প্রথম আলাপ আমার লেখা প্রথম দূরদর্শন ধারাবাহিক সোনার সংসারের সেটে। পরিচালক নিশীথদা (অগ্রদূতের নিশীথ বন্দ্যোপাধ্যায়) আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রীলা মজুমদার তখন হিন্দি বাংলা অন্যধারার ছবিতে যথেষ্ট পরিচিত নাম। শুক্রবার রাত আটটা রবিবার দুপুর তিনটের বাংলা নাটকে তার অসাধারণ কণ্ঠস্বর বহুবার শুনে ফেলেছি। এমন একজন শিল্পী আমার মতো নতুন একজন চিত্রনাট্যকারের সঙ্গে প্রথম দিন যেভাবে কথা বলেছিলেন তা আমাকে অবাক করেছিল।
শঙ্করের সোনার সংসার উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই মুকুলিকা বা মুকুলের চরিত্র এখনও মনে রেখেছেন। বেশ কিছুদিন আগে প্রদীপদা প্রদীপ মুখোপাধ্যায় চলে যাবার পর সোনার সংসার প্রসঙ্গ এসেছিল। আজ আবার এল। প্রতিবেশী পরিবারের যুবক অমলেন্দুকে ভালোবাসতো মুকুলিকা। অমলেন্দুর সামনে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবার একটা সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সুযোগটা নেওয়া দূরের কথা বিমানের টিকিট কাটার পয়সাও তার কাছে ছিল না। মুকুলিকার মা মারা গিয়েছেন ছোটবেলায়। তার কাছে রাখা মায়ের হার বিক্রি করে সেই টাকা অমলেন্দুর হাতে তুলে দিয়েছিল মুকুলিকা। অমলেন্দু বিদেশে গিয়েছিল। সেখানে সসম্মানে চাকরি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিল।
অমলেন্দুর পরিবারের চেহারা বদলে গিয়েছিল। বিদেশ থেকে অমলেন্দুর এক বান্ধবী এসেছিল অমলেন্দুর কলকাতার বাড়ি দেখতে। কেউ না বুঝতে পারলেও মুকুলিকা বুঝতে পেরেছিলকি ঘটতে যাচ্ছে? বুঝতে পেরেছিলেন অমলেন্দুর বাবা আদর্শবান শিক্ষক। শঙ্করের বিখ্যাত উপন্যাস সোনার সংসার অবলম্বনে গত ৩০ শে আগস্ট ২০২২ সময় আপডেটের পাতায় প্রদীপদার স্মৃতিচারণায় যে টুকরো চিত্রনাট্যটি তুলে ধরেছিলাম আজ আবার সেখানেই ফিরে গেলাম। স্মৃতি তো বারবার অতীতেই ফিরতে চায়…
ইডেন/ সামনে ছোট্ট লেক/ আউটডোর/ দুপুর
জলের দিকে চেয়ে মুকুল। ওঁর দিকে পিঠ করে বসে অমলেন্দু।
অমলেন্দু: শুদ্ধু টাকার জন্যে চান্সটা হাত থেকে বেরিয়ে গেল। শুনলুম একটা এয়ারলাইন্স ধারে টিকিট দেয়। কিন্তু সেখানেও কিছুটা অ্যাডভান্স দিতেই হবে।
মুকুল জলের দিকে চেয়ে বলে —
মুকুল: আরও তো তিনদিন সময় আছে!
অমলেন্দু ম্লান হাসে তারপর মুকুলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে—
অমলেন্দু: মিস্টার জ্যামিশনের কাছ থেকে আজই একটা টেলিগ্রাম এসেছে মুকুল। Schedule Date -এ reach না করলে—
মুকুল: তুমি schedule date-এই reach করবে।
অমলেন্দু সামান্য হেসে মাটিতে ঘুসি মেরে বলে—
অমলেন্দু: Hope! Sweet Hope!
মুকুল পার্সখুলে একটা মোটা খাম বের করে অমলেন্দুকে বাড়িয়ে দেয়—
মুকুল: এটা রাখো
অমলেন্দু পাশ ফেরে —
অমলেন্দু: কী এটা?
উঠে বসে খামটা নেয়। মুকুল হাসছে।
মুকুল: কাল সকালেই এয়ারলাইন্স অফিসে জমা দিয়ে আসবে।
অমলেন্দু ইতিমধ্যে খামটা খুলেছে। গোটা পঞ্চাশ-ষাট একশো টাকার নোট।
অমলেন্দুর হাতে ধরা টাকাটার — ক্লোজআপ
আজ থেকে ৩৮ বছর আগের লেখা একটি চিত্রনাট্যের অংশবিশেষ। ১৯৮৬-তে দূরদর্শন কেন্দ্র কলকাতা সম্প্রচার করেছিলেন প্রথম স্পনসর্ড সিরিয়াল ‘সোনার সংসার’। মুকুলিকার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন শ্রীলা মজুমদার।
এরপর আবার দেখা হল আমার চিত্রনাট্যে ওমপুরিকে নিয়ে করা স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি প্রেমচন্দ রচিত ‘সওয়া সের গেঁহু’ ছবিতে। ওম পুরীর বিপরীতে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন শ্রীলা মজুমদার। পাকুড়ে ছবির আউটডোর শুটিং হয়েছিল।
এরপর আরও বেশ কিছুদিন পর রবীন্দ্র সদনে আস্থায়ী সংস্থার বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমি অনুষ্ঠান সংযোজনা করছিলাম। শ্রীলা শ্রুতি নাটক পড়লেন। অনবদ্য কণ্ঠস্বর অসাধারণ শব্দোচ্চারণ অতুলনীয় কণ্ঠ প্রক্ষেপণ।
জানাতে চাননি তাঁর শরীরের মধ্যে বাসা বাঁধা দূরারোগ্য ব্যাধির কথা। শ্রীলা মজুমদার না ফেরার দেশে চলে গেলেন, কিন্তু তার অভিনীত বেতার নাটকে চলচ্চিত্রের অনবদ্য সব চরিত্রে তিনি বারবার ফিরে আসবেন আমাদের মনে। চিরকালীন হয়ে থেকে যাবেন।
* মুভি রিভিউ: জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’। বসুন্ধরা এবং… ১ম খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে এই উপন্যাসের ২য় খণ্ড শেষ করে এখন লিখছেন তৃতীয় খণ্ড।