শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


প্রিয় স্যারের সঙ্গে লেখক।

আমি কি বহুমুখী! মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি নিজেকেই। বহুমুখী শব্দটির মধ্যে একটু ঔদ্ধত্য আছে, একটা জাহির করা ব্যাপার আছে। আসলে পেশাগত ‘এক’টা পরিচয় আমার থাকলেও, আমার তো গমন, ভালোলাগা, ভালোবাসা ‘বহু’তে। অভিনয় করি সেই সাত-আট বছর বয়স থেকেই, এখনও যা বর্তমান। লেখালেখিটাও স্কুল বয়স থেকেই। বই পড়ার নেশা? সেটাও ছোট্ট বয়স থেকেই। গান ভালোবাসি মায়ের গলায় ছোটবেলা থেকেই শুনে শুনে। পেশাগত তালিম নেই, তবে অভিনয়ের প্রয়োজনে কাজ চালাবার মতো গাইতেও পারি। ছোটবেলায় খেলাধুলা করতাম, দেশ-বিদেশের স্টাম্প জমাতাম। বই বাঁধানোও শিখেছিলাম।
আসলে অনেক কিছু নিয়েই তো আমার জীবন, শুধু আমার কেন, সবারই। যৌথ পরিবারে বড় হয়ে ছিলাম বলে মূল্যবোধের পোকাটা আজও মাথায় কিলবিল করে। সব ছেড়ে শেষ পর্যন্ত তিনটি বিষয়ে এসে এখন আটকেছি। ডাক্তারি, অভিনয় আর লেখালেখি। দীর্ঘদিন ধরে এই তিনটে জগৎকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। বহু গুণী মানুষের স্পর্শে ধন্য হয়ে অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছি। নানা সাধারণ-অসাধারণ ঘটনায় এবং ঘাত-প্রতিঘাতে জীবনের ঝুলি একটু একটু করে ভরে উঠেছে।
সেই সব এলোমেলো কিছু কথা আপনাদের শোনাব এই ধারাবাহিকে। যদিও কোনও ঘটনার ধারাবাহিকতা থাকবে না এই লেখায়। শুধু আমার অভিজ্ঞতা, ভালোলাগা-ভালোবাসা ভাগ করে নেব পাঠকদের সঙ্গে। পেশা এবং ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে যখন ডাক্তারি রয়েছে সবার আগে, তখন ডাক্তারি জীবনের নানা কথা দিয়েই শুরু করি এই ধারাবাহিক।

আর জি কর মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলাম সেই সত্তর দশকের ৭৪ থেকে। ডাক্তারি পাশ করে ইন্টার্নশিপ-হাউসস্টাফশিপ কমপ্লিট করে যখন হাসপাতাল ছাড়লাম সেই ১৯৮৩-তে, তখন পেরিয়ে গেছে দশটি বছর। মেডিসিনে মাস্টারমশাই হিসেবে পেয়েছিলাম প্রখ্যাত ডাক্তার ব্যোমকেশ ভট্টাচার্যকে। তার অনেক কথার মধ্যে একটি কথা আজও মাথায় গেঁথে আছে, ডাক্তারিটা ঠিকঠাক করতে গেলে রোগীর সাইকোলজি বোঝাটা খুব জরুরি। সেই বয়সে মনে হয়েছিল, এ আবার কী! রোগীর অসুবিধা জেনে বুকে স্টেথো বসিয়ে, পেট টিপে, প্রয়োজন হলে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই তো চিকিৎসা করতে হয়। এখানে আবার সাইকোলজির কী ব্যাপার আছে! সব রোগীই মানসিক নাকি, যে সাইকোলজি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে! বয়স যতই এগিয়েছে, ডাক্তার হিসেবে যতই পরিপক্ব হয়েছি, বুঝেছি স্যারের কথা ১০০ ভাগ সত্যি। ডাক্তারিতে ঢোকার আগে থেকেই বিধান রায়ের গল্প শুনতাম, আপনারাও শুনেছেন। তিনি রোগীকে না ছুঁয়ে শুধুমাত্র দূর থেকে দেখেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগের নিদান দিতে পারতেন। আসলে ডাক্তারিতে অবজারভেশন বা পর্যবেক্ষণ একটা বিরাট ব্যাপার। যেভাবে একজন টিকিট চেকার সহজেই বিনা টিকিটের যাত্রীদের শনাক্ত করতে পারেন, তেমনি একজন ডাক্তারও অনেক রোগীকে শুধুমাত্র দেখে, তার কথা শুনে, তার সাইকোলজি স্টাডি করে রোগের সুলুক-সন্ধান অনেকটাই করে ফেলতে পারেন।

