বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সিনেমা লাইনে প্রতিভার সঙ্গে ভাগ্য একটা বিশাল ব্যাপার। সাথ দিলে রাজা, নইলে যে-কে-সেই! তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, বর্তমান টলিউডের একজন নামকরা পরিচালক, যিনি একসময় জুনিয়র আর্টিস্ট হয়ে গ্রামবাসী সেজে খালি পায়ে ইটভাটার রাস্তায় দৌড়েছিলেন। আর আজ তিনি টলিউডের নাম্বার ওয়ান পরিচালক। নিশ্চয়ই তিনি প্রতিভাবান, কিন্তু ভাগ্যবানও। নইলে ওরকম প্রতিভা তো আরও কত আছে, তাঁরা গতকালও যা, আজও তাই। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে যে জিরো থেকে হিরো হওয়া যায় এরকম ঘটনা অনেক আছে। একটা ঘটনা আজ বলব। সিনেমাজগতে কাজ করার সুবাদে শুটিং নিয়ে সাধারণ মানুষের যতটা আগ্রহ থাকে, ততটা আমার নেই। না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবু রবীন্দ্র সরোবর লেকের পাশে সারি সারি শুটিং-এর গাড়ি দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হঠাৎ সামনে একটা বিলাসবহুল গাড়ি এসে দাঁড়াল। চালকের আসন থেকে নেমে একটি ছেলে আমার গা ঘেঁষে গটগট করে গিয়ে মেকআপ ভ্যানে উঠল। তার গা থেকে ছড়িয়ে পড়া পারফিউম পুরো জায়গাটা সুবাসিত করে দিল।

তবে ছেলেটাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল। কোনও নায়ক নয় জানি, কিন্তু একেবারে সাধারণ কেউ নয়, সেটাও বুঝতে পারলাম। তবে ছেলেটা কে? এবার নায়কের গাড়ি এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে প্রোডাকশনের লোকজন হালকা ব্যারিকেড করে সেই নায়ককে মেকআপ ভ্যানে পৌঁছে দিল। কিছুক্ষণ পর দুকাপ কফি আর দু প্লেট স্যান্ডউইচ পৌঁছে গেল। এসব নিয়ে আমার আলাদা কোনও কৌতূহল নেই। সবই দেখা। কিন্তু কৌতূহল একটাই, প্রথমজনটি কে? অনেক ভেবে অতীত-বর্তমানের আগে পিছে হেঁটে আবিষ্কার করলাম, এ সেই গণেশ নয় তো? সোনারপুর ছাড়িয়ে জয়নগরে যার বাড়ি? ফিরে গেলাম প্রায় কুড়ি বছর আগে। বারুইপুর জমিদারবাড়িতে শুটিং চলছে। এই নায়ক তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। নায়ক এবং তার শুটিং দেখার জন্য চারদিকে লোকে লোকারণ্য । ইউনিটে মাত্র তিনজন প্রোডাকশন বয়। হাবুলদা, বিজয়দা আর হরিদা। এর মধ্যে হাবুলদা আর বিজয়দার কাজ নায়ক-নায়িকা দুজনের মাথায় দুজনে ছাতা ধরে থাকা। বাকি রইল হরিদা। তার একার পক্ষে এত লোক সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ল। শুটিং চালু হতেই ক্যামেরার ফ্রেমে বারবার লোকজন ঢুকে পড়তে শুরু করল। শুটিং প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়। তখন প্রোডাকশনের বিজয়দা নায়কের মাথায় ধরে থাকা ছাতাটা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলের হাতে ধরিয়ে বললেন, এই ভাই, ছাতাটা ধর তো, আমি ভিড়টা সামলাই। প্রায় জোর করে তার হাতে ছাতা ধরিয়ে বিজয়দা ভিড় সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিকেল তিনটে পর্যন্ত যতক্ষণ না নায়কের ‘প্যাক আপ’ হল বিজয়দা আর ছাতামুখো হলেন না। সেই ছেলেটা ঠায় তিনটে পর্যন্ত ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আসলে একটানা ছাতা ধরে থাকার বোরিং কাটাতে বিজয়দা ভিড় হটানোর অজুহাত করে কেটে পড়েছিলেন। ছেলেটি কিন্তু বেশ গর্ব নিয়ে ছাতা ধরে দাঁড়িয়েছিল। হাজার হোক নায়কের মাথা তো! সেখানে কি সবাই ছাতা ধরতে পারে? নায়ক চলে যাবার আরও এক ঘণ্টা পর বিকেল চারটায় ইউনিটের প্যাক আপ হল। তার মধ্যে লাঞ্চ ব্রেকে সবাই যে যার মতো খেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সেই ছেলেটিকে কেউ খাবার অফার করেনি। চারটের সময় বিজয়দা বললেন, কিছু খাবে? খিদের জ্বালায় লজ্জার মাথা খেয়ে ছেলেটি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতেই বিজয়দা প্রায় ফেলে দেবার আগের মুহূর্তের ভাত ডাল তরকারি যা ছিল, একটা থার্মোকলের প্লেটে দিয়ে বললেন, খেয়ে নাও ভাই। ছেলেটা তাই খেল। তারপর বাড়ি যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল, দাদা কাল আবার আসব? বিজয়দা তো হাতে চাঁদ পেলেন। বিনা পয়সায় শুধু দুটো খেতে দেবার বিনিময়ে এমন ছেলে যদি পাওয়া যায় ক্ষতি কী! সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই আসবি। ছেলেটির খুশি যেন আর ধরে না।

