শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে।

আমার কাছেই ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমি কিনা, নিয়েছিলাম কানন দেবীর ইন্টারভিউ, তাঁর বাড়িতে গিয়ে, তাঁর পদতলে বসে! এমনকী একসঙ্গে ছবিও তুলেছিলাম, আমার সদ্য কেনা একটি সস্তার ক্যামেরায়!

ব্যাপারটা খুলেই বলি। আমি তখন ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে কর্মরত। অভিনয়ের পোকা এবং লেখালেখির পোকা, দুটোই সমান তালে মাথায় কিলবিল করছে। ঋতীশ চক্রবর্তী নামে এক সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওই হাসপাতালেই। তিনি তখন সত্যযুগ পত্রিকায় কর্মরত এবং সংস্কৃতি বিভাগটি দেখাশোনা করতেন। তাঁর উৎসাহে আমিও একে-তাকে ইন্টারভিউ করে বেশ কিছু ফিচার লিখে ফেললাম সত্যযুগ পত্রিকায়। কিছু বিখ্যাত মানুষের ইন্টারভিউও করে ফেললাম। সংগীতশিল্পী জগন্ময় মিত্র, বিখ্যাত খেলোয়াড় এবং উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী সুকুমার সমাজপতি, প্রখ্যাত সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-দিলীপ রায় এবং আমার ডাক্তারি প্রফেশনের কয়েকজন বিখ্যাত ডাক্তারকে। ঋতীশদা আমার উপর খুব খুশি। আমার কোয়ার্টারে প্রায়ই আমাদের আড্ডা হত। একদিন বলল, আপনি কানন দেবীর ইন্টারভিউ করতে পারবেন? আমি বললাম, কানন দেবী মানে সেই বিখ্যাত নায়িকা-গায়িকা! আমার সঙ্গে তো ওঁর পরিচয় নেই, দু’তিনটে সিনেমা দেখেছি ঠিকই, কিন্তু বেশি কিছু জানিও না। আমি এটা পারব না দাদা। উনি আর কিছু বললেন না।

কয়েকদিন বাদে চিত্রসাংবাদিক রবি বসুর লেখা একটি বই আমাকে দিয়ে বললেন, এখানে ওঁর সম্বন্ধে অনেক কিছু পেয়ে যাবেন, পড়ে নিন, আর এই হল ওঁর ফোন নাম্বার। ফোনে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলবেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যাবেন। বইটিতে আরও অনেকের সঙ্গে কানন দেবীকে নিয়েও বিস্তারিত লেখা রয়েছে। পড়ে অনেক কিছু জানলাম, কৌতূহল বাড়ল। একদিন ফোন করলাম, নিজের পরিচয় দেওয়াতে যিনি ফোন ধরেছিলেন, তিনি কানন দেবীকে ডেকে দিলেন। আমি আমার উদ্দেশ্য ফোনেই জানালাম। উনি শুনে বললেন, আমি এখন আর এইসব বিষয় নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলি না। কিন্তু আপনি ডাক্তার, আমার বাড়িতে আসতে চাইছেন, আচ্ছা ঠিক আছে একদিন আসুন, কথা বলা যাবে।

