শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


মন থেকে কিছু চাইলে, মানে সিনসিয়ারলি চাইলে, সেটা নাকি সত্যিই পাওয়া যায়, এমন কথা ছোটবেলা থেকে বহু বারই শুনেছি। চেয়েছিও অনেকবার। সিনসিয়ারিটি কম থাকাতে বা না থাকাতে, প্রায় কোনও চাওয়াই পাওয়াতে পরিণত হয়নি। এবার কিন্তু হল। আমি সেই অমূল্য ধন খুঁজে পেলাম। আজ থেকে ৩২ বছর আগে ১৯৯০-এর দশই জুন তারিখে নেওয়া প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের একটি সাক্ষাৎকার। বিষয় ছিল: সিনেমার মৃত্যু দৃশ্য কেমন হওয়া উচিত! একই বিষয় নিয়ে আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম চিত্র পরিচালক তপন সিংহ-র। আমার আগের একটি লেখায়, এই দুই কিংবদন্তি পরিচালকের কাছে আমি কীভাবে পৌঁছে ছিলাম, সে সব কথা বিস্তারিত ভাবে জানিয়েছিলাম। কিন্তু এই সাক্ষাৎকার দুটি খুঁজে না পাওয়ায় সেগুলো প্রকাশ করতে পারিনি। মৃণাল সেনের সাক্ষাৎকারটি খুঁজে পেয়ে ভালোভাবে আবার পড়লাম এবং মনে হল এর একটি আর্কাইভাল এবং হিস্টরিকাল ভ্যালু আছে। আমার প্রিয় পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি এখানে প্রকাশ করলাম।
বিশ্ববরেণ্য পরিচালক মৃণাল সেনের সিনেমার যে কোনও দৃশ্য বিন্যাসেই অসাধারণ সব দিকে ডিটেলিংস থাকে। ডাক্তারি ব্যাপার, কোর্ট বা জেলখানা যাই হোক না কেন, সব ব্যাপারেই অসাধারণ যত্নবান তিনি। এসব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরাও তাঁর ছবি দেখে কদাচিৎ ভুল ধরতে পারেন। মৃণাল সেন সব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হবেন, এমনটা আশা করা অন্যায়। সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু তাঁর ছবি দেখে মাঝে মাঝে বেশ ধন্দেই পড়ে যেতে হয়, ভদ্রলোক কি সবই জানেন, সব ব্যাপারেই বিশেষজ্ঞ!

প্রসঙ্গ উঠতেই মৃণালবাবু বললেন, শুধু মৃত্যু দৃশ্য কেন, যে কোনও দৃশ্য পরিকল্পনার পেছনেই আমার নিজস্ব চিন্তাধারা থাকে। ব্যাপারটা যদি টেকনিক্যাল হয়, তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করি, যাতে ব্যাপারটা বাস্তবসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। আপনার জিজ্ঞাসা যখন সিনেমার মৃত্যু দৃশ্য, তখন আমি ‘খারিজ’ ছবিটির একটি দৃশ্যের কথা বলি। যেখানে পালান মানে বাড়ির কাজের ছেলেটি মারা গিয়েছে। রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাসে ছেলেটির মৃত্যুর কারণ হিসেবে অ্যাসপেক্সিয়া এবং কার্বন মনোক্সাইড পয়েজেনিং দুটোরই উল্লেখ আছে। আমি বিষয়টি সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জে বি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। উনি আমাকে বলেন যে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হতে পারে ঘুমের মধ্যেই। এখানে যদি পালানের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে দেখাতে হয়, তাহলে ওর ঘুম ভেঙে যাবে এবং ও বাইরে চলে আসবে অথচ আমাকে দেখাতে হবে পালান ওই রান্নাঘরেই মরে পড়ে আছে, বাইরে আসার সুযোগই পায়নি। ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব চিন্তায় পড়ে যাই।
ছবি শুরু হতে তখন মাত্র দিন ১৫ বাকি। এই অবস্থায় আমার স্ত্রী গীতা হঠাৎ মুশকিল আসানের ভূমিকা নেয়। ও বলে সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসারে রান্নাবান্নার পর উনুনের গনগনে আঁচ থাকলে সে আঁচ ফেলে দিয়ে কম আঁচে সাবান জলে কাপড় চোপড় বসিয়ে রাখা হয় পরের দিন কাচার জন্য। অর্থাৎ উনুনে সামান্য আঁচ থেকেই যায়। বন্ধ ঘরে সারারাত যদি এভাবে অল্প আঁচে উনুন জ্বলে, তবে তার থেকে ধোঁয়া বার হয়ে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস তৈরি হবে। এখন ব্যাপার হল, উনুনের অল্প আঁচ তো আর সারারাত জ্বলবে না, কিছুক্ষণ বাদেই নিভে যাবে সেজন্য আমি পালানের মৃত্যুর পর যখন দরজা ভেঙে রান্নাঘরে ঢোকা হল, তখন নিভে যাওয়া উনুনের পাশে দেখা গেল বেশ কিছু কয়লার কুচি পড়ে আছে অর্থাৎ পালান শীতের হাত থেকে বাঁচতে সারারাত ধরে যাতে উনুন জ্বলে এবং ঘর গরম থাকে সেজন্য আরও কিছু কয়লা উনুনে নিজেই দিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৪১: একটি মৃত্যু এবং কয়েকটি প্রশ্ন

