বিমল কর।
বিমল কর। সাহিত্য জগতের এক মহীরুহ। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন আনন্দবাজার গ্রুপের দেশ পত্রিকায়। এখন যারা প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, তার অনেকেরই মেন্টর তিনি। আমি বিমলদাকে ডাকতাম গুরুর গুরু বলে। কেন ডাকতাম! কারণ আমার সাহিত্য গুরু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তাঁকে গুরু বলে ডাকতেন। শুধু ডাকতেন নয়, মানতেনও। সঞ্জীবদার কাছে একাধিক বার শুনেছি, কীভাবে এই গুণী মানুষটি হাতে ধরে তাঁকে পত্রিকা সম্পাদনার এবং লেখালেখির নানা কাজকর্ম শিখিয়েছেন। বিমল কর এর লেখা ‘আমি ও আমার তরুণ বন্ধুরা’ বইটিতে এগুলো বিস্তারিতভাবে বলা আছে। সাহিত্যিক হিসেবে এই মানুষটিকে আমি চিনতাম, কারণ ততদিনে আমার ‘অসময়’ ও ‘খড়কুটো’ উপন্যাসগুলো পড়া হয়ে গিয়েছে। সিনেমার পর্দায় অসময়, যদুবংশ, ছুটি, বসন্ত বিলাপ কিংবা বালিকা বধূ… এগুলোও দেখা হয়ে গিয়েছে। আমি যখন সঞ্জীব সান্নিধ্য পাবার জন্য দেশ পত্রিকা দপ্তরে যাতায়াত শুরু করেছি (১৯৮৫-৮৬), ততদিনে বিমলদা সেখান থেকে রিটায়ার করে গিয়েছেন।
সঞ্জীবদার বাবার ক্যানসার চিকিৎসা সূত্রে ওঁর বাড়িতে দীর্ঘদিন আমি ঘনঘন যাতায়াত করেছি। বাবার মৃত্যুর পরেও সেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি, আজও আছে। সেই সঞ্জীবদা ৯০ দশকের গোড়ায় একদিন ফোন করে আমাকে বললেন যে বিমলদার দাদার ক্যানসার। অ্যডভান্স স্টেজ। যেখানে দেখাচ্ছিলেন, সেখান থেকে কেমোথেরাপির অ্যাডভাইস করেছে। বিমলদা চাইছেন না কোথাও আর ভাইকে ভর্তি করতে। যদি আমি একটু বাড়িতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করি, মানে যদি পুরো দায়িত্বটা নেই আর কি…। বাড়িতে রেখে এই ধরনের রোগের চিকিৎসা করা, বিশেষ করে অ্যাডভান্স স্টেজে, যথেষ্ট ঝামেলার ব্যাপার। এর আগে একাধিক বার আমার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে তখন বয়স কম ছিল, তাই বাড়িতেই কেমোথেরাপি দিয়েছি, এমনকি ব্লাডও চালিয়েছি। যাই হোক, সঞ্জীবদার অনুরোধ তো আমার কাছে আদেশের সমান, আমি রাজি হলাম। বিমলদার সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিয়ে একদিন বিকেলে গিয়ে হাজির হলাম তাঁর সল্টলেকের বাড়িতে। এই প্রথম দেখলাম তাঁকে। ফর্সা টুকটুকে সুদর্শন চেহারা, পরনে ফুলছাপ লুঙ্গি এবং গায়ে একটি হাফ হাতা পাঞ্জাবি। চশমার আড়ালেও ভীষণ উজ্জ্বল চোখ দুটো নজর এড়ায় না, আর মুখে সবসময় একটা চাপা হাসি।
সঞ্জীবদার বাবার ক্যানসার চিকিৎসা সূত্রে ওঁর বাড়িতে দীর্ঘদিন আমি ঘনঘন যাতায়াত করেছি। বাবার মৃত্যুর পরেও সেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি, আজও আছে। সেই সঞ্জীবদা ৯০ দশকের গোড়ায় একদিন ফোন করে আমাকে বললেন যে বিমলদার দাদার ক্যানসার। অ্যডভান্স স্টেজ। যেখানে দেখাচ্ছিলেন, সেখান থেকে কেমোথেরাপির অ্যাডভাইস করেছে। বিমলদা চাইছেন না কোথাও আর ভাইকে ভর্তি করতে। যদি আমি একটু বাড়িতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করি, মানে যদি পুরো দায়িত্বটা নেই আর কি…। বাড়িতে রেখে এই ধরনের রোগের চিকিৎসা করা, বিশেষ করে অ্যাডভান্স স্টেজে, যথেষ্ট ঝামেলার ব্যাপার। এর আগে একাধিক বার আমার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে তখন বয়স কম ছিল, তাই বাড়িতেই কেমোথেরাপি দিয়েছি, এমনকি ব্লাডও চালিয়েছি। যাই হোক, সঞ্জীবদার অনুরোধ তো আমার কাছে আদেশের সমান, আমি রাজি হলাম। বিমলদার সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিয়ে একদিন বিকেলে গিয়ে হাজির হলাম তাঁর সল্টলেকের বাড়িতে। এই প্রথম দেখলাম তাঁকে। ফর্সা টুকটুকে সুদর্শন চেহারা, পরনে ফুলছাপ লুঙ্গি এবং গায়ে একটি হাফ হাতা পাঞ্জাবি। চশমার আড়ালেও ভীষণ উজ্জ্বল চোখ দুটো নজর এড়ায় না, আর মুখে সবসময় একটা চাপা হাসি।
যাতায়াত করতে করতে বেশ একটা সখ্য তৈরি হয়ে গেল। ছেলেমানুষ ছিলাম তখন! নিজে যে টুকটাক লিখছি, সেটা মাঝে মাঝে বেশ জাহির করে বলতাম সাহিত্য আকাদেমি পাওয়া এই লেখককে, দু-একটি লেখা সুযোগ পেয়ে তাঁকে শুনিয়েও ফেললাম। ক্যানসার নিয়ে একটা ছোট গল্প শুনিয়ে ছিলাম, মনে আছে। ‘রিক্তাকে নিয়ে চিঠি’। খুব মন দিয়ে শুনে বললেন, লেখাটা তুমি ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দাও। আমি বললাম, ‘একটি ছোট পত্রিকায় গল্পটি অলরেডি প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে।’ শুনে বললেন, ‘তাহলে আর হল না। আরও ১৫ বছর আগে যদি তোমার সঙ্গে পরিচয় হতো, তাহলে আমি তোমাকে দিয়ে গল্প লেখানোর চেষ্টা করতাম।’ আমি বললাম, ‘আমি জানি দাদা। আপনার সক্রিয় প্রচেষ্টায় বেশ কয়েকজন শুধু গল্পকার হিসেবে নয়, এখন রীতিমতো সাহিত্যিক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছেন।’ চাপা হাসি হেসে দাদা বললেন, ‘তোমাকে কে বললো?’ আমি বললাম, ‘আমার গুরু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেছেন।’ বিমলদা একটু মশকরা করেই যেন বললেন, ‘সঞ্জীব সবসময় আমার সম্বন্ধে বাড়িয়েই বলে। যোগ্যতা না থাকলে কেউ কি আর ওই জায়গায় পৌঁছয়!’
টানা তিন মাসে অন্তত ১৪-১৫ বার তো তাঁর বাড়িতে আমাকে যেতেই হয়েছে। এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে থাকতেও হয়েছে। এর ফলে শুধু দাদার সঙ্গে নয়, বাড়ির অন্যান্যদের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। বৌদিও ছিলেন ভীষণ সাধারণ, একেবারে আটপৌরে বলতে যা বোঝায়। দাদা, বৌদি ও আমি মিলে বিমলদার লেখার ঘরে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডাও দিয়েছি। একবার গান গেয়েও শুনিয়েছিলাম। বিমলদার লেখক জীবনের শুরু, চাকরি জীবন, আনন্দবাজারের জীবন… দারুন মজা করে সব বলতেন আমাকে। মানুষটি বড্ড খুতখুঁতে ছিলেন, একটু ভীতু প্রকৃতিরও। আমি যেদিন তাঁর ভাইকে বাড়িতে ফ্লুইড চালিয়ে কেমোথেরাপির ফাস্ট কোর্স দেব, তার আগের রাতে উনি ভালো করে ঘুমোতেই পারলেন না। যতক্ষণ কেমোথেরাপি চলল, কি টেনশন তাঁর! একবার পায়চারি করছেন, একবার আমার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন, একবার আমার পিঠে হাত রেখে বলছেন, কোনও ভয় নেই তো… ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বাড়িতে কেমোথেরাপি দিতে পারি জেনে উনি আমাকে খুব বড় ডাক্তার ঠাউরে ছিলেন। বেশ খাতির যত্নও করতেন। আমার জন্য বৌদি স্পেশাল খাবার তৈরি করতেন, কোনওদিন বাইরে থেকেও স্পেশাল খাবার আসতো। আমি যতক্ষণ খেতাম, বিমলদা উল্টোদিকে বসে সেটা খুব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতেন। উনি হয়তো এক কাপ চা নিয়েই বসে আছেন, আর আমি ভালো-মন্দ গিলেই যাচ্ছি। আসলে একটা স্নেহের বাঁধনে আমাকে বেঁধে ফেলেছিলেন।
