সেই অর্থে সাহিত্যপ্রেমী আমি কোনওদিনই ছিলাম না। তাই বলে ছোটবেলায় যে পড়ার বইয়ের বাইরে কিছু পড়িনি, তাও নয়। মনীষীদের জীবনী আর রূপকথার গল্প পড়তে খুবই ভালো লাগতো। ভালো লাগতো গোয়েন্দা গল্প-রহস্য গল্প পড়তে। ইস্কুলের সেই সোনার দিনগুলোতে স্বপন কুমারের রহস্য সিরিজের প্রায় সবটাই গোগ্রাসে গিলতাম। তখন সোভিয়েত সাহিত্যের দারুণ দারুণ সব বই বাংলাতে পাওয়া যেত। মনে আছে ‘চুক আর গেক’ নামে একটি বই অন্তত বার পঞ্চাশেক তো পড়েই ছিলাম। সেই বইটি আজও আমার সংগ্রহে আছে। ছোটবেলা থেকে আমার ছোট কাকা একটা অভ্যাস আমাদের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন, সেটা হল নিয়মিত খবর কাগজ পড়ার অভ্যাস। আর জি করে ডাক্তারি পাস করার পর যখন হাউসস্টাফশিপ করতে হোস্টেলে থাকতাম, তখন নিয়মিত ‘দেশ’ পত্রিকা পড়ার অভ্যেস গড়ে ওঠে। রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে পড়তাম সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লোটা কম্বল। পরবর্তীকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম, সেই সময় ও প্রথম আলো, সমরেশ মজুমদারের কালবেলা… সব দেশ পত্রিকাতেই ধারাবাহিক পড়েছি। এছাড়া নাটকের বই পড়তে খুব ভালো লাগতো। যেহেতু নিজে নাটকটা ভালোবাসতাম এবং করতাম।
কোনওদিন লেখালেখি করব, সেটা কখনও ভাবিনি। কিন্তু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এসে লিখতে লিখতে সত্যিই এক সময় লেখক হয়ে গেলাম। দে’জ পাবলিশিং-এর ঘর থেকে খান পঞ্চাশেক বই বার হওয়ার পর নিজেকে লেখক এখন বোধহয় ভাবতেই পারি। আর লেখালেখির জগতে এসেছিলাম বলেই সঞ্জীবদা বাদ দিয়েও আরও কিছু বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। বিখ্যাত সাহিত্যিক মনি শংকর মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ শংকর বাদে তাদের সবাই-ই আজ প্রয়াত। এই লেখা তাদেরই স্মৃতিচারণ।
কোনওদিন লেখালেখি করব, সেটা কখনও ভাবিনি। কিন্তু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এসে লিখতে লিখতে সত্যিই এক সময় লেখক হয়ে গেলাম। দে’জ পাবলিশিং-এর ঘর থেকে খান পঞ্চাশেক বই বার হওয়ার পর নিজেকে লেখক এখন বোধহয় ভাবতেই পারি। আর লেখালেখির জগতে এসেছিলাম বলেই সঞ্জীবদা বাদ দিয়েও আরও কিছু বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। বিখ্যাত সাহিত্যিক মনি শংকর মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ শংকর বাদে তাদের সবাই-ই আজ প্রয়াত। এই লেখা তাদেরই স্মৃতিচারণ।
প্রথমেই বলি মহান সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথা। কলেজে পড়ার সময় ওঁর ঘনাদা সিরিজের বেশ কিছু লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ওঁকে বলা হত কল্লোল যুগের সাহিত্যিক। বেশ কিছু সিনেমার কাহিনীকার এবং চিত্রনাট্যকার ছাড়াও পরিচালকও ছিলেন উনি। ক্যানসার চিকিৎসার প্রবাদ পুরুষ ডাঃ সরোজ গুপ্তর সুপারিশের দৌলতে একবার ওঁর বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের সাহায্যার্থে আমার নাটকের গ্রুপ থেকে আমি ১৯৮৪ এবং ৮৫ সালে শিশির মঞ্চে এবং রবীন্দ্র সদনে দুটি বড় অনুষ্ঠান করেছিলাম, যে কথা আমি আগের লেখাগুলোতে একাধিক বার বলেছি। শিশির মঞ্চের অনুষ্ঠানে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে আসার জন্য একেবারে সরাসরি ওঁর কালীঘাটের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম একদিন সকালবেলা। সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে বেল বাজিয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। দরজা খুলে দিলেন সাহিত্যিক স্বয়ং। পরিচয় দিলাম। ছোট্ট খাটো মানুষটি বেশ আন্তরিকতার সঙ্গেই আমাকে ডেকে নিয়ে সোফাতে বসালেন। বললাম, ‘আপনি নিজেই খুলে দিলেন, অন্য কেউ নেই! প্রেমেন্দ্রবাবু বললেন, ‘আছে সবাই তবে যে যার কাজে ব্যস্ত। যতদিন স্ত্রী বেঁচে ছিলেন, উনিই খুলে দিতেন। এখন বয়স হয়েছে, চোখে গ্লকোমা, ভালো দেখি না, তাই যে কোনও কাজই সময় নিয়ে করতে হয়। আপনাকে সেজন্য অনেকক্ষণ বেল বাজিয়ে দাঁড়াতে হল।’ কথাতে একটা বেদনার সুর। আমি বললাম, ‘ছি ছি, এ কথা বলছেন কেন! আমার কোনও কষ্টই হয়নি।’
তারপরে আরও বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে, চা বিস্কুট খাইয়েছিলেন, এসেওছিলেন আমাদের অনুষ্ঠানে। তখন আমার নিজের গাড়ি ছিল না। একটা প্রাইভেট গাড়ি যে ভাড়া করব, সে সামর্থ্যও ছিল না। দলের একজনকে পাঠিয়েছিলাম। ট্যাক্সি ভাড়া করে অত বড় মানুষটিকে নিয়ে সে চলে এলো আমাদের অনুষ্ঠানে। ফেরার সময় ডাঃ সরোজ গুপ্ত তাঁর নিজের গাড়িতে ওঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। একেবারে শেষ পর্যন্ত ছিলেন আমাদের অনুষ্ঠানে। গ্রিনরুমে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এবং বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডাও দিয়েছিলেন। আমাকে ওঁর ভালো লেগেছিল, সে কথা সরোজ গুপ্তকে জানিয়েওছিলেন। তারপর ফোনে একাধিকবার কথা হয়েছে ওঁর সঙ্গে। হঠাৎ শুনলাম উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ইচ্ছে ছিল গিয়ে একবার দেখে আসি। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তারপর তো উনি চলেই গেলেন। মানুষটিকে আমার খুব সাদাসিধে এবং আন্তরিক লেগেছিল। উনি যে কত বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন, সেটা ওঁর মৃত্যুর পরে ওঁর লেখা কবিতা এবং শ্রেষ্ঠ গল্প পড়তে গিয়ে বুঝেছি। সদ্য হাতে এসেছে দে’জ প্রকাশিত প্রেমেন্দ্র মিত্র রচনা সংগ্রহের প্রথম খন্ড। সিরিয়াসলি বইটি এবার পড়তে হবে।
