শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে

এই লেখা কোথা থেকে শুরু করব আর কোথায় যে শেষ করব, ভাবতে ভাবতেই অনেকগুলো দিন কেটে গেল। এক বিরাট সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে যেমন তার ঢেউ গোনার চেষ্টা পাগলামি ছাড়া কিছু নয়, ঠিক তেমনি এই ছোট্ট পরিসরে আমার মতো অতি ছোট মানুষের পক্ষে তাকে পরিমাপ করাও নিতান্ত ছেলেমানুষি। বরং এই চার দশকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বহুমুখী প্রতিভার সঙ্গে কাটানো অসংখ্য স্বর্ণালি মুহূর্তগুলোর কথা সবার সঙ্গে একটু ভাগ করে নিতে চাই, এই লেখার মাধ্যমে। দাদার প্রতি এটাই আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আগে অনেকবারই বলেছি আমার মেডিকেল ছাত্রাবস্থা কেটেছে আর জি করে। এই মেডিকেল কলেজে ডাক্তারিপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলা সব ব্যাপার নিয়েই বেশ মাতামাতি ছিল। হ্যাঁ রাজনীতি নিয়েও। অভিনেতা দিলীপ বসুর সূত্রে আমার এই কলেজ জীবনেই টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় যাতায়াত শুরু হয়। সালটা ছিল ১৯৭৮। এর আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে তরুণ মজুমদারের ‘সংসার সীমান্তে’ সিনেমার শুভ মহরত অনুষ্ঠানে দেখেছি। কিন্তু পরিচিত হবার সুযোগ পাইনি। একদিন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফি হাউসে দিলীপদাকে কথাটা বলতেই উনি বললেন, তাহলে চল একদিন পুলুদা-র নাটক দেখে আসি। সেখানে তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। আমি আগেই জানতাম যে সৌমিত্রদার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মধ্যে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন দিলীপদা। তখন কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘নাম জীবন’ নাটকটি চলছিল। এক শনিবার ইভিনিং শো-তে দিলীপদা আমাকে নিয়ে গেলেন নাটক দেখাতে। নাটক শেষে গ্রিন রুমে নিয়ে গিয়ে আমার সঙ্গে সৌমিত্রদার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই প্রথম মানুষটিকে এত কাছ থেকে দেখলাম। খালি গায়ে মেকআপ তুলছিলেন। টুকটাক দু’চারটে কথা হল। অবশ্যই ভালো লাগল। কিন্তু উত্তমকুমারকে দেখে যে তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছিলাম, সেরকম কোনও অনুভূতি কিন্তু হল না। তবে প্রথম আলাপচারিতায় মানুষটিকে বেশ মাটির কাছাকাছি বলেই মনে হল। তারকাসুলভ কোনও গ্ল্যামার চোখে পড়ল না। আমি ছাড়াও অনেকের সঙ্গেই বেশ আন্তরিকভাবেই কথাবার্তা বলছিলেন, হাসিঠাট্টা করছিলেন।

