শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


দূরদর্শনে মাধবীদি, তরুণকুমার, নির্মলকুমারের সঙ্গে আমি। দিদির পাশে দাঁড়িয়ে প্রযোজক সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়।

অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়কে তো সবাই চেনেন। আমাদের সকল বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি ‘চারুলতা’ হয়ে আজও বিরাজমান। সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা ছাড়াও মহানগর এবং কাপুরুষ ও মহাপুরুষের কাপুরুষ পর্বে তিনি অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, অজয় কর, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়-সহ বহু বিখ্যাত এবং অখ্যাত পরিচালকদের ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। আমার প্রিয় অভিনেত্রীদের মধ্যে অন্যতম তিনি। একবার ইচ্ছে হল, বইমেলায় আমার বইয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ওঁকে আমন্ত্রণ জানানোর। তখনও পর্যন্ত আমার সঙ্গে ওঁর কিন্তু কোনও পরিচয়ই নেই। একজনের থেকে ফোন নম্বর জোগাড় করে সরাসরি ফোন করে বসলাম। তখন আমার দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিতব্য ‘গৃহিণীরা শুনছেন’ বইটির প্রস্তুতি চলছে। ফোনেই দুটি অনুরোধ করলাম মাধবীদিকে। আমার বইয়ের একটি ছোট্ট ভূমিকা ওঁকে লিখে দিতে হবে, আর বইটির উদ্বোধন করতে হবে বইমেলায় এসে। শুনে রাজি হলেন। একদিন ওঁর বাড়িতে যেতে বললেন।

দুদিন পরেই গিয়ে হাজির হলাম লেক গার্ডেন্সে ওঁর বাড়িতে। বেল বাজাতে নিজেই দরজা খুলে দিলেন। ড্রইংরুমটি ভীষণ রুচিসম্মতভাবে সাজানো। দেওয়ালের এক পাশের আলমারি জুড়ে ওঁর সারাজীবনে পাওয়া নানারকম মেমেন্টো, সার্টিফিকেট ও কয়েকটি শো-পিস। মাধবীদির চালচলন এবং কথাবার্তায় ভীষণ ঘরোয়া একটা ব্যাপার আছে। খুব সহজেই অপরকে আপন করে নিতে পারেন। প্রথম দিনের পরিচয়েই মনে হল, উনি যেন আমার কতদিনের চেনা।

নির্দিষ্ট দিনে ধৃতিকণা আর আমার কন্যা অর্কমিতা গাড়ি নিয়ে গেল মাধবীদি-কে আনতে। অর্কমিতার তখন চার বছর বয়স। সারাটা পথ ও নাকি দিদির সঙ্গে বকবক করে গেছে। আমি শুনে ধৃতিকে জিজ্ঞেস করলাম, মাধবীদি বিরক্ত হননি? ধৃতি উত্তরে বলল, বিরক্ত হওয়া তো দূরের কথা, দিদি ওর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন, যেন মনে হচ্ছিল ওঁর বয়সও কমে গেছে। দুজনে একসঙ্গে কয়েক কলি গানও গেয়েছে, ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…

