মহানায়ক উত্তমকুমার।
জীবনের চলার পথে কত মানুষের সঙ্গেই তো দেখা হল, সবারই যেমন হয়। তবু তারই মাঝে কিছু দেখা, কিছু পরিচয়, কিছু ঘনিষ্ঠতা অন্তরের মণিকোঠায় চিরকালের জন্য ফ্রেমবন্দি হয়ে থাকে। সেদিন টিভির পর্দায় বহুবার দেখা সেই সোনার সিনেমা ‘সন্ন্যাসী রাজা’ দেখছিলাম। পঞ্চাশ বছর আগের সিনেমা এখনও হাঁ করে গিলতে হয়। মনে পড়ে গেল, মহানায়ককে প্রথমবার যখন দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম, এভাবে হাঁ করেই গিলেছিলাম। আমার ডাক্তারির জীবন, নাটকের জীবন এবং লেখালেখির জীবনের অনেক কথাই এর আগে বলেছি। এবার একটু প্রসঙ্গান্তরে যাই। উত্তমকুমার-দর্শনের গল্প শোনাই।
তখন সবে আরজি কর মেডিকেল কলেজে ঢুকেছি, সালটা ছিল ১৯৭৪। দু-চারবার স্টুডিও পাড়ায় ঢুঁ মারা হয়ে গেছে। অনেক ফিল্মস্টারকেও দেখে ফেলেছি, তাঁদের অটোগ্রাফও নিয়েছি। সে সব গল্পই দু-একজন বন্ধুকে করতাম। আমার প্রতিবেশী বন্ধু জয়দেব একদিন হঠাৎ বলে বসল, আমাকে একবার উত্তমকুমারকে দেখাতে পারিস। স্টুডিওতে যাতায়াত ভাড়া, চা-কাটলেট সব খরচ আমি দেব, তুই শুধু গুরুকে একবার দেখিয়ে দে। দু’চোখ ভরে দেখব আর আমার খাতায় একটা অটোগ্রাফ নেব। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, আমিই এখনও দেখার সুযোগ পাইনি, তোকে দেখাব কী করে! আসলে গুরুকে দেখার ইচ্ছে অন্য পাঁচজনের মতো আমারও তো কোনও অংশে কম নয়, কিন্তু সুযোগ পাব কী করে! আর তাছাড়া তখন তো রাস্তাঘাটে বা মাচায়, পুজো উদ্বোধনে, পলিটিক্যাল নাচন-কোঁদনে এত চিত্রতারকার দেখা পাওয়া যেত না। এখন তো ক্যাশ ডাউন করলে অনেকেই আসেন। জয়দেব আমার মধ্যে গুরুকে দেখার সুপ্ত ইচ্ছেটা আবার উসকে দিল। সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম।
আমার এক মেসোমশাই মালদহ টাউনে বিচিত্রা নামে একটি সিনেমাহলের মালিক ছিলেন ভাইদের সঙ্গে জয়েন্ট পার্টনারশিপে। শুনলাম, ওঁরা একটা সিনেমা করছে উত্তমকুমারকে নিয়ে শ্রীমা পিকচার্সের ব্যানারে। ভাবলাম এই তো সুযোগ। এটাকেই কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু কিছুতেই মেসোর সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারলাম না। তখন তো আর মোবাইল ছিল না, ল্যান্ড লাইনে অনেকবার ফোন করলাম, কিন্তু মেসোকে পেলাম না। হঠাৎ আনন্দবাজারের সিনেমার পাতায় দেখলাম খবরটা বেরিয়েছে এবং কবে থেকে কোথায় শ্যুটিং শুরু, সেটাও উল্লেখ আছে। ভাবলাম কপাল ঠুকে একবার গিয়েই দেখি, যদি ম্যানেজ করে শ্যুটিং দেখা যায়। জয়দেবকে বলতে, ও তো এক পায়ে খাড়া। সকাল এগারোটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। গেটে দশাসই এক দারোয়ান পথ আটকে জানতে চাইল, কিধার যায়েগা? আমি উত্তর দেবার আগেই জয়দেব বলে উঠল, আমরা শ্রীমা পিকচার্সের লোক। শ্যুটিং আছে আমাদের। আমাদের কিছুক্ষণ ধরে জরিপ করল দারোয়ানজি, তারপর বলল, যাইয়ে। মুখে বলল বটে কিন্তু তার চোখে-মুখে