শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়।
আকাশবাণী। প্রথম যার অবস্থান ছিল গাস্টিন প্লেসে। আমি অবশ্য ছোটবেলা থেকে ইডেন গার্ডেনের পাশেই আকাশবাণীকে দেখে এসেছি। আমাদের ছোটবেলায় টিভি ছিল না। বিনোদনের শেষ কথা ছিল রেডিওই। ঘুমোনোর সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাদিনই রেডিও খোলা থাকত। যে যার পছন্দের অনুষ্ঠান শুনত। আমার খুব প্রিয় ছিল প্রতি শুক্রবার রাত আটটার এবং রবিবার দুপুরের নাটক। এছাড়া বিবিধ ভারতীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান, রম্যগীতি এবং স্থানীয় সংবাদ খুব মন দিয়ে শুনতাম। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে হত, যদি আমিও রেডিওতে কিছু বলতে পারতাম, তাহলে কত লোক আমার গলাও শুনতে পেত! বাইরে থেকে আকাশবাণী ভবনকে অনেকবারই দেখেছি, কিন্তু ভিতরে ঢোকার সুযোগ হয়নি। সম্ভবত সালটা ছিল ১৯৭৩। সদ্য হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছি। ধর্মতলায় কোনও কাজে গিয়েছিলাম, হাতে সময় ছিল, হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম আকাশবাণী ভবনের সামনে। হঠাৎ একজন বিখ্যাত মানুষকে দেখলাম আকাশবাণীর গেটের পাশের থামে হেলান দিয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন। দেখেই চিনে ফেললাম প্রখ্যাত নট রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তকে। কারণ মাসখানেক আগেই ওঁদের নান্দীকারের নাটক ফুটবল দেখেছি। সোজা চলে গেলাম ওঁর কাছে। চলে গিয়ে খেজুরে আলাপ জুড়লাম ফুটবল নিয়ে। উনি তখন বিকেসি কলেজে ইংরেজি পড়ান, সম্ভবত বিভাগীয় প্রধানও ছিলেন। আমার জ্যাঠতুতো দিদি দেবযানী ছিল ওঁর ছাত্রী। দিদির মুখে ওঁর সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনতাম। সেসব কথা ওঁকে বলাতে দিদিকে চিনতেও পারলেন। একথা সেকথার পর ওঁর কাছে মনের ইচ্ছে ব্যক্ত করলাম। স্যার, আমাকে একটু আকাশবাণীতে ঢোকার সুযোগ করে দিতে পারেন, আমি শুধু একটু ঘুরে-ফিরে দেখেই চলে আসব। উনি বললেন, একটু আগেই তো আমি রেকর্ডিং করে বেরোলাম। আচ্ছা তুমি এসো আমার সঙ্গে।
বিখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর বদান্যতায় আমি প্রথম ঢুকলাম আকাশবাণী ভবনে। নিজের মতো করে ঘুরেফিরেও দেখলাম। ওখানে অনুষ্ঠান করার সুপ্ত বাসনা মনের মধ্যে আবার কিলবিল করে উঠল। এর মধ্যে ডাক্তারিতে চান্স পেয়ে আরজি কর মেডিকেল কলেজে প্রি-মেডিকেলে ভর্তি হলাম। তখন ডাক্তারি কোর্স ছিল পাঁচ বছরের। তার আগে এক বছর প্রি-মেডিকেল পড়ানো হত, যেখানে বায়োলজি, কেমিস্ট্রির সঙ্গে বাংলা ইংরেজিও পড়তে হত। এই কোর্স অনেকদিনই উঠে গেছে। আমি স্কুল জীবনের শেষদিকে প্রণবেশ ঘোষ নামে একজন শিক্ষককে পেয়েছিলাম যিনি তখন রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরবর্তীকালে দূরদর্শনেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। হঠাৎ একদিন প্রণবেশ স্যারের সঙ্গে দেখা আরজি করে। একথা সেকথার পর বললেন, রেডিওতে প্রোগ্রাম করবে? তাহলে নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর একটা কাগজে লিখে আমাকে দাও। দিলাম। মাসখানেক বাদে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে আমার নামে একটা বাদামি খাম এল বাই পোস্টে। ভেতরে চিঠি। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বাংলায় কথিকা পাঠ করার জন্য। বিষয়টা এখনও মনে আছে। পাঁচ মিনিট বলতে হবে গণতন্ত্র নিয়ে যুববাণী বিভাগে। প্রণবেশ স্যারের হাত ধরে এভাবেই আমার প্রবেশ আকাশবাণীতে।
বিখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর বদান্যতায় আমি প্রথম ঢুকলাম আকাশবাণী ভবনে। নিজের মতো করে ঘুরেফিরেও দেখলাম। ওখানে অনুষ্ঠান করার সুপ্ত বাসনা মনের মধ্যে আবার কিলবিল করে উঠল। এর মধ্যে ডাক্তারিতে চান্স পেয়ে আরজি কর মেডিকেল কলেজে প্রি-মেডিকেলে ভর্তি হলাম। তখন ডাক্তারি কোর্স ছিল পাঁচ বছরের। তার আগে এক বছর প্রি-মেডিকেল পড়ানো হত, যেখানে বায়োলজি, কেমিস্ট্রির সঙ্গে বাংলা ইংরেজিও পড়তে হত। এই কোর্স অনেকদিনই উঠে গেছে। আমি স্কুল জীবনের শেষদিকে প্রণবেশ ঘোষ নামে একজন শিক্ষককে পেয়েছিলাম যিনি তখন রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরবর্তীকালে দূরদর্শনেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। হঠাৎ একদিন প্রণবেশ স্যারের সঙ্গে দেখা আরজি করে। একথা সেকথার পর বললেন, রেডিওতে প্রোগ্রাম করবে? তাহলে নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর একটা কাগজে লিখে আমাকে দাও। দিলাম। মাসখানেক বাদে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে আমার নামে একটা বাদামি খাম এল বাই পোস্টে। ভেতরে চিঠি। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বাংলায় কথিকা পাঠ করার জন্য। বিষয়টা এখনও মনে আছে। পাঁচ মিনিট বলতে হবে গণতন্ত্র নিয়ে যুববাণী বিভাগে। প্রণবেশ স্যারের হাত ধরে এভাবেই আমার প্রবেশ আকাশবাণীতে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
কথিকা দিয়ে শুরু হল। তারপর গ্রুপ ডিসকাশন, কবিতা পাঠ, নাটক, গুণীজনের ইন্টারভিউ, গীতি আলেখ্যতে ভাষ্যপাঠ এমনতরো নানারকম কাজ করেছি। সবথেকে বেশি করেছি মেডিকেল এডুকেশন প্রোগ্রাম। চারজন হবু ডাক্তারকে নিয়ে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। আলোচক নির্বাচনের দায়িত্ব আমার উপরেই থাকত। এই সুযোগে আমি আমার ডাক্তারি সহপাঠীদের অনেককেই এই সময় রেডিওতে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। পরিষ্কার মনে আছে, জীবনে প্রথম রেডিও প্রোগ্রাম করে একটা ২৫ টাকার চেক পেয়েছিলাম। রেডিওতে প্রোগ্রাম করতে গিয়ে বহুগুণী মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম। তৎকালীন প্রযোজক প্রদীপকুমার মিত্রের কথা এখনও মনে আছে। মানুষটা ছিলেন একাই একশো। দু’হাতে সামলাতেন দশ হাতের কাজ এবং সবটাই হাসিমুখে। যুববাণী বিভাগটিকে একাই দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রদীপদা।
