শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে লেখক।

ওই যে একটা কথা আছে না, বসতে পেলে শুতে চায়, আমারও হল সেই দশা। দু’হাতে তখন লিখে চলেছি বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায়। পরিচিত অনেকেই লেখা পড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এভাবে দু’বছর গড়িয়ে গেল। বেশকিছু লেখাও জমা হল। এবার মনের কোণে উঁকি দিল সেই দুরাশা, যদি এগুলো থেকে বাছাই করে একটা বই করা যায়! কিন্তু আমি তো কোনও প্রকাশককে চিনি না। একদিন সঞ্জীবদাকে মনের কথা বলে ফেললাম। শুনে বললেন, আমি সুধাংশুদাকে একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, কথা বলে দেখতে পারেন। সুধাংশুদা মানে সুধাংশুশেখর দে। দে’জ পাবলিশিং-এর কর্ণধার। বইমেলায় অনেকবারই মানুষটিকে দেখেছি দূর থেকে।

সঞ্জীবদা অফিসে বসে প্যাডের পাতায় তিন লাইনের একটি চিঠি লিখে দিলেন। লাইনগুলো আজও মনে আছে। ‘সুধাংশুদা, একজন ভালো লেখককে পাঠালাম। তার থেকেও বড় কথা, মানুষটা বড় ভালো। কাজে লাগাতে পারেন।’ নীচে স্বাক্ষর, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সেই চিঠি নিয়ে কয়েকদিন বাদেই হাজির হলাম দে’জ পাবলিশিং-এ। সুধাংশুদার সঙ্গে দেখা করে চিঠিটা দিলাম। উনি আমাকে বসতে বললেন। আমার সব কথা শুনলেন। তারপর বললেন, দেখুন, সঞ্জীবদা আপনাকে পাঠিয়েছেন। ওঁর কথা তো ফেলতে পারি না। আপনাকে আমি একটা সুযোগ দেব অর্থাৎ আপনার একটা বই আমরা বার করব। তারপর পুরো ব্যাপারটাই আপনার হাতে। যদি নিজের যোগ্যতায় পাঠকমহলে জায়গা করে নিতে পারেন, তাহলে পরের বই এখান থেকেই বার হবে। তা না হলে এটিই প্রথম, এটিই শেষ। জানি না, সেই যোগ্যতার প্রমাণ আমি দিতে পেরেছি কি না! হয়তো পেরেছি, তা না হলে ৩২ বছরে ৫২টি বই এই ঘর থেকে আমার প্রকাশিত হত না। সুধাংশুদা আমাকে পাঠালেন সুবীরবাবুর ঘরে। উনি তখন নতুন লেখকদের পাণ্ডুলিপি দেখতেন। বললেন ফাইলটা থাক, উলটেপালটে দেখি, তারপর ফোন করে ডাকব। দু’সপ্তাহের মধ্যেই ফোন পেলাম। গিয়ে দেখা করলাম। সুবীরবাবু বললেন, লেখাগুলো ঠিকমতো সাজান। কয়েকটি লেখা আরেকটু বাড়াতে হবে। আরও কিছু প্রয়োজনীয় সাজেশন দিলেন। ওঁর নির্দেশ মেনে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সব কাজ করে আবার ফাইল জমা দিলাম সুবীরবাবুর কাছেই।