টানা তিন মাসে অন্তত ১৪-১৫ বার তো তাঁর বাড়িতে আমাকে যেতেই হয়েছে। এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে থাকতেও হয়েছে। এর ফলে শুধু দাদার সঙ্গে নয়, বাড়ির অন্যান্যদের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। বৌদিও ছিলেন ভীষণ সাধারণ, একেবারে আটপৌরে বলতে যা বোঝায়। দাদা, বৌদি ও আমি মিলে বিমলদার লেখার ঘরে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডাও দিয়েছি। একবার গান গেয়েও শুনিয়েছিলাম। বিমলদার লেখক জীবনের শুরু, চাকরি জীবন, আনন্দবাজারের জীবন… দারুন মজা করে সব বলতেন আমাকে। মানুষটি বড্ড খুতখুঁতে ছিলেন, একটু ভীতু প্রকৃতিরও। আমি যেদিন তাঁর ভাইকে বাড়িতে ফ্লুইড চালিয়ে কেমোথেরাপির ফাস্ট কোর্স দেব, তার আগের রাতে উনি ভালো করে ঘুমোতেই পারলেন না। যতক্ষণ কেমোথেরাপি চলল, কি টেনশন তাঁর! একবার পায়চারি করছেন, একবার আমার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন, একবার আমার পিঠে হাত রেখে বলছেন, কোনও ভয় নেই তো… ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বাড়িতে কেমোথেরাপি দিতে পারি জেনে উনি আমাকে খুব বড় ডাক্তার ঠাউরে ছিলেন। বেশ খাতির যত্নও করতেন। আমার জন্য বৌদি স্পেশাল খাবার তৈরি করতেন, কোনওদিন বাইরে থেকেও স্পেশাল খাবার আসতো। আমি যতক্ষণ খেতাম, বিমলদা উল্টোদিকে বসে সেটা খুব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতেন। উনি হয়তো এক কাপ চা নিয়েই বসে আছেন, আর আমি ভালো-মন্দ গিলেই যাচ্ছি। আসলে একটা স্নেহের বাঁধনে আমাকে বেঁধে ফেলেছিলেন।
দিব্যেন্দুদার সঙ্গে।
আমার একটা বদ অভ্যাস আছে, কোথাও জমিয়ে বসবার সুযোগ পেলেই সেখানে শুতে চাই। এখানেও অন্যথা হল না। একদিন দাদার কাছে আবদার করেই ফেললাম, ‘দে’জ পাবলিকেশন থেকে আমার এ বছর বইমেলায় বেরোচ্ছে ‘রোগ-দুর্ভোগ’ নামে একটি বই। সঞ্জীবদা প্রচ্ছদ আঁকছেন। আপনি যদি একটি ভূমিকা লিখে দেন।’ বিমলদা রাজি হয়েছিলেন। পুরো পান্ডুলিপিটি তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিলাম। সেটি উল্টোপাল্টে দেখার পরই ভূমিকাটি লিখেছিলেন। এই লেখার সঙ্গে সেটি প্রকাশ করলাম। আমাকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন দাদা ‘বিমল করের সরস গল্প’। ভিতরে আমার নাম লিখে সইও করে দিয়েছিলেন। আমার কাছে এ এক পরমপ্রাপ্তি। সযত্নে সেটি আগলে রেখেছি আজও। মাস তিনেক বাদে আমার রোগী অর্থাৎ বিমলদার ভাই বাড়িতেই মারা গেলেন আমার উপস্থিতিতেই। ডেথ সার্টিফিকেট আমিই লিখেছিলাম। শেষ কাজেও উপস্থিত ছিলাম। এরপর বিমল দার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগটা অনেক কমে আসে। তবে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। বৌদি অসুস্থ হওয়ার পরে একবার দেখতেও গিয়েছিলাম।