আমাদের প্রতি সন্দেহ ফুটে উঠল। আমি ঢুকতে একটু ইতস্তত করছিলাম, কিন্তু জয়দেব স্মার্টলি ঢুকে গেল, পিছন ফিরে আমাকে ডাকল, চলে আয়। আমিও ঢুকে পড়লাম। কিন্তু যাব কোথায়! কোন দিকে? সোজা গিয়ে একটা গোল বেদির সামনে দাঁড়ালাম। এখন আর বেদিটা নেই। পাতাল রেলের গর্ভে চলে গেছে। তখন টেকনিশিয়ান স্টুডিওটা অনেক বড় ছিল। স্টুডিওর বেশিরভাগটাই মেট্রোরেল নিয়ে নিয়েছে সেই আশির দশকেই। বেদিটাই ছিল লাস্ট ল্যান্ডমার্ক। তারপরে ডান দিকে যেতে হবে, কিংবা বাঁদিকে। আমি আর জয়দেব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কোন দিকে যাব, কাকে জিজ্ঞেস করব শ্রীমা পিকচার্সের কথা। দারোয়ান গেটের ওখানে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রথম থেকেই লক্ষ করছিল। এবার দেখলাম পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। বুঝলাম, আমাদের মিথ্যাচার ধরে ফেলেছে ও। এবার ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে গেট দিয়ে বার করে দেবে।
তখন সবে আরজি কর মেডিকেল কলেজে ঢুকেছি, সালটা ছিল ১৯৭৪। দু-চারবার স্টুডিও পাড়ায় ঢুঁ মারা হয়ে গেছে। অনেক ফিল্মস্টারকেও দেখে ফেলেছি, তাঁদের অটোগ্রাফও নিয়েছি। সে সব গল্পই দু-একজন বন্ধুকে করতাম। আমার প্রতিবেশী বন্ধু জয়দেব একদিন হঠাৎ বলে বসল, আমাকে একবার উত্তমকুমারকে দেখাতে পারিস। স্টুডিওতে যাতায়াত ভাড়া, চা-কাটলেট সব খরচ আমি দেব, তুই শুধু গুরুকে একবার দেখিয়ে দে। দু’চোখ ভরে দেখব আর আমার খাতায় একটা অটোগ্রাফ নেব। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, আমিই এখনও দেখার সুযোগ পাইনি, তোকে দেখাব কী করে! আসলে গুরুকে দেখার ইচ্ছে অন্য পাঁচজনের মতো আমারও তো কোনও অংশে কম নয়, কিন্তু সুযোগ পাব কী করে! আর তাছাড়া তখন তো রাস্তাঘাটে বা মাচায়, পুজো উদ্বোধনে, পলিটিক্যাল নাচন-কোঁদনে এত চিত্রতারকার দেখা পাওয়া যেত না। এখন তো ক্যাশ ডাউন করলে অনেকেই আসেন। জয়দেব আমার মধ্যে গুরুকে দেখার সুপ্ত ইচ্ছেটা আবার উসকে দিল। সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম।
আমার এক মেসোমশাই মালদহ টাউনে বিচিত্রা নামে একটি সিনেমাহলের মালিক ছিলেন ভাইদের সঙ্গে জয়েন্ট পার্টনারশিপে। শুনলাম, ওঁরা একটা সিনেমা করছে উত্তমকুমারকে নিয়ে শ্রীমা পিকচার্সের ব্যানারে। ভাবলাম এই তো সুযোগ। এটাকেই কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু কিছুতেই মেসোর সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারলাম না। তখন তো আর মোবাইল ছিল না, ল্যান্ড লাইনে অনেকবার ফোন করলাম, কিন্তু মেসোকে পেলাম না। হঠাৎ আনন্দবাজারের সিনেমার পাতায় দেখলাম খবরটা বেরিয়েছে এবং কবে থেকে কোথায় শ্যুটিং শুরু, সেটাও উল্লেখ আছে। ভাবলাম কপাল ঠুকে একবার গিয়েই দেখি, যদি ম্যানেজ করে শ্যুটিং দেখা যায়। জয়দেবকে বলতে, ও তো এক পায়ে খাড়া। সকাল এগারোটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। গেটে দশাসই এক দারোয়ান পথ আটকে জানতে চাইল, কিধার যায়েগা? আমি উত্তর দেবার আগেই জয়দেব বলে উঠল, আমরা শ্রীমা পিকচার্সের লোক। শ্যুটিং আছে আমাদের। আমাদের কিছুক্ষণ ধরে জরিপ করল দারোয়ানজি, তারপর বলল, যাইয়ে। মুখে বলল বটে কিন্তু তার চোখে-মুখে আমাদের প্রতি সন্দেহ ফুটে উঠল। আমি ঢুকতে একটু ইতস্তত করছিলাম, কিন্তু জয়দেব স্মার্টলি ঢুকে গেল, পিছন ফিরে আমাকে ডাকল, চলে আয়। আমিও ঢুকে পড়লাম। কিন্তু যাব কোথায়! কোন দিকে? সোজা গিয়ে একটা গোল বেদির সামনে দাঁড়ালাম। এখন আর বেদিটা নেই। পাতাল রেলের গর্ভে চলে গেছে। তখন টেকনিশিয়ান স্টুডিওটা অনেক বড় ছিল। স্টুডিওর বেশিরভাগটাই মেট্রোরেল নিয়ে নিয়েছে সেই আশির দশকেই। বেদিটাই ছিল লাস্ট ল্যান্ডমার্ক। তারপরে ডান দিকে যেতে হবে, কিংবা বাঁদিকে। আমি আর জয়দেব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কোন দিকে যাব, কাকে জিজ্ঞেস করব শ্রীমা পিকচার্সের কথা। দারোয়ান গেটের ওখানে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রথম থেকেই লক্ষ করছিল। এবার দেখলাম পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। বুঝলাম, আমাদের মিথ্যাচার ধরে ফেলেছে ও। এবার ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে গেট দিয়ে বার করে দেবে।
মহানায়কের দেওয়া অটোগ্রাফ আজও সযত্নে আমার কাছে রাখা আছে।
একবার ডানে একবার বাঁয়ে তাকাচ্ছি। হঠাৎ ডানদিকে জনা তিনেক লোককে স্টুডিও ফ্লোরের ঠিক বাইরে আড্ডা দিতে দেখলাম। কালো ট্রাউজার আর ঘিয়ে রঙের শার্ট পরা এক সুদর্শন ভদ্রলোক ক্যামেরার ভাষায় একটু স্লো মোশনে আমাদের দিকে ঘুরে একটা সিগারেট ধরালেন। দেখেই জয়দেব চেঁচিয়ে উঠল, ওই তো গুরু। আমি তাকিয়ে দেখলাম, ওমা তাই তো, এ তো মহানায়ক! আমাদের থেকে কয়েক মিটার দূরে দাঁড়িয়ে সেই পাগল-করা ভঙ্গিতে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন, পর্দায় এমনটা কতবার দেখেছি। জয়দেবকে বললাম, চল গুরুর পায়ে গিয়ে পড়ি, সব কথা খুলে বলি, একটা হিল্লে হলেও হতে পারে। দুজনে গিয়ে দাঁড়ালাম গুরুর সামনে। বুকে কাঁপন ধরানো সেই কণ্ঠস্বর বেজে উঠল আমাদের কানে, বলুন কী চাই? জয়দেব আমার থেকে অনেক স্মার্ট। অটোগ্রাফের খাতা মেলে ধরল গুরুর সামনে, হাতে তুলে দিল পেন। দেখাদেখি আমিও খাতা মেলে ধরলাম। গুরু দুজনকেই অটোগ্রাফ দিলেন, যেটি আজও সযত্নে আমার কাছে রাখা আছে। জয়দেব এবার কাঁদো কাঁদো স্বরে উত্তমকুমারকে অনুরোধ করল, স্যার আমরা সেই কৃষ্ণনগর থেকে এসেছি আপনার শুটিং দেখব বলে। যদি একটু ব্যবস্থা করে দিতেন! আমরা দুজনেই ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছি আরজি কর মেডিকেল কলেজে, হস্টেল পাইনি এখনও, তাই বাড়ি থেকেই যাতায়াত করি। আমার তো চোখ কপালে! জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ডাক্তারিতে তো চান্স পেয়েছি