নিজের সাইকেলটা হারিয়ে ফেলে আবার সেটা খুঁজে পাওয়ার পরে যে অদ্ভুত আনন্দ পায় আমার ছবির আইস্ক্রিমওয়ালাটি, সেই ছোট ছোট আনন্দগুলোতেই জীবনের যে ডিটেইলিং, যে সূক্ষ্মতা সেইটুকুই ধরতে চাওয়া কেবল, আর কিছুই না। হালকা মজার মোড়কে একটা সহজ সরল স্মৃতির কোলাজ, এইটুকুই ‘নিতান্তই সহজ সরল’।

পরিচালক সত্রাবিত পাল

বিশ্বায়ন পরবর্তী জীবনে বেড়েছে আমাদের যান্ত্রিকতা, লক্ষ্যে পৌঁছানোর তাড়ায় জীবনের সূক্ষ্মতা, ছোট ছোট ভালোলাগাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ‘নিতান্তই সহজ সরল’ কি এই পৃথিবীরই এক বিপ্রতীপ পিঠ?
●● বলতে অনেকটা সেরকমই। আমাদের হলদিবাড়ি কিন্তু এখনও বেশ শ্লথগতিতে, ঢিমেতালেই চলে। আমাদের ওখানে মোবাইল এসেছে ২০১০-২০১২ সালে। এই ছবিটা কিন্তু কেবলমাত্র একজন আইসক্রিমওয়ালারই গল্প নয়। আমার ছবিতে সেই সমস্ত প্রান্তিক মানুষদের গল্প উঠে এসেছে যাদের কারও জীবিকা হয়তো চাষ করা, আবার কেউ হয়তো পুকুর থেকে শাপলা ফুল তুলে বিক্রি করে পেট চালায়। এই জীবনযাত্রাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য যে পটভূমিকাটা যথাযথ হতে পারে সেই দিকেই নজর দেওয়ার চেষ্টা করেছি কেবল। আমরা এখানে কোচবিহারের লোকায়ত বিভিন্ন আর্ট ফর্মকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। ‘চোর চুরনী’, বলে এখানকার একটা খুব পুরনো ফোকলোর আছে। সেটা খুঁজে পেলাম না কিছুতেই। কিন্তু আমি এখানকার ‘বেদে বেদেনির গান’ বলে একটা ফোকলোর আছে, সেটা ব্যবহার করেছি আমার ছবিতে। এখানকার পালাটিয়া কীর্তনও ব্যবহার করেছি।

এই যে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষদের জীবনযাত্রাকে তুমি তোমার ছবিতে তুলে আনতে চেয়েছ এই ক্লাস স্ট্রাকচার সম্পর্কে বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্র কতটা সচেতন বলে তোমার মনে হয়?
●● দেখো প্রান্তিক মানুষরা চিরকালই অবহেলিত। আর আমাদের মূল ধারার ছবির বিষয়বস্তু যে মূলত আরবান সংস্কৃতিকেন্দ্রিক সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে, বলতে পারো যে, সচেতনতা সত্যি খুব একটা চোখে পড়ে না। তার চেয়ে বরং পুরনো অনেক ছবিতে গ্রামকে, গ্রামের মানুষদের যাপনকে যেভাবে পোট্রে করা হত তাতে অনেক বেশি গ্রামসংক্রান্ত ডিটেইলিংগুলো ধরা পড়ত। বর্তমানে ছবিতে গ্রাম দেখানো হলেও বাস্তব ইমেজারির একটা অভাব সেখানে থেকেই যায় কারণ প্রথমত যে মানুষটি শহরে বসে গ্রামের কথা লিখছে তার কাছে প্রান্তিক জীবনের সূক্ষ্মতাগুলো ধরা একটু কঠিন তো হবেই। আর দ্বিতীয়ত, গ্রাম তো সব জায়গায় একরকম নয়। আঞ্চলিক বিচিত্রতার ভিত্তিতে গ্রামের লোকায়ত সংস্কৃতি তো বদলে বদলে যায়, সুতরাং একরৈখিকভাবে প্রান্তিক জীবনের রিপ্রেজেন্টেশন করতে গেলে তাতে ডিটেইলিং-এর অভাব থাকাটাই স্বাভাবিক।

