রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


আমার বাবা ও মা।

দাদু অর্থাৎ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বাবার ডেথ সার্টিফিকেটা আমিই লিখেছিলাম। ওঁর সেরকমই ইচ্ছে ছিল। দাদু পর্ব শেষ হওয়ার পরেও সঞ্জীবদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ রইল। উনি তখন দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে কর্মরত। প্রতি সপ্তাহে শনিবার আমি ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতাল থেকে বিকেলে সোজা এসে হাজির হতাম ধর্মতলায় আনন্দবাজারের তিনতলায় দেশ পত্রিকার দপ্তরে। সঞ্জীবদার সান্নিধ্য পাব বলেই যে এই ছুটে আসা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। দেশ পত্রিকার দপ্তরে তখন চাঁদের হাট। কয়েক ফুট দূরে সার সার বসে আছেন সুনীল গাঙ্গুলি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, কিশলয় ঠাকুর, হর্ষ দত্ত-সহ নানা জ্ঞানীগুণী মানুষ। বৈকালিক ঝালমুড়ি, চা, কখনও বা চানাচুর টুকটাক চলত প্রায়ই। আমি বসে থাকতাম হংস মধ্যে বক তথা। আমিও ভাগ পেতাম। সঞ্জীবদার বাবার ডাক্তার বলে কথা! সাহিত্য জগতের উত্তমকুমার সমরেশ বসুকে আমি এই দপ্তরেই প্রথম দেখি। চা খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে গেলেন সঞ্জীবদার সঙ্গে আমারই পাশে বসে। প্রতি শনিবার বিকেল পাঁচটার মধ্যেই আমি দেশ দপ্তরে পৌঁছে যেতাম। সঞ্জীবদা পৌনে ছটা নাগাদ নীচে নেমে অফিসের গাড়িতে উঠতেন। সঙ্গে আমি, আরও দুই-একজন স্টাফ, যাঁদের সঞ্জীবদা নিজেই ডেকে গাড়িতে তুলে নিতেন। বরানগর কুঠিঘাটে সঞ্জীবদাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে প্রায় দিনই আমাকে বেলঘরিয়ায় আমার বাড়িতে পৌঁছে দিত গাড়ি।

ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতাল থেকে আমায় বিদায় নিতে হল ১৯৮৭-র ৩১ মার্চ। প্রতিবছর আমাদের চাকরির রিনিউয়াল হত পয়লা এপ্রিল। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেবার আর হল না। আমরা এপ্রিলফুল হলাম। শুধু আমি নই, আমার সঙ্গে আরও দুজন ডাক্তার। এতদিন পর এই ব্যাপারে আর কারও দিকে অভিযোগের আঙুল তুলতে চাই না। কিন্তু জব্বর ধাক্কা খেয়েছিলাম সেদিন আচমকা চাকরি চলে যাওয়াতে। তখন লুকিয়ে-চুরিয়ে দু’একদিন প্র্যাকটিস করতাম বাড়িতেই। তাছাড়া ছয় সপ্তাহ বাদেই ছিল আমার বিয়ে। একেবারে বেকার হয়ে গেলাম। কর্মস্থল থেকে কিছু টাকা লোন নেব ভেবেছিলাম, সে আশাও শেষ। অবশ্য বেকার ডাক্তারেরও যে বিয়ের বাজারে দাম আছে, সেটা নিজেকে দিয়েই বুঝেছিলাম। আমার জীবন রসিক বাবা সব শুনে বললেন, ডাক্তার কখনও বেকার থাকে শুনেছিস! তুই আজ বেকার, কয়দিন পরেই তো রোজগার করবি। বিয়ে ওই দিনই হবে। আমি টাকা দেব, পরে আমাকে শোধ করে দিস। ছুটলাম আমার গুরু সঞ্জীবদার কাছে। সব শুনে তিনিও একই মত দিলেন। শুধু তাই নয়, আমাকে সান্ত্বনাও দিলেন, ভেঙে পড়তে না করলেন এবং আউটডোর অ্যাটাচমেন্টের জন্য আড়িয়াদহ রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যারাকপুরে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনের মহারাজের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন। দু’জায়গাতেই সঞ্জীবদার নাম বলাতে আমার কাজ জুটেছিল। তবে উপার্জন ছিল খুবই কম। যাতায়াত ভাড়াটুকুই যা উঠত। তবে এই অ্যাটাচমেন্ট আমাকে মানসিক জোর দিয়েছিল। বাড়িতে প্র্যাকটিস শুরু করলাম বিয়ের পরেই। বাবার টাকায় শুধু যে বিয়ে করলাম তাই নয়, হানিমুনেও গেলাম জীবনে প্রথমবার প্লেনে চেপে কাঠমান্ডুতে। পরে রোজগার করে বাবার এই ধার আমি শোধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু জীবনের ধার! সে তো রয়েই গেল তার কাছে আমার আজীবন। বড্ড পরিশ্রম করতেন আমার বাবা। প্রায় ১৫ জনের জয়েন্ট ফ্যামিলি। বেলঘরিয়া থেকে প্রায়দিনই চার কিলোমিটার হেঁটে বিরাটি স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে বনগাঁ যেতেন, তারপর সেখান থেকে ভ্যানরিকশায় বেনাপোল-পেট্রাপোল বর্ডার। কাস্টমে খুব সাধারণ একটি কাজ করতেন বাবা। ছোটবেলায় খুব সকালে বাবা যখন বেরিয়ে যেতেন, তখন আমরা ঘুমিয়ে থাকতাম। আবার রাতে যখন ফিরতেন তখনও আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। বাবার সঙ্গে সেই অর্থে দেখা হত শুধু রবিবার। ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল হয়ে আসা একটি বিশাল পরিবারকে বাবা দাঁড় করিয়েছিলেন শুধু উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। পরবর্তীকালে আমার দুই কাকাও কিছুটা হাল ধরেছিলেন। আমার তিন পিসতুতো দাদা, দিদি, এক মাসি আমাদের বাড়িতেই মানুষ হয়েছেন। খুব সচ্ছলতা না থাকলেও খুব আনন্দেই সবার সঙ্গে মিলেমিশে বেড়ে উঠেছিলাম আমরা। মূল্যবোধের শিক্ষা ছোটবেলাতেই পেয়েছিলাম এই পরিবার থেকেই আর পরিশ্রম করার প্রেরণা পেয়েছিলাম আমার পরলোকগত বাবার থেকে। পরিবারের গল্প আবার পরে করব। ফিরে আসি সঞ্জীবদার কথায়।