আমি, জয়দেব তো সুরেন্দ্রনাথে কমার্সে ঢুকেছে! উত্তমকুমার আমাদের দুজনকে একটু ভালো করে দেখলেন, তারপর বললেন, তাহলে আজকে দুজনেরই কলেজ গেল, কিন্তু আমি কী করে আপনাদের শ্যুটিং দেখাব বলুন তো! আপনারা এক কাজ করুন, এই সিনেমার ডিরেক্টর যাত্রিক মানে দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলুন, উনি যদি জিজ্ঞেস করেন, বলবেন যে আমার কোনও আপত্তি নেই। উনি পারমিশন না দিলে কিন্তু শুটিং দেখা যাবে না, একটু অন্যরকম মানুষ কিনা উনি। উত্তমকুমারের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত সংগীত পরিচালক ডাক্তার নচিকেতা ঘোষ, যিনি ডাক্তারি পড়েছেন আরজি কর মেডিকেল কলেজেই। উনিও ঘাড় নেড়ে সহমত পোষণ করলেন। হঠাৎ জয়দেব উত্তমকুমারকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বসল, দেখাদেখি আমিও। উনিও একটু ইতস্তত করে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনারা দিলীপবাবুর সঙ্গে গিয়ে দেখা করুন।
গেলাম দিলীপবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন অ্যাসিস্ট্যান্টদের সঙ্গে শট ডিভিশন নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমাদের আবেদন শুনে রীতিমতো বিরক্ত হলেন। উত্তমকুমারের কথা বলাতে একটু নরম হয়ে বললেন, এই মাসের শেষের দিকে আসুন, দেখছি কী করা যায়। ওঁর ভাবভঙ্গি দেখে আমরা দুজনেই বুঝতে পারলাম, শ্যুটিং দেখার কোনও আশাই নেই। মন খারাপ করে স্টুডিওর মধ্যেই ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছি। ক্যান্টিনে গিয়ে চাও খেয়ে এলাম। দারোয়ানজিও ওখানে চা খাচ্ছিল, আমাদের দিকে আর ফিরেও তাকাল না। জয়দেবকে বললাম, গুরুদর্শন তো হয়ে গেছে, এবার ফিরে চল। জয়দেব বলল, একবার যখন স্টুডিওতে ঢুকেছি, যেভাবেই পারি গুরুর শ্যুটিং দেখব। আমরা দুজন বেদিতেই বসে আছি। হঠাৎ দেখি নায়িকা মিঠু মুখোপাধ্যায় ফ্লোর থেকে বেরিয়ে মেকআপ রুমের দিকে যাচ্ছেন। আমরা এক দৌড়ে তাঁর কাছে হাজির হয়ে যথারীতি অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিলাম। অটোগ্রাফ নেওয়ার ফাঁকে প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে আমাদের ইচ্ছে নিবেদন করলাম এবং যা যা ঘটেছে সবকিছুই বিস্তারিতভাবে বললাম। সব শুনে উনি সেই বিখ্যাত আদুরে গলায় বললেন, দাদার যখন কোনও আপত্তি নেই, তখন একটা ব্যবস্থা আমি করছি। এখন তো লাঞ্চ ব্রেক। ঘণ্টাখানেক বাদে আমি যখন ফ্লোরে ঢুকব, আমার সঙ্গে সঙ্গে আপনারাও ঢুকে যাবেন। তবে দিলীপবাবুর কাছাকাছি কিন্তু ভুলেও যাবেন না। আমরা তো একথা শুনে একেবারে আহ্লাদে গদো-গদো। আনন্দে জয়দেব একটা সিগারেট ধরিয়ে রিং ছেড়ে বলল, আর কোনও চিন্তা নেই। উত্তমকুমারের শ্যুটিং দেখব, তারপর গুরুর সঙ্গে আরেকবার দেখা করে বাড়ি ফিরব। প্রায় দুপুর দুটো বাজে। আমি বললাম, জয়দেব, চল কিছু খেয়ে আসি ক্যান্টিন থেকে। জয়দেব বলল, কক্ষনো না। যদি মিঠুদি এই ফাঁকে ফ্লোরে ঢুকে পড়ে!