তারপরে আরও বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে, চা বিস্কুট খাইয়েছিলেন, এসেওছিলেন আমাদের অনুষ্ঠানে। তখন আমার নিজের গাড়ি ছিল না। একটা প্রাইভেট গাড়ি যে ভাড়া করব, সে সামর্থ্যও ছিল না। দলের একজনকে পাঠিয়েছিলাম। ট্যাক্সি ভাড়া করে অত বড় মানুষটিকে নিয়ে সে চলে এলো আমাদের অনুষ্ঠানে। ফেরার সময় ডাঃ সরোজ গুপ্ত তাঁর নিজের গাড়িতে ওঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। একেবারে শেষ পর্যন্ত ছিলেন আমাদের অনুষ্ঠানে। গ্রিনরুমে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এবং বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডাও দিয়েছিলেন। আমাকে ওঁর ভালো লেগেছিল, সে কথা সরোজ গুপ্তকে জানিয়েওছিলেন। তারপর ফোনে একাধিকবার কথা হয়েছে ওঁর সঙ্গে। হঠাৎ শুনলাম উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ইচ্ছে ছিল গিয়ে একবার দেখে আসি। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তারপর তো উনি চলেই গেলেন। মানুষটিকে আমার খুব সাদাসিধে এবং আন্তরিক লেগেছিল। উনি যে কত বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন, সেটা ওঁর মৃত্যুর পরে ওঁর লেখা কবিতা এবং শ্রেষ্ঠ গল্প পড়তে গিয়ে বুঝেছি। সদ্য হাতে এসেছে দে’জ প্রকাশিত প্রেমেন্দ্র মিত্র রচনা সংগ্রহের প্রথম খন্ড। সিরিয়াসলি বইটি এবার পড়তে হবে।
বুদ্ধদেব গুহুর সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় তিন দশকের এবং অবশ্যই সেটা দে’জের ঘরে এক নববর্ষের সন্ধ্যায়। দেজের কর্ণধার সুধাংশুদাই ওঁর সঙ্গে আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ওখান থেকে আমার প্রথম শ্রুতি নাটক সংকলন ‘এক ডজন শ্রুতি নাটক’ প্রকাশ করার প্রস্তুতি চলছিল। সেখানে আমার নিজের লেখা ছয়টি শ্রুতি নাটক ছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্যিকের গল্প অবলম্বনেও আরও ছয়টি নাটক ছিল। একটি নাটক ছিল বুদ্ধদেব গুহর গল্প অবলম্বনে সাঁঝবেলাতে। সুধাংশুদা বিষয়টা জানতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লেখকের পারমিশন নিয়েছেন?’ আমি বললাম,’ না তো।’ উনি বললেন, ‘ফোনে যোগাযোগ করে একবার ওঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করুন। যাতে পরে কোনও ঝামেলা ঝঞ্ঝাট না হয়।’
তাই করলাম। উনি একদিন দুপুরে দেখা করার সময় দিলেন ওঁর অফিসে। আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন যে বুদ্ধদেব গুহ একজন খুব নামকরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টানট ছিলেন। বিরাট ফার্ম অফিস ছিল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের রাস্তায় একটি বহুতল বাড়ির দোতালায়। সম্ভবত ওয়াটার লু স্ট্রিটে। সাজানো-গোছানো বিরাট অফিস। ওঁর খাস কামরায় আমার ডাক পরল। সেটিও ভীষণ সাজানো। বুদ্ধদেবদা, পরবর্তীকালে যাকে লালাদা নামে আমরা সবাই ডাকতাম, বেশ অভিজাত মানুষ ছিলেন। চলনে-বলনে, আচার-আচরণে এবং পোশাক আশাকে। বেশ একটা জমিদারি ভাব। যেখানে বসতেন, সেখানেই একটা রাজকীয় আভিজাত্য ফুটে উঠতো। আমার সঙ্গে অল্প পরিচয় আগেই ছিল। সেটা আরেকটু ঝালিয়ে নিয়ে বললেন, ‘তোমাকে তুমি করেই বলবো। আমি কাউকে বেশিক্ষণ আপনি বলতে পারি না। কফি খাবে তো? ‘গদোগদো ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। এরপর কফি খেতে খেতে আসল কথায় এলাম। বললাম, ‘আমি আপনার ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ পুরোটাই পড়েছি। তার মধ্যে থেকে ‘সাঁঝ বেলাতে’ গল্পটি আমি বেছে নিয়েছি, যেটি আমি শ্রুতি নাট্যরূপ করতে চাই, যদি আপনি অনুমতি দেন।’ লালাদা বললেন, ‘তুমি ডাক্তার মানুষ, তোমাকে না করি কি করে! তাছাড়া তোমাকে সুধাংশু পাঠিয়েছে। কোনও রয়ালিটিওতো চাইতে পারবো না। বেশ আমি অনুমতি দিলাম। তবে লেখা শেষ হলে একবার আমাকে দেখিয়ে নিও।’ এই বলে ওঁর প্যাডের পাতায় উনি চার-পাঁচ লাইন অনুমতি পত্র লিখে দিলেন। সেটি হাতে পেয়েই আমি আসল মূর্তি ধরলাম। দন্ত বিকশিত করে বললাম, ‘দাদা আমি নাট্যরূপ অলরেডি করে ফেলেছি এবং একটি নাটকের ম্যাগাজিনে সেটি প্রকাশিতও হয়েছে। আপনি রাগ করবেন না। আমি জানতাম, আপনি অনুমতি দেবেন। এখন একটু পড়ে শোনাবো?’ বুদ্ধদেব দা চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, ‘তুমি তো দেখছি এক কাঠি সরেস। আমার এমন একটা সন্দেহ যে একেবারে হয়নি, তা নয়। যাই হোক পারমিশন তো আদায় করেই ফেলেছ। আবার চটপট নাটকটা পড়ে ফেলো। দাঁড়াও একটু পারফিউম স্প্রে করে দেই।’ এই কথা বলে দাদা কি একটা ফরাসি পারফিউম ফ্যাস ফ্যাস করে চারপাশে স্প্রে করে দিলেন। আমি শুরু করলাম নাটক পড়া। নাটক পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে ওঁর দিকে তাকাচ্ছিলাম। চোখ-মুখের মুগ্ধতাই বলে দিচ্ছিল নাট্যরূপটি দাদার পছন্দ হয়েছে।
তাই করলাম। উনি একদিন দুপুরে দেখা করার সময় দিলেন ওঁর অফিসে। আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন যে বুদ্ধদেব গুহ একজন খুব নামকরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টানট ছিলেন। বিরাট ফার্ম অফিস ছিল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের রাস্তায় একটি বহুতল বাড়ির দোতালায়। সম্ভবত ওয়াটার লু স্ট্রিটে। সাজানো-গোছানো বিরাট অফিস। ওঁর খাস কামরায় আমার ডাক পরল। সেটিও ভীষণ সাজানো। বুদ্ধদেবদা, পরবর্তীকালে যাকে লালাদা নামে আমরা সবাই ডাকতাম, বেশ অভিজাত মানুষ ছিলেন। চলনে-বলনে, আচার-আচরণে এবং পোশাক আশাকে। বেশ একটা জমিদারি ভাব। যেখানে বসতেন, সেখানেই একটা রাজকীয় আভিজাত্য ফুটে উঠতো। আমার সঙ্গে অল্প পরিচয় আগেই ছিল। সেটা আরেকটু ঝালিয়ে নিয়ে বললেন, ‘তোমাকে তুমি করেই বলবো। আমি কাউকে বেশিক্ষণ আপনি বলতে পারি না। কফি খাবে তো? ‘গদোগদো ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। এরপর কফি খেতে খেতে আসল কথায় এলাম। বললাম, ‘আমি আপনার ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ পুরোটাই পড়েছি। তার মধ্যে থেকে ‘সাঁঝ বেলাতে’ গল্পটি আমি বেছে নিয়েছি, যেটি আমি শ্রুতি নাট্যরূপ করতে চাই, যদি আপনি অনুমতি দেন।’ লালাদা বললেন, ‘তুমি ডাক্তার মানুষ, তোমাকে না করি কি করে! তাছাড়া তোমাকে সুধাংশু পাঠিয়েছে। কোনও রয়ালিটিওতো চাইতে পারবো না। বেশ আমি অনুমতি দিলাম। তবে লেখা শেষ হলে একবার আমাকে দেখিয়ে নিও।’ এই বলে ওঁর প্যাডের পাতায় উনি চার-পাঁচ লাইন অনুমতি পত্র লিখে দিলেন। সেটি হাতে পেয়েই আমি আসল মূর্তি ধরলাম। দন্ত বিকশিত করে বললাম, ‘দাদা আমি নাট্যরূপ অলরেডি করে ফেলেছি এবং একটি নাটকের ম্যাগাজিনে সেটি প্রকাশিতও হয়েছে। আপনি রাগ করবেন না। আমি জানতাম, আপনি অনুমতি দেবেন। এখন একটু পড়ে শোনাবো?’ বুদ্ধদেব দা চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, ‘তুমি তো দেখছি এক কাঠি সরেস। আমার এমন একটা সন্দেহ যে একেবারে হয়নি, তা নয়। যাই হোক পারমিশন তো আদায় করেই ফেলেছ। আবার চটপট নাটকটা পড়ে ফেলো। দাঁড়াও একটু পারফিউম স্প্রে করে দেই।’ এই কথা বলে দাদা কি একটা ফরাসি পারফিউম ফ্যাস ফ্যাস করে চারপাশে স্প্রে করে দিলেন। আমি শুরু করলাম নাটক পড়া। নাটক পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে ওঁর দিকে তাকাচ্ছিলাম। চোখ-মুখের মুগ্ধতাই বলে দিচ্ছিল নাট্যরূপটি দাদার পছন্দ হয়েছে।
এরপর দাদার কাছে আমি অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছিলাম। যখনই দেখা হয়েছে খুব আন্তরিক ব্যবহার করেছেন। দে’জ থেকে ১৯৯১-এ প্রকাশিত আমার ‘রোগটা যখন ক্যানসার’ বইটি যখন ওঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম, উনি বলেছিলেন, ‘আমি তো কালই রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি যাচ্ছি, ট্রেনেই তোমার বইটি পড়ে ফেলব এবং মতামত জানাবো।’ সপ্তাহ দু’য়েক বাদে একটি খাম ডাকযোগে এসেছিল আমার বাড়িতে। তাতে উনি ওঁর প্যাডে একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করেছিলেন আমার লেখা বইটির, যেটি আমার কাছে আজও আছে। সেই অমূল্য চিঠিটি এখানে প্রকাশ করলাম।
এমন অনেক সোনার স্মৃতি আছে দাদার সঙ্গে আমার। লালাদা খুব ভালো টপ্পা গাইতেন, সে কথা হয়তো অনেকে জানেন। আমার একাধিকবার সৌভাগ্য হয়েছে সামনে বসে ওঁর গান শোনার। প্রথম শুনেছিলাম বছর পঁচিশ আগে ক্যালকাটা ক্লাবের এক সান্ধ্য মজলিসে। পরবর্তীকালে আমাদের ইএনটি অ্যাসোসিয়েশনের প্রোগ্রামে। রীতিমতো ওস্তাদ গাইয়ে ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় এই জঙ্গল সাহিত্যিক। গানের অনুরোধ কেউ করলেই বলতেন, ‘টাকা দাও, তারপর গাইবো। অনেক কষ্ট করে গান শিখেছি। এটাও আমার প্রফেশন।’ অবশ্য মজা করেই বলতেন এসব।
এমন অনেক সোনার স্মৃতি আছে দাদার সঙ্গে আমার। লালাদা খুব ভালো টপ্পা গাইতেন, সে কথা হয়তো অনেকে জানেন। আমার একাধিকবার সৌভাগ্য হয়েছে সামনে বসে ওঁর গান শোনার। প্রথম শুনেছিলাম বছর পঁচিশ আগে ক্যালকাটা ক্লাবের এক সান্ধ্য মজলিসে। পরবর্তীকালে আমাদের ইএনটি অ্যাসোসিয়েশনের প্রোগ্রামে। রীতিমতো ওস্তাদ গাইয়ে ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় এই জঙ্গল সাহিত্যিক। গানের অনুরোধ কেউ করলেই বলতেন, ‘টাকা দাও, তারপর গাইবো। অনেক কষ্ট করে গান শিখেছি। এটাও আমার প্রফেশন।’ অবশ্য মজা করেই বলতেন এসব।
