ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
‘এই লাইনে বলবে কম, শুনবে বেশি’, সিনেমাজগতে প্রবেশ করার পর প্রোডাকশন ম্যানেজার কাশীদার (সাউ) এই ছিল উপদেশবাণী। সদ্য সদ্য স্টুডিওতে পা রাখা ‘আমি’ তখন হাঁ করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মানে? উনি উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন, মানেটা আমি বলব না। অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারবে। আর একটা কথা মনে রেখো, এখানে কেউ তোমার আপন নয়। কাশীদার বলা দুটো উপদেশের মানেটা আপাতভাবে খুব সহজ, কিন্তু পালন করাটা বেশ কঠিন মনে হল। কাজ করতে গেলে সম্পর্ক তৈরি হবে। বয়সে বড়রা দাদা বা দিদি (সিনেমা লাইনে যেহেতু কাউকে কাকা বা জেঠু বা কাকিমা বা মাসিমা বা বউদি ডাকতে শুনিনি) সমবয়সিরা বন্ধু আর ছোটরা ভাইয়ের মতো হবে। তাদের ভুল যেমন আমি ধরিয়ে দেব, তারাও আমার ভুল ধরাবে। তাদের বিপদে আমি যেমন পাশে থাকব, উলটোটাও তারা করবে। কিন্তু কাশীদার কথায় চলতে গেলে তো ‘বোবা’ হয়ে থাকতে হবে। দেখা যাক, অভিজ্ঞতা কী শিক্ষা দেয়?
অভিজ্ঞতা এক: বানতলার গ্রামে আউটডোর শ্যুটিং। সকাল সাতটায় কল। আর্টিস্ট, টেকনিশিয়ান নিয়ম মেনে স্টুডিও হয়ে স্পটে পৌঁছে গেল আটটায়। ক্যামেরা রেডি, আর্টিস্টও রেডি। প্রথম সিন শুরু হল ন’টায়। শেষ হল দশটা নাগাদ। ড্রেস চেঞ্জ করে পরের সিন শুরু হল সাড়ে দশটায়। শেষ হল সাড়ে এগারোটায়। যেহেতু ডে লাইট-এ কাজ, তাই ঝড়ের গতিতে কাজ উঠছে। এবার থার্ড সিন। হঠাৎ টেকনিশিয়ান, আর্টিস্টদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। চাপা ক্ষোভ-বিক্ষোভ। ক্যামেরাম্যানের নজরে আসতেই বললেন, কী ব্যাপার? কী হয়েছে? সবাই বলল, দাদা এখনও টিফিন আসেনি। সকাল সাতটায় কল, প্রায় বারোটা বাজে, চড়া রোদে এভাবে না খেয়ে কাজ করা যায়? সিনিয়র ক্যামেরাম্যান অসীমদা উত্তেজিত হয়ে বললেন, সে কী! তোমরা কেউ টিফিন পাওনি? ম্যানেজার কোথায়? ডাকো? একটু দূরে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যানেজারকে হাঁক পেড়ে ডাকা হল। কী ব্যাপার সজলবাবু? এরা কেউ খায়নি বলছে? আমি কী করব! প্রোডিউসার নিজের লোককে দিয়ে টিফিনের ব্যবস্থা করেছে। বলতে বলতে প্রোডিউসারের টেনিয়া সোনু বাইকের দুদিকে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে প্যাকেট নিয়ে হাজির হল। অসীমদা ক্যামেরা ছেড়ে নেমে প্রায় মারার ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, কটা বাজে? এখন ব্রেকফাস্ট দিচ্ছ? ব্রেকফাস্ট কথাটার মানে জানো? এখন এগুলো খেলে লাঞ্চ খাবে কখন? শোনো ভাই, আজ প্রথম দিন, বেশি কিছু বললাম না, কাল থেকে যেন আর না হয়। প্রোডিউসারের টেনিয়াটি মুখ বুজে সব শুনে দুপুর ১২টায় ব্রেকফাস্ট খাওয়ানোর