অপেক্ষা করতে করতে ঘণ্টাদেড়েক কেটে গেছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি নেমেছে। আমরা একটা টিনের চালার নীচে গিয়ে দাঁড়ালাম, যেখান থেকে শুটিং ফ্লোরের এন্ট্রান্সটা পরিষ্কার দেখা যায়। আরও ঘণ্টাখানেক কাটল। বিকেল চারটে বেজে গেল। মিঠুদির দেখা নাই রে! পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে দুজনেরই। ভাবছি ফিরেই যাই। হঠাৎ দেখি মিঠু মুখোপাধ্যায় সপার্ষদ এগিয়ে আসছেন ফ্লোরের দিকে। প্রোডাকশন বয় বিশাল এক ছাতা ধরে আছেন তাঁর মাথায়। প্রায় যখন তিনি ঢুকে পড়েছেন ফ্লোরে, শেষ মুহূর্তে জয়দেব চিৎকার করে উঠল, মিঠুদি এই যে আমরা এখানে। উনি থমকে দাঁড়ালেন। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখলেন, তারপরে হাতের ইশারায় বললেন চলে আসতে। ওঁর সঙ্গে আমরাও ঢুকে পড়লাম স্টুডিও ফ্লোরে। সিনেমার নাম ছিল ‘হোটেল স্নো ফক্স’। আলোয় ঝলমল করছে পুরো ফ্লোর। মহানায়ক মেকাপের ফাইনাল টাচ নিচ্ছেন। চুল আঁচড়ানোই ছিল, তবু দু’চারবার চিরুনি বুলিয়ে নিলেন। বিশাল এক আয়না ধরা রয়েছে তাঁর মুখের সামনে। নায়িকা মিঠুর সঙ্গে একটু রসিকতা করলেন। স্টার্ট ক্যামেরা, অ্যাকশন বলতেই অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। মিঠুকে ‘আমি তাহলে যাই’ কথাটি বলে ব্যাক টু ক্যামেরা হয়ে দরজা দিয়ে অন্য ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি আর জয়দেব দিলীপবাবুর আড়ালে ফ্লোরের এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছি। মিনিট দশেকের মধ্যেই শট শেষ হল। দিলীপবাবু পরের শট নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জয়দেব গিয়ে উত্তমকুমারের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে বলল, স্যার আমরা ঢুকে পড়েছি, শ্যুটিংও দেখছি। উনি বললেন, বেশ বেশ যতক্ষণ খুশি দেখুন, কিন্তু দিলীপবাবুর ধারেকাছে যাবেন না। আপনারা চা খাবেন? আমরা না বলার আগেই উনি প্রোডাকশনের একজনকে ডেকে বলে দিলেন, এদের চা দাও। স্পেশাল কাপে চা এল। উত্তমকুমারের গেস্ট বলে কথা! গুরু আমাদের চা খাওয়াচ্ছেন, এ কথা ভাবতেই খিদে তৃষ্ণা সব উধাও হয়ে গেল। চা খেয়ে আরও আধঘণ্টা শ্যুটিং দেখে গুরুকে আর একবার প্রণাম করে আর মিঠুদিকে অনেকবার থ্যাঙ্কস জানিয়ে আমরা যখন ফ্লোর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম, তখন মনে হল, আমরা নিজেরাই যেন একেকজন উত্তমকুমার। গ্ল্যামার আর ক্যারিশমা যেন আমাদের শরীর থেকেও একটু একটু করে ঝরে পড়ছে।
ছবি লেখক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
গেলাম দিলীপবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন অ্যাসিস্ট্যান্টদের সঙ্গে শট ডিভিশন নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমাদের আবেদন শুনে রীতিমতো বিরক্ত হলেন। উত্তমকুমারের কথা বলাতে একটু নরম হয়ে বললেন, এই মাসের শেষের দিকে আসুন, দেখছি কী করা যায়। ওঁর ভাবভঙ্গি দেখে আমরা দুজনেই বুঝতে পারলাম, শ্যুটিং দেখার কোনও আশাই নেই। মন খারাপ করে স্টুডিওর মধ্যেই ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছি। ক্যান্টিনে গিয়ে চাও খেয়ে এলাম। দারোয়ানজিও ওখানে চা খাচ্ছিল, আমাদের দিকে আর ফিরেও তাকাল না। জয়দেবকে বললাম, গুরুদর্শন তো হয়ে গেছে, এবার ফিরে চল। জয়দেব বলল, একবার যখন স্টুডিওতে ঢুকেছি, যেভাবেই পারি গুরুর শ্যুটিং দেখব। আমরা দুজন বেদিতেই বসে আছি। হঠাৎ দেখি নায়িকা মিঠু মুখোপাধ্যায় ফ্লোর থেকে বেরিয়ে মেকআপ রুমের দিকে যাচ্ছেন। আমরা এক দৌড়ে তাঁর কাছে হাজির হয়ে যথারীতি অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিলাম। অটোগ্রাফ নেওয়ার ফাঁকে প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে আমাদের ইচ্ছে নিবেদন করলাম এবং যা যা ঘটেছে সবকিছুই বিস্তারিতভাবে বললাম। সব শুনে উনি সেই বিখ্যাত আদুরে গলায় বললেন, দাদার যখন কোনও আপত্তি নেই, তখন একটা ব্যবস্থা আমি করছি। এখন তো লাঞ্চ ব্রেক। ঘণ্টাখানেক বাদে আমি যখন ফ্লোরে ঢুকব, আমার সঙ্গে সঙ্গে আপনারাও ঢুকে যাবেন। তবে দিলীপবাবুর কাছাকাছি কিন্তু ভুলেও যাবেন না। আমরা তো একথা শুনে একেবারে আহ্লাদে গদো-গদো। আনন্দে জয়দেব একটা সিগারেট ধরিয়ে রিং ছেড়ে বলল, আর কোনও চিন্তা নেই। উত্তমকুমারের শ্যুটিং দেখব, তারপর গুরুর সঙ্গে আরেকবার দেখা করে বাড়ি ফিরব। প্রায় দুপুর দুটো বাজে। আমি বললাম, জয়দেব, চল কিছু খেয়ে আসি ক্যান্টিন থেকে। জয়দেব বলল, কক্ষনো না। যদি মিঠুদি এই ফাঁকে ফ্লোরে ঢুকে পড়ে!