অমন বড় মাপের একজন সাহিত্যিককে তার জীবনের শেষ প্রান্তে আমি খুব অল্প সময়ের জন্যই পেয়েছিলাম। তবু ওই অল্প সময়েই উনি আমার মনে একটি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। গতবছর আমরা পেরিয়ে এলাম বিমল করের জন্ম শতবর্ষ। এই দুঃসময়ে ‘অসময়’-এর স্রষ্টাকে প্রণাম জানাই।
উত্তম-অপর্ণা অভিনীত আজ থেকে ৬০ বছর আগের সুপার ডুপার হিট সিনেমা ‘মেম সাহেব’ দেখেননি, এমন প্রৌঢ় খুব কমই আছেন। এই ‘মেম সাহেব’ উপন্যাসটির লেখক ছিলেন প্রয়াত নিমাই ভট্টাচার্য, আমাদের সবার প্রিয় জীবন রসিক মানুষ নিমাইদা। ওই একটি মাত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য প্রেমিক যে কোনও বাঙালির কাছে তিনি ছিলেন কাছের মানুষ। ওই একটি মাত্র উপন্যাসই তাকে অমর করে রেখেছে বাঙালি পাঠক সমাজে। অথচ এরপরেও অনেক অনেক গল্প উপন্যাস লিখেছেন তিনি, একাধিক প্রকাশনা থেকে সেগুলো প্রকাশিতও হয়েছে। তবু মৃত্যুর পরেও ‘মেম সাহেব’ এবং নিমাই ভট্টাচার্য আজও সমার্থক।
উত্তম-অপর্ণা অভিনীত আজ থেকে ৬০ বছর আগের সুপার ডুপার হিট সিনেমা ‘মেম সাহেব’ দেখেননি, এমন প্রৌঢ় খুব কমই আছেন। এই ‘মেম সাহেব’ উপন্যাসটির লেখক ছিলেন প্রয়াত নিমাই ভট্টাচার্য, আমাদের সবার প্রিয় জীবন রসিক মানুষ নিমাইদা। ওই একটি মাত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য প্রেমিক যে কোনও বাঙালির কাছে তিনি ছিলেন কাছের মানুষ। ওই একটি মাত্র উপন্যাসই তাকে অমর করে রেখেছে বাঙালি পাঠক সমাজে। অথচ এরপরেও অনেক অনেক গল্প উপন্যাস লিখেছেন তিনি, একাধিক প্রকাশনা থেকে সেগুলো প্রকাশিতও হয়েছে। তবু মৃত্যুর পরেও ‘মেম সাহেব’ এবং নিমাই ভট্টাচার্য আজও সমার্থক।
দে’জ-এর ঘরের লেখক হতে না পারলে আমি কখনওই এত সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসতে পারতাম না। নিমাইদার সঙ্গেও তো দে’জের ঘরেই পরিচয়। সে প্রায় ৩০ বছর আগের কথা তো বটেই! তখন তো সপ্তাহে অন্তত একবার শিয়ালদার চেম্বার সেরে ফেরার পথে, কোনও সময় চেম্বারে ঢোকার আগেই দে’জে ঢূঁ মেরে আসতাম। নিমাইদার সঙ্গে মাসে একবার তো দেখা হতোই। আড্ডা হতো। নানা বিষয়ে কথা হতো। একসঙ্গে চা-মুড়ি খেতাম। দাদার সঙ্গে বেশ একটা বন্ডিং তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কয়েকবার গল্প-উপন্যাস লিখতে গিয়ে মেডিকেল ব্যাপারে আমার সঙ্গে পরামর্শও করেছেন। মানুষটি খুব ফুর্তিবাজ ছিলেন। নববর্ষের সন্ধ্যায় দে’জ-এর আসর একাই জমিয়ে রাখতেন। দেখা হলেই খুব হৈ হৈ করতেন। আমার মেয়ের পিছনেও খুব লাগতেন। আমি প্রায় কুড়ি বছর বইমেলায় দে’জের ব্যানারে আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠান করেছি। দুই এক বছর বাদ দিয়ে প্রায় প্রতি বছরই আমার অনুষ্ঠানে নিমাইদার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। শুধু উপস্থিতই থাকতেন না, বই উদ্বোধনের পর যে বিতর্ক সভা থাকতো, তাতেও অংশগ্রহণ করতেন এবং যথারীতি নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে আসর জমিয়ে দিতেন। দাদার বেশ কয়েকটি উপন্যাস আমার পড়া। তার মধ্যে ‘লাস্ট কাউন্টার’ উপন্যাসটি, যেটি শ্মশান ঘাটের কিছু চরিত্র নিয়ে লেখা, আমার অন্যতম প্রিয় উপন্যাস। একসময় এই উপন্যাসটি নিয়ে সিরিয়াল করার কথা উঠেছিল। আমি বেশ কয়েকটি পর্বের চিত্রনাট্যও তৈরি করেছিলাম, পরবর্তীকালে যদিও সেটি আর হয়নি।
