রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


টিকটিকি নাটকের একটি দৃশ্য।

নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয় আমার। এক জীবনের মধ্যে তিন তিনটি জীবন পেয়েছি আমি। চেটেপুটে তাকে উপভোগ করেছি, এখনও করছি। ডাক্তারি জীবনে ডাঃ আবিরলাল মুখোপাধ্যায়, ডাঃ শান্তনু বন্দোপাধ্যায়, ডাঃ সুনীল ঠাকুর, ডাঃ অবনী চন্দ্র, ডাঃ আর এন চট্টোপাধ্যায়, ডাঃ রণবীর মুখোপাধ্যায়, ডাঃ এস পি ঘোষ, ডাঃ সরোজ গুপ্ত, ডাঃ মনীশ প্রধান-সহ বহু বিখ্যাত ডাক্তারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছি। লেখালেখির জীবনে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, দুলেন্দ্র ভৌমিক, দিব্যেন্দু পালিত, নিমাই ভট্টাচার্য, শংকর, বুদ্ধদেব গুহ, সুজন চন্দ, দীপক চন্দ্র-সহ অনেকের সঙ্গেই আন্তরিক সম্পর্ক আমার। আমার লেখক জীবনকে নানাভাবে এরা লালন-পালন করেছেন। অভিনয় জগতে যাদের স্নেহ সান্নিধ্য পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে মাধবী চক্রবর্তী, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, তরুণ মজুমদার, হরনাথ চক্রবর্তী, দীপঙ্কর দে, প্রসেনজিৎ, সব্যসাচী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, পরান বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম।

সৌমিত্রদার সঙ্গে আমার প্রায় চার দশকের সম্পর্ক হলেও, মাত্র চারটি সিনেমায় তাঁর সঙ্গে আমি কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। প্রথম সিনেমাটির নাম ছিল সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ‘অগ্নিসংকেত’। আমি এই সিনেমায় এক অকিঞ্চিৎকর রোল করেছিলাম এক হোটেল মালিকের ভূমিকায়। বলা যায়, আমার ওখানে উপস্থিতি ছিল পলক দর্শন। একটু বড় কাজ করার সুযোগ পাই জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সিনেমা ‘বালিগঞ্জ কোর্ট’-এ। ফ্ল্যাট বাড়ির গল্প নিয়ে এই ছবি, যেখানে অধিকাংশ দম্পতির সন্তানেরা বিদেশে থাকেন, মা-বাবা তাদের ছেড়ে নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। দাদার সঙ্গে একটি দৃশ্যে সুন্দর সংলাপ বিনিময় করার সুযোগ হয়েছিল এই সিনেমায়। তাছাড়া মমতাশঙ্কর, তনুশ্রী শংকর, সব্যসাচী চক্রবর্তী, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ের মত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে এই সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।

সৌমিত্রদা যখন এই ছবিতে কাজ করছেন তখন তাঁর বয়স সত্তরোর্ধ্ব। সদ্য প্রস্টেট ক্যানসার ধরা পড়েছে। চিকিৎসা করানোর জন্য বাইরে যাবেন, কানাঘুষো শুনছিলাম। প্রতিদিন লাঞ্চের পরে আমি দেখতাম, বেনুদা অর্থাৎ সব্যসাচী চক্রবর্তী ড্রেসারের কাছ থেকে কিছু জিনিসপত্র চেয়ে নিয়ে দাদার জন্য একটা সুন্দর বিছানা বানিয়ে, তাঁকে অনুরোধ করতেন বিশ্রাম নিতে। দাদা প্রথমে না-না করতেন, তারপর ওখানে শুয়েই একটু ঘুমিয়ে নিতেন। সিনিয়র ফেলুদার প্রতি জুনিয়র ফেলুদার এমন শ্রদ্ধা দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। বেনুদাও এটা করে ভীষণ পরিতৃপ্তি লাভ করতেন। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে আমরা দাদাকে ঘিরে বসতাম। তাঁর অভিনয় জীবনের নানা গল্প শুনতাম এবং সেই গল্পের মধ্যে এমন সরসতা মেশানো থাকতো যে না হেসে আমাদের উপায় থাকত না। উত্তম কুমার, ভানু বন্দোপাধ্যায়, রবি ঘোষ এবং অনুপ কুমারের কথা বারেবারেই বলতেন।