১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি শুরু হল আমার প্রথম সন্তান মানে আমার প্রথম বইয়ের জন্মের প্রস্তুতিপর্ব। তখন দে’জ-এর কাউকেই চিনি না। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গল এবং শুক্রবার সন্ধ্যায় তখন আমি কলেজ স্ট্রিটের এক ওষুধের দোকানে বসতাম, মানে রোগী দেখতাম। একদিন সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র শী নামে দে’জ-এর একজন স্টাফ দেখা করতে এলেন। জানালেন, আমার বইয়ের দেখভালের দায়িত্বে উনিই আছেন। আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। তাহলে তো ওঁর থেকেই আমি এবার সব খোঁজখবর পাব। জিজ্ঞেস করলাম, বইটা বইমেলায় বেরোবে তো? উনি বললেন, চেষ্টা হচ্ছে, সবে কম্পোজ হতে গেছে। আগে ফার্স্ট প্রুফ আসুক। কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্র শী আমার বঙ্কিমদা হয়ে গেলেন। আসলে আমরা প্রায় সমবয়সিই ছিলাম। অবশেষে এল ফার্স্ট প্রুফ। বঙ্কিমদা একটা ফাইল হাতে ধরিয়ে বললেন, কারেকশন করে রাখবেন। আমার তো শুনে চোখ কপালে! প্রুফ কারেকশন! কীভাবে করে? আমি তো কিছুই জানি না। বঙ্কিমদাই শেখালেন, প্রাইমারি প্রুফ কারেকশন কাকে বলে, কীভাবে করতে হয়, চ্যাপটারগুলো কীভাবে সাজাতে হয়, প্রতিটি চ্যাপটারের আগে একটা করে ফ্ল্যাপ রাখতে হয়, সেখানে স্কেচ বা ক্যামেরায় তোলা ছবি যাবে ইত্যাদি। এরপর প্রফেশনাল লোক প্রুফ কারেকশন করলেন। আবার আমি প্রুফ দেখলাম, আবার কারেকশন হল। বারতিনেক কারেকশানের পরে ব্যাপারটা ফাইনাল হল। এবার বইয়ের প্রচ্ছদ কে করবেন, কীভাবে করবেন, আমি তো কিছুই জানি না। মুশকিল আসান সেই বঙ্কিমদা।

ধীরেন দেবনাথ বলে একজন শিল্পীকে দিয়ে কাজটি করালেন। অসাধারণ কাজ করেছিলেন ধীরেনদা। প্রথম সন্তান গর্ভে থাকার সময় মা যেমন একটু একটু করে সব কিছু শিখতে থাকেন, আমিও দে’জ-এর গর্ভে আমার বই প্রস্তুত হওয়ার পর্বে একটু একটু করে অনেক কিছুই শিখতে লাগলাম। অবশেষে বই গেল ছাপা হতে। বঙ্কিমদা বললেন, আপনার আর কিছু করার নেই, হাত গুটিয়ে বসে থাকুন, বই বেরোলে সন্তানকে কোলে নেবেন। শুরু হয়ে গেল সেবারের বইমেলা। আমারও শুরু হল প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। দে’জ-এর বইমেলায় প্রকাশিতব্য বইয়ের তালিকা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হল। সেখানে মেডিক্যাল হ্যান্ডবুক বিভাগে আমার বইয়ের নাম দেখে আহ্লাদে আটখানা হলাম।

দেখতে দেখতে প্রথম সপ্তাহ পার হল বইমেলার। কিন্তু আমার বইয়ের দেখা নাই রে। দে’জ-এর স্টলের আশপাশেই ঘুরঘুর করছি। সেভাবে তখন তো আমাকে দে’জ-এর কেউ চেনে না। জনগণের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়েই ঢুকতে হয়। বেশ কয়েকদিন সেভাবেই ভিতরে ঢুকে খোঁজখবর নিলাম। একদিন পরিচয় হল কাউন্টারে বসে থাকা বাবুর সঙ্গে, দে’জ-এর কর্ণধার সুধাংশুদা’র ভাই সুভাষচন্দ্র দে’র সঙ্গে। উনি ততদিনে আমাকে চিনে গেছেন। বললেন, আজকালের মধ্যেই আসবে। সেই থেকে তিন দশক ধরে বাবুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। আমরা প্রায় একই বয়সি। যৌবনের বন্ধুত্ব এখন প্রৌঢ়ত্বে এসে ঠেকেছে, আলগা হয়নি তা একদিনের জন্যও। বরং আরও আঁটোসাঁটো হয়েছে। বাবুর মতো এমন পরিশ্রমী, কর্তব্যনিষ্ঠ, লো প্রোফাইল মানুষ খুব কমই পাওয়া যায়। প্রকাশনার জগতের গ্ল্যামার থেকে ও সবসময় দূরে থাকতেই পছন্দ করে।