টানা ছ’দিন শুটিং-এ নায়কের মাথায় একাগ্রচিত্তে ছাতা ধরে নিষ্ঠার প্রমাণ দিল সে। কেউ কেউ ঠাট্টা করে ডাকল ‘ছত্রপতি’ বলে। কিন্তু নায়ক সিরিয়াস। নিজের মেকআপ ম্যান বিকাশকে বললেন, ছেলেটার গ্রামের বাড়ি গিয়ে সব খোঁজখবর নিয়ে আয়। সেইমতো বিকাশ গিয়ে জয়নগরে সব খোঁজ নিয়ে এল। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। ছোটবেলায় বাবা মারা যাবার পর মা কোনওরকমে সংসার চালান। বহুকষ্টে মাধ্যমিক পাশ করে সেও সব কাজে সঙ্গ দেয় মাকে। পয়সা জমিয়ে বাংলা সিনেমা দেখে। ছেলেটি নাকি বাংলা সিনেমার অন্ধ ভক্ত। সেই টানে বারুইপুরে শুটিং দেখতে আসা। সব শুনে নায়ক মশাই ছেলেটিকে পারসোনাল এটেনডেন্ট নিয়োগ করলেন। একটু বিশ্বাস অর্জন করতেই গাড়ির ড্রাইভিং শিখিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং তার হাতে ছাড়লেন। তারপর ছাড়লেন নিজের মেকআপ-এর ভার। ধীরে ধীরে নায়কমশাই তার উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন যে, শুটিংয়ের ডেট সংক্রান্ত ডায়েরিটাও তার হাতে সঁপে দিলেন। বড় বড় ডিরেকটর, প্রোডিউসাররা বা ফাংশন অর্গানাইজাররা সেই ছেলেটির কাছে ডেটের জন্যে হাঁ করে বসে রইল। দিল্লি বোম্বে সিঙ্গাপুর লন্ডন যেখানে শুটিং, সেখানে ছেলেটির অবাধ যাতায়াত। তারপর কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে মাকে নিয়ে সেখানে উঠে এল। এই অবধি ছিল আমার জানা। তারপর দীর্ঘ ১৮ বছর কোনও যোগাযোগ ছিল না। আজ সামনে দিয়ে কি সেই তাকেই যেতে দেখলাম? মনে হয় এই সেই গণেশ। নাকি আমার কোনও ভুল হচ্ছে! সন্দেহ নিরসনে শুটিংয়ের এক টেকনিশিয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা নায়কের আগে যে ছেলেটি মেকআপ ভ্যানে উঠল তার নাম কী? উত্তর এল: গণেশ। বিস্ময়ের একটা সীমা থাকে, সেটাও ছাড়িয়ে গেল, যখন দেখলাম কিছুক্ষণ পর নায়কের সঙ্গে গণেশের মাথাতেও প্রোডাকশন বয় ছাতা ধরে শুটিং স্পটে চেয়ার এগিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটির সততা একাগ্রতাকে সম্মান জানানোর জন্য তার আসল নাম এবং সেই নায়কের নাম লিখতে দ্বিধা বোধ হল। তবে এটাই সিনেমাজগৎ। যেখানে ভাগ্য সহায় হলে তুমি প্রসেনজিৎ বা দেব। না হলে প্রসেনজিতের ‘ভাই’ বা ‘বন্ধু’ চরণজিৎ কিংবা দেবের ভাই বা বন্ধু রণদেব বা সহদেব হয়েই থেকে যাবে।

Skip to content