এরপর কলকাতা-ক বিভাগে বিভিন্ন ডাক্তারি আলোচনায় অংশগ্রহণ করতাম। একদিন বিশাল কাচে ঘেরা স্টুডিও ফ্লোরে রেকর্ডিং সবে শুরু হয়েছে। একদিকে চলছে রেকর্ডিং, অন্যদিকে মাইকের সামনে আমি বকবক করে চলেছি। হঠাৎ দেখি এক ভদ্রলোক কাচের পার্টিশনের ওপারে, যেখানে রেকর্ডিস্ট রেকর্ডিং করছেন, সেখান থেকে ইশারায় আমাকে থামতে বলছেন। আমি থামলাম। একটু বাদে উনি আমার ঘরে এসে বললেন, আমার নাম সমরেশ ঘোষ, এখানে কাজ করি। কিছু মনে করবেন না, আপনার বলাটা আমার ঠিক ভালো লাগছে না। আপনি কিছু মনে না করলে আমি একটু পড়ে দেখিয়ে দেব। মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও সমরেশ ঘোষ নামটা যেহেতু আমার আগে থেকেই চেনা ছিল, তাই আর না করলাম না। সমরেশদা আমাকে ধরে ধরে দেখিয়ে দিলেন, কোন কোন শব্দের ওপর জোর দিতে হবে, কোথায় পস দিতে হবে, গলার ওঠানামা কীভাবে হবে ইত্যাদি। আসলে সমরেশদা ছিলেন নাট্য বিভাগের সিনিয়র প্রযোজক। তাঁর বহু নাটক সর্বভারতীয় বেতার নাটক প্রতিযোগিতায় একাধিকবার পুরস্কৃত হয়েছে। ওঁর সঙ্গে দারুণ ভাব জমে গেল আমার। আমিও অন্য সব বিভাগ ছেড়েছুড়ে সমরেশদা নাটকের বিভাগেই যাতায়াত শুরু করলাম।
তখন আমি শ্রুতিনাটক লিখছি। দে’জ পাবলিশিং থেকে শ্রুতিনাটকের প্রথম বইটিও প্রকাশিত হয়েছে। সমরেশদাকে একটা বই উপহার দিলাম। উনি পড়ে একটি নাটক নির্বাচিত করে বললেন, এই নাটকটা রেডিওতে করা যেতে পারে, তবে এভাবে হবে না, রেডিওর মতো করে তোমাকে নাটকটিকে সাজাতে হবে। শ্রুতিনাটক শব্দটি উনি পছন্দ করতেন না, এখনও করেন না, বলেন শ্রাব্যনাটক। আমাকে বুঝিয়ে বললেন, বেতার নাটকের জন্য আমার একটি শ্রুতিনাটককে কীভাবে ঘষামাজা করে সাজাতে হবে। ওঁর কথামতো তাই করে স্ক্রিপ্টটা জমা দিলাম। উনি আরও বারদুয়েক কাটাছেঁড়া করার পর ফাইনাল করলেন। নাটকের নামটিও পালটে দিলেন। শ্রুতিনাটক পরচুলা বেতার নাটক শিল্পতৃষা নামে সম্প্রসারিত হল কলকাতা ক-তে শুক্রবার রাত আটটায়। সমরেশদাই আমাকে বেতার নাট্যকার বানিয়ে তুললেন। এরপর উনি আমার লেখা তৃতীয় পক্ষ, মানবপুত্র, অবশেষে-সহ বেশ কয়েকটি নাটক প্রযোজনা করেছিলেন। এবং বলাই বাহুল্য, প্রতিটি নাটক নিয়েই আমাকে ভীষণ রকম খাটিয়েছিলেন। এক এক সময়ে এজন্য বিরক্তও হয়েছি। মনে আছে, একবার বাড়ির চেম্বারে পেশেন্ট দেখছি। হঠাৎ সমরেশদার ফোন। আমার নতুন নাটকে উনি একটু সংযোজন করতে চান এবং কী কী ডায়লগ থাকবে সেগুলো অ্যাকটিং করে ফোনেই বলতে শুরু করলেন। নাটক পাগল মানুষ ছিলেন সমরেশদা এবং হান্ড্রেড পার্সেন্ট পারফেকশনিস্ট একজন নাট্য প্রযোজক। যে জন্য বহুবার সেরা নাট্য প্রযোজকের সম্মান পেয়েছেন। এমনকী আমার নাটক মানবপুত্র ওঁর প্রযোজনায় ১৯৯৭ সালে সার্টিফিকেট অফ মেরিট