এক অনুষ্ঠানে দিদির সঙ্গে।

মনে মনে ভাবলাম, অমন একজন আন্তর্জাতিক মানের অভিনেত্রী নিজেকে এতটা ‘ডাউন টু আর্থ’ রাখেন কী করে! বইমেলায় এসে সেদিন খুব আনন্দ করেছিলেন মাধবীদি। আরও অনেক বিখ্যাত মানুষ সেদিন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায়, ইয়ার্কি ঠাট্টায় মেতেছিলেন। পাশাপাশি অনেকের সঙ্গে ছবি তোলা, অটোগ্রাফ দেওয়া, এগুলোও করে গেছেন। প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা বলছি। তখনও মাধবীদির জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। তবে তখন তো আর মোবাইল ছিল না, থাকলে হয়তো সেলফির বায়নাক্কায় দিদি বিরক্তই হতেন। আমার মায়ের খুব পছন্দের অভিনেত্রী ছিলেন মাধবদি। মা-কে সেবার বইমেলা নিয়ে গিয়েছিলাম, আর বসিয়েছিলাম দিদির ঠিক পাশের চেয়ারেই। দুজনে অনেক গল্প করেছিলেন। মায়ের মুখে বারবার দেখেছিলাম পরিতৃপ্তির হাসি। সেই সব সুখস্মৃতি আমার অ্যালবামে আজও ধরে রাখা আছে। মাধবীদি এই অনুষ্ঠানে প্রকাশ করেছিলেন আমার লেখা ‘গৃহিণীরা শুনছেন’ বইটি। শুধু প্রকাশ করেই থেমে থাকেননি, কেউ তাঁর কাছে অটোগ্রাফ চাইলেই বলছিলেন, আগে আপনি পাশের স্টল থেকে অমিতাভর বইটি কিনে আনুন, সেই বইয়ে আমি সই করব। দিদির অযাচিত সৌজন্যে উদ্বোধন অনুষ্ঠানেই আমার বেশ কয়েক কপি বই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তখন আমাকে লেখক হিসেবে কেই-বা চেনে!

এরপর আমি মাধবীদি’র সঙ্গে প্রায় নিয়মিত যোগাযোগ রেখেই চলতাম। মাসে বারদুয়েক ফোনাফুনি তো হতই। দিদি ভীষণ পরোপকারী মানুষ ছিলেন। ওঁর এই পরিচয়টা অনেকের মতো আমিও তখন জানতাম না। কাউকে কোনও ব্যাপারে কথা দিলে খুব বিপদে না পড়লে সেই কথার খেলাপ করতেন না। একবার ওঁর সঙ্গে শ্রুতিনাটক পরিবেশন করার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমারই আমন্ত্রণে নিমতায় একটি ক্লাবের অনুষ্ঠানে উনি এসেছিলেন। আবৃত্তি করেছিলেন। তারপর আমরা একসঙ্গে একটি ছোট নাটক পরিবেশন করেছিলাম। সামান্য পারিশ্রমিক দিয়েছিলাম দিদিকে। একবারও জিজ্ঞেস করেননি, কত দিলাম। যা দিয়েছিলাম, সেটাই হাসিমুখে নিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে আমার বাড়িতে এসেছিলেন। চা খেয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে অন্য একটি অনুষ্ঠানে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম, সেই অনুষ্ঠানটি হবে বনগাঁ লাইনের অশোকনগরে। তখন রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। তার মানে উনি ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে পৌঁছবেন রাত্রি বারোটায়। দিদিকে বললাম, আপনি কি ওই অনুষ্ঠানের জন্য কোনও অ্যাডভান্স নিয়েছেন। উনি বললেন, না না, ওঁর সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক, তাতে অ্যাডভান্স কেন, কোনও টাকা নেওয়ারই প্রশ্নে আসে না। উনি বহু গরিব মানুষের জন্য কাজ করেন। একটি প্রতিষ্ঠানও ওখানে গড়েছেন৷ আমার ভালো লেগেছে ওঁর কর্মকাণ্ড। তাই একবার বলতেই যেতে রাজি হয়েছি। দিদির কথা শুনে আমার সেই কথাটিই মনে পড়ল, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।

একদিন মাধবীদি ফোন করে আমাকে বললেন, টেকনিশিয়ান স্টুডিওর প্রাক্তন অধিকর্তা আনন্দবাবুর জিভে ক্যানসার হয়েছে, অনেকটা নাকি ছড়িয়েও গেছে। পিজি-তে একে-তাকে বলে উনি ভর্তির ব্যবস্থা করেছেন। আমি গিয়ে কি একবার আনন্দবাবুকে দেখে আসতে পারব এবং ঠিকঠাক চিকিৎসা যাতে হয় সেই ব্যবস্থা করে দিতে পারব। দিদির অনুরোধে আমি গিয়েছিলাম এবং আমার সীমিত ক্ষমতায় যেটুকু করা সম্ভব, করেছিলাম।