বালিগঞ্জ কোর্ট সিনেমায়

আমাদের সবার মতো দাদাও ছিলেন উত্তম কুমারের ফ্যান। একবার বলেছিলেন, উত্তম কুমারের সংস্পর্শে এলে, তার প্রেমে পড়তেই হবে, সে পুরুষ নারী যিনিই হোন না কেন! এমনই মোহময় আকর্ষণ ছিল উত্তম কুমারের। সৌমিত্রদার কথা যে একশো ভাগ সত্যি ছিল সে প্রমাণ তো আমি আগেই পেয়েছিলাম। ভানু বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা মজার গল্প বলেছিলেন একবার। ভানু, অনুপ কুমার এবং সৌমিত্রদা একবার কোনও বিখ্যাত পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন সম্ভবত পান-সিগারেট কেনার ফাঁকে। একজন যুবক এসে ভানুদার পিছনে লাগার জন্য একাধিকবার তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলেন, দাদা কেমন আছেন। ভানুদা তিনবার-চারবার উত্তর দিলেন, হ্যাঁ ভালো আছি। কিন্তু সেই যুবকের একই প্রশ্ন, ভানুদা কেমন আছেন! চার-পাঁচবার উত্তর দেওয়ার পর ভানুদা খেপে গিয়ে বললেন, ভালো নাই রে ভাই, তর মায়েরে রাইতে পাঠাইয়া দিস আমার ঘরে, যদি আমারে ভালো রাইখতে চাইস। বলাইবাহুল্য এমন উত্তর শুনে সেই যুবক লজ্জা পেয়ে তখনই কেটে পড়েছিল।

দাদার সঙ্গে পরের ছবি আমার ‘পুনশ্চ’। পরিচালক ছিলেন শৌভিক মিত্র, যিনি একসময় ঋতুপর্ণর প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। গল্পটা সংক্ষেপে বলি: একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার আনতে দিল্লি গিয়েছিলেন। কাউকে না জানিয়ে পুরস্কার পাওয়ার পরই হঠাৎ তিনি ফিরে আসেন তার শহর কলকাতায় এবং এসে ওঠেন তার যৌবনের প্রেমিকার বাড়িতে, যাকে তিনি বহুদিন আগে কথা দিয়েছিলেন সুযোগ পেলে একটি রাত তিনি তার সঙ্গে কাটাবেন। এই প্রৌঢ় বয়সে এসে সে সুযোগ মিলল। প্রেমিকা নিজের হাতে রান্না করে তার প্রেমিককে খাওয়ালেন, সেবা-যত্ন করলেন। কিন্তু মাঝরাতে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে সাহিত্যিক- প্রেমিকের মৃত্যু হল সেই প্রেমিকারই বাড়িতে এবং প্রতিবেশী ডাক্তার হিসেবে আমার সেখানে ডাক পড়ল। এমন সেলিব্রেটির আচমকা মৃত্যুর ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে সেই ডাক্তার বাবু ওরফে আমি অস্বীকার করলাম। তারপর আরও অনেক ঘটনার ঘনঘটা ছিল। সাহিত্যিকের চরিত্রে সৌমিত্রদা এবং প্রেমিকার চরিত্রে রূপা গঙ্গোপাধ্যায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃতও হয়েছিল।

শুটিং হয়েছিল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। শুটিংয়ের দিন আমি সকালে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে আমার মেকআপ রুমে গিয়ে বসলাম। শুনলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও সেই মেকআপ রুমে বসবেন। আমি প্রোডাকশন ম্যানেজার প্রদ্যুৎকে জিজ্ঞাসা করলাম, সৌমিত্রদা জানেন যে তাঁর সঙ্গে আমি একই মেকআপ রুম শেয়ার করব। প্রদ্যুৎ বলল, হ্যাঁ জানেন। তুমি দাদার সঙ্গে থাকবে জেনে দাদা খুশি হয়েছেন। আমি মেকআপ করে বসে আছি। একজন এসে খবর দিলেন, দাদা এসেছেন। আমি দাদার সঙ্গে দেখা করব বলে শ্যুটিং ফ্লোরের কাছে আসতেই দেখি দাদা বাইরে এক চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন, পরনে লাল টকটকে একটা গেঞ্জি। আমাকে দেখেই হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, এই যে অমিতাভ, কী শুরু করেছে বলতো! টিভি খুললেই দেখি, কোনও না কোনও চ্যানেলে তোমাকে কখনও ডাক্তারি আলোচনায়, কখনও বা সিরিয়াল-সিনেমায়। তুমি আমাদের ভাত মারবে নাকি এই বয়সে! আমি হাঁটু মুড়ে দাদার সামনে বসে পড়ে বললাম, ছিঃ দাদা কি যে বলেন! বেশ কিছুক্ষণ ইয়ার্কি ঠাট্টা হল।