জায়ান্টের মুখোমুখি বালিগঞ্জ কোর্ট সিনেমায়।

এই ক্ষীণ পরিচয়ের সূত্র ধরেই একদিন সকালবেলা সৌমিত্রদার লেক রোডের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তখনও দাদা গলফ গ্রিনে নতুন বাড়ি করে উঠে আসেননি। আমি সেই প্রথম ‘বিতর্ক’ নামে একটি পত্রিকা নিজের উদ্যোগে ছাপতে চলেছি। এর আগে আর জি করে এবং পাড়ার ক্লাবে দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করেছি। কিন্তু ছাপা পত্রিকা এই প্রথম। আমার একটা বাজে দোষ হল, জীবনে যখনই কোনও কাজ প্রথমবারের জন্য করতে গেছি, সব সময় একটু বড়সড় করেই সেটা করতে চেয়েছি। করতে গিয়ে কখনও সফল হয়েছি, কখনও চূড়ান্ত ল্যাজেগোবরে হয়েছি। প্রথমবার পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে তাই ভাবলাম, কিছু ভিআইপি-র লেখা জোগাড় করতে হবে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে মাঝেমধ্যে কবিতা লেখেন, সেটা আমি জানতাম, বিশেষ করে লেখেন লিটল ম্যাগাজিনে। এও জানতাম, কাউকেই তিনি এ ব্যাপারে সচরাচর বিমুখ করেন না এবং কোনও অর্থও দাবি করেন না। সেই আশাতেই সরাসরি দাদার কাছে এসে পড়া। একজন দরজা খুলে দিয়ে বসতে বললেন। একটু বাদে দাদা এসে জানতে চাইলেন, কী অভিপ্রায়ে আগমন। আমি পরিচয় দিতেই আমাকে চিনতে পারলেন। সব শুনে বললেন, এবার একটি মফস্বল পত্রিকা আমার কবিতা চেয়েছে। ওদের জন্য কালকেই একটি লিখেছি। তুমি এটাই নিয়ে যাও। আমি ওদের পরে লিখে বাই পোস্টে পাঠিয়ে দেব।

এ তো মেঘ না চাইতেই জল! দিলীপ বসুর নাম এবং আমি মেডিকেল স্টুডেন্ট—এই দুটো লাক ফ্যাক্টর কাজ করে যাওয়াতে আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্যাডের পাতায় লেখা কবিতাটি পকেটস্থ করে প্রায় লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ফুটপাতে এসে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে কবিতাটি বার করে খুব মন দিয়ে পড়লাম। কবিতার নামটি এই চুয়াল্লিশ বছর পরেও আমার মনে আছে: ‘এইখানে দুঃখ কেন তবু’। বারো লাইনের ছোট্ট মিষ্টি একটি কবিতা। শুধু দাদার কবিতা নয়, আমার এই মাত্র তিন ফর্মার চটি পত্রিকাটিতে গজেন্দ্রকুমার মিত্রর গল্প, শঙ্কু মহারাজের ভ্রমণকাহিনি, আকাশবাণীর প্রদীপ মিত্রর ছড়া এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের একটি ইন্টারভিউও আমি প্রকাশ করেছিলাম। আমার ২৪ বছর বয়সে সেটা একটা দুঃসাহসিক প্রচেষ্টাই ছিল বটে।

না থেকেও তিনি ভীষণভাবে আছেন আমাদের মধ্যেই।

আর এর পর থেকেই নানা কারণে-অকারণে আমি সৌমিত্রদাকে বিরক্ত করে গেছি ক্রমাগত। কোনও সময় পাড়ায় নাটক উপলক্ষে প্রকাশিতব্য সুভিনিয়রের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা, কখনও রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে বা ছেলেবেলার পুজো কেমন ছিল—ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে দাদাকে ইন্টারভিউ। এগুলো সেই সময় আজকাল, সত্যযুগ, গণশক্তি-সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেটা অবশ্য আমার জন্য নয়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-সহ বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির ইন্টারভিউয়ের সৌজন্যে। তখনও মোবাইলের যুগ আসেনি। গত শতাব্দীর পুরো আশির দশকটা জুড়েই, হঠাৎ করেই দাদাকে ল্যান্ডলাইনে আমি ফোন করে বসতাম। প্রায় সময় দাদা নিজেই ফোন ধরতেন এবং আমি নিজের নাম বলতেই, সস্নেহে বলতেন, বলো ভাই। আমি এখনও ভেবে পাই না, এমন একজন ব্যস্ত এবং বিখ্যাত মানুষ আমার এত আবদার সেই সময় সহ্য করতেন কেন! উনি তো তখন জনপ্রিয়তার মধ্যগগনে। চুটিয়ে নাটকও করছেন। যে হলেই দাদার নাটক হোক না কেন, আমি একাধিকবার একা কিংবা দোকা হয়ে তখন সেই নাটক দেখতে যেতাম। না টিকিট কেটে নয়, দাদার সৌজন্যে নাটক শুরুর আগে গ্রিন রুমে গিয়ে দাদার কাছ থেকেই আমার টিকিট সংগ্রহ করতাম। কখনও সেই টিকিট রাখা থাকত মেকআপ রুমে বসে তুমুল আড্ডায় রত রবি ঘোষের কাছে। দাদার নাটক দেখতে গিয়েই কিন্তু রবি ঘোষের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং পরবর্তীকালে ওঁকে নিয়ে শ্যুটিং। সে গল্প পরে একদিন বলব। নাটক শেষে দাদার সঙ্গে দেখা করতে গেলেই, উনি নাটক কেমন লাগল জানতে চাইতেন। আমি আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের বোধ-বুদ্ধি মিশিয়ে কিছু মতামত দিতাম। একবার বিজন থিয়েটারে (বর্তমানে প্রোমোটারের কল্যাণে সেটি ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে) কোনও একটি নাটক দেখার শেষে যথারীতি দাদা আমার কাছে মতামত চেয়েছেন। আমিও পাকা পাকা এবং বোকা বোকা কিছু কথা বলে নিজেকে বিরাট নাট্যবোদ্ধা প্রমাণ করার অপচেষ্টা করতেই দাদার ধমক খেয়ে ছিলাম। ধমক শেষে উনি আমাকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, আমি যেটা বলছি সেটা ঠিক নয় এবং কেন ঠিক নয়। দাদার সঙ্গে প্রায় চার দশকের সম্পর্কে আমি বোধহয় ওই একবারই ওঁর কাছে ধমক খেয়েছিলাম।