অপেক্ষা করতে করতে ঘণ্টাদেড়েক কেটে গেছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি নেমেছে। আমরা একটা টিনের চালার নীচে গিয়ে দাঁড়ালাম, যেখান থেকে শুটিং ফ্লোরের এন্ট্রান্সটা পরিষ্কার দেখা যায়। আরও ঘণ্টাখানেক কাটল। বিকেল চারটে বেজে গেল। মিঠুদির দেখা নাই রে! পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে দুজনেরই। ভাবছি ফিরেই যাই। হঠাৎ দেখি মিঠু মুখোপাধ্যায় সপার্ষদ এগিয়ে আসছেন ফ্লোরের দিকে। প্রোডাকশন বয় বিশাল এক ছাতা ধরে আছেন তাঁর মাথায়। প্রায় যখন তিনি ঢুকে পড়েছেন ফ্লোরে, শেষ মুহূর্তে জয়দেব চিৎকার করে উঠল, মিঠুদি এই যে আমরা এখানে। উনি থমকে দাঁড়ালেন। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখলেন, তারপরে হাতের ইশারায় বললেন চলে আসতে। ওঁর সঙ্গে আমরাও ঢুকে পড়লাম স্টুডিও ফ্লোরে। সিনেমার নাম ছিল ‘হোটেল স্নো ফক্স’। আলোয় ঝলমল করছে পুরো ফ্লোর। মহানায়ক মেকাপের ফাইনাল টাচ নিচ্ছেন। চুল আঁচড়ানোই ছিল, তবু দু’চারবার চিরুনি বুলিয়ে নিলেন। বিশাল এক আয়না ধরা রয়েছে তাঁর মুখের সামনে। নায়িকা মিঠুর সঙ্গে একটু রসিকতা করলেন। স্টার্ট ক্যামেরা, অ্যাকশন বলতেই অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। মিঠুকে ‘আমি তাহলে যাই’ কথাটি বলে ব্যাক টু ক্যামেরা হয়ে দরজা দিয়ে অন্য ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি আর জয়দেব দিলীপবাবুর আড়ালে ফ্লোরের এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছি। মিনিট দশেকের মধ্যেই শট শেষ হল। দিলীপবাবু পরের শট নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জয়দেব গিয়ে উত্তমকুমারের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে বলল, স্যার আমরা ঢুকে পড়েছি, শ্যুটিংও দেখছি। উনি বললেন, বেশ বেশ যতক্ষণ খুশি দেখুন, কিন্তু দিলীপবাবুর ধারেকাছে যাবেন না। আপনারা চা খাবেন? আমরা না বলার আগেই উনি প্রোডাকশনের একজনকে ডেকে বলে দিলেন, এদের চা দাও। স্পেশাল কাপে চা এল। উত্তমকুমারের গেস্ট বলে কথা! গুরু আমাদের চা খাওয়াচ্ছেন, এ কথা ভাবতেই খিদে তৃষ্ণা সব উধাও হয়ে গেল। চা খেয়ে আরও আধঘণ্টা শ্যুটিং দেখে গুরুকে আর একবার প্রণাম করে আর মিঠুদিকে অনেকবার থ্যাঙ্কস জানিয়ে আমরা যখন ফ্লোর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম, তখন মনে হল, আমরা নিজেরাই যেন একেকজন উত্তমকুমার। গ্ল্যামার আর ক্যারিশমা যেন আমাদের শরীর থেকেও একটু একটু করে ঝরে পড়ছে।
ছবি লেখক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।