৫০ টি শ্রুতি নাটক বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছিলেন দাদা।

মেকআপ নিয়ে পোশাক পরার পর দাদার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ নাটক নিয়ে কথা হল মেকআপ রুমে। তাঁর নাট্যগুরু শিশিরকুমার ভাদুড়ির সংস্পর্শে উনি কীভাবে এসেছিলেন, কী কী শিখেছিলেন… ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে প্রায় এক তরফাই বলে গেলেন আমার মতো একনিষ্ঠ এক শ্রোতাকে। আমি হ্যাঁ-হুঁ করে সংগত করার চেষ্টা করলাম। এই আলোচনায় একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা দাদা বলেছিলেন। দেখ, গ্রুপ থিয়েটার-বাণিজ্যিক থিয়েটার বলে কিছু হয় না। সব থিয়েটারেরই মূল উদ্দেশ্য থাকে বেশি বেশি করে দর্শকের কাছে পৌঁছনো এবং অবশ্যই টাকা রোজগার করা। টাকা না এলে থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কীভাবে! আমার কাছে থিয়েটার দু’ রকমের, গুড থিয়েটার অ্যান্ড ব্যাড থিয়েটার। এখনও নাটক করার সময় দাদার এই উপদেশটা আমি ভীষণভাবে মেনে চলি।

ফ্লোরে ঢুকে দাদা শুয়ে পড়লেন বিছানায়। আমি মাথার সামনের চেয়ারে বসলাম। দাদা বললেন, প্রেসার মাপার যন্ত্রটা থাকলে একবার মাপ তো দেখি। আমি মেপে বললাম, উপরেরটা একটু বেশি আছে, নিচেরটা ঠিকই আছে। বুকে স্টেথো বসিয়ে দেখলাম, দাদার বুক জুড়ে হাঁপরের ওঠানামার শোঁ শোঁ শব্দ, ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে ‘রনকাই’। এককথায় দুটো বুকই ঝাঁজরা। দাদা হেসে বললেন, ৫৫ বছর টানা সিগারেট খেয়েছি, এত বিষ যাবে কোথায়!

লাঞ্চ ব্রেকে মেকআপ রুমে ফিরে এসে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করার পর দাদার কাছে একটা আবদার করে বসলাম। আমার লেখা প্রথম শ্রুতি নাটকের বইয়ের নাম ছিল ‘এক ডজন শ্রুতি নাটক’, যেটি দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইয়ে একটি সুন্দর মুখবন্ধ লিখেছিলেন সৌমিত্রদা। এবার সেই দে’জ থেকেই আমার ৫০টি শ্রুতি নাটকের সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে। আমি দাদাকে অনুরোধ করলাম, সেই বইটিরও ভূমিকা লিখে দেওয়ার জন্য। দাদা রাজি হলেন। আগের বইটিতে উনি কী লিখেছিলেন, সেটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর আমার এগিয়ে দেওয়া পেন এবং প্যাড নিয়ে খাওয়ার টেবিলেই বসে গেলেন লিখতে। লেখা শেষে বললেন, পড়ে দেখ, ঠিক আছে তো? ছোট্ট কথায় সুন্দর বিশ্লেষণ করেছিলেন, আমাকে এবং আমার লেখা নাটককে। এই সবকিছুই আমার জীবনে অমূল্য স্মৃতি হয়ে রয়ে গিয়েছে।