১৯৯০ সাল। আমার জীবনে এল এক নতুন মোড়। দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হল আমার জীবনের প্রথম বই: ‘শরীর স্বাস্থ্য জিজ্ঞাসা’। তখন আমার লেখালেখির দিকে প্রচণ্ড ঝোঁক। দেশ পত্রিকায় প্রচ্ছদকাহিনি বেরিয়েছে, আনন্দবাজারে টুকটাক লেখার সুযোগ পাচ্ছি, অন্য পত্রপত্রিকাতেও লিখছি। সৌমিত্রদা দেশ পত্রিকা নিয়মিত রাখতেন, আমার প্রচ্ছদকাহিনি পড়েছিলেন এবং সুচিন্তিত একটি মতামতও দিয়েছিলেন টেলিফোনে। আমার যে বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, সেটাও ওঁকে জানিয়েছিলাম।
জীবনে প্রথম বই প্রকাশ অনেকটা প্রথমবার বাবা হওয়ার অনুভূতি এনে দিয়েছিল আমাকে। তখন স্টার থিয়েটারে দাদার নাটক ‘ঘটক বিদায়’ চলছে। দিনটা ছিল রবিবার, শো ছিল বিকেল তিনটেয়। আমি জানতাম, দাদা একটার মধ্যেই হলে চলে আসেন। কিছুক্ষণ রেস্ট নেন। বই পড়েন, গান শোনেন, তারপর মেকআপে বসেন। আমি আমার নতুন বই নিয়ে দেড়টা নাগাদ হাজির হয়ে গেলাম দাদার কাছে। দাদা সোফাতে শুয়ে ছিলেন। আমায় দেখে উঠে বসলেন। বইটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন, কয়েকটি পাতাও ওলটালেন। তারপর বললেন, প্রেজেন্টেশনটি ভারি সুন্দর হয়েছে। যেমন প্রচ্ছদ, তেমনি ছাপা। আমি বললাম, দাদা আপনিও তো দে’জ থেকে আপনার কবিতার বই বার করতে পারেন। সৌমিত্রদা বললেন, আমার তো ওদের কারও সঙ্গে চেনাজানা নেই। বার হলে মন্দ হত না। তবে আমার কিন্তু কয়েকটি তিন-চার ফর্মার কবিতার বই বিভিন্ন প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে, তারা কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগও করে না, বইগুলো বিক্রি হয়েছে কি হয়নি, তাও জানি না, অথচ দুটি বইয়ের প্রচ্ছদ মানিকদার করা। অযত্নে-অবহেলায় ওরা বইগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিল। আমি বললাম, দাদা সেই কবিতাগুলোর পাণ্ডুলিপি আপনার কাছে আছে? যদি থাকে, তাহলে আমি কি একবার চেষ্টা করব, দে’জ পাবলিশিং-এর সঙ্গে কথা বলব? সৌমিত্রদা বললেন, দেখো চেষ্টা করে। আমাকে সপ্তাহ দুয়েক সময় দিলে, আমি কবিতাগুলো সব সংগ্রহ করে, ঠিকঠাক সাজিয়ে, তোমার কাছে পৌঁছে দেব। আমি দাদাকে বললাম, আমি দশ মিনিট বাইরে থেকে আসছি। জাস্ট একটা ফোন করে। বলেই ধাঁ করে বেরিয়ে গেলাম। স্টারের ঠিক উলটোদিকের এসটিডি বুথ থেকে ল্যান্ডলাইনে ফোন করলাম দে’জ পাবলিশিং-এ। কপালটা ভালো ছিল। দে’জ-এর কর্ণধার সুধাংশুদা নিজেই ফোনটা ধরলেন। ওঁকে সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন এবং বললেন, আপনি আমাদের প্রতিনিধি হয়ে সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা বলুন এবং ওঁর থেকে পাণ্ডুলিপিটি সংগ্রহ করুন।