মাইগ্রেনের মুক্তি সঠিক ডায়েটেই, রোজকার খাদ্যতালিকায় রাখুন এই খাবারগুলি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৯: দুঃসময়ের স্মৃতিগুলো ‘কার পাপে’? [১৫/০৮/১৯৫২]

তুষারপাতের সেই দিনগুলি, পর্ব-৬: জনমানবহীন প্রান্তর, আঁকাবাঁকা রাস্তা, এক অন্য অনুভূতি, শুধু দু’ চোখ ভরে দেখি…

ইনভেস্টিগেশন অফিসার যখন তদন্তে আসেন তখন জেরা করে জানা যায়, সেদিন বাড়ির অন্যান্যরা রাত দশটার মধ্যেই খেয়ে নিয়েছিল। পালান খেয়েছিল তারপরে। এরপরে ও শুতে যায় দরজায় খিল দিয়ে। যদি আমি দেখাতাম ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তবে তো ওর ঘুম ভেঙে যেত এবং ও গিয়ে দরজার খিল খুলে বাইরে চলে আসতো। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে পালান ওই একই ঘরে শোয়, কাজেই শ্বাসকষ্ট এবং ঘুম চোখ থাকা সত্ত্বেও ও অনায়াসেই খিল খুলে বাইরে চলে আসতে পারতো। কিন্তু বিষক্রিয়ায় যেহেতু ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে গেল, সেহেতু ব্যাপারটা বাস্তবসম্মত হল এবং রমাপদবাবুর উপন্যাসেও যেভাবে দৃশ্যটা ছিল, যে ঘর ভেঙে ছেলেটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যাবে, সে পারপাসটাও সার্ভ হল।

মৃণালবাবুর কথাবার্তা শুনে আমার তো আক্কেল গুড়ুম! একটা মৃত্যু দৃশ্য নিয়ে এই ধরনের ভাবনা-চিন্তা কেউ করতে পারেন, এ ধারণা আমার আগে ছিল না! প্রশ্ন করলাম, আপনার অন্য কোনও ছবির কোনও মৃত্যু দৃশ্য পরিকল্পনার কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে? উত্তর যেন তৈরিই ছিল, যেন গতকালই দৃশ্যটা গ্রহণ করেছেন, এমন ভাবে বলে গেলেন।