এই আমুদে মানুষটি শেষ জীবনে নানা অসুখে বড় কষ্ট পেয়েছেন। সেরিব্রাল তো ছিলই। কানেরও একটা সমস্যা ছিল। কানে সোঁ সোঁ শব্দ হতো, ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলা হয় টিনাইটাস। কানের নার্ভ নষ্ট হওয়ার ফলে এমনটা হয়। তাছাড়া বয়সজনিত কারণে কানে কমও শুনতেন। দাদার অনুরোধে একবার বাড়িতে গিয়ে দেখেও এসেছিলাম। ওষুধপত্র খেয়ে কয়েক মাস ভালো ছিলেন। আবার সমস্যা দেখা দেয়। টেলিফোনেই অ্যাডভাইস দিতাম। কিন্তু সব কথা ফোনে শুনতে পেতেন না। লকডাউনের মাস কয়েক আগে বাজারে ওষুধ পাচ্ছিলেন না। আমি এক কোম্পানির থেকে চেয়ে চিনতে নিয়ে বাই পোস্টে কিছু ওষুধ পাঠিয়েছিলাম। দাদা খুব খুশি হয়েছিলেন। ফোনে আমাকে ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন। সেটাই শেষ কথা নিমাইদার সঙ্গে। লকডাউনের মধ্যেই দাদা চলে গেলেন দুই হাজার কুড়ির ২৫ জুন। আমিও চিরতরে হারালাম আমার একজন প্রিয় সাহিত্যিক এবং প্রিয় মানুষকে।
এই আমুদে মানুষটি শেষ জীবনে নানা অসুখে বড় কষ্ট পেয়েছেন। সেরিব্রাল তো ছিলই। কানেরও একটা সমস্যা ছিল। কানে সোঁ সোঁ শব্দ হতো, ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলা হয় টিনাইটাস। কানের নার্ভ নষ্ট হওয়ার ফলে এমনটা হয়। তাছাড়া বয়সজনিত কারণে কানে কমও শুনতেন। দাদার অনুরোধে একবার বাড়িতে গিয়ে দেখেও এসেছিলাম। ওষুধপত্র খেয়ে কয়েক মাস ভালো ছিলেন। আবার সমস্যা দেখা দেয়। টেলিফোনেই অ্যাডভাইস দিতাম। কিন্তু সব কথা ফোনে শুনতে পেতেন না। লকডাউনের মাস কয়েক আগে বাজারে ওষুধ পাচ্ছিলেন না। আমি এক কোম্পানির থেকে চেয়ে চিনতে নিয়ে বাই পোস্টে কিছু ওষুধ পাঠিয়েছিলাম। দাদা খুব খুশি হয়েছিলেন। ফোনে আমাকে ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন। সেটাই শেষ কথা নিমাইদার সঙ্গে। লকডাউনের মধ্যেই দাদা চলে গেলেন দুই হাজার কুড়ির ২৫ জুন। আমিও চিরতরে হারালাম আমার একজন প্রিয় সাহিত্যিক এবং প্রিয় মানুষকে।
দিব্যেন্দু পালিত।
প্রয়াত হয়েছেন মাত্র তিন বছর। অথচ এত অল্প সময়ের মধ্যে একজন শক্তিমান সাহিত্যিক এবং কবি প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেলেন। সাহিত্য একাডেমি-সহ বিভিন্ন পুরস্কার ভূষিত প্রচার বিমুখ এই মানুষটির নাম দিব্যেন্দু পালিত। তখন আমি লেখালেখির সুবাদে আনন্দবাজারে ঘন ঘন যাতে যাতায়াত করছি। দেশ, আনন্দলোক, সানন্দা প্রবাসী আনন্দবাজারের দপ্তর হয়ে একদিন পৌঁছে গেলাম আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে। আমি গিয়েছিলাম সাংবাদিক সুদেষ্ণা বসুর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি শনিবারের পাতার ফিচার বিভাগটি তখন দেখতেন। আরও কী কী দেখতেন, আজ আর মনে পড়ে না। সেখানে ‘গৃহিণীরা শুনছেন’ শিরোনামে একটি সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কলাম