মহান দায়িত্ব পালন করে বাইক নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রলি সেটিং-এর রতন বলল, এই যে গেল একেবারে বিকেল চারটেতে লাঞ্চ নিয়ে আসবে। শুনে অসীমদা বললেন, তাই নাকি! ওর সাহস হবে বিকেল চারটেতে আমার সামনে লাঞ্চের প্যাকেট ধরানোর? ম্যানেজার সজলবাবুর কাজ ‘ম্যানেজ’ করা। তিনি রতনকে ধমক দিয়ে বললেন, কেন ফালতু এসব কথা বলছ? তুমি সব বুঝে গেছ? আমি পইপই করে বলে দিয়েছি, দুটোর মধ্যে যেন লাঞ্চ ঢুকে যায়। দোকানে বিরিয়ানি বলা আছে। শুধু সময়ে গিয়ে আনতে হবে। সোনু যদি দেরি করে আমি ফোন করে চলে যাব। এই তো পাক সার্কাস, ১০ মিনিটের রাস্তা। তখনকার মতো সবাই চুপচাপ। ব্রেকফাস্ট সেরে কাজে ঢুকে গেল।
টলিউডের টেকনিশিয়ানদের সম্বন্ধে একটা কথা গর্ব করে বলা যায়, টাকাপয়সা বা খাবারদাবার নিয়ে যা-ই অভিযোগ থাক, কাজে তার প্রভাব পড়ে না। দু-একজন আড়ালে-আবডালে ঘোট পাকালেও কাজটা হইহই করে তুলে দেয়। কারণ সম্পর্কটা তৈরি হয় ডিরেক্টরকে কেন্দ্র করে। সেই সম্পর্ক সহজে কেউ ভাঙতে চায় না। যা-ই হোক, কচুরি আর জিলিপি খেয়ে দুটো পর্যন্ত মুখ বুজে কাজ করার পর লাঞ্চের খোঁজ পড়ল। জানা গেল, সজলবাবু নিজে গেছেন খাবার আনতে। শুনে ডিরেক্টর বললেন, ঠিক আছে তাহলে লাঞ্চ আসতে আসতে আরেকটা সিন হোক। পার্ক সার্কাস থেকে বিরিয়ানি আসছে, এই আনন্দে সবাই পরের সিনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিকেল তিনটে পনেরোতে সিন শেষ। কিন্তু বিরিয়ানি কই? সজলবাবুই বা কোথায়? এবার সেই রতনের সিনেমাটিক সংলাপ, আরে দাদা ১৫ বছর ধরে ট্রলি ঠেলছি। সকাল দেখে বলে দেব বিকেলটা কেমন যাবে? রতনের কথার মাঝে অসীমদা ফোনে ধরলেন সজলবাবুকে। কী ব্যাপার সজলবাবু? বাকি কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সজলবাবু বললেন, এই তো হয়ে গেছে। ১৫ মিনিটের মধ্যে ঢুকছি। ফোনটা কেটে অসীমদা ডিরেক্টরকে বললেন, কী করবেন? বলছে ১৫ মিনিট? রতন হেসে বলল, দাদা কচুরিগুলো এখনও জ্যান্ত আছে, আপনি বরং যে সিনটা বাকি আছে সেটা করে একেবারে প্যাক আপ করে দিন। উনি কি আর এমনি এমনি বারোটায় ব্রেকফাস্ট খাইয়েছেন? বুঝেশুনেই এসব করেছেন। পেটে খিদে, মুখে রাগ। তবু কাজে যেন তার প্রভাব না পড়ে৷ সবাই লাস্ট সিনের জন্য মনোযোগ দিল। সিন শেষ করে প্যাক আপ হল সাড়ে চারটেয়। খাবার নিয়ে সজলবাবু কুড়ি মিনিট আগে না এলে হয়তো ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ‘প্যাক আপ’ শব্দটা শুনতে পেতেন। ওঁর সেই সৌভাগ্য হল না। বিরিয়ানির প্যাকেটটা নিজে হাতে অসীমদার দিকে এগিয়ে সজলবাবু দোষ কবুল করলেন, সরি দাদা, বুঝতে পারিনি, এরা এতটা অপেশাদার। কাল থেকে আমি নিজে হাতে সব করব। অসীমদা কিছু বলতে পারলেন না। নিজের প্যাকেটটা ট্রলি সেটিং-এর রতনের হাতে দিয়ে বললেন, বাড়িতে নিয়ে যাস। তারপর পরের দিনের কল টাইমটা জেনে নিজের গাড়িতে বেরিয়ে গেলেন। পরের দিন শ্যুটিং স্পটে গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। শ্যুটিংয়ে সবাই আছে, গতকাল যারা যারা ছিল, শুধু অসীমদা আর রতন নেই। বুঝলাম, টেকনিশিয়ানদের হয়ে গলা ফাটানোর জন্য প্রোডিউসারের তরফ থেকে ‘পুরস্কার’ পেয়েছে ওই দুজন। সৌজন্যে টেনিয়া সোনু। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, ইউনিটের মধ্যে কোনও প্রতিবাদ নেই।
অভিজ্ঞতা দুই: পরবর্তী পর্বে…
অভিজ্ঞতা এক: বানতলার গ্রামে আউটডোর শ্যুটিং। সকাল সাতটায় কল। আর্টিস্ট, টেকনিশিয়ান নিয়ম মেনে স্টুডিও হয়ে স্পটে পৌঁছে গেল আটটায়। ক্যামেরা রেডি, আর্টিস্টও রেডি। প্রথম সিন শুরু হল ন’টায়। শেষ হল দশটা নাগাদ। ড্রেস চেঞ্জ করে পরের সিন শুরু হল সাড়ে দশটায়। শেষ হল সাড়ে এগারোটায়। যেহেতু ডে লাইট-এ কাজ, তাই ঝড়ের গতিতে কাজ উঠছে। এবার থার্ড সিন। হঠাৎ টেকনিশিয়ান, আর্টিস্টদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। চাপা ক্ষোভ-বিক্ষোভ। ক্যামেরাম্যানের নজরে আসতেই বললেন, কী ব্যাপার? কী হয়েছে? সবাই বলল, দাদা এখনও টিফিন আসেনি। সকাল সাতটায় কল, প্রায় বারোটা বাজে, চড়া রোদে এভাবে না খেয়ে কাজ করা যায়? সিনিয়র ক্যামেরাম্যান অসীমদা উত্তেজিত হয়ে বললেন, সে কী! তোমরা কেউ টিফিন পাওনি? ম্যানেজার কোথায়? ডাকো? একটু দূরে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যানেজারকে হাঁক পেড়ে ডাকা হল। কী ব্যাপার সজলবাবু? এরা কেউ খায়নি বলছে? আমি কী করব! প্রোডিউসার নিজের লোককে দিয়ে টিফিনের ব্যবস্থা করেছে। বলতে বলতে প্রোডিউসারের টেনিয়া সোনু বাইকের দুদিকে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে প্যাকেট নিয়ে হাজির হল। অসীমদা ক্যামেরা ছেড়ে নেমে প্রায় মারার ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, কটা বাজে? এখন ব্রেকফাস্ট দিচ্ছ? ব্রেকফাস্ট কথাটার মানে জানো? এখন এগুলো খেলে লাঞ্চ খাবে কখন? শোনো ভাই, আজ প্রথম দিন, বেশি কিছু বললাম না, কাল থেকে যেন আর না হয়। প্রোডিউসারের টেনিয়াটি মুখ বুজে সব শুনে দুপুর ১২টায় ব্রেকফাস্ট খাওয়ানোর মহান দায়িত্ব পালন করে বাইক নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রলি সেটিং-এর রতন বলল, এই যে গেল একেবারে বিকেল চারটেতে লাঞ্চ নিয়ে আসবে। শুনে অসীমদা বললেন, তাই নাকি! ওর সাহস হবে বিকেল চারটেতে আমার সামনে লাঞ্চের প্যাকেট ধরানোর? ম্যানেজার সজলবাবুর কাজ ‘ম্যানেজ’ করা। তিনি রতনকে ধমক দিয়ে বললেন, কেন ফালতু এসব কথা বলছ? তুমি সব বুঝে গেছ? আমি পইপই করে বলে দিয়েছি, দুটোর মধ্যে যেন লাঞ্চ ঢুকে যায়। দোকানে বিরিয়ানি বলা আছে। শুধু সময়ে গিয়ে আনতে হবে। সোনু যদি দেরি করে আমি ফোন করে চলে যাব। এই তো পাক সার্কাস, ১০ মিনিটের রাস্তা। তখনকার মতো সবাই চুপচাপ। ব্রেকফাস্ট সেরে কাজে ঢুকে গেল।
