বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

জীবনে এ রকম বারবার হয়েছে, যে অনেক চেষ্টা করেও যে রকমটা চাইছি সে রকমটা করে উঠতে পারছি না। যেমন স্কুলে পড়তে অনেক চেষ্টাতেও কিছুতেই ভূগোল বা জীবনবিদ্যা ভালো করে রপ্ত করতে পারিনি, কিংবা অন্য বিষয়ে অনেক খাটাখাটুনির পরেও পরীক্ষায় মনোসংযোগ হারিয়ে জানা জিনিস ভুল করে একগাদা নম্বর হারিয়ে এসেছি। বড় হয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি যে, বহুমাসের চেষ্টার পরেও কিছুতেই ঠিক ফলাফল আসছে না। ‘কেন হচ্ছে না, কেন পারছি না’ এই নিয়ে চিন্তা করেছি, বিরক্ত হয়েছি, মন খারাপ করেছি — বুঝতে পেরেছি যে আমার ডাক্তারি পড়তে যাওয়া বন্ধুদের মতো জীবনবিদ্যা বিষয়ে দক্ষতা আমার নেই, কিংবা আবার নতুন করে কোমর বেঁধে গবেষণার কাজে লেগেছি। কিন্তু নানাকিছুর মধ্যে নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলিনি।

বড় হয়ে (বুড়ো হয়ে) বুঝেছি যে, নিজের ওপর বিশ্বাস না হারানোর অভ্যাসটা বহু বিপদ-আপদে সাহায্য দিয়েছে। এহেন অভ্যাস তৈরি হওয়ার পিছনে আমার নিজের কৃতিত্ব কিছুই নেই, বরং সেই কৃতিত্ব আমার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। আমার ছোটবেলার বহু ব্যর্থতা সত্ত্বেও তারা কখনও আমার ওপর বিশ্বাস হারাননি। আবার এমন কিছু বলেননি যাতে আমার মনে হবে যে আমি সাফল্যের যোগ্যই নই। ভরসা জোগানো সেই শিক্ষক-শিক্ষিকা কখনও অন্যমনস্ক আমাকে ধরে-বেঁধে পড়তে বসানো আমার নিজের মা-বাবা। কখনও তিনি পঞ্চম শ্রেণির অঙ্কের প্রতিযোগিতা করানো অঙ্কের শিক্ষক যিনি ভুল অঙ্কের জন্য ছাত্রদের কোনও শাস্তি দিতেন না। কখনও তিনি ২০০৪ সালের ‘টিচার্স ডে’-তে একজন ছাত্রকে ক্লাস পড়ানোর দায়িত্ত্ব দেওয়া ইংরাজি সাহিত্যের শিক্ষক। কখনও বা একজন সামান্য ছাত্রকেও সম্মান দিয়ে কথা বলা ভিনদেশি পিএইচডি গাইড। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার যা অবদান, তার থেকে কোনও অংশে কম নয়, তাঁদের অকারণ-নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অবদান, ভরসা এবং বিশ্বাসের অবদান।
আমার ধারণা যে এই অভিজ্ঞতা শুধু আমার একার না, অনেকের। অন্যরা আমাদের যেভাবে দেখে, আমরা অনেকসময় অজান্তেই নিজেদেরও সে ভাবে দেখা শুরু করি। যারা শিক্ষকদের অকারণ-অযৌক্তিক ভালোবাসা আর ভরসা পায়, তাঁরা নিজেদের ব্যর্থতাতেও নিজেদের ভালোবাসতে এবং নিজেদের ওপর ভরসা রাখতে ভোলেন না। যারা পায় না, তাদের লড়াই আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই শিক্ষক হিসেবে আমরা ছাত্রদের যা যা দিতে পারি, তার মধ্যে আমি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসা এবং ভরসাকে একই গুরুত্ব দেব। এবং সেই ভালোবাসা অযৌক্তিক এবং অকারণ হওয়াতেও গুরুত্ব দেব, যাতে যারা আমার মতো জীবনবিদ্যা কিংবা ভূগোলে কিংবা অন্য কিছুতে ভালো ফল করতে পারেনি, তারাও তার সমান ভাগ পায়।