ডেট ফিক্স করে একদিন সকাল এগারোটা নাগাদ আমার ছোটবেলার বন্ধু দীপুকে নিয়ে হাজির হলাম টালিগঞ্জে (সম্ভবত রিজেন্ট পার্কে) কানন দেবীর বাড়িতে। আগের দিনের পেল্লায় বাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকে বাড়ির একতলায় বিশাল ড্রইং কাম ডাইনিং রুম। কানন দেবী তখন একটি ছোট টুলে বসে মেঝেতে রাখা বঁটিতে তরিতরকারি কাটছিলেন। বিংশ শতাব্দীর সেরা বাঙালি নায়িকা এবং গায়িকা, আমার বাবা-কাকাদের যৌবন বয়সের হৃদয়ে ঝড় তোলা কাননবালাকে এভাবে দেখে একটু চমকে উঠেছিলাম বইকি! পরিচয় দিতেই পাশে রাখা একবাটি জলে হাত ধুয়ে নিয়ে আঁচলে মুছে আমাদের একটু দূরে রাখা দুটি মোড়াতে বসতে বললেন। এটা ১৯৮৬ সালের ঘটনা। কানন দেবীর বয়স তখন সত্তর। শরীর একটু ভারী হয়েছে, বেশ একটা গৃহকর্ত্রীর ভাব চলনে-বলনে। এক সময়ের অত্যাধুনিক এই নায়িকার মাথায় কিন্তু দেখলাম সব সময় ঘোমটা টানা রয়েছে। আমাদের আপনি বলেই সম্বোধন করলেন। বারবার বলা সত্ত্বেও তুমিতে নামলেন না। ওঁর বউমা এবং বাড়ির আরও দু-একজনের সঙ্গে ডেকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রান্নাবান্নার খবরদারির সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা। ওঁর অনুমতি নিয়ে আমার সঙ্গে থাকা এক ঢাউস টেপ রেকর্ডার অন করলাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা সেদিন নানা বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম এই কিংবদন্তি-সম শিল্পীর সঙ্গে। সেই আলাপচারিতার প্রায় পুরোটাই তুলে দিলাম পাঠকদের জন্য, ১৯৮৬ সালের ১৪ অক্টোবর সত্যযুগ পত্রিকার সংস্কৃতির পাতায় যেটি প্রকাশিত হয়েছিল। কপিটি হারিয়ে গিয়েছিল বহুদিন আগেই, মুছে গিয়েছিল সেই ইতিহাসও। সম্প্রতি সেটি খুঁজে পাবার পর, এই লেখার ভাবনাটি মাথায় এল।

গান এবং অভিনয়, এই দুটোতেই সমান পারদর্শী নায়িকা সেই যুগে আর কে ছিলেন! অসাধারণ কণ্ঠ এবং গায়কী থাকা সত্ত্বেও কানন দেবী কিন্তু কখনওই গায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেননি, করেছেন নায়িকা হিসাবে। তাঁর কালজয়ী যেসব গান শুনে আমরা বড় হয়েছি, সেগুলোর সবগুলোই তাঁর স্বকণ্ঠে গীত। অর্থাৎ অভিনয়ের প্রয়োজনেই তিনি গান গেয়েছেন। স্বীকৃতি পেয়েছেন অভিনেত্রী হিসেবে, প্লাস পয়েন্ট ছিল সুন্দর কণ্ঠ, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে পরিচালকেরা যেটিকে ব্যবহার করেছেন। স্বভাবতই মনে হয়, গান নয়, অভিনয়ই ছিল কানন দেবীর প্রথম ভালোবাসা, গান তার অভিনয়ে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে মাত্র। তবু তাঁর প্রথম ও প্রধান পরিচয় তিনি অভিনেত্রী, তারপর গায়িকা।

কিন্তু শুনে আশ্চর্য হতে হল যে অভিনয় নয়, গানই ছিল কানন দেবীর জীবনের প্রথম ভালোবাসা। তিনি গায়িকা হতে চেয়েছিলেন, অভিনেত্রী নয়। কোনও সংগীত ঘরানার মধ্যে জন্ম হয়নি তাঁর। জন্মেছিলেন ভবানীপুর এলাকায় এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন সাধারণ মার্চেন্ট অফিসার। অনেকগুলো পরিবার পাশাপাশি একসঙ্গে থাকত। কোনও বাড়িতে কলের গান বাজত, কোনও বাড়ির মেয়ে নাচ শিখত, আবার কোনও বাড়িতে নাটকচর্চা হত। এমন একটি পরিবেশে খুব ছোটবেলা থেকেই গান তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত। বয়স তখন বছর পাঁচেক হবে। বাড়িতে একটা ছোট পিঁড়ে ছিল, ওটাকেই হারমোনিয়াম বানিয়ে মনের সুখে গলা ছেড়ে গান গাইতেন। ফুটফুটে মিষ্টি চেহারা আর মিষ্টি গলা শুনে আশপাশের অনেকেই তাকে গান গাইতে বলতেন। ছোট্ট কানন সঙ্গে সঙ্গেই গেয়ে শুনিয়ে দিত। আসলে ওই বয়সেই কলের গান দু-একবার শুনে, খুব সহজেই গলায় তুলে নিতে পারত সে। এদিকে পাশের এক বাড়িতে এক মাস্টারমশাই একটি মেয়েকে গান শেখাতে আসতেন। ছোট্ট কানন সেখানে এসে হাজির হয়ে বসে বসে গান শুনত। একদিন তার গান শুনতে চাইলেন মাস্টারমশাই। শুনে তিনি বেজায় খুশি হয়ে কাননকে গান শেখাতে চাইলেন৷