প্রায় ছুটে এসে দাদাকে সুখবরটা দিলাম। দাদা খুব খুশি হলেন। বললেন, তুমি দিন দশেক বাদে আমাকে ফোন করে এখানে চলে এসো, আমি এর মধ্যে সব রেডি করে ফেলছি। আমি ঠিক দিনে গিয়ে হাজির হলাম স্টার থিয়েটারের মেকআপ রুমে। কিন্তু দাদা ফাইলটা আনতে সেদিন ভুলে গিয়েছিলেন। খুব লজ্জিত হয়ে আমাকে বললেন, অমিতাভ আমি ফাইলটা আনতে ভুলে গেছি। আই অ্যাম অফুলি সরি। অফুলি শব্দটা আমি জীবনে প্রথমবার দাদার মুখ থেকেই শুনেছিলাম। ওটার অর্থ তখনও আমি জানতাম না। পরে অবশ্য জেনেছিলাম। অবশেষে সেই কবিতার ফাইল নিয়ে গিয়ে আমি পৌঁছে দিলাম দে’জ-এর সুধাংশুদার কাছে। সুধাংশুদা বললেন, একদিন চলুন ওঁর সঙ্গে আমি নিজে গিয়ে দেখা করি। আমারও তো উচিত ওঁকে এই ব্যাপারে একটা ধন্যবাদ জানানো। তাছাড়া উনি যদি কোনও টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন-এর কথা বলেন, সেটাও শোনা দরকার। আমরা একদিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে গিয়ে সৌমিত্রদার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনি তখন তপন সিংহর ‘অন্তর্ধান’ সিনেমায় কাজ করছিলেন। সৌমিত্রদা সুধাংশুদাকে বললেন, দেখুন আমি এই বই লিখে কোনও টাকার প্রত্যাশা করি না। আপনারা যা খুশি দেবেন। তবে দেখবেন যেন কাজটা ভালো হয়। আর অমিতাভ পুরো ব্যাপারটা দেখাশোনা করবে। যখন দরকার আমার সঙ্গে নেগোসিয়েশন করবে।

মাসখানেক বাদেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরোল দে’জ পাবলিশিং থেকে আমারই উদ্যোগে। বইটির নাম ছিল, ‘হায় চির জল’। ভূমিকাতে সৌমিত্রদা আমার নামও উল্লেখ করেছিলেন। আমি যথারীতি খুব সম্মানিত বোধ করেছিলাম। এরপর দাদার আরও বেশ কয়েকটি বই দে’জ থেকে বেরিয়েছিল। সেসব গল্প করব পরের পর্বে। আজ দাদা নেই। কিন্তু ভাবতে ভালো লাগে, দাদার প্রথম কবিতার বই-এর সঙ্গে আমার নামটাও জড়িয়ে রয়েছে, থাকবেও চিরদিন।

ছবি: লেখক

Skip to content