একটা কথা বলা হয়নি। আমার বিয়ের কার্ড নিজের হাতে স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিয়েছিলেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, অফসেটে যা ছাপা হয়েছিল। আমার কাছে এ এক বিরাট পাওনা। আমার বউভাতে উনি বউদিকে নিয়ে এসেছিলেন, অনেকটা সময় কাটিয়েও গিয়েছিলেন। প্রথম লেখাটা ক্যাজুয়ালি লিখেছিলাম সঞ্জীবদার উৎসাহে এবং গাইডেন্সে। তারপর কয়েক মাস কেটে গেছে। আমি কেরিয়ার তৈরির জন্য সাইকেল নিয়ে এই চেম্বার ওই চেম্বার দৌড়চ্ছি, পাশাপাশি চুটিয়ে নাটকও করছি। লেখার ইচ্ছে মাথা থেকে নেমে গেছে। হঠাৎ একদিন রাতের দিকে সঞ্জীবদার বাড়ি থেকে ফোন। ওঁর একমাত্র ছেলে অপূর্ব বললেন, কাকা, আপনার সঙ্গে বাবা কথা বলবেন। সঞ্জীবদা কুশল বিনিময়ের পর আমাকে বললেন, এবার দেশ পত্রিকার জন্য আপনাকে প্রচ্ছদকাহিনি লিখতে হবে। বিষয় হল, ডাক্তারিতে পিছিয়ে পড়ছে বাঙালি। আমি শুনে বললাম, সেকি! আমি কী করে পারব! এ তো বিরাট বিশাল ব্যাপার! উনি বললেন, অবশ্যই পারবেন। কাল একবার দেশ পত্রিকার অফিসে আসুন, আমি আপনাকে গাইডলাইন বলে দেব। ওঁর সঙ্গে কথা বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম লেখার কাজে। সরকারি-বেসরকারি বহু হাসপাতালের আউটডোর-ইনডোরে ঢুঁ মারলাম, এমনকী একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে ডাঃ দেবী শেঠির ইন্টারভিউও করে ফেললাম। তিন সপ্তাহের প্রস্তুতিপর্ব সেরে জমা দিলাম লেখা, কিছুদিন বাদেই আনন্দবাজারে প্রকাশিত হল বিজ্ঞাপন। প্রচ্ছদ কাহিনির একমাত্র লেখক আমি, জ্বলজ্বল করছে আমার নাম। দেখে কেমন ঘোর লেগে গেল। প্রকাশিত হল দেশ পত্রিকা। লেখক হিসাবে জাতে উঠলাম আমি। লেখার সঙ্গে এই প্রথম ভালোবাসা তৈরি হল আমার। সঞ্জীবদা আমার প্রশংসা করে বললেন, আপনার হাতে সরস্বতী অধিষ্ঠান করছেন, তাকে সরিয়ে দেবেন না, লেখাটা চালিয়ে যান। আনন্দবাজারের অন্য বিভাগগুলোতে যোগাযোগ শুরু করলাম। সানন্দা, আনন্দমেলা, আনন্দলোক এবং সেই সময়ে প্রকাশিত প্রবাসী আনন্দবাজার দপ্তরে। সব জায়গাতেই টুকটাক লেখালেখির সুযোগ পেলাম। তবে সব থেকে বেশি লিখেছি সানন্দায়। দশ বছরে প্রায় ২৫টি প্রচ্ছদকাহিনি। যেগুলো নিয়ে একাধিক বই বেরিয়েছে দে’জ পাবলিশিং থেকে। সপ্তাহে তখন অন্তত দু’দিন আনন্দবাজারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে বেড়াতাম লেখক হবার তাগিদে। বেশকিছু গুণী মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও হল। প্রবাসী আনন্দবাজারের সুজন চন্দ, সুকুমার মুখোপাধ্যায়। তবে বিশেষ করে বলব সাহিত্যিক দুলেন্দ্র ভৌমিকের কথা। উনি তখন সিনেমা পত্রিকা আনন্দলোকের