লেখার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। দীর্ঘ সাত-আট মাস সেটি চালু ছিল। পরবর্তীকালে ওই লেখাগুলোর সঙ্গে আরও কিছু নতুন লেখা সংযোজন করে দে’জ পাবলিশিং থেকে বই হয়ে প্রকাশিত হয়। সুদেষ্ণা দির কাছে শুনেছিলাম যে দিব্যেন্দু বাবু নিজেই রবিবারের পাতার কভার স্টোরি ঠিক করেন। একদিন ওঁকে সরাসরি আমার মনের অভিপ্রায় জানালাম। তার আগেই অবশ্য যাতায়াতের সূত্রে উনি আমাকে চিনে গিয়েছেন। ভালো করে শুনলেন এবং বললেন আপনি ঠিক কোন কোন পয়েন্টসের উপর লেখাটি লিখতে চান তা আমাকে একটু লিখে জানান। আমার লেখার শিরোনাম ছিল, প্রথম পর্যায়ে ধরা পড়লে ক্যানসার অবশ্যই সারে। বিষয়টি তাঁর পছন্দ হয় এবং শেষ অব্দি লেখাটি আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে প্রকাশিত হয়।
নিমাই ভট্টাচার্য।
আপাতদৃষ্টিতে দিব্যেন্দুদা মানুষটি একটু সিরিয়াস প্রকৃতির, অনেকটা তাঁর লেখার বিষয়বস্তুর মতো। কিন্তু এই আপাত গাম্ভীর্যের পিছনে মানুষটি ছিলেন বড্ড সহজ সরল মনের। বইমেলায় আমার অনুষ্ঠানে একাধিক বার এসেছেন। বছর ২৫ আগে সম্ভবত প্রথমবার এসেছিলেন। আমার মেয়ে তখন খুব ছোট। অনুষ্ঠান চলাকালীনই সারা মঞ্চ জুড়ে হুটোপাটি করে বেড়াচ্ছিল। দিব্যেন্দুদা মঞ্চাসীন হয়ে বারে বারে ওকে দেখছিলেন। আমি মেয়েকে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। দিব্যেন্দু আমাকে না করলেন, বললেন, ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি মেয়েকে নিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। উনি দু’-চারটে কথার পরে বেশ ভাব জমিয়ে নিলেন আমার মেয়ের সঙ্গে। ওকে ডাকলেন ‘বন্ধু’ বলে। তারপরে যতবারই দেখা হয়েছে আমার সঙ্গে, জিজ্ঞেস করেছেন, আমার বন্ধু কেমন আছে? আর যখন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তখন বেশ হই হই করে কথা বলতেন, তাতে মনে হতো যে দুজনে যেন সমবয়সী। শেষ জীবনে সেরিব্রাল হয়ে খুব কষ্ট পেয়েই মারা গেলেন। শিল্পীদের তো মৃত্যু হয় না। কাজে এই কথাশিল্পীও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকবেন। কিন্তু পাশাপাশি, আমরা যারা নিমগ্ন পাঠক, তার বইয়ের প্রকাশক, তাদেরও দায়িত্ব আছে, তাঁর লেখাগুলোকে আর একটু পাঠক পরিচিতি দেওয়ার।
শংকর।
সাহিত্যিক শংকরকেও খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি। বইমেলায় পাশে বসে দেখেছি, এখনও কী পরিমাণ বই তাঁর বিক্রি হয়! আর উনি প্রায় তিন ঘণ্টা একটানা বসে থেকে অকাতরে বিক্রিত বইয়ে সই বিলিয়ে যান। এখনও প্রায় ৯০ বছর বয়সেও ওনার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ সচল। বহু পুরনো গল্প চমৎকার বলতে পারেন, এমনকি সাল তারিখও বলে দেন। প্রফুল্ল রায় এবং সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। এরাও কিন্তু ৯০ এর কাছাকাছি। কিন্তু এখন কি চমৎকার সাহিত্য সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। এদের সবাইকেই পাঠক হিসেবে কুর্নিশ জানাতেই হয়। আর নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াই এই কথা ভেবে যে, এই বিখ্যাত মানুষগুলোর সঙ্গ ধন্য হয়েছে আমি। সার্থক আমার মানব জনম।