পেয়েছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও ড্রামা কম্পিটিশনে। জানি না, এমন প্রযোজক এখন আর আকাশবাণীতে আছেন কি না! এই আকাশবাণীতেই পরিচয় হয়েছিল প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী জগন্নাথ বসুর সঙ্গে। অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক ঘণ্টার এক আড্ডার অনুষ্ঠান করেছিলাম এই বেতারেই। প্রখ্যাত বেতার প্রযোজক শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কালব্যাধি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এখানেই। চলমান ইতিহাস বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে প্রথম দেখি আকাশবাণীতেই। উনি তখন অবসর নিয়েছেন। সম্ভবত কারও সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে অবশ্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর স্নেহসান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য আমি লাভ করেছিলাম একাধিকবার। আকাশবাণীতে আমার আরেকটি আনন্দের জায়গা ছিল, ক্যান্টিন। খুব সস্তায় নানা ধরনের খাবার পাওয়া যেত সেখানে। শুধু নিজে যে খেয়েছি তাই নয়, অনেককে নিয়ে গিয়ে অনেকবারই সেখানে খাইয়েছি।
এরপর কলকাতা-ক বিভাগে বিভিন্ন ডাক্তারি আলোচনায় অংশগ্রহণ করতাম। একদিন বিশাল কাচে ঘেরা স্টুডিও ফ্লোরে রেকর্ডিং সবে শুরু হয়েছে। একদিকে চলছে রেকর্ডিং, অন্যদিকে মাইকের সামনে আমি বকবক করে চলেছি। হঠাৎ দেখি এক ভদ্রলোক কাচের পার্টিশনের ওপারে, যেখানে রেকর্ডিস্ট রেকর্ডিং করছেন, সেখান থেকে ইশারায় আমাকে থামতে বলছেন। আমি থামলাম। একটু বাদে উনি আমার ঘরে এসে বললেন, আমার নাম সমরেশ ঘোষ, এখানে কাজ করি। কিছু মনে করবেন না, আপনার বলাটা আমার ঠিক ভালো লাগছে না। আপনি কিছু মনে না করলে আমি একটু পড়ে দেখিয়ে দেব। মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও সমরেশ ঘোষ নামটা যেহেতু আমার আগে থেকেই চেনা ছিল, তাই আর না করলাম না। সমরেশদা আমাকে ধরে ধরে দেখিয়ে দিলেন, কোন কোন শব্দের ওপর জোর দিতে হবে, কোথায় পস দিতে হবে, গলার ওঠানামা কীভাবে হবে ইত্যাদি। আসলে সমরেশদা ছিলেন নাট্য বিভাগের সিনিয়র প্রযোজক। তাঁর বহু নাটক সর্বভারতীয় বেতার নাটক প্রতিযোগিতায় একাধিকবার পুরস্কৃত হয়েছে। ওঁর সঙ্গে দারুণ ভাব জমে গেল আমার। আমিও অন্য সব বিভাগ ছেড়েছুড়ে সমরেশদা নাটকের বিভাগেই যাতায়াত শুরু করলাম।
তখন আমি শ্রুতিনাটক লিখছি। দে’জ পাবলিশিং থেকে শ্রুতিনাটকের প্রথম বইটিও প্রকাশিত হয়েছে। সমরেশদাকে একটা বই উপহার দিলাম। উনি পড়ে একটি নাটক নির্বাচিত করে বললেন, এই নাটকটা রেডিওতে করা যেতে পারে, তবে এভাবে হবে না, রেডিওর মতো করে তোমাকে নাটকটিকে সাজাতে হবে। শ্রুতিনাটক শব্দটি উনি পছন্দ করতেন না, এখনও করেন না, বলেন শ্রাব্যনাটক। আমাকে বুঝিয়ে বললেন, বেতার নাটকের জন্য আমার একটি শ্রুতিনাটককে কীভাবে ঘষামাজা করে