সৌমিত্রদার সঙ্গে আমার করা শেষ ছবি হল প্রভাত রায়ের ‘বিরাট বাইশ’। দেখানো হয়েছিল জি বাংলা সিনেমায়। বছর আটেক আগে শুটিং হয়েছিল জোকার নারায়ণী স্টুডিওতে। আমি পৌঁছনোর একটু পরে দাদা শ্যুটিং লোকেশন এসে প্রভাত রায়কে বললেন, প্রভাত, আসল ডাক্তার পেয়ে গিয়েছ, সিনটা ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে নাও। আমি যথারীতি ডাক্তারের ভূমিকায় ছিলাম। আর সৌমিত্রদা ছিলেন এক অসহায় দাদুর ভূমিকায়, যাঁর নাতনি গ্যাং রেপড হয়ে আমার নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছে। ছোট্ট সিন ছিল। খুব তাড়াতাড়ি শুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি সৌমিত্রদার মেকআপ রুমে গিয়ে ঢুকলাম। দু’ জনে নানা বিষয়ে কথা তো হলই, পাশাপাশি উনি তাঁর একটি ব্যাগ থেকে প্রচুর ওষুধ বার করে আমার সামনে মেলে ধরলেন। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, আপনাকে এত ওষুধ খেতে হয়! দাদা বললেন, তুমি একটু বেছে দাও না। যেগুলো না খেলেই নয়, শুধু সেগুলোই খাব। এত ওষুধ আর খেতে পারছি না। খুব খারাপ লেগেছিল আমার প্রিয় অভিনেতার এই কথা শুনে। আমি আমার সামান্য বুদ্ধিতে যেটুকু পেরেছিলাম, বেছে দিয়েছিলাম। তিন-চারটে ওষুধ কমিয়ে দিয়েছিলাম। আর তাঁর অনুরোধে কীভাবে ইনহেলার নিতে হয়, সেটা ডেমনস্ট্রেট করে দেখিয়ে দিয়েছিলাম। বাধ্য ছাত্রর মতো সেটা দেখার পর দাদা নিজেও প্র্যাকটিস করে নিলেন। মেডিকেলের ব্যাপারে দাদার ছিল অপরিসীম কৌতুহল। একসময় এই কৌতুহল শুভেন্দুদা মেটাতেন। পরবর্তীকালে আমি এবং আরও দু’-একজন অল্প বয়সী ডাক্তার।

বিরাট বাইশ সিনেমার সেটে

আমার গল্প এবং চিত্রনাট্যে সৌমিত্রদা একটি টেলিফিল্মে অভিনয় করেছিলেন। আমার জীবনে এ এক পরম প্রাপ্তি যে আমার লেখা সংলাপ পর্দায় উচ্চারণ করেছিলেন এই মহান শিল্পী। ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি। রানা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার খুব স্নেহভাজন একজন অভিনেতা এবং পরিচালক। ‘বিষ’ নামে আমার একটি গল্প একদিন তাঁকে শুনিয়েছিলাম। তার ভালো লেগেছিল। বলেছিল, সুযোগ পেলে এটা নিয়ে কাজ করবে। জি বাংলায় তখন প্রতি সপ্তাহে একটি করে একঘণ্টার টেলিফিল্ম দেখানো হতো। একদিন রানা ফোন করে বলল, ও জি বাংলার জন্য কিছু টেলিফিল্ম তৈরি করবে, তার মধ্যে আমার বিষ গল্পটিকে ও রেখেছে। আমি যেন চট করে একটা চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলি। আমি ওকে বললাম, এর আগে আমার অনেকগুলো গল্প নিয়ে টেলিফিল্ম হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমি তো নিজে সেগুলোর কোনওটাই চিত্রনাট্যের জন্য তৈরি করিনি। আমি কি পারব! রানা বলল, আলবাৎ পারবেন, নেমে পড়ুন। তিনদিনের মধ্যেই চিত্রনাট্য রেডি করে ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ও বলল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মূল চরিত্র অর্থাৎ ক্যানসার রোগীর চরিত্রে অভিনয় করবেন। শুনে তো আমার অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা!

গল্পের মূল চরিত্র বৃদ্ধ অজিতবাবুর ছিল গলার ভোকাল কর্ডে ক্যানসার, অ্যাডভানসড স্টেজ। এজন্য গলার সামনের দিকে ফুটো করে ট্রাকিওস্টোমি অপারেশন করা হয়েছিল। এই চরিত্রটিই করেছিলেন সৌমিত্রদা। মাস কয়েক আগে আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন সেরিব্রাল অ্যাটাকে। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। ট্রাকিওস্টোমি করে ভেন্টিলেশন থেকে বার করে বাড়িতে এনেছিলাম বাবাকে। বাবার মৃত্যুর পর একদম অব্যবহৃত একটি ট্রাকিওস্টোমি টিউব আমার কাছে থেকে গিয়েছিল। টিউবের যে অংশটি গলার দিকে ঢুকানো থাকে সেটি কেটে আমি সৌমিত্রদার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলাম। দাদা আমার কাছ থেকে ভালো করে শিখে নিলেন, কীভাবে আঙুল দিয়ে টিউবের সামনের দিকটা বন্ধ করে কথা বলতে হয়, কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে কাশতে হয়, কফ আটকে গেলে কী অবস্থা হয়… ইত্যাদি নানা খুঁটিনাটি। ক্যানসার কী, কেন, কীভাবে হয় ইত্যাদি নানা বিষয়ও আমাকে জিজ্ঞেস করে ভালো করে জেনে বুঝে নিলেন। তারপর পর্দায় সেটি এমন নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন যে দেখে মনে হচ্ছিল, উনি নিজে একজন ভোকাল কর্ড ক্যানসারের সত্যিকারের রোগী। কী ডেডিকেশন ওই বৃদ্ধ বয়সেও, ভাবা যায় না! আমি এই টেলিফিল্মে তাঁর স্বার্থপর বড় ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। কত মধুর সব স্মৃতি! আমার লেখা সংলাপ বলেছিলেন দাদা এই টেলিফিল্মে, আমার ট্রেনিংয়ে অভিনয় করেছিলেন, এই অহংকার আমৃত্যু সঙ্গী হয়ে থাকবে আমার।