আমার আরেক মাস্টারমশাই প্রয়াত ডাক্তার এস পি ঘোষ-এর কথা হঠাৎ মনে পড়ল। তখন আমি ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের ইএনটি রেজিস্টার। আউটডোরে স্যারের সঙ্গে ইএনটি পেশেন্ট দেখছি। একটি পেশেন্ট বাঁদিকের কান হাত দিয়ে চেপে আউটডোরে আমাদের ঘরে ঢুকলেন। স্যার তাকে বসতে বললেন। জিজ্ঞেস করলেন তার কষ্ট। সে জড়িয়ে জড়িয়ে কিছু কথা বলল। স্যার রোগী না ছুঁয়ে, শুধুমাত্র তার কথা শুনে বলে দিলেন, ক্যানসারের ক্ষত জিভের বাম দিকে রয়েছে এবং তার থেকে তীব্র ব্যথা পৌঁছে গেছে কানে এবং রোগটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে। স্যারকে বললাম, সবই বুঝলাম, কিন্তু রোগটা বাঁদিকে আপনি বুঝলেন কী করে! স্যার বললেন, দেখো, যন্ত্রণায় লোকটি বাম কান চেপে ধরে আমাদের সামনে বসে আছে। কাজেই অসুখটা বাম দিকে। আর ওর জড়ানো কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে অসুখটা জিভের কোন জায়গায়। বাড়াবাড়ি কেন? যেহেতু ইতিমধ্যে অসুখ কানের দিকে পৌঁছেছে। দেখবে হয়তো গলায় গ্ল্যান্ড হয়ে গেছে। সেদিন স্যারের অবজারভেশন দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন এই রকম অনেক রোগ নির্ণয় রোগীকে না ছুঁয়ে আমিও করতে পারি। সবটাই অভিজ্ঞতা এবং অবশ্যই পর্যবেক্ষণ।

আমার ডাক্তারি জীবনের অনেকটাই জুড়ে আছেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডাক্তার শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি যখন আর জি কর-এর ছাত্র তখন ফাইনাল ইয়ারে মানে পঞ্চম বর্ষে কান-নাক-গলা বিষয়টি পড়তে হত। আমাদের ক্লাস করাতেন সুদর্শন গৌরবর্ণের দীর্ঘদেহী শান্তনুস্যার। এমন সুন্দরভাবে গল্পচ্ছলে পড়াতেন যে ওঁর পড়ানোর গুণেই আমাদের সব মুখস্থ হয়ে যেত। ডাক্তারি পাশ করার পর বিভিন্ন বিভাগে ঘুরে ঘুরে ইন্টার্নশিপ করতে হত। তারপর বিশেষ কোনও বিষয়ে হাউসস্টাফশিপ করতে হত। স্যারের সংস্পর্শে আসার পর আমি কান-নাক-গলা অর্থাৎ ইএনটি-র দিকেই ঝুঁকে পড়লাম। হাউসস্টাফ হলাম ইএনটি বিভাগের। মূল আকর্ষণ অবশ্যই স্যারের সান্নিধ্য পাওয়া। আমার ডাক্তারি জীবনের শুরুটা, বলা ভালো ভিতটা স্যার শুধু গড়ে দেননি, আমার সাংস্কৃতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিচরণভূমিতেও জলসিঞ্চন করেছিলেন আমার সেই ২৩ বছর বয়সেই। স্যারকে আমার ভীষণ কালারফুল লাগত। যেমন মিশুকে, হাসিখুশি। ছাত্রদের সহজেই কাছে টেনে নিতে পারতেন। নানা গল্প করতেন।

বহু ভিআইপি রোগী ছিল স্যারের। উনি উত্তমকুমারকে দেখতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন শুনে আমরা তো রীতিমতো এক্সাইটেড। তখন তপন সিংহের ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমা রিলিজ করেছে। সেই সিনেমার প্রধান চরিত্রাভিনেতা মনোজ মিত্র একদিন আর জি কর আউটডোর এলেন স্যারকে দেখাতে। তারপর অনেকক্ষণ আড্ডা দিলেন। স্যার আমাকেও সেই আড্ডায় ডেকে নিয়েছিলেন। স্যারের মাধ্যমেই মনোজবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয়, গত ৪০ বছর পার হয়ে যা আজও অটুট আছে। সেই সময় স্যার রেডিওতে এবং দূরদর্শনে চিকিৎসা বিষয়ক অনেক প্রোগ্রাম করতেন। আমাকেও করার জন্য উৎসাহিত করতেন। সেসময় নাটক ছাড়া আমার আর কিছুই ভালো লাগত না। আমার জীবনের প্রথম নাটক ‘বড়বাবুর বাঘ শিকার’, অপারেশন থিয়েটারে স্যারের মুখে শোনা একটি গল্প অবলম্বনে। স্যারের বয়স এখন ৮৪। এখনও রোগী দেখেন উডল্যান্ডস নার্সিং হোমে। মাঝেমধ্যে অপারেশনও করেন। এই তো গত মাসে তপন থিয়েটারে আমার দলের নাটক দেখতে এসেছিলেন। ভালো থাকুন স্যার, সুস্থ থাকুন। আপনার ছাত্র আপনার উদ্দেশে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানায়।

 


Skip to content