শেষ কয়েক বছর চোখে ভালো দেখতেন না। খুব কষ্ট করে সঙ্গী নিয়ে বইমেলায় লাঠি হাতে আসতেন। যত কষ্টই হোক একদিন বা দু’দিন বইমেলায় তাঁর আশা চাই-ই। দুই হাজার কুড়ির বই মেলায় তাঁর শেষ আশা। একটা ছবি এখনও চোখে ভাসে। আজ থেকে ২৬-২৭ বছর আগে, দে’জ পাবলিশিং-এর সামনে বইমেলার মাঠে সোফায় বসে উনি অকাতরে ওঁর বিক্রিত বইতে সই করছেন। সামনের টেবিলে তাঁর বিভিন্ন বইয়ের স্তুপ। সই করার পাশাপাশি অনেক পরিবারের সদ্য জাতক-জাতিকার নামাকরণও করছেন। দারুণ সুন্দর সুন্দর নাম দিতেন দাদা। তাঁর পাশে আমি গুটিসুটি মেরে বসে আছি। তখন আমারও গোটা চারেক বই বেরিয়ে গিয়েছে। ক্রেতা নেই। কেউ বই কিনে আমাকে দিয়ে সই করাতেও আসছে না। বসে বসে দাদার দিকে একটা করে বই এগিয়ে দিচ্ছি, আর উনি সই করে যাচ্ছেন। হঠাৎ দেখি একজন ক্রেতা আমার লেখা ‘গৃহিণীরা শুনছেন’ বইটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। দেখে একই সঙ্গে বিস্মিত এবং আনন্দিত হলাম, কিন্তু একটু হেসিটেটও করছিলাম। অত বড় একজন লেখকের সামনে নিজের বইয়ে সই করব কিনা! ব্যাপারটা লালাদার দৃষ্টি এড়ায়নি। মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, ‘ন্যাকামি না করে অটোগ্রাফটা দাও। দিন তোমারও আসবে। শুধু লেখাটা চালিয়ে যাও।’
প্রেমেন্দ্র মিত্র, ডাঃ সরোজ গুপ্ত এবং লেখক।
দিন এসেছে কিনা জানি না! তবে এখন বইমেলায় দে’জ পাবলিশিং-এর স্টলে গিয়ে ঘণ্টাখানেক থাকলে খান দশেক বই তো বিক্রি হয়ই এবং যথারীতি অটোগ্রাফও দিতে হয় এবং তখন ভীষণভাবে দাদার কথাগুলো মনে পড়ে। শেষদিকে ভালো দেখতে পারতেন না বলে কিছুটা আন্দাজেই বিক্রিত বইগুলোতে সই করে দিতেন। আমার লেখা ‘ডায়াবেটিসে সব খাবেন’ বইটি ওঁর হাতে বছর তিনেক আগে তুলে দিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। আশীর্বাদ করে বললেন, ‘আমি তো কিছুই পড়তে পারব না, তবে বইটি আমি আমার সংগ্রহে রাখবো।’ সেদিন কিছুক্ষণ বইয়ে সই করার পরে বললেন, ‘চলো চা খেয়ে আসা যাক।’ দে’জের অরুণ আর আমি, দাদা এবং তার সঙ্গীকে নিয়ে গিল্ডের অফিসে এলাম। দাদা খুব তৃপ্তি করে চিনি ছাড়া লিকার চা এবং ৫-৬টা ফিশ ফিঙ্গার খেলেন। বুদ্ধদেব গুহ খেতে এবং খাওয়াতে খুবই ভালোবাসতেন। এ ব্যাপারেও ছিল তার বনেদিয়ানা। ভোজন পর্ব শেষে বইমেলার গেট দিয়ে সামনের রাস্তায় বেরিয়ে ওনাকে গাড়িতে তুলে দিলাম আমরা। পিছনের সিটে ভারী অশক্ত শরীরটাকে নিয়ে একটু কষ্ট করেই বসলেন। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করতে যাচ্ছে। হঠাৎ জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘তোমার ডায়াবেটিসের বইটা কোথায়?’ আমি বললাম, ‘দাদা সামনের সিটে অন্য বই গুলোর সঙ্গে রাখা আছে।’ গাড়ি বেরিয়ে গেল জঙ্গল সাহিত্যিক, প্রকৃতিপ্রেমী বুদ্ধদেব গুহ-কে নিয়ে। সেই শেষ দেখা দাদার সঙ্গে। এর বছর খানেক বাদেই তো চির ঘুমের দেশে চলে গেলেন। লালাদার সেদিনের সেই চলে যাওয়াটাকে আমার মনে হয়েছিল, রাজকীয় প্রস্থান। সাহিত্য জগতের রাজাই ছিলেন বটে মানুষটি।