চলতি নাটক 'কৈলাসে চা পান'এ আমি ব্রহ্মার ভূমিকায়।
যে রাধে সে চুল বাঁধে। একটি প্রচলিত প্রবাদ। কিন্তু যে ডাক্তারি করে সে একই সঙ্গে অভিনয় করে, এটা শোনা গেলেও, একটি নাটকের দল পরিচালনা করে, এমনটি বোধহয় খুব একটা শোনা যায় না। তার সঙ্গে নিয়মিত লেখালেখি এবং বই প্রকাশনার ব্যাপার তো আছেই। আমি জানি, এটা একটু নিজের ঢাক নিজে পেটানো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি করব বলুন! ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি অভিনয় করি বলে তো অনেক কথা শুনতেই হয়। সবাই বাঁকা কথা বলেন, তা কখনওই নয়। কিন্তু আমি নাটকের দল চালাই শুনে অনেকেই চোখ কপালে তোলেন। এবং ধরেই নেন ডাক্তারিটা আমার গোল্লায় গিয়েছে। আমার এক শুভানুধ্যায়ী গিরিশ মঞ্চে আমার চলতি নাটক ‘কৈলাসে চা পান’ দেখার পরে খুব আমোদিত হয়ে বলেছিলেন, ‘বয়স হয়েছে, ডাক্তারিটাও ছেড়ে দিয়েছো, সময় কাটবে কি করে? তুমি বরং এই নাটক-যাত্রা নিয়েই থাকো, শরীর এবং মন দুটোই ভালো থাকবে। একটা কাজে এনগেজ থাকা অবসর জীবনে সব সময় ভালো।’ শুনে তো আমার চোখ কপালে! বাড়ির চেম্বারে চুটিয়ে প্র্যাকটিস করছি। এখনও তিন- তিনটি হাসপাতালের সঙ্গে ভিজিটিং সার্জেন হিসেবে যুক্ত আছি, ডাক্তারিটা ছাড়লাম কখন! অবসর জীবনটাই বা এলো কীভাবে! তবে এই যে অনেকে আমাকে নিয়ে এত কিছু ভাবেন, তার একটাই কারণ, অভিনয়টা নিয়ে, বিশেষ করে নাটক নিয়ে আমার পাগলামি। রেডিও, ছোট পর্দা, বড় পর্দা, শ্রুতি নাটক-সহ নানা মাধ্যমে অভিনয় করলেও, মঞ্চে নাট্যাভিনয় আমাকে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি এনে দেয়।
কেনারাম বেচারাম নাটকে প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক সরোজ গুপ্তর সঙ্গে।
শুধু অভিনয় করব কোনও গ্রুপ থিয়েটারে, এমনটাই কিন্তু ভেবেছিলাম সেই ছাত্রাবস্থা থেকেই। অথচ পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে নাট্য পরিচালক হতে এবং পরবর্তীকালে প্রধান নাট্য সংগঠক হয়ে দল পরিচালনা করতে। ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে এবং বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি।
লেখালেখির অভ্যাসটা সেই ছাত্রাবস্থা থেকে। আর অভিনয়ের সঙ্গে যোগাযোগ তো সেই বাল্যকাল থেকেই। ডাক্তারি পড়ার সময় ট্যালেন্ট নামে একটি গ্রুপ থিয়েটারে বছর দু’য়েক অভিনয় করি। ডাক্তারি পাশ করার পরে ১৯৮২-তে প্রথম নাটক লিখি, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডাঃ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে শোনা একটি গল্প অবলম্বনে, ‘বড়বাবুর বাঘ শিকার’। পরবর্তীকালে দে’জ পাবলিশিং থেকে যেটি প্রকাশিত হয়। লেখার পরেই আমার মনে হয়েছিল এটি মঞ্চস্থ করা দরকার। দর্শকের জন্যই তো নাটক। তারা দেখে কি বলে, সেটা জানলে, পরবর্তীকালে নাটক লিখতে সুবিধা