এক বিশেষ মুহূর্তে

আরেকটি ঘটনা বলি। আমার এক ভাগনির অ্যাপেনডিক্স অপারেশন হয়েছে পিজি হাসপাতালে। আমি দেখতে যাব শুনে দিদি আমাকে অনুরোধ করলেন, ওখানে হাসিদি মানে আমাদের সবার প্রিয় অভিনেত্রী সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় ভর্তি আছেন, যদি আমি একটু দেখে আসি।

অনেক খোঁজাখুঁজি করে মেডিসিনের ইনটেনসিভ কেয়ার ওয়ার্ডে হাসিদি-র খোঁজ পেলাম। ডাক্তার পরিচয় দিয়ে কেবিনে ঢুকে দেখি, ওঁর তখন প্রচণ্ড কনভালশন, মানে খিঁচুনি হচ্ছে। দু-তিনজন চেপে ধরে থেকেও খিঁচুনি কমাতে পারছেন না। একজন জুনিয়র ডাক্তার ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশন দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু শিরা খুঁজে পাচ্ছেন না। অকুস্থলে হাজির হয়ে আমাকেই নামতে হল সেই কাজে। আমার প্রিয় অভিনেত্রীর শিরাতে স্যালাইন চালালাম, তারপর দিলাম প্রয়োজনীয় ইঞ্জেকশন। একটু বাদে খিঁচুনি বন্ধ হল, হাসিদি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ওঁর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে আমারই ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। সুমিত্রাদি-র নাম কে হাসি দিয়েছিল জানি না! সারা জীবনটাই তো ওঁর দুঃখ কষ্ট কান্নায় ভরা। যার অনেকটাই আমি জানি, হয়তো আপনারাও অনেকেই জানেন।

হাসিদি-র কথাই যখন উঠল, তখন ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটি বলি। ১৯৮৪-তে আমি প্রথম সিনেমায় অভিনয় করি পান্না হোসেনের ‘বীজ’ ছবিতে। যদিও এই ছবিটি রিলিজ করেনি। ওঁর পরের ছবি ‘একাকী’তে অভিনয় করতে জলপাইগুড়িতে গিয়েছিলাম আউটডোরে ১৯৮৭-তে। আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন মুনমুন সেন, অয়ন ব্যানার্জি, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় ও আরও অনেকে। আমরা সবাই একই রিসর্টে ছিলাম পাশাপাশি ঘরে। অল্প সময়ের মধ্যেই হাসিদি-র সঙ্গে আমার পরিচয় শুধু নয়, কিছুটা আড্ডা মারার সম্পর্কও তৈরি হল। এক সন্ধ্যায় শ্যুটিং শেষে হাসিদি আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে পাঠালেন। বললেন, শরীরটা খারাপ লাগছে, মাথা ঘুরছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, নানা সমস্যার জন্য প্রতিদিনই তাঁকে বেশ কিছু ওষুধ খেতে হয়। আমার কাছে বিপি মেশিন ছিল। আমি প্রেশার মেপে দেখলাম, প্রেশার কিছুটা হাই। আমার স্টেথোস্কোপটা হাসিদি হাতে নিয়ে ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, এটা কি নতুন কেনা? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমার বাবা বাংলাদেশ থেকে এই বিদেশি স্টেথোটি আমার জন্য আনিয়েছেন। জানেন, আমার ছেলেও ডাক্তারি পড়ে, আপনার বাবাকে বলে ওর জন্য এরকম একটা স্টেথো আনিয়ে দেবেন, যা টাকা লাগে আমি অ্যাডভান্স আপনাকে দিয়ে রাখছি। আমি বললাম, হাসিদি আমি নিশ্চয়ই আপনাকে আনিয়ে দেব। এখন টাকা দেবার দরকার নেই। মাস তিনেকের মধ্যেই আমি সত্যিই ওঁর ছেলের জন্য একটি স্টেথো বাংলাদেশ থেকে আনিয়ে ওঁর হাতে পৌঁছে দিয়েছিলাম।