সম্পাদক। এক রবিবার পৌঁছে গেলাম খড়দহ রহড়া অঞ্চলে ওঁর বাড়িতে। সব শুনে বললেন, সিনেমা পত্রিকায় তুমি কী লিখবে, ওখানে তো ডাক্তারি চলবে না। আমি বললাম, ডাক্তারি বিষয় নিয়েই একটু যদি অন্যরকম লেখা লিখি। দুলেন্দ্রদার সঙ্গে আলোচনা করে আমি বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছিলাম আনন্দলোক পত্রিকায়। যেগুলোর শিরোনাম ছিল, সিনেমার মৃত্যুদৃশ্য কেমন হওয়া উচিত, সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীতের প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ ও তরুণ মজুমদার, সিনেমার ডাক্তার বনাম বাস্তবের ডাক্তার ইত্যাদি। এই লেখাটি আনন্দলোক পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। আনন্দবাজার হাউসে এই এক বারই আমি পুজো সংখ্যায় লেখার দুর্লভ সুযোগ ও সম্মান পেয়েছিলাম। এই লেখাগুলো লিখতে গিয়ে আমি বেশ কিছু গুণী মানুষের স্নেহধন্য হবার সুযোগ পেয়েছিলাম। মহান চিত্রপরিচালক তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, মৃণাল সেন, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়-সহ অনেকেরই ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম, তাঁদের বাড়িতেও গিয়েছিলাম, একাধিকবার ফোনে কথাও হয়েছে। এঁদের মধ্যে তরুণবাবু এখনও আমাদের মধ্যে আছেন, তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগও রয়েছে। সে গল্প পরে শোনাব। আনন্দলোকে লেখালেখির জন্য একবার সত্যজিৎ রায়ের ব্যক্তিগত ফোন নাম্বারে ফোন করে বসেছিলাম। উনি আমার পরিচয় পেয়ে মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনাকে এই ফোন নম্বরটি কে দিয়েছে? আমি কম্পিত কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলাম, আপনার ইউনিটের রঞ্জিত সেনগুপ্ত, যিনি ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে আমার আন্ডারে ভর্তি ছিলেন। আপনি দেখতে গিয়েছিলেন। আপনাকে আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলাম।

লেখার নেশা সঞ্জীবদা তো আমাকে ধরিয়ে দিলেন। কিন্তু উনি ওই দু’বারের পর আর কখনওই আমাকে দেশ পত্রিকায় লেখার আর আমন্ত্রণ জানাননি, আমিও অনুরোধ করিনি। আনন্দবাজার হাউস ছাড়াও আমি তখন আজকাল, বর্তমান ওভারল্যান্ড, বঙ্গলোক, জনগণ জনমত, গণশক্তি, এককথায় সেই সময় এই বঙ্গে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রায় সব দৈনিক পত্রিকাতেই লিখে বেড়াচ্ছি। লেখার বিষয়ে সঞ্জীবদার মতামত নিচ্ছি, ওঁকে সুযোগ পেলে দু-একটি লেখা পড়েও শোনাচ্ছি। সঞ্জীবদাকে নিয়ে আরও অনেক কথাই বলার আছে। অবশ্যই বলব পরের কিস্তিতে।

Skip to content