হবে। নতুন নাট্যকারের নাটক কোন দলই বা করবে! আর তখন আমার নাট্য জগতে তেমন কোনও পরিচিতিও ছিল না। সেজন্য আমার মনে হল, নিজেই যদি একটি দল তৈরি করতে পারি, তাহলে তো এই নাটকটি মঞ্চস্থ করা যেতে পারে। ছোটবেলায় পাড়ার ক্লাব ভ্রাতৃসংঘ থেকে আমরা প্রতিবছর একটি করে নাটক করতাম। আমার সেই ছোটবেলার নাট্য বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। অনেকেই উৎসাহ দেখালো, তৈরি করলাম নাট্যদল ‘থিয়েটার কোরাম’। আমার বাড়িতেই রিহার্সাল শুরু হল।
লেখালেখির অভ্যাসটা সেই ছাত্রাবস্থা থেকে। আর অভিনয়ের সঙ্গে যোগাযোগ তো সেই বাল্যকাল থেকেই। ডাক্তারি পড়ার সময় ট্যালেন্ট নামে একটি গ্রুপ থিয়েটারে বছর দু’য়েক অভিনয় করি। ডাক্তারি পাশ করার পরে ১৯৮২-তে প্রথম নাটক লিখি, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডাঃ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে শোনা একটি গল্প অবলম্বনে, ‘বড়বাবুর বাঘ শিকার’। পরবর্তীকালে দে’জ পাবলিশিং থেকে যেটি প্রকাশিত হয়। লেখার পরেই আমার মনে হয়েছিল এটি মঞ্চস্থ করা দরকার। দর্শকের জন্যই তো নাটক। তারা দেখে কি বলে, সেটা জানলে, পরবর্তীকালে নাটক লিখতে সুবিধা হবে। নতুন নাট্যকারের নাটক কোন দলই বা করবে! আর তখন আমার নাট্য জগতে তেমন কোনও পরিচিতিও ছিল না। সেজন্য আমার মনে হল, নিজেই যদি একটি দল তৈরি করতে পারি, তাহলে তো এই নাটকটি মঞ্চস্থ করা যেতে পারে। ছোটবেলায় পাড়ার ক্লাব ভ্রাতৃসংঘ থেকে আমরা প্রতিবছর একটি করে নাটক করতাম। আমার সেই ছোটবেলার নাট্য বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। অনেকেই উৎসাহ দেখালো, তৈরি করলাম নাট্যদল ‘থিয়েটার কোরাম’। আমার বাড়িতেই রিহার্সাল শুরু হল।
পরশমণি নাটকের একটি দৃশ্য।
তবে প্রথম নাটক কিন্তু ‘বড়বাবুর বাঘ শিকার’ ছিল না। প্রথমে আমি আর জি করে থেকে মঞ্চস্থ হওয়া বিদ্যুৎ নাগের ‘হ্যামলেটও হিটলার’ এবং ‘রাজা নিরুদ্দেশ’ নিয়ে কাজ শুরু করি। তারপর করি পূর্ণেন্দু হালদারের নাটক ‘চিনু বনাম ভিয়েতনামু’। চতুর্থ প্রযোজনা ছিল ‘বড়বাবুর বাঘ শিকার’। তখন আমরা বিভিন্ন একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায় যোগ দিতাম। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলা মফসসলে হই হই করে বিভিন্ন নাট্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। নাটক করতে আমরা বর্ধমানে, কালনায়, মালদহে শিলিগুড়িতে, বনগাঁয়–কত জায়গায় না গিয়েছি। বহু জায়গায় রাতে থেকেছিও। দরজা-জানলার পোর্টেবল সেট তৈরি করেছিলাম, সেগুলো নিজেরাই বহন করতাম। আমি তখন ডাক্তারি পাশ করে সামান্য স্টাইপেন্ড পাই। অন্যেরা পূর্ণ বা অর্ধ বেকার। সেই অর্থে দলের মধ্যে একমাত্র রোজগেরে ছিলাম আমি। ট্রেনে কোনও সময়ই টিকিট কাটতাম না, দুই একবার ধরাও পড়েছি। গায়ে গতরে খেটে নাটক করতাম। দু-চার বার পুরস্কার