সাজাতে হবে। ওঁর কথামতো তাই করে স্ক্রিপ্টটা জমা দিলাম। উনি আরও বারদুয়েক কাটাছেঁড়া করার পর ফাইনাল করলেন। নাটকের নামটিও পালটে দিলেন। শ্রুতিনাটক পরচুলা বেতার নাটক শিল্পতৃষা নামে সম্প্রসারিত হল কলকাতা ক-তে শুক্রবার রাত আটটায়। সমরেশদাই আমাকে বেতার নাট্যকার বানিয়ে তুললেন। এরপর উনি আমার লেখা তৃতীয় পক্ষ, মানবপুত্র, অবশেষে-সহ বেশ কয়েকটি নাটক প্রযোজনা করেছিলেন। এবং বলাই বাহুল্য, প্রতিটি নাটক নিয়েই আমাকে ভীষণ রকম খাটিয়েছিলেন। এক এক সময়ে এজন্য বিরক্তও হয়েছি। মনে আছে, একবার বাড়ির চেম্বারে পেশেন্ট দেখছি। হঠাৎ সমরেশদার ফোন। আমার নতুন নাটকে উনি একটু সংযোজন করতে চান এবং কী কী ডায়লগ থাকবে সেগুলো অ্যাকটিং করে ফোনেই বলতে শুরু করলেন। নাটক পাগল মানুষ ছিলেন সমরেশদা এবং হান্ড্রেড পার্সেন্ট পারফেকশনিস্ট একজন নাট্য প্রযোজক। যে জন্য বহুবার সেরা নাট্য প্রযোজকের সম্মান পেয়েছেন। এমনকী আমার নাটক মানবপুত্র ওঁর প্রযোজনায় ১৯৯৭ সালে সার্টিফিকেট অফ মেরিট পেয়েছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও ড্রামা কম্পিটিশনে। জানি না, এমন প্রযোজক এখন আর আকাশবাণীতে আছেন কি না! এই আকাশবাণীতেই পরিচয় হয়েছিল প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী জগন্নাথ বসুর সঙ্গে। অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক ঘণ্টার এক আড্ডার অনুষ্ঠান করেছিলাম এই বেতারেই। প্রখ্যাত বেতার প্রযোজক শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কালব্যাধি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এখানেই। চলমান ইতিহাস বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে প্রথম দেখি আকাশবাণীতেই। উনি তখন অবসর নিয়েছেন। সম্ভবত কারও সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে অবশ্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর স্নেহসান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য আমি লাভ করেছিলাম একাধিকবার। আকাশবাণীতে আমার আরেকটি আনন্দের জায়গা ছিল, ক্যান্টিন। খুব সস্তায় নানা ধরনের খাবার পাওয়া যেত সেখানে। শুধু নিজে যে খেয়েছি তাই নয়, অনেককে নিয়ে গিয়ে অনেকবারই সেখানে খাইয়েছি।
সমরেশ ঘোষ।
বেতারে তখন এফএম চ্যানেল সবে শুরু হয়েছে। আমার বন্ধু বাচিক শিল্পী অঞ্জন বিশ্বাস একবার আমাকে আমন্ত্রণ জানাল আজ রাতের অতিথি অনুষ্ঠানে। বছর পঁচিশ কিংবা তারও একটু বেশি আগের ঘটনা বলছি। রাত দশটা থেকে বারোটা অবধি টানা দু’ঘণ্টা আমার সঙ্গে লাইফ আড্ডা দিয়েছিল অঞ্জন। আমার জীবনের নানা ঘটনা শ্রোতাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিলাম, শুনিয়েছিলাম কিছু নাটকের সংলাপ, প্রিয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের কয়েকটি কলি। অঞ্জন সহশিল্পী নিয়ে পরিবেশন করেছিল আমার লেখা ক্যানসার নিয়ে নাটক, রিক্তাকে নিয়ে চিঠি। ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত একটি অনাথ মেয়ে ধরেই নিয়েছিল সে মারা যাবেই, কারণ ক্যানসার হলে কেউ বাঁচে না, তাই চিকিৎসা শুরু করতে চাইনি সে, জানায়নি কাউকেই। তার প্রেমিক সবকিছু জানার পর, তাকে জোর করেই নিয়ে গেল চিকিৎসা করাতে, কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে রিক্তা দেখল, কত মানুষ ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছে, বেঁচে ফিরছেও। রিক্তাও চাইল আবার নতুন করে বেঁচে উঠতে, কিন্তু পারল না। অসাধারণ অভিনয় করেছিল অঞ্জন। প্রচুর ফোন এসেছিল ডিউটি রুমে। তিন-চারটির বেশি ফোন ধরা সম্ভব হয়নি। অনুষ্ঠান শেষ করে ডিউটি রুমে আসতেই অফিসার বললেন, একটি ফোন আপনাকে ধরতেই হবে ডাক্তারবাবু, এক ভদ্রমহিলা খুব কান্নাকাটি করছেন। ফোন ধরলাম। অপর প্রান্তে এক মাঝবয়সি মহিলা। তার একমাত্র কন্যাকে ব্রেস্ট ক্যানসারে হারিয়েছেন কিছুদিন আগেই। উনি তখনও জানতেন না যে প্রথম পর্যায়ে ধরা পড়লে ক্যানসার সারে এবং এর সঠিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাও আছে। শুধু অজ্ঞানতার জন্য মেয়েকে অকালে হারিয়েছেন। আমার নাটক তাঁর হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন তিনি এই কথাগুলো বলতে গিয়ে। বলেছিলেন, এমন নাটক আরও লিখুন ডাক্তারবাবু আমাদের মতো অজ্ঞান মানুষদের সচেতন করতে। কতদিন আগের কথা। এখনও সেই ভদ্রমহিলার কান্না-ভেজা কণ্ঠে আমি যেন শুনতে পাই, ‘একটু আগে চিকিৎসা শুরু করলে আমার মেয়েটা বেঁচে যেত ডাক্তারবাবু। আমরাই ওকে মেরে ফেললাম।’
আকাশবাণীতে এটিই ছিল আমার শেষ অনুষ্ঠান। এরপরেও একাধিকবার আমন্ত্রণ পেয়েছি স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানে। মন সায় দেয়নি, তাই আর প্রোগ্রামও করিনি। তাছাড়া সমরেশদা রিটায়ার করে যাবার পরে নাটকেও কেউ আর সেভাবে আমাকে ডাকেনি। আজও মাঝে মাঝে এফ এমে আমার নাটক প্রচারিত হয়। হঠাৎ করে কয়েকবার শুনেও ফেলেছি। বেশ লাগে। একটা নস্টালজিক ফিলিংসও হয়। নয় নয় করে প্রায় তিরিশ বছর আকাশবাণীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল যে, এত সহজে সেটা ভুলি কী করে!
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
আকাশবাণীতে এটিই ছিল আমার শেষ অনুষ্ঠান। এরপরেও একাধিকবার আমন্ত্রণ পেয়েছি স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানে। মন সায় দেয়নি, তাই আর প্রোগ্রামও করিনি। তাছাড়া সমরেশদা রিটায়ার করে যাবার পরে নাটকেও কেউ আর সেভাবে আমাকে ডাকেনি। আজও মাঝে মাঝে এফ এমে আমার নাটক প্রচারিত হয়। হঠাৎ করে কয়েকবার শুনেও ফেলেছি। বেশ লাগে। একটা নস্টালজিক ফিলিংসও হয়। নয় নয় করে প্রায় তিরিশ বছর আকাশবাণীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল যে, এত সহজে সেটা ভুলি কী করে!
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।