সেই হাসিদি! আমাদের সবার প্রিয় বিকেলে ভোরের ফুল এখন হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। শুনেছিলাম, নানা ধরনের ড্রাগ নেওয়ার ফলেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সংসার জীবনে চূড়ান্ত অশান্তির কারণে ডিপ্রেশনে ভুগতেন। মাধবীদিকে ফোন করে হাসিদি-র ব্যাপারটা সবিস্তারে জানালাম। পিজিতে শুনেছিলাম, ওঁর বাড়ির লোকেরা চিকিৎসার ব্যাপারে একদম সহযোগিতা করছেন না। সেটাও দিদিকে জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লোকের সঙ্গে এবং পিজি-র সুপারের সঙ্গে কথা বলে মাধবীদি হাসিদি-র সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন এবং ওঁকে হাসপাতাল থেকে প্রায় সুস্থ করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনলেন। এই পুরো ঘটনাটার সাক্ষী আমি নিজেই। কারণ আমি পিজি হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন হাসিদি-র ট্রিটমেন্টের পুরো ব্যাপারটা ফলো-আপ করতাম। শুধু হাসিদি নয়, এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেউ অসুস্থ হলে বা বিপদে পড়েছে, এই কথা কানে গেলেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

মাধবীদি’র সঙ্গে একবার কলকাতা দূরদর্শনে আমার নাটক করার সৌভাগ্য হয়েছিল। নাটকটির নাম এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না। তবে প্রযোজক ছিলেন সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়। মাধবীদি ছাড়াও ওঁর স্বামী প্রখ্যাত অভিনেতা নির্মলকুমার এবং তরুণকুমারও এই নাটকে ছিলেন। আমাদের দিন তিনেক রিহার্সাল হয়েছিল, তারপর হয়েছিল ফাইনাল শ্যুটিং। এই কটাদিন ওঁদের সঙ্গে আমি খুব এনজয় করেছিলাম। আপনারা অনেকেই জানেন যে মাধবীদি দীর্ঘকাল নির্মলকুমারের সঙ্গে থাকেন না, থাকেন আলাদা বাড়িতে। আমি ইএনটি বিশেষজ্ঞ জেনে নির্মলদা একদিন আমাকে বললেন, তুমি ভাই আমার বাড়িতে গিয়ে আমার মেয়েকে একটু দেখে দেবে। ওর কানের সমস্যা। তোমার বাড়ি অনেক দূরে, তা না হলে আমিই ওকে নিয়ে তোমার চেম্বারে যেতাম। আমি বললাম, দাদা আমার সঙ্গে তো ইন্সট্রুমেন্ট নেই, পরশুদিন তো শ্যুটিং আছে, আমি ওগুলো সঙ্গে নিয়ে আসব, সেদিন না হয় শ্যুটিং শেষে আপনার বাড়ি যাব। নির্মলদা শুনে খুব খুশি হলেন। মাধবীদি একটু দূর থেকে কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলেন। পরে আমাকে আলাদা করে ডেকে বললেন, কী হয়েছে মেয়ের? আমি বললাম আমি তো তেমন কিছু এখনও জানি না। কানে একটা সমস্যার কথা দাদা আমাকে বললেন। আগে গিয়ে দেখি। তখন দিদি আমাকে বললেন যে আপনারা যখন যাবেন তখন আমিও যাব মেয়েকে দেখতে।

অটোগ্রাফ দিচ্ছেন

দু’দিন বাদে সত্যিই উনি গিয়েছিলেন ওঁর ছেড়ে আসা সেই বাড়িতে। মেয়ের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা বললেন। আমার কাছ থেকে অসুখের গতিপ্রকৃতি জানতে চাইলেন। তারপর নিজে হাতে চা করে আমাদের সবাইকে খাওয়ালেন। একটু বাদে আমি যখন নির্মলদার বাড়ি থেকে বার হচ্ছি, তখন দিদিকেও দেখলাম বেরিয়ে এসে ওঁর গাড়িতে উঠে নিজের বাড়ির পথ ধরতে।

