মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


মঞ্চে রোবট নির্মাণ

সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অভিনীত হল লোককৃষ্টি’র এই জমজমাট জনপ্রিয় নাটক। অতিমারির শেকলপরা আতঙ্কের মধ্যে এই নিটোল পারিবারিক কমেডি দুঘণ্টার মানসিক মুক্তি।

নাটকের গল্প

মাঝবয়সি (৩৫-৩৬) পলাশ কাঞ্জিলাল একজন সফটওয়্যার জিনিয়াস। ইঞ্জিনিয়ারিং সেকেন্ড ইয়ার থেকেই সুন্দরী তন্বী বেবী রায় তার স্থিতু মানসসঙ্গিনী—মানে স্টেডি সোল মেট আর কী। বেবীও তার আদরের পুলুসোনাকে পাগলের মতো ভালোবাসত আজও ভালোবাসে। পাশ করে স্বচ্ছন্দে পলাশ ঠান্ডাঘরের মোটা মাইনের চাকরিতে সেঁটে বিয়ে-থা করে বাচ্চাকাচ্চা গাড়ি কুকুর কোলস্টেরল নিয়ে দিব্যি থাকতে পারত— কিন্তু সে তা করেনি। কারণ তার মাথায় অন্যকিছু করার পোকারা কিলবিল করে উঠেছিল। এবং হালিশহরের তারক ও সন্ধ্যারানি কাঞ্জিলালের একমাত্র সন্তান তিন বছরের জম্পেশ চাকরির পাকাঘুঁটি কাঁচিয়ে ছাতনাতলায় না গিয়ে আরও পড়াশোনা করতে ইউ-কে পাড়ি দিল। সেখানে সসম্মানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর বিদেশের ইউনিভার্সিটিই পলাশকে ডক্টরেট করার সুযোগ দিল৷ শর্ত একটাই—পিএইচডি করার চার-পাঁচ বছরের পুরো খরচটার হয় ফান্ডিং জোগাড় করতে হবে—নতুবা নিজেকে পুরো খরচ দিতে হবে। খরচ নিজে দেবার সুযোগ নেই—ফান্ডিংও জুটল না—চাকরি পেলেও টিকল না ভিসার চক্করে। সেটা ব্রেক্সিট বা ইউরোপ অর্থনীতি থেকে গ্রেট ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার টালমাটাল শুরুটা। একরাশ হতাশা নিয়ে দেশে ফিরে এল পলাশ।

বেবী এখন নামী মেয়েদের স্কুলে ইংরিজি পড়ায়—পলাশের রোজগার যথেষ্ট কিন্তু ঠিক কতদিন যে পলাশ এখনকার চাকরিটা করবে—এটা স্বয়ং পলাশও জানে না। শুধু তাই নয়, সে ব্লুচিপ কোম্পানিতেও কাজ করবে না—পলাশের বিশ্বাস সেখানে ট্যালেন্টের অপমৃত্যু ঘটে—সে বেছে বেছে লড়াই করছে এমন স্টার্ট-আপ-এ চাকরি নেয়। ফলে পলাশকে অনেক দায়িত্ব নিতে হয়—অথচ রোজগার সেই অনুপাতে… বেবীর এটাই পছন্দ নয়। পলাশের এই উলটোস্রোতে হাঁটার জেদ, খামখেয়ালি ভাব, এই ছটফটানি আর কথায় কথায় চাকরি বদলের বদভ্যেসটুকু ছাড়া বেবীর আর কোনও অশান্তি নেই। অথচ এটা পলাশেরও খুব দুর্বল জায়গা। সুখের সংসার তবে মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়। আর ঝগড়া মেটাবার একটা অদ্ভূত নিয়ম আছে ওদের মধ্যে। বাবা তারকবাবু রেলওয়েজের রিটায়ার্ড গার্ড সাহেব— তোতলামোর ভয়ে মিতভাষী এবং উলটোদিকে মা সন্ধ্যারানি মহা গপ্পোবাজ—অনবরত জর্দা পান খান আর আইবুড়ো মেয়ে দেখলেই সম্বন্ধ করেন। বেবী পলাশের ঠিক উলটোমুখো ফ্ল্যাটের পড়শি স্যান্নালকাকু অকৃতদার। মহিলা মাত্রেই কাকু বড়ই দুর্বল, বেবীর প্রতি সদা-গদগদ, সারাক্ষণ বেবীর খোঁজখবর নেন। মাঝেমধ্যে আসে পলাশের আবাল্যহৃদয় বন্ধু পিকলু। আর আছে রেলবস্তির কমলাদি। বেবী- পলাশের কাজের মাসি। জাঁহাবাজ মহিলা সব দিকে নজর। কাউকে রেয়াত করে না—স্যান্নালকে দুচক্ষে দেখতে পারে না— তবে বেবী-পলাশকে ভালোবাসে, ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। বেবী রোজকার মতো স্কুলে যায় আসে—সে জানেও না পলাশ এখনকার চাকরিটাও ছাড়ছে। এদিকে পলাশ একটা দুর্দান্ত চাকরি পাচ্ছে।