পাওয়াতে সামান্য অর্থ প্রাপ্তিও ঘটেছিল। টেনেটুনে দল চললেও আমাদের উৎসাহ এবং আনন্দে কিন্তু কোনও ঘাটতি ছিল না। দল পরিচালনা এবং নাট্য পরিচালনার ট্রেনিং আমার এই থিয়েটার কোরামেই হয়ে যায়। এরপর আমি ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে জয়েন করি রেসিডেন্সিয়াল পোস্টে। সপ্তাহে মাত্র একদিন এসে একবেলা গ্রুপের রিহার্সাল করতাম। আমি সময় দিতে না পারাতে, এই নাটকের দল ভেঙে যায়।
থিয়েটার কোরাম পরিচালনা করার সময় আমার বারবার মনে হতো, নাটকের আমি কিছুই বুঝি না। অন্য নাট্য দলে যোগ্য গুরুর অধীনে কিছুদিন কাজ করা উচিত। এমন সময় যোগাযোগ হয় নাট্যকার-পরিচালক পূর্ণেন্দু হালদারের সঙ্গে। আসলে পূর্ণদা আমার সিনিয়র ডাক্তার প্রতাপ হালদারের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। প্রতাপদাই যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এই দলের প্রথম নাম ছিল ‘অগ্রগামী’, পরে রেজিস্ট্রেশনের সময় নাম বদলে হয় ‘নর্থ ক্যালকাটা থিয়েটার অ্যাকাডেমি’। এখান থেকে দুটো নাটক আমরা করি। ‘গণ্যমাণ্য’ এবং ‘চে গুয়েভারা’। শো করেছিলাম অধুনালুপ্ত বিজন থিয়েটার এবং বাসুদেব মঞ্চে। পূর্ণদার কাছে আমি শুধু অভিনয় নয়, প্রোডাকশনের অন্য কাজকর্মও শিখেছি।
হ্যামলেট ও হিটলার নাটকের একটি দৃশ্য।
তবে আমার এই শেখাটা পূর্ণতা পায়, যখন আমি ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতাল ছাড়ার পরে ১৯৮৭-তে আমার দাদা মানবেন্দ্র গোস্বামীর দল ‘অবেক্ষণ’-এ যোগদান করি। এর আগে আমার লেখা একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘প্রতি রাতে সে আসে’ যখন পাড়ায় মঞ্চস্থ করি, তখন দাদা আমাকে সেট-লাইট ইত্যাদির ব্যাপারে গাইড করেছিলেন। ডাক্তারি পেশাতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তখন আমি দশ জায়গায় দৌড়ে বেড়াচ্ছি। ব্যস্ততার জন্য তখন আর আমার পক্ষে দল চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। দাদার দলেরও তখন নড়বড়ে অবস্থা। দাদার অনুরোধে আমি আমার নাট্য সহযোগীদের নিয়ে অবেক্ষণে জয়েন করি। মৃণাল, সিন্টু, পারমিতা, সুশংকর, দিপু, রঞ্জন-সহ প্রায় দশ জন দাদার দলে কাজ শুরু করি। প্রথম প্রযোজনা ছিল উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর গল্প অবলম্বনে চিররঞ্জন দাশের নাটক ‘কামার কাহিনী’। অপরূপ রূপকথার এই নাটকটিতে আমি একটি মজার শয়তানের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম, যে চরিত্রটি ছন্দে ছন্দে কথা বলে। কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে অনেকগুলো শো হয়েছিল এই নাটকের। নাটকটি যেমন দর্শকদের ভালো লেগেছিল, তেমনি আমার অভিনয়ও উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৩৭: ডাক্তারবাবুদের পুজো কেমন কাটে
শারদীয়ার গল্প-৬: পর্সতার
অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি
দশভুজা: তিনিই সারস্বত সাধনার প্রতিরূপা সত্যিকারের দশভুজা
এই প্রযোজনায় কাজ করে আমার মনে হল, এতদিনে ঠিকঠাক দলে একটি ঠিকঠাক নাটকে অভিনয় করলাম। খুব নিষ্ঠা ভরে কাজ শেখাতেন মানব দা। কীভাবে লাইট এবং মিউজিক নিয়ে অভিনয় করতে হয়, মঞ্চকে ব্যবহার করতে হয়, চরিত্রানুযায়ী গলাকে নানা মাত্রায় খেলাতে হয়–এসব আমার এই নাট্য দলে এসেই শেখা। অভিনয় বাদে এখানে আমি সাংগঠনিক কাজকর্মও দেখাশোনা করতাম। হল ঠিক করা, কল শো জোগাড় করা, টিকিট ডিস্ট্রিবিউট করা, টাকা সংগ্রহ করা, শো থাকলে গাড়ি ভাড়া করে সেট নিয়ে যাওয়া, পোশাক-আশাক গুছিয়ে নেওয়া–ইত্যাদি হরেক কাজের তদারকি করতে হতো আমাকে, গায়ে গতরে খাটতেও হতো। মানবদা প্রধানত নাট্য পরিচালনার কাজটাই দেখতেন। তখনই আমি বুঝেছিলাম, ভালো প্রযোজনা করতে গেলে অনেক অর্থের প্রয়োজন। ‘কামার কাহিনী’র আশাতীত সাফল্যের পর শ্যামাকান্ত দাসের পুরনো নাটক ‘পরশমনি’ এবং ‘গুলশন’ মানব দা আবার নতুন করে মঞ্চস্থ করান। এরপর ‘সমকাল’, ‘ফিফটি ফিফটি’তেও আমি অভিনয় করি। তারপর নানা কারণে এই নাট্য দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আমি অভিনয় থেকে সরে আসি। তবে অভিনয় বাদে গ্রুপের সাংগঠনিক কাজকর্ম আগের মতোই করতাম। ১৯৮৭ থেকে ২০১৩, অর্থাৎ প্রায় ১৭ বছর সক্রিয় থাকার পর আমি ‘অবেক্ষণ’-এ যাতায়াত বন্ধ করি। তবে আত্মিক সম্পর্ক কখনও ছিন্ন হয়নি। মাঝখানে এই দলের কাজকর্মও অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। এখন আবার নতুন নাটক প্রযোজনায় হাত দিয়েছে দলের কর্ণধার মানবেন্দ্র গোস্বামী। তবে দীর্ঘদিন এই নাট্য দলে সক্রিয় থাকলেও ‘অবেক্ষণ’ কোনদিনই আমার লেখা কোনও নাটক প্রযোজনা করেনি।
নাটকের নাম: চে গুয়েভারা
এই গ্রুপে অভিনয়ের পাশাপাশি আমি ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কামারহাটি শাখার বার্ষিক সম্মেলনে সভ্য ডাক্তারবাবুদের নিয়ে প্রতিবছরই একটি করে নাটক মঞ্চস্থ করাচ্ছিলাম। এবং সেখানে আমার পরবর্তীকালে লেখা নাটকগুলো এক এক করে মঞ্চস্থ করানোর সুযোগ পাই। ‘জীবনের খোঁজে’, ‘এক যে ছিল ভূত’, ‘রবীন্দ্র জয়ন্তী’, ‘কাগজের বিয়ে’-সহ বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ হয় এবং দর্শকদের ভালো লাগে। অবেক্ষণ ছাড়ার পর বছরের দু-মাস ডাক্তার বাবুদের নাটক নিয়ে মেতে থাকলেও, বাকি সময়টা আমার নাটকহীন হয়েই কাটাতে হতো। মাঝে মাঝে রবীন্দ্রসদন, গিরিশ মঞ্চ কিংবা শিশির মঞ্চে নাটক দেখতে গিয়ে স্ত্রীর কাছে আক্ষেপ করতাম, কবে যে আবার এই সব মঞ্চে নাটক করবো! স্ত্রী বলতো, এত হা-হুতাশ না করে অন্য কোনও নাটকের দলে যোগ দিলেই তো পারো! পারতাম নিশ্চয়ই। কিন্তু তখন পেশাগত ব্যস্ততা ভীষণ বেড়ে গিয়েছে। তাই গ্রুপ থিয়েটারি টাইমিং মেনটেন করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া সিনেমা সিরিয়ালের কাজেরও চাপ ছিল। প্রখ্যাত অভিনেতা পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিন পারিবারিক সখ্য। শ্রুতি রঙ্গম নামে ওনার প্রতিষ্ঠিত একটি নাট্যদলও আছে। একদিন আমার বাড়িতে এসেছিলেন গলা দেখাতে। তারপর একেবারে যাকে বলে কাছা খোলা আড্ডা। আড্ডার মাঝপথে দাদাকে আমার স্ত্রী বিষয়টি জানায়। দাদা শুনে চটজলদি উত্তর দেন, ‘তোর তো সময় সমস্যা। তা না হলে বলতাম, আমার দলে যোগ দে। তুই বরং নিজেই একটা দল তৈরি করে ফেল। তুই-ই ডিরেকশন দিবি। তোর সময় মতো রিহার্সাল রাখবি। অল্প বয়সে তো একটা দল করেছিলি!’ আমাকে চিন্তান্বিত দেখে দাদা সংযোজন করলেন, ‘তুই তো দীর্ঘদিন ডাক্তারদের নাটকে ডিরেকশন দিয়েছিস। পুরো ব্যাপারটা অরগানাইজ করেছিস। তাহলে তুই পারবি না কেন! চিরকাল তো হল ঠিক করা, টাকা জোগাড় করা ,দর্শক হলে আনা — এই কাজগুলো তুই ভালোভাবেই করেছিস, এখানেও তাই করবি।’
নাটক: চিনু বনাম ভিয়েতনামু
দাদা চলে গেলে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম, প্রস্তাবটা মন্দ নয়। তাছাড়া সেই বছর থেকে ডাক্তারদের কনফারেন্সে নাটক করাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এদিকে রেখা রায় মেমোরিয়াল এড সোসাইটির উদ্যোগে বেলঘরিয়াতে একটি স্বাস্থ্যমেলা শুরু হয়েছে, যার অন্যতম উদ্যোক্তা আমিও, যেখানে বছর দুয়েক ধরে আমাকে সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানে একটি করে নাটক করতে হচ্ছে। ভেবেচিন্তে আমার পুরনো নাট্যবন্ধু এবং দু’ চারজন নতুনকে নিয়ে ২০১১ সালে বেলঘরিয়া থিয়েটার অ্যাকাডেমি তৈরি করে ফেললাম। রেজিস্ট্রেশন করালাম। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমির অনুমোদনও জোগাড় করলাম। এসব ব্যাপারে আমার পর্দার পরিচিতি আমাকে খুব সাহায্য করল। সেই বছর আমার এই নতুন নাট্য দলের ব্যানারে আমার লেখা নাটক ‘এক যে ছিল ভূত’ মঞ্চস্থ হলো স্বাস্থ্যমেলার সান্ধ্যকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। প্রথম নাটকই হিট হয়ে যাওয়াতে নাট্য সদস্যরা আবদার করলো এই নাটকটিকে কন্টিনিউ করতে। আমার প্ল্যান ছিল, বছরে একটি করে নতুন নাটক করব, এবং একটিই শো করব। আসলে আমি চেয়েছিলাম নিজের মতো করে নাটকের মধ্যে থাকতে। কটা শো করলাম বা কোন হলে শো করলাম, সেগুলো নিয়ে সেই মুহূর্তে ভাবিত ছিলাম না। কিন্তু সদস্যদের জোরাজুরি এবং নাটকের প্রতি তীব্র ভালবাসা দলকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে উৎসাহ দিল। বছরে দু-তিনটে কল শো জুটে যেতে লাগলো। ২০১৩-তে পরশুরামের বিখ্যাত গল্প ‘চিকিৎসা সংকট’ আমি নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করলাম স্বাস্থ্যমেলায়। এবং সেই নাটকটি নিয়েই প্রথম আমার দল কলকাতা মঞ্চে যাত্রা শুরু করলো। পরপর দু’টি শো করলাম শিশির মঞ্চ এবং গিরিশ মঞ্চে।