খুব মজার মানুষ ছিলেন তরুণকুমার। আর অভিনেতা হিসেবে যে কত বড় ছিলেন তা তো আমরা সবাই জানি। মহানায়ক উত্তমকুমার অব্দি ভয়ে ভয়ে তাঁর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করতেন। রিহার্সাল কিংবা শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়তেন তরুণকুমার, সঙ্গে চলত বিকট শব্দে নাক ডাকা। সেদিন উনি যথারীতি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন কলকাতা দূরদর্শনের শ্যুটিং ফ্লোরে। অনেক সাংবাদিক এসেছেন প্রোগ্রাম কভার করতে। নির্মলকুমার তরুণকুমারের কানের সামনে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, এই বুড়ো ওঠ, দেখ কত রিপোর্টার এসেছে, জানতে চাইছে তুই বেঁচে আছিস না মারা গেছিস, নিজের মুখে একটু বলে দে। তরুণকুমার ধড়ফড় করে উঠে বসলেন তারপর নির্মলকুমারকে তো এই মারে কি সেই মারে অবস্থা।

বছর চারেক আগে মাধবীদি’র সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল হায়াত হোটেলে একটি স্বাস্থ্য পত্রিকার প্রকাশ অনুষ্ঠানে। এই পত্রিকার সম্পাদক প্রখ্যাত স্কিন স্পেশালিস্ট ডাঃ সুব্রত মালাকার একদিন আমাকে ফোন করে বললেন, তোর সঙ্গে তো মাধবীদি’র খুব ভালো পরিচয় আছে, ওঁকে আমার অনুষ্ঠানে নিয়ে আসতে হবে, এই দায়িত্বটা আমি তোকে দিলাম, টাকা-পয়সা নিয়ে কোনও চিন্তা করিস না। ফোনে আমার অনুরোধ শুনে দিদি এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। উদ্যোক্তারা গাড়ি পাঠিয়ে ওঁকে নিয়ে এসেছিল এবং পৌঁছেও দিয়েছিল। প্রায় দু’ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানে নানা বিষয়ে মাধবীদির সঙ্গে অনেক কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। দেখলাম আমার প্রতি তাঁর স্নেহ ভালোবাসা ঠিক আগের মতোই আছে। বয়সজনিত কারণে ওয়াকিং স্টিক ছাড়া মাধবীদি এখন আর হাঁটতে পারেন না। অনুষ্ঠান শেষে আমি তাই খাবার এনে ওঁকে বসিয়ে খাইয়েছিলাম। আমার মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। ও ডাক্তারি পড়ছে জেনে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। আরেকটা বিষয় জেনে খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। উদ্যোক্তাদের পক্ষে যে ভদ্রলোক ওঁকে বাড়ি থেকে আনতে গিয়েছিলেন, তিনি আমাকে বললেন, আসবার পথে অনেকক্ষণ ধরে তিনি নাকি শুধু আমার গুণগানই করে গেছেন। আমি ওঁর কোনও পেশেন্টকে ফিস না নিয়ে দেখে দিয়েছিলাম, সুমিত্রাদি-র জন্য কী করেছিলাম, এই রকম নানা ঘটনা। প্রায় ২৫-৩০ বছর আগের ঘটনা এসব। দিদি এখনও মনে রেখেছেন দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল আমার।

সম্প্রতি হাসপাতাল থেকে ফেরার পর দিদির সঙ্গে সেদিন টেলিফোনে কথা বললাম। গলায় সেই আন্তরিকতা, সেই স্বাভাবিকতা, শুনে মনে হল মাধবীদি সুস্থই আছেন। আরেকটি কথা বলে শেষ করি। বহু বছর আগে শেষ যেবার মাধবীদি’র বাড়িতে গিয়েছিলাম, উনি ওঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী গ্রন্থ ‘আমি মাধবী’ বইটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই সময় একটি মাত্র কপিই ওঁর কাছে ছিল। আমি বলেছিলাম, দিদি আমি পরে এটি সংগ্রহ করে নেব, উনি বললেন, না, এটি আমি আপনাকে সই করে দিচ্ছি, আপনি এক্ষুনি নেবেন। আমি নিয়েছিলাম পরম শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায়। বইটি আজও আমার কাছে রাখা আছে মাধবীদি। এ যে আমার কাছে এক মহার্ঘ উপহার।

Skip to content