৩৬ বছর আগে নেওয়া কানন দেবীর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল সত্যযুগ পত্রিকায়।

কিন্তু বাড়ির লোকের তো আর গান শেখানোর মতো আর্থিক সংগতি নেই। আগ্রহ দেখে মাস্টারমশাই বিনা পারিশ্রমিকে কাননকে গান শেখাতে শুরু করলেন। মেয়েটির অভিভাবকেরা কিন্তু ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখলেন না। তাঁদের মেয়েকে ছেড়ে অন্য বাড়ির মেয়ের দিকে মাস্টারমশাই বেশি নজর দিচ্ছেন! কথাটা পৌঁছল কাননের মায়ের কানে। প্রথম গান শেখার সেখানেই ইতি হল তাঁর। এই বয়সে এসে কানন দেবী মুক্তকণ্ঠে আজও স্বীকার করেন যে এই মাস্টারমশাই-ই তাঁর প্রথম সংগীত শিক্ষাগুরু।

মাত্র দশ বছর বয়সে হঠাৎ বাবাকে হারান তিনি। প্রচণ্ড আর্থিক অনটনে পড়ে যায় পুরো সংসার। ম্যাডান ফিল্ম কোম্পানির তুলসী চক্রবর্তী ছিলেন তাদের প্রতিবেশী। এই অবস্থা দেখে একদিন তাঁর মায়ের কাছে প্রস্তাব দিলেন একটি সিনেমায় রাধার ভূমিকার জন্য কাননকে তিনি পেতে চান। মা রাজি হলেন না। ছোট্ট কানন কিন্তু নাছোড়বান্দা। অল্প বয়সেই সে বুঝে গেছে, টাকা ছাড়া সংসার চলবে না। অভিনয় করলে কিছু টাকা তো পাওয়া যাবে। যদি সেই টাকা দিয়ে একটা হারমোনিয়াম কিনে ফেলা যায়! মেয়ের বায়নায় মা অবশেষে রাজি হলেন। ১৯২৬ সালে প্রথম সিনেমায় নামলেন কানন দেবী। যখন তাঁর মাত্র দশ বছর বয়স। পারিশ্রমিক ঠিক হয়েছিল ২৫ টাকা। অভিনয়ের পর হাতে পেলেন মাত্র পাঁচ টাকা, বাকি টাকা কারা যেন মেরে দিয়েছে। সেই শুরু। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি কানন দেবীকে।

১৯২৯-৩০ নাগাদ বায়োস্কোপে টকি এল। অর্থাৎ নির্বাক ছবি সবাক হল। ভয়েস টেস্টের অডিশনে সবাইকে ডাকা হল। কানন দেবী তো ভয়েই অস্থির, প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। বাতিল হয়ে যাবার আশঙ্কায় কাঁপছেন। পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসাহে অডিশন দিলেন এবং পাশ করলেন এক চান্সেই। ম্যাডান কম্পানিতেই চাকরি পেলেন। বাড়ি এসে খবর দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন এবার একটা হারমোনিয়াম তাকে কিনে দিতেই হবে। মাইনের টাকা জমিয়ে কুড়ি টাকায় হারমোনিয়াম কিনে দিলেন মা। বহুদিনের সুপ্ত বাসনা এবার বাস্তবে রূপ নিল। নিয়মিত সংগীতচর্চা করতে শুরু করলেন তিনি।