‘মৃগয়া’ ছবি করার সময়ও এ ব্যাপারে খুব খাটতে হয়েছিল, বললেন মৃণালবাবু। শেষ দৃশ্যে যেখানে মিঠুনের ফাঁসি হবে, সেই ফাঁসির ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে গেলাম জেল বিশেষজ্ঞ সাহিত্যিক জরাসন্ধর সঙ্গে। ওঁনার সঙ্গে চার দিন দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করলাম। উনি প্রথমেই জানতে চাইলেন, পর্দায় সিকোয়েন্সটা কতক্ষণের? আমি বললাম, দু’মিনিটের। উনি টেকনিক্যাল ব্যাপারে নানা পরামর্শ দেওয়ার পর আমাকে একজন জল্লাদের ঠিকানা দিয়ে বললেন যে, এই ভদ্রলোক নিজের হাতে মাস্টারদা সূর্যসেনের যে লোক দেখানো ফাঁসি হয়েছিল, সেই ফাঁসি দিয়েছিলেন। আমি ঠিকানা খুঁজে তার বাড়ি বার করলাম। কিন্তু গিয়ে শুনলাম, উনি মারা গিয়েছেন, ওঁর ছেলে এখন এই কাজ করছে। তাঁকে ধরলাম। সে জানালো, ইতিমধ্যে আঠারোটা ফাঁসি সে দিয়ে ফেলেছে। তবে বাজার খুবই মন্দা। প্রতি কেসে মাত্র ২৬ টাকা পাওয়া যায়। আজকাল ফাঁসিও খুবই কম হচ্ছে। এভাবে আর চলে না। পেশা পাল্টাতে হবে।
আমি ওই জল্লাদ ভদ্রলোককে আমার ছবির ওই দৃশ্যের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার করলাম। তিনি মিঠুনকে পাখি পড়া করে সব বোঝালেন, নিজে করেও দেখালেন। মিঠুন ঠিক সেভাবেই করল। কিন্তু ছবি রিলিজের পর একজন চিত্র সমালোচক দেখলাম তার পত্রিকায় প্রশ্ন তুলেছেন ওই দৃশ্যে মিঠুন কেন নতুন জামা কাপড় পরলো, কেন চুল আঁচড়ে বাবুটি সেজে ফাঁসি নিতে গেল… ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে বাস্তবে ব্যাপারটা কীভাবে হয় সে বিষয়ে সামান্যতম জ্ঞান না থাকার জন্যই উনি এসব কথা লিখেছিলেন। ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়াতে বললাম, লেখার আগে বিষয়টা জানার জন্য আমাকে একটা ফোন করলেও তো পারতেন! তা এই তো ব্যাপার-স্যাপার। সিরিয়াসলি এসব নিয়ে আর কজন ভাবেন বলুন তো!

ব্যক্তিগত জীবনে মৃত্যুকে কীভাবে গ্রহণ করেন, এ কথা জানতে চাইলে মৃণালবাবু শোনালেন তাঁর বাবার মৃত্যুর কথা। কত গভীর উপলব্ধি এবং জীবনকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতার অধিকারী হলে মৃত্যুকে এ ভাবে গ্রহণ করা যায়, তার সঙ্গে রিঅ্যাক্ট করা যায়, তা মৃণাল সেনের মুখেই শুনুন।
আমার বাবার জীবনের শেষ কয়েক বছর ওঁনার সঙ্গে নানা কারণে আমার যোগাযোগ কম ছিল। রাত দুটোয় উনি মারা গেলেন, আমি ভোর ছটায় গিয়ে পৌঁছলাম। দেখি, মা পাষাণ প্রতিমার মতো বসে আছেন বাবার মৃতদেহর সামনে। মায়ের চোখের সব জলই তখন শুকিয়ে গিয়েছে। আমি মায়ের ওই অবস্থা দেখে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম। প্রিয়তমজনের মৃত্যু একটা মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ এবং বিধ্বস্ত করতে পারে, মাকে দেখে আমি সেদিন তাই বুঝেছিলাম এবং সেটাই আমার কান্নায় ভেঙে পড়ার কারণ। তারপর বাবাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল। তখন ইলেকট্রিক চুল্লি ছিল না। কাঠ দিয়ে পোড়ানো হল খোঁচাখুঁচি করে। বীভৎস সেই দৃশ্য! তবু আমার একটুও ভাবান্তর হল না। খুব সহজভাবেই সব নিচ্ছিলাম। বাড়ি ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে ৭-৮ ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে। শোক অনেকটাই সংযত হয়ে এসেছে। আমরা সব ঘরে বসে আছি। হঠাৎ দেখি মা আস্তে আস্তে উঠে টেবিলের সামনে গিয়ে দু’হাত দিয়ে ধরে ঝুকে দাঁড়ালেন, তারপরেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। মায়ের সামনে টেবিলের উপর বাবার টুথব্রাশে, মা আগের দিন রাতে যে পেস্ট লাগিয়ে রেখেছিলেন, সেটা সেভাবেই পড়ে আছে। শুধু মানুষটাই আর নেই।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৯: কলকাতায় মাঝপথে পড়াশোনা থামিয়ে মুম্বইয়ের ট্রেন ধরলেন অশোককুমার/১