সেদিন যা ছিল অভিনয়, বেলভিউ নার্সিংহোমে দাদাকে সেই ট্রাকিওস্টোমি করেই বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করা হয়েছিল মৃত্যুর দিন দশেক আগে। আমি বা দাদা কেউ কি স্বপ্নেও ভেবেছিলাম, তেরো বছর আগের ট্রাকিওস্টোমি টিউব পরে অভিনয় কীভাবে বাস্তবের সঙ্গে মিলে যেতে পারে! বড্ড কষ্ট পেয়েছিলেন দাদা। আমিও যতবার কাকতলীয় এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি, ততবারই ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।

নাটকটাও ছিল দাদার প্রাণ। কত যে নাটক দেখেছি তাঁর। আমার দেখা দাদার সেরা অভিনয় ‘টিকটিকি’ নাটকে। তারপর নাম করব ‘কিং লিয়র’। দাদার শেষ অভিনয় দেখেছি তপন থিয়েটারে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘ছাড়ি গঙ্গা’ নাটকে। একটা মজার ঘটনা বলে এই লেখা শেষ করি। ২৫-২৬ বছর আগের ঘটনা। মনোজ মিত্রর ‘দর্পণে শরৎশশী’ নাটকটি তপন থিয়েটারে তখন অভিনয় করছেন দাদা। আমার মেয়ের বয়স তখন সাত থেকে আট হবে। ওকে নিয়ে সপরিবারে নাটক দেখতে গিয়েছি। নাটক শুরুর আগে দাদার সঙ্গে দেখা করে টিকিট সংগ্রহ করলাম। দাদা মেয়েকে একটু আদর করলেন, বললেন, ও যদি নাটক চলাকালীন কোনও ডিস্টার্ব করে, তাহলে তুমি ওকে নিয়ে হলের বাইরে চলে যাবে। বৌমা একাই নাটক দেখবে। মেয়ে কোনও ডিস্টার্ব করেনি। হাফ টাইমে আবার মেয়েকে নিয়ে দাদার সঙ্গে দেখা করলাম। দাদা বললেন, একশোতে পঞ্চাশ পেয়েছে ও, নাটক শেষ হলে আর একবার এস। নাটক শেষে ওর গাল টিপে দিয়ে বলে উঠলেন, তুই একশোতে একশোই পেলি। পরবর্তীকালে আমার মেয়ে যখন ডেন্টাল সার্জেন হল, দাদার সঙ্গে দেখা হলেই রসিকতা করে বলতেন, তোমরা বাপ-বেটি মিলে দেহের উপরের পুরোটাই তো নিয়ে নিলে। আমার ডাক্তারির বিষয় ছিল কান নাক গলা আর ওঁর দাঁত। আরেকটা কথা দাদা প্রায়ই বলতেন। আমার প্রতি বছরই দে’জ পাবলিশিং থেকে নতুন বই বার হয়। সেই বইটি যখন দাদার হাতে তুলে দিতাম, দাদা সহাস্যে বলতেন, অমিতাভ তোমার বইয়ের সেঞ্চুরি হতে আর কত দেরি! দাদা অবশ্য আমার বইয়ের হাফসেঞ্চুরি দেখে গিয়েছেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে স্নেহ ছায়া পেয়েছি এই মহান অভিনেতার। নিজেকে তাই ভাগ্যবান বলেই মনে করি।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে


Skip to content