বিবাহবার্ষিকীর দিন বেবী পলাশকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল—পলাশ জানিয়েছিল মনে আছে। কিন্তু সেদিনও সে ঠিকসময়ে ফিরতে পারল না! এমনকী মোবাইলেও বেপাত্তা। বাড়ির অমতে জেদ করে বেবী পলাশকে বিয়ে করেছে—তাদের সকলের সামনে একেবারে দুমড়েমুচড়ে যায় বেবী—মাথায় আগুন জ্বলছে বেবীর—সব ফুল মিষ্টি খাবারদাবার কমলাদিকে দিয়ে একরাশ অভিমান নিয়ে বেবী চলে গেল তার বাপের বাড়ি। অফিসে মোবাইল জ্যামার লাগানো—সারাটা দিন অনলাইন মিটিঙে ব্যস্ত পলাশ খবরটুকু দেবার সুযোগও পায়নি। ভেবেছিল কেক ব্যোকে এনে বেবীর মানভঞ্জন করবে। সে সুযোগ সে পেল না। অভিমানে অভিমান বাড়ে। পলাশেরও জেদ চেপে গেল—সে যোগাযোগ তো করলই না, উলটে তড়িঘড়ি রোবটের চেহারায় বদল এনে তাকে অবিকল বেবীর চেহারা দিয়ে বাড়ি নিয়ে এল—RUBY language-এ লেখা তাই নাম দিল রুবী। পরিচয় বেবীর যমজ বোন দূরসম্পর্কের কাকার কাছে আমেরিকায় থাকত। কাঞ্জিলাল ঘরনি হবার আগে বেবীর পদবি ছিল রায়—তাই রুবী রায়। শুরু হল রুবীর ট্রেনিং। শুরু হল হুলুস্থুলু কাণ্ড— একদিকে স্যান্নালকাকু, অন্যদিকে কমলাদি। এর মধ্যে এসে উপস্থিত পলাশের মা-বাবা। তাঁরা জানতেন যে বেবী একমাত্র সন্তান— প্রায় ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে যায় রুবী। পলাশ চায় রুবীর মধ্যে অক্সিটোসিন হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে মানবিক অনুভূতি প্রেম ভালোবাসা জাগাতে—এরই মধ্যে পিকলুর আবির্ভাব!! সে পিকলু আর বেবী কখনও পলাশের জন্মদিন মিস করেনি। এবারও পিকলু থাকবে কিন্তু বেবী থাকবে না—তার বদলে থাকবে রুবী।

পরদিন হ্যাপি বার্থডে বলে পলাশের ঘুম ভাঙায় রুবী। রুবী বদলে গেছে যন্ত্র থেকে পরিপূর্ণ মানবী সে—রুবীকে দেখে সে রোমাঞ্চিত। কিন্তু পিকলুকে পলাশ জোরের সঙ্গে জানায় সে কখনও রুবীকে বেবীর জায়গা দেয়নি। রুবী তার স্বপ্নের প্রজেক্ট। কিন্তু বেবীর এত্তটুকু ধৈর্য নেই—সে একটা চিঠিতে সব শেষ করে দিল—ব্যস!! পিকলুর চিত্রনাট্যে রুবী-সাজা বেবী স্বমূর্তি ধারণ করল এবং মধুরেণ সমাপয়েৎ!! কিন্তু রুবীর কী হল? পলাশের প্রজেক্টের কী হবে? পলাশের স্বপ্ন কি শেষমেশ এভাবে গোঁত্তা খাবে? তাই কখনও হয়? বেবীর বুদ্ধিতে রুবী হল কমলাদির দূরসম্পর্কের বোন রমলাদি—যে কিনা বিদেশে কাজ করত!! আর রমলাদিকে আদরে ঘরে তুললেন কলির কেষ্টো— স্যান্নালকাকু!! এক্কেবারে—ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস!! ইয়াক! ইয়াক!