এদিকে একের পর এক ছবিতে কাজ আসতে লাগল। কয়েক বছরেই মাইনে বেড়ে হল ৮০ টাকা। মাকে বললেন, এবার গানের মাস্টার রেখে দিতে। আল্লারাখখা নামে এক ওস্তাদের কাছে নাড়া বাঁধলেন। প্রতিদিন ভোর চারটায় উঠে খোলা ছাদে তানপুরা নিয়ে গলা সাধতে বসতেন। খেয়াল রেওয়াজ করতেন মাস্টার মশাইয়ের নির্দেশে। আল্লারাখখা ছিলেন কড়া ধাতের মানুষ। কোনও রকম ফাঁকি তাঁর পছন্দ ছিল না। বলতেন, কাঠকে রোদ বৃষ্টি ঝড় জলে রাখলে যেমন তা ঠিক থাকে, গলাকেও তেমনি কঠোর পরিশ্রমে পোড়ালে, তবেই তা সত্যিকারের গলা হয়ে উঠবে। কানন দেবী একদিন গুরুজিকে বললেন, খোলা ছাদে ঠান্ডা লাগে যে। গুরুজি বললেন, বেশ তো, চাদর গায়ে দিয়ে নাও, কিন্তু নিয়মিত রেওয়াজ চালাতেই হবে। কাজেই সারাদিন ফিল্মের ধকল সামলে প্রতিদিন ভোর চারটেতেই উঠতে হত। এদিকে ফিল্মের কাজ বাড়ছে, আরও সময় দিতে হচ্ছে সেদিকে, ফলে রেওয়াজে ভাটা পড়তে লাগল। গুরুজির কাছে ধরা পড়ে গেলেন একদিন। একদিকে ফিল্ম অর্থাৎ নাম-ডাক-গ্ল্যামার-অর্থ। অন্যদিকে নিবিড় সংগীত সাধনা। সংঘাত শুরু হল। কী করবেন তিনি! কোনটাকে বেছে নেবেন! অভিনয় না সংগীত? গুরুজি সব বুঝে বললেন, যে কোনও একটিকে বেছে নিতে হবে। দুই নৌকায় পা দিয়ে সফল হওয়া যায় না। এদিকে সংসারেও তো অর্থের দরকার। সংশয় আর দ্বন্দ্বের ঝড় উঠল কানন দেবীর মনে। বাধ্য হয়ে বেছে নিলেন অভিনয় জীবনকে। ক্ষমা চেয়ে বিদায় দিলেন গুরুজিকে। সেই দুঃখের দিনের কথা আজও তিনি ভুলতে পারেন না। গুরুজির একটি কথা আজও তাঁর কানে বাজে। ‘বেটি, একদিন তুম পস্তাও গে।’ প্রশ্ন করলাম, আজকে কী মনে হয়, গুরুজিই ঠিক কথাই বলেছিলেন? বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, ঠিক জানিনে। জীবনে পেয়েছি অনেক। তবু মনে হয়, ওই সময় ওই সিদ্ধান্ত না নিয়ে আমার কোনও উপায় ছিল না। যাক, যা হবার তা তো হয়েই গেছে আর ভেবে কী হবে। একরাশ বিষণ্ণতা ঝরে পড়ল প্রবীণা এই কিংবদন্তি শিল্পীর কণ্ঠে।

১৯৮৬-তে কানন দেবী। বয়স যখন ৭০।

ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক কোন সালে, জানতে চাইলাম। ১৯৩২-৩৩ সালে ‘কণ্ঠহার’ ছবিতে। ওই সময় একটি উর্দু ছবিতেও অবশ্য আমি গান গেয়েছিলাম। তবে গান গেয়ে প্রথম নাম করেছিলাম, ‘মানময়ী গার্লস হাই স্কুল’ ছবিতে। সেটা ১৯৩৫ সাল। রাতারাতি নায়িকার পাশাপাশি গায়িকা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হলাম এই ছবিতে। গান গাইবার প্রচুর অফার আসতে লাগল।