আজ বাদে কাল বইমেলা শেষ। আমার বই আর স্টলে এসে পৌঁছল না। বঙ্কিমদাকে রোজই ফোন করি। বলেন, বাইন্ডারের ঘরে আছে, কালকেই চলে যাবে। শেষদিনে বইমেলায় প্রচণ্ড ভিড় হয়, এই আশঙ্কায় এবং কিছুটা হতাশায় আমি আর শেষ দিন বইমেলায় গেলাম না। সন্ধ্যায় ল্যান্ডলাইন ফোন বেজে উঠল। বাড়িতেই ছিলাম, ধরলাম। ও প্রান্তে বঙ্কিমদার গলা, আপনি কোথায়, আপনার বই কাউন্টারে চলে এসেছে, একজন এইমাত্র কিনলেন, আপনার খোঁজও করছিলেন। শুনে ভীষণ খুশি হলাম। বঙ্কিমদাকে অনেক থ্যাংকস দিলাম। পাশাপাশি ভীষণ আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে, আমার মতো এক অখ্যাত লেখকের বই বেরোতে না বেরোতেই কে কিনবে, লেখকের খোঁজই বা করবে কেন! একটু বাদেই আমার সাহিত্যপ্রেমী এবং জামাইপ্রেমী শ্বশুরমশাইয়ের ফোন পেলাম, জানলাম তিনিই আমার বইয়ের প্রথম ক্রেতা। খুব প্রশংসা করলেন আমার বইয়ের এবং আশীর্বাদও করলেন। আসলে আমার বইয়ের পাণ্ডুলিপির অনেকটাই উনি সাগ্রহে নিজের হাতে কপি করে দিয়েছিলেন প্রেসে যাবার আগে। নিজের লেখা প্রথম বই প্রকাশের আনন্দ অনেকটা প্রথমবার বাবা হওয়ার আনন্দের মতোই। খবরটা পেয়ে মাকে সবার আগে জানালাম, তারপর পরিবারের অন্যদের। আমাদের বংশে আমিই নাকি প্রথম লেখক! কাজেই আনন্দে-আহ্লাদে আটখানা হল সবাই। আবার এল সেই বইমেলা, বার্ষিক বই পার্বণ। ময়দান থেকে ঠাঁই নাড়া হলেও বইমেলার আকর্ষণ বইপ্রেমীদের কাছে আজও এতটুকুও কমেনি। একটি নয়, দুটিও নয়, এবার বইমেলায় আমার তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ডাক্তারি বিষয়ক ‘করোনা নিয়ে সত্যি মিথ্যা’, বেড়ানোর বই ‘ইউরোপে ১৬ দিন’, নাটকের বই, ‘নয় স্বাদের নয়টি শ্রুতি নাটক’৷ কিন্তু সত্যি বলছি, আজ থেকে ৩১ বছর আগের প্রথম বই প্রকাশের সেই যে আনন্দ, সেটা আজ আর তেমনভাবে ফিল করি না। এটা বয়স কালের ভীমরতি কি না, কে জানে! বইমেলা এলে খুব মিস করি বঙ্কিমদাকে। অকালে চলে গেছেন তিনি। আমি হারিয়েছি আমার এক অকৃত্রিম বন্ধুকে। মিস করি চ্যাটার্জিদা, কার্তিকদা-সহ অনেককেই, বয়সের ভারে অনেকেই দে’জ থেকে বিদায় নিয়েছেন, কেউ-বা এই পৃথিবী থেকেই।

বইমেলা এলে আমার মায়ের কথাও খুব মনে পড়ে। সদ্য প্রকাশিত বইয়ের প্রথম কপিটি তুলে দিতাম মায়ের হাতে, তারপর আমার স্ত্রীর হাতে। মা বই হাতে পেয়ে তখনই পড়তে বসে যেত, আর প্রতিবারই বলত, এসব বই পড়লে কত কিছু জানা যায়। পরে যখন পড়তে পারত না, তখন বইয়ে হাত বুলিয়ে মাথার বালিশের তলায় বইটা রেখে শুয়ে পড়ত। দু-চারদিন বাদে বইটি পাশের আলমারিতে, যেখানে আমার অন্য বইগুলো রাখা থাকত, সেখানে সাজিয়ে রাখত। মা নেই, কিন্তু বইগুলো একইভাবে আজও রাখা আছে। লেখক হিসেবে আজ আমার পাঠকমহলে যেটুকু পরিচিতি, তার সবটাই আমার সাহিত্যগুরু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ এবং দে’জ-এর কর্ণধার সুধাংশুদার অকুণ্ঠ সহযোগিতা এবং প্রশ্রয়। লেখক হব, এমন কথা আমি কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, তবু হয়েছি। কিন্তু সত্যিই কি হয়েছি! ৫২টি বই বেরোনোর পরও মাঝে মাঝে নিজেকে এমন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে।

Skip to content