মঞ্চ সফল নাটক 'বিষ'-এর একটি দৃশ্য।
দেখতে দেখতে বারো বছরে পা দিলাম আমরা। এই বছর বিলম্বিত দশম বর্ষপূর্তি উদযাপনও করেছি সাড়ম্বরে। কারণ করোনার জন্য গত দুবছর বড় কোনও অনুষ্ঠান করতে পারিনি। প্রায় একযুগ দল চালাতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা সম্মুখীন হয়েছি। ভালো-খারাপ দু’রকম অভিজ্ঞতাই হয়েছে, তবে ভালো অভিজ্ঞতাই বেশি। অনেকেই দলে এসেছে, কিছুদিন থেকে বা দীর্ঘ ৪-৫ বছর থেকেও দল ছেড়ে চলে গিয়েছে। একদম আনকোরা ছেলে মেয়েকে নিয়েও কাজ করেছি, যারা নাটকের ‘ন’ পর্যন্ত বুঝতো না, পরবর্তীকালে তারাও সিরিয়ালে কাজ করেছে। মঞ্চে নাটক করে বাহবাও পেয়েছে। আমি ছাড়াও প্রথম দিন থেকে আমার দলে থেকে আমাকে সব রকম সহযোগিতা করে চলেছেন সুকান্ত মুখোপাধ্যায়, শিবনাথ আচার্য এবং ধৃতিকণা ভট্টাচার্য। ১২ বছরে ১১টি প্রযোজনা করেছি আমরা। কোনটা ভালো, কোনটা অল্প ভালো, কোনটা বা ভালো নয়। আমরা কিন্তু থেমে যাইনি করোনার সময়টুকু ছাড়া। তখনও কিন্তু আমরা ফোনে সপ্তাহে দুদিন রিহার্সাল চালিয়ে গিয়েছি।
ছোটদের যত্নে: বাচ্চা খেতেই চায় না? কী করে খিদে বাড়াবেন? কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত
ইংলিশ টিংলিশ: চলুন আজ পুজো নিয়ে মজার ছলে কিছু শব্দ শিখে নিই
যোগা-প্রাণায়াম: কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন? প্রাণায়ামে হবে শ্বাসকষ্টের উপশম, জেনে নিন কীভাবে করবেন
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-২৯: কবির মুখাগ্নি করেননি কবিপুত্র
নিজে দল চালানোর যেমন সমস্যা আছে,তেমনি আনন্দও আছে। সবথেকে বড় সমস্যা, সিরিয়ালের হাতছানি ভুলে কেউ এখন আর সেভাবে নাটকটা করতে চাইছে না। অল্প বয়সী যারা নাটক করতে আসছে, তারা অভিনয় শিখতে চাইছে না, চাইছে এখান থেকে সিরিয়ালে ঢোকার একটা ‘এন্ট্রি পয়েন্ট’ জোগাড় করতে। এ সমস্যা শুধু আমার দলের নয়, সব দলেরই। তাছাড়া টুকটাক নাটুকে রাজনীতি তো আছেই। তবু নাটক বেঁচে আছে, থাকবে তার নিজের জোরেই। তীব্র ভালোবাসা না থাকলে কোনওভাবেই গ্রুপ থিয়েটার করা সম্ভব নয়। আর যারা দল চালাবেন অর্থাৎ নেতৃত্ব দেবেন, তাদের নাটক নিয়ে পাগলামি থাকতেই হবে, নাটকটাকে তাদের লাইভ প্রসেসের মধ্যে জুড়ে দিতে হবে। আমি আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে এই কথা বলছি। একজন নাট্য সংগঠক তথা পরিচালকের অনেক কাজ। অধিকাংশ নাট্য দলে এই দুটি পদে একই ব্যক্তি থাকেন, না থেকেও কোনও উপায় থাকে না। নাটক নির্বাচন করা, রিহার্সাল রুম জোগাড় করে ছেলেপুলে জুটিয়ে রিহার্সাল শুরু করা, নিয়মিত রিহার্সাল চালিয়ে যাওয়া, সরকারি বা বেসরকারি হল ভাড়া করার জন্য নিয়মিত আবেদনপত্র পাঠানো, যোগাযোগ রাখা, ডেট পেলে অনলাইন বুকিং, কর্পোরেশন পারমিশন, ফি বছর অডিট করানো, রিনিউয়াল করানো এবং সর্বোপরি