পরের বছর কানন দেবী ম্যাডান ছেড়ে রাধা ফিল্ম কোম্পানিতে যোগ দিলেন। এর বছর দুয়েক বাদেই নিউ থিয়েটার্সে যোগ দিলেন। গায়িকা হিসেবে নাম হতেই কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে ডাক পেলেন। বেশ কিছু গানের রেকর্ডও বাজারে বেরোল, জনপ্রিয়ও হল। ফিল্মের গানের প্রয়োজনে কানন দেবী প্রথম রবীন্দ্রসংগীত শিখলেন একজনের কাছে, যাকে তিনি দাদা বলে ডাকতেন। গানটি ছিল, ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে…।’ এরপর মেগাফোন থেকে ডাক পেলেন। সেখানে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে নাড়া বাঁধলেন। নজরুলগীতি শিখেছেন স্বয়ং নজরুলের কাছে। বিদ্যাপতি ছবিতে গাইলেন, ‘শাওন আসিল ফিরে সে তো ফিরে এল না..।’ এছাড়াও নজরুলগীতি শিখেছেন ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে। রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, অনাদি ঘোষ দস্তিদার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখের কাছে। ফিল্মের গানের জন্য ট্রেনিং নিয়েছেন রাইচাঁদ বড়াল, দিলীপ রায়, কমল দাশগুপ্তের মতো গুণী শিল্পীদের কাছ থেকে। সকলের কাছেই কৃতজ্ঞ তিনি। জীবনে বহু সংগীতজ্ঞর সংস্পর্শে এসে ফলে-ফুলে পল্লবিত হয়েছে তার সংগীত জীবন। তবে নিয়মিত সাধনা বলতে যা বোঝায়, তা কিন্তু আর হয়ে ওঠেনি ফিল্মের অভিনয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার জন্য। এই আক্ষেপ ৭০ বছর বয়সে এসেও তিনি করলেন আমাদের কাছে।

যতদিন ফিল্ম জগতে ছিলেন ততদিন অভিনয়ের পাশাপাশি অনেক গানই গেয়েছেন। ‘প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম’ কিংবা ‘আমি বনফুল গো’, ‘তুফান মেল যায়…’ এসব গান তো কালজয়ী। শুধু আধুনিক নয়, ভক্তিগীতি, ভজন, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি… সংগীত জগতের বিভিন্ন ধারায় সাবলীলভাবে অবগাহন করেছিলেন তিনি। কিন্তু সিনেমার পর্দা থেকে বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গানের জগৎ থেকেও স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে নিয়েছিলেন। অথচ তখনও তার কণ্ঠে ভেলকি দেখানোর মতো ক্ষমতা ছিল। তবু তিনি সরে গেলেন কেন! অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই বললেন, নতুনদের তো জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে বাবা। চিরকাল তো আর নায়িকা সাজা যায় না। আর তাছাড়া আমার গান জনপ্রিয় হবার মূল কারণ তো অভিনয়। সেই অভিনয় জগৎ ছেড়ে শুধু গান নিয়ে জনপ্রিয়তার কম্পিটিশনে আমি তো নামতে চাইনি। অকপট স্বীকারোক্তি এই বর্ষীয়ান শিল্পীর।

কানন দেবীর বাড়িতে ১৯৮৬ সালে।

এজন্য তার অগণিত ভক্ত-শ্রোতার হৃদয়ে দুঃখ থাকলেও, তার কিন্তু কোনও দুঃখ নেই। চোখের আড়াল থেকে সরে গেলেও আমাদের অন্তরের মণিকোঠায় তিনি চিরকালের জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে রয়েছেন। জীবনে বহু জ্ঞানীগুণী সঙ্গ করেছেন কানন দেবী। প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকীকুমার বসু, সীমান্ত গান্ধী, মহাত্মা গান্ধী, নজরুল, এমনকী গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদও পেয়েছিলেন তিনি। ‘মানুষের এই ছোট্ট জীবনে এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে! তবে দুঃখ একটা আছে আমার, রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে শান্তিনিকেতন গিয়ে তাঁকে গান শোনানোর সৌভাগ্য আর হয়ে ওঠেনি আমার।’ কথাগুলো বলার সময় যেন একটু গলা ধরে এল কানন দেবীর।