জীবনের বেশিরভাগটা ছাত্র হিসেবে কাটিয়ে আজ যখন শিক্ষক দশায় পৌঁছেছি, তখন বুঝেছি যে ভরসা ও ভালোবাসার প্রয়োজনটা উল্টোদিকেও প্রায় সমান। ছাত্রদের থেকে শিক্ষকদের সব থেকে বড় পাওয়া সেই একই- ভালোবাসা এবং ভরসা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর টাকায় সংসার এবং গবেষণা চলে বটে, কিন্তু সমস্ত দিনের কাজের শেষে রাত্রিবেলা আবার বই নিয়ে পরের দিনের ক্লাসনোট তৈরি করতে বসার জোর পাই একমাত্র আমার ছাত্রদের উজ্জ্বল উৎসাহী মুখগুলোর কথা ভেবে। সব ক্লান্তি এক নিমেষে দূর হয়ে যায় যদি কোনও ছাত্র ক্লাস শেষে বা কোর্স শেষে বলে যে, ক্লাসটা বা কোর্সটা ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে এই কথা জানানো একটা অদ্ভুত অকারণ ভালোবাসা— অকারণ কেন না পড়ানোটাই তো আমার জীবিকা। সেই করেই সংসার চালাই, আমি তো শুধুমাত্র সেই কাজটাই করেছি। সেই মানুষটাকে আলাদা করে কোনও প্রশংসা না করলেও তো চলতো! তারপরেও ছাত্রদের এই অকারণ ভালোবাসা জানানোর অভ্যাসের জন্যেই শিক্ষা এখনও নিছক বাজারি লেনদেনের হিসেবে এসে দাঁড়ায়নি। সেই ভালোবাসার জন্যেই আমরা শিক্ষকরা পড়িয়ে আনন্দ পাই।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৩: রবীন্দ্রনাথের মাস্টারমশায়

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৩: কর্কোটকনাগের দংশনে নলরাজার শরীর বিকৃত হল

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩২: দীক্ষার আংটি হেমলতাকে দিয়েছিলেন মহর্ষিদেব

এবার আসি ছাত্রদের ভরসার কথায়। এই ভরসার নমুনা প্রথমবার অজান্তেই পেয়েছি অনেক ছোটবেলায়। আমার বাবা পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। অনেক পুরোনো আমলের শিক্ষক, যে সময় পড়া না পারলে ভালোরকম শাসনের রীতি চালু ছিল। রাস্তায় বাবার হাত রাস্তায় বেরিয়ে মাঝে মধ্যে বাবার পুরোনো ছাত্রদের সঙ্গে দেখা হতো, তাঁরা হঠাৎ করে এগিয়ে এসে বাবাকে বলতো “স্যার, আপনি সে সময় শাসন না করলে আজকে এখানে পৌঁছতে পারতাম না।”

কোনও শিক্ষকের বকুনি-শাসানি খেয়ে, রাগ-অভিমানের পালা চুকিয়ে, সেই শিক্ষকেরই উপদেশ মেনে চলার অসাধ্যসাধন তখনই সম্ভব হয়, যখন শিক্ষকের ওপর অগাধ ভরসা রাখা যায়। ভরসা রাখা যায় এই ভেবে যে, “স্যার বা ম্যাডাম যা করছেন বা বলছেন, তা আমার ভালোর জন্যেই করছেন। আজ বুঝতে না পারলেও, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বুঝতে পারবো।” যে শিক্ষক-শিক্ষিকা ভালোবাসতে জানেন, তিনি ভুল শুধরে দিলে সেই ভুল শুধরানোর মধ্যে রাগের ঠিক নিচেই ভালোবাসা রয়েছে — এটা ভাবতে পারাটাই ভরসা। এই ভরসা ছাত্ররা আপামরকাল ধরে রেখে এসেছে বলেই আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়াতে পেরেছি। এই ভরসার যোগ্য হয়ে উঠতে পারাটাই আজকের শিক্ষকের-শিক্ষিকার কর্তব্য— এটাই আমার জন্যে ‘টিচার্স ডে’র সব থেকে বড় উপলব্ধি।

লেখাটা লিখতে গিয়ে আরেকটা জিনিস শিখতে পারলাম। ‘শিক্ষক দিবস’ না বলে দিনটিকে ‘টিচার্স ডে’ বললেই বোধ হয় ভালো হয়। ‘টিচার’ কথাটি ‘জেন্ডার-নিউট্রাল’, শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাই তো ‘টিচার’।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-২৮: অনুপুষ্টিতে ভরপুর পুঁটিমাছ ছোটদের দৃষ্টিশক্তির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৩: বসুন্ধরা এবং…


Skip to content