এই যে একটা আরবানকেন্দ্রিকতা এটা কি মূলত ফাইনানশিয়াল সুবিধা বা পুঁজিকেন্দ্রিকতার জন্য?
●● সেটা একটা কারণ হতে পারে কিন্তু সবটা নয়। এই সময়ে কলকাতাকেন্দ্রিক ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি অধিকাংশ বাংলা ছবিতে যেভাবে গ্রাম বা আঞ্চলিক ভাষাকে রিপ্রেজেন্ট করা হয় সেটা তো আগাগোড়াই কাল্পনিক একটা ইমেজারি থেকে খাড়া করা, দোষ কিন্তু নির্মাতাদের নয়, তাদের পক্ষে সম্ভব নয় কলকাতায় বসে আঞ্চলিকতাকে ডিসকভার করা, অথচ দর্শকের গ্রাম দেখার একটা বিলাসী শখ যে আছে সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না, ফলত যা হওয়ার সেটাই হচ্ছে।

'নিতান্তই সহজ সরল' -এর একটি দৃশ্য।

আবার একটু তোমার ছবিতে ফিরি। তোমার ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন অমিত সাহা। অমিতদা দুর্দান্ত একজন অভিনেতা, কিন্তু স্টারডমটা দুর্ভাগ্যবশত এখনও ঠিক অ্যাচিভ করে উঠত পারেনি অমিতদা। মূল ধারার ছবিতে স্টারকেন্দ্রিকতকা একটা বড় বিষয়। এটা নিয়ে তোমার কী মত?
●● অমিত ভয়ংকর ভালো একজন অভিনেতা। ও হয়তো মূল চরিত্রে আগে কাজ করার সুযোগ পায়নি। কিন্তু পরিচালক অরিন্দম শীলের সঙ্গে কাজ করেছে, প্রদীপ্তদা তো প্রায় প্রথম থেকেই অমিতকে নিয়ে কাজ করছেন। তবে স্টারডমটা মুম্বই যেভাবে হ্যান্ডেল করে টলিউড দুর্ভাগ্যবশত সেভাবে করে না৷ বলিউডে ইরফান খানের মতো একজন চরিত্রাভিনেতাও স্টার আবার শাহরুক খানও স্টার। যদিও এখানে সেই আবহ এখন অনেকটাই তৈরি হয়েছে কিন্তু হ্যাঁ, ছবির সঙ্গে বাণিজ্যিক পারপাসে ডিল করার ব্যাপার থাকলে স্টারকেন্দ্রিকতাকেও পাত্তা দিতে হয় কখনও কখনও (হাসি)।

তোমার ছবির আবহ কে করেছেন?
●● আমার ছবিতে কোনও আবহ নেই। পুরো কাজটাই অ্যাম্বিয়েন্স ক্রিয়েটেড সাউন্ডে করা হয়েছে। সাউন্ড ডিজাইনিং-এর কাজ করেছে ঋদ্ধি চ্যাটার্জি। ওরও এটা প্রথম কাজ। ও রূপকলা কেন্দ্রের ছাত্র। সাউন্ড ডিজাইনিং-এর দায়িত্বে ঋদ্ধি ছিল।

কলকাতায় কবে আসতে চলেছে ‘নিতান্তই সহজ সরল’?
●● আমরা তো অলরেডি প্যানোরমাতে (গোয়ার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল) ছবিটা পাঠিয়েছিলাম। এরপর লস এঞ্জেলস একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়, ওখানে পাঠানোর ইচ্ছে আছে। আর কলকাতায় আমার আর নিমাইদার (প্রযোজক নিমাই শাসমল) দুজনেরই ইচ্ছে আছে ছবিটা নন্দনে রিলিজ করানোর। এখন দেখা যাক কী হয়।

Skip to content