টাকা এবং দর্শক জোগাড় করা — একেবারে যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। বলতে দ্বিধা নেই, এই প্রত্যেকটি কাজে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিতে হয় আমাকেই। অর্থাৎ কিছু কাজ নিজে হাতে করি, কিছু কাজ একে তাকে দিয়ে করাই। এবং এই কাজগুলো করে আমি কিন্তু যথেষ্ট আনন্দও পাই। যে কাজ করে আনন্দ পাওয়া যায় সেই কাজের পরিশ্রম কিন্তু গায়ে লাগে না। আমিও আমার নাট্য সতীর্থদের উদ্দেশ্যে সব সময় বলি, কাজটা ভালোবেসে করবি, আনন্দের সঙ্গে করবি। নাটকের প্রতি এই ভালোবাসা আর আনন্দ যদি না থাকে, তবে নাটকটা করিস না।
আরও পড়ুন:
ত্বকের পরিচর্যায়: ত্বক শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে? যত্নে কী কী করবেন? জেনে নিন ত্বক বিশেষজ্ঞের জরুরি পরামর্শ
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-২১: অবাঞ্ছিত মাছগুলিই এখন পরম কাঙ্ক্ষিত
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: কবে আসবে তুমি মননের সে ‘সহযাত্রী’? [০৯/০৩/১৯৫১]
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৩: রাজা থেকে ঋষি — উত্তরণের আলোকপথযাত্রী বিশ্বামিত্র
আলাদা দল করলেও পুরোনো দল অবেক্ষণ এবং মানব দা-র সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিন্তু নষ্ট হয়নি। আমার যে কোনও নতুন প্রযোজনার আগে আমি ওঁর সঙ্গে পরামর্শ করি। এই বছর যে নতুন নাটকটি আমরা করছি (কৈলাসে চা পান), সেটির ব্যাপারেও ওঁর সঙ্গে আলোচনা করেছি। মঞ্চসজ্জায় তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেছি। আমি নিজেকে এখনও নাট্য শিক্ষার্থী ভাবি। একটি ভালো প্রযোজনার স্বার্থে আমি আলো নিয়ে কথা বলি বাবলু চৌধুরীর সঙ্গে, সঙ্গীত নিয়ে কথা বলি গৌতম চক্রবর্তী এবং অমিত ঘোষের সঙ্গে, রূপসজ্জা এবং পোশাক নিয়ে বিশ্বনাথ মাইতি এবং মঞ্চ নিয়ে গদাইয়ের সঙ্গে। এরা দীর্ঘদিন আমার সঙ্গে বিভিন্ন প্রযোজনায় কাজ করে চলেছেন। সর্বোপরি আমার নাট্য দলের বর্তমান সদস্যদের মধ্যে ধৃতিকণা ভট্টাচার্য, শিবনাথ আচার্য, সুকান্ত মুখোপাধ্যায়, সোমা চক্রবর্তী, মনীষা মুখোপাধ্যায়, লাবনী সরকার, বাসুদেব পাল, রাকেশ পাল, সোমনাথ মন্ডল, শক্তি প্রসাদ নিয়োগী, অর্পিতা দাস, লক্ষ্মী চক্রবর্তী, ইন্দ্রজা চক্রবর্তী, গোপাল চক্রবর্তী, গৌতম চক্রবর্তী, আরজে নায়ার ইসলাম, প্রদীপ মণ্ডল, রীনা শীল এবং অনিরুদ্ধ দাশগুপ্ত—সবাই আমার সঙ্গে আছে। আসলে নাটক কখনও একা করা যায় না। নাট্য পরিবার আক্ষরিক অর্থেই একটি বৃহত্তর পরিবার। কেউ মঞ্চে অভিনয় করেন, কেউ বা থাকেন নেপথ্যে। সর্বোপরি মাথার উপর থাকেন আমাদের দর্শক দেবতারা। এদের সবার সান্নিধ্য পাই বলেই নাটক করে আমি আনন্দে থাকি, সুস্থ থাকি। এবং যতদিন শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা থাকবে, ততদিন নাটকটাই করে যেতে চাই।