টলিউডের টেকনিশিয়ানদের সম্বন্ধে একটা কথা গর্ব করে বলা যায়, টাকাপয়সা বা খাবারদাবার নিয়ে যা-ই অভিযোগ থাক, কাজে তার প্রভাব পড়ে না। দু-একজন আড়ালে-আবডালে ঘোট পাকালেও কাজটা হইহই করে তুলে দেয়। কারণ সম্পর্কটা তৈরি হয় ডিরেক্টরকে কেন্দ্র করে। সেই সম্পর্ক সহজে কেউ ভাঙতে চায় না। যা-ই হোক, কচুরি আর জিলিপি খেয়ে দুটো পর্যন্ত মুখ বুজে কাজ করার পর লাঞ্চের খোঁজ পড়ল। জানা গেল, সজলবাবু নিজে গেছেন খাবার আনতে। শুনে ডিরেক্টর বললেন, ঠিক আছে তাহলে লাঞ্চ আসতে আসতে আরেকটা সিন হোক। পার্ক সার্কাস থেকে বিরিয়ানি আসছে, এই আনন্দে সবাই পরের সিনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিকেল তিনটে পনেরোতে সিন শেষ। কিন্তু বিরিয়ানি কই? সজলবাবুই বা কোথায়? এবার সেই রতনের সিনেমাটিক সংলাপ, আরে দাদা ১৫ বছর ধরে ট্রলি ঠেলছি। সকাল দেখে বলে দেব বিকেলটা কেমন যাবে? রতনের কথার মাঝে অসীমদা ফোনে ধরলেন সজলবাবুকে। কী ব্যাপার সজলবাবু? বাকি কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সজলবাবু বললেন, এই তো হয়ে গেছে। ১৫ মিনিটের মধ্যে ঢুকছি। ফোনটা কেটে অসীমদা ডিরেক্টরকে বললেন, কী করবেন? বলছে ১৫ মিনিট? রতন হেসে বলল, দাদা কচুরিগুলো এখনও জ্যান্ত আছে, আপনি বরং যে সিনটা বাকি আছে সেটা করে একেবারে প্যাক আপ করে দিন। উনি কি আর এমনি এমনি বারোটায় ব্রেকফাস্ট খাইয়েছেন? বুঝেশুনেই এসব করেছেন। পেটে খিদে, মুখে রাগ। তবু কাজে যেন তার প্রভাব না পড়ে৷ সবাই লাস্ট সিনের জন্য মনোযোগ দিল। সিন শেষ করে প্যাক আপ হল সাড়ে চারটেয়। খাবার নিয়ে সজলবাবু কুড়ি মিনিট আগে না এলে হয়তো ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ‘প্যাক আপ’ শব্দটা শুনতে পেতেন। ওঁর সেই সৌভাগ্য হল না। বিরিয়ানির প্যাকেটটা নিজে হাতে অসীমদার দিকে এগিয়ে সজলবাবু দোষ কবুল করলেন, সরি দাদা, বুঝতে পারিনি, এরা এতটা অপেশাদার। কাল থেকে আমি নিজে হাতে সব করব। অসীমদা কিছু বলতে পারলেন না। নিজের প্যাকেটটা ট্রলি সেটিং-এর রতনের হাতে দিয়ে বললেন, বাড়িতে নিয়ে যাস। তারপর পরের দিনের কল টাইমটা জেনে নিজের গাড়িতে বেরিয়ে গেলেন। পরের দিন শ্যুটিং স্পটে গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। শ্যুটিংয়ে সবাই আছে, গতকাল যারা যারা ছিল, শুধু অসীমদা আর রতন নেই। বুঝলাম, টেকনিশিয়ানদের হয়ে গলা ফাটানোর জন্য প্রোডিউসারের তরফ থেকে ‘পুরস্কার’ পেয়েছে ওই দুজন। সৌজন্যে টেনিয়া সোনু। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, ইউনিটের মধ্যে কোনও প্রতিবাদ নেই।
অভিজ্ঞতা দুই: পরবর্তী পর্বে…