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৭: রান্নাবান্নার ঠাকুরবাড়ি

যোগা-প্রাণায়াম: পেটের মেদ নিয়ে চিন্তিত? এই ৫টি যোগাসনে মিলবে সুফল

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি

মৃণাল বাবুর এই ঘটনা শুনে আমি যেমন কিছুক্ষণের জন্য কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তেমনি উনিও। সামলে নিয়ে বলে উঠলেন, কোনও মৃত্যুকেই যে মারা গেল, তার আসপেক্টে আমি দেখি না, দেখি চারপাশের লোকজনের রিঅ্যাকশনের আসপেক্টে। কেউ মারা গিয়েছে শুনলেই তার পরিবার, পরিচিত লোকজন, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক, তার সামাজিক অবদান… এইসব কথাগুলোই আমার আগে মনে পড়ে। ছবিতে খুব ভিভিডলি মৃত্যু দৃশ্য দেখানোর পক্ষপাতি আমি নই। বরং মৃত্যুটা কি পারপাস সার্ভ করছে সেটাই আমার কাছে বড় কথা। আমি চাই মৃত্যুদৃশ্য হয়ে উঠুক বাস্তবসম্মত শিল্প।

অন্য কোনও পরিচালকের কোন ছবির মৃত্যু দৃশ্য নিয়ে মন্তব্য করবেন? উত্তর পাব না ধরে নিয়েই মৃণালবাবুকে শেষ প্রশ্নটি করেছিলাম। এবারও অবিচল মৃণালবাবু। বললেন, আমার দেখা সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম সেরা ছবি ‘অপরাজিত’। যে ছবির প্রতিটি দৃশ্যই আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়, শুধু একটি দৃশ্য ছাড়া। সেটি হল হরিহরের মৃত্যু দৃশ্য। হরিহর ‘আ আ’ করে হঠাৎ পড়ে গেলেন। ব্যাপারটা আমার ভীষণ লাউড মনে হয়েছে। বরং অপুর গুরু দশা, গঙ্গার ঘাট, পাখি উড়ে যাচ্ছে… এসব অনেক ইমোশনালি মৃত্যুকে এক্সপ্রেস করেছে বলে আমার মনে হয়েছে।

১৯৯০ সালের আনন্দলোক পুজো সংখ্যায় ‘সিনেমার মৃত্যু দৃশ্য কেমন হওয়া উচিত’ শিরোনামে এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল। সঙ্গে ছিল আরেক কালজয়ী চিত্র পরিচালক তপন সিংহ-র এই ব্যাপারে বক্তব্য। এই দুই মহান স্রষ্টাকে প্রণাম জানাই। প্রণাম জানাই প্রয়াত সাহিত্যিক এবং তৎকালীন আনন্দলোক পত্রিকার সম্পাদক দূলেন্দ্র ভৌমিককেও।

Skip to content