নাটক কেমন লাগল

এমন একটা কাহিনিকে বার্থডে কেকের মতো স্তরে স্তরে সাজিয়ে ঝকমকে বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপে মুড়ে—নির্দেশক-এর হাতে তুলে দিয়েছেন নাট্যকার জিৎ সত্রাগ্নি। লোককৃষ্টির আগের নাটক ‘ছুমন্তর’ এই একই নাট্যকারের লেখা। তাই বোঝাপড়াটা ছিলই ‘পুনরায় রুবী রায়’ নাটকে তা আরও পূর্ণতা পেল। রোবট নিয়ে কমেডি এভাবে আমরা আগে দেখিনি। সেই কারণে নির্দেশকের ওপর এক গুরুদ্বায়িত্ব ছিল। ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায় নির্দেশক-এর ভূমিকায় ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা দাবি পূর্ণ করেছেন।

নাটকে মজার টাইটেল এবং আবহের চমৎকারিত্ব অনুভব করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আজ আর সদ্যপ্রয়াত সংগীত রচয়িতা পিলু ভট্টাচার্যকে কোনও প্রশংসা বা সাধুবাদ আর স্পর্শ করবে না। নাটকের টাইটেল অডিও রইল তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। নীল কৌশিকের সুচিন্তিত মঞ্চ ভাবনা ও সুদীপ সান্যালের মনোরম আলোক পরিকল্পনা নাটকের বিষয় ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরেছে। প্রতিটি চরিত্রের আদল অনুযায়ী নিখুঁত করে সাজিয়ে তুলেছেন বিধাতৃদেব সরকার। বিশেষ করে রোবটের সাজসজ্জা অকুণ্ঠ ধন্যবাদ দাবি করে। পোশাক পরিকল্পনায় রুমকি চট্টোপাধ্যায় যথাযথ।

পলাশের ভূমিকায় স্নেহেন্দু দেওয়ানজি অত্যন্ত সাবলীল অভিনয় করেছেন। মানবী বেবী এবং যন্ত্রমানবী রুবীর দ্বৈত ভূমিকায় মোনালিসার অভিনয় দেখে বিস্মিত হতে হয়। বিশেষ করে রোবট রুবীর চলাফেরায় যান্ত্রিক স্প্রিং মুভমেন্টটুকুও নিখুঁত। এমনকী কণ্ঠ প্রয়োগেও মোনালিসা দুই চরিত্রে উল্লেখযোগ্য বদল নিয়ে এসেছে। নিকুঞ্জ সরকারের সান্যালকাকু অনিশা মজুমদার অভিনীত কমলাদি’র অনবদ্য কমেডি বহুদিন মনে থাকবে। পিকলু চরিত্রে এদিন অভিনয় করেছিলেন অনির্বাণ রায় চৌধুরি। তবে শম্পায়ন লাহিড়ী-ও এই একই চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন। দুজনেই এই মজার চরিত্রে তুখোড় অভিনয় করেন। তারকবাবু ও সন্ধ্যাদেবীর ভূমিকায় প্রতিভাশালী শিল্পী দম্পতি ফাল্গুনী ও রুমকি চট্টোপাধ্যায় অসাধারণ। তাদের অভিনীত ওই একটি দৃশ্য যেন গোটা নাটকের ডায়নামিকস বদলে দেয়। একটি মাত্র শব্দে এ নাটক বর্ণনা করতে গেলে সন্ধ্যা দেবীর সংলাপ ধার করে বলতে হয় ‘কপালের ওপর মাতা’! শুরুতে খুব সাবেকি আন্তরিকতায় নাটকের প্রারম্ভ ঘটান প্রসূন ভট্টাচার্য, যিনি সুঅভিনেতা এবং ছুমন্তর নাটকের নির্দেশক।

তবে এত সব ভালোর মধ্যে মন খারাপ করায়, কিছু খালি থেকে যাওয়া দর্শকাসন। কার্টন কলে নির্দেশক আক্ষেপের সুরে বলেন—’আমরা অতিমারিকে হারাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি কিন্তু মানুষ হয়তো এখনও সাহস করে লড়াইটা নিতে পারেননি।’ দর্শক আনুকূল্য না পেলে নাট্যদলগুলির পক্ষে ভালো বাংলা থিয়েটারকে লালন করা অদূর ভবিষ্যতে ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লোককৃষ্টি’র ছুমন্তর নাটকটি দূরদর্শন কলকাতা বহুবার সম্প্রচার করেছেন। পুনরায় রুবি রায় নাটকও দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হবে।

ছবি ও ইউটিউব লিঙ্ক সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে


Skip to content