এই ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম ১৯৮৬ সালে, কানন দেবীর বয়স যখন সত্তর। তারপর আর মাত্র ছয় বছর বেঁচেছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই ছিয়াত্তর বছর বয়সে তিনি চিরকালের জন্য আমাদের ছেড়ে অন্য জগতে চলে যান। ইন্টারভিউ চলাকালীন একাধিকবার ওঁকে ‘কানন মা’ বলে সম্বোধন করেছিলাম। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল এই ডাকে খুব খুশি হচ্ছেন তিনি। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাঁধুনি এবং বউমাকে রান্নার ব্যাপারে নানা ডিরেকশন দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের চা-বিস্কুট-মিষ্টি ছাড়াও বকফুল ভাজা খাইয়েছিলেন, এমনকী দুপুর হয়ে গেছে বলে লাঞ্চ খেয়ে যাবার কথাও বলেছিলেন। ইন্টারভিউ শেষে আমার সদ্য কেনা একটি হট শট ক্যামেরায় ওঁর ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করি। প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বারবার বললেন, ‘এখন আমার এই চেহারা আর কেউ দেখতে চাইবে না। তাছাড়া এই দেখো, মাথার চুল সামনের দিকে সব উঠে গেছে (ঘোমটা সরিয়ে দেখালেন)। এই ছবি কার ভালো লাগবে বল তো! তারা আমাকে সিনেমায় যেভাবে দেখেছেন সেই চেহারাতেই মনে রাখুক।’ আমার মা বারবার বলে দিয়েছিল, পারলে কানন দেবীর ছবি তুলে আনিস, দেখব এখন কেমন দেখতে হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত মায়ের সেন্টিমেন্ট দিলাম এবং ওঁকে রাজি করিয়েই ছাড়লাম। আমি ওঁর পাশে বসলাম, আমার বন্ধু দীপু ফটো তুলল, আবার দীপু ওঁর পাশে বসল, আমি ফটো তুললাম। এছাড়া কয়েকটি সিঙ্গেল ফটোও তুললাম।

বিদায় নিয়ে চলে আসার আগের মুহূর্তে বললেন, দেখুন বাবা, আপনাদের একটা রিকোয়েস্ট করি, এই ফটোগুলো কিন্তু আপনার মা-কে ছাড়া আর কাউকে দেখাবেন না। ‘কানন মা’-কে দেওয়া সেই কথা আমি দীর্ঘদিন রেখেওছিলাম। কিন্তু ছয় বছর আগে ২০১৬ সালে কানন দেবীর জন্মশতবর্ষে ৩৬ বছর আগে আমার সেই হট শট ক্যামেরায় তোলা কয়েকটি ফটো আমি ফেসবুকে পোস্ট করি এবং এজন্য এই মহান শিল্পীর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিই। এবার আমার এই লেখার সঙ্গে আবার কয়েকটি ফটো পোস্ট করছি এবং যথারীতি ওঁর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিচ্ছি। কারণ এই ফটোগুলোর একটা ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে। আশা করি, যে লোকেই থাকুন না কেন, আমাকে উনি মার্জনা করবেন। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম তার স্মৃতির প্রতি।
এজন্য তার অগণিত ভক্ত-শ্রোতার হৃদয়ে দুঃখ থাকলেও, তার কিন্তু কোনও দুঃখ নেই। চোখের আড়াল থেকে সরে গেলেও আমাদের অন্তরের মণিকোঠায় তিনি চিরকালের জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে রয়েছেন। জীবনে বহু জ্ঞানীগুণী সঙ্গ করেছেন কানন দেবী। প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকীকুমার বসু, সীমান্ত গান্ধী, মহাত্মা গান্ধী, নজরুল, এমনকী গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদও পেয়েছিলেন তিনি। ‘মানুষের এই ছোট্ট জীবনে এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে! তবে দুঃখ একটা আছে আমার, রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে শান্তিনিকেতন গিয়ে তাঁকে গান শোনানোর সৌভাগ্য আর হয়ে ওঠেনি আমার।’ কথাগুলো বলার সময় যেন একটু গলা ধরে এল কানন দেবীর।

এই ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম ১৯৮৬ সালে, কানন দেবীর বয়স যখন সত্তর। তারপর আর মাত্র ছয় বছর বেঁচেছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই ছিয়াত্তর বছর বয়সে তিনি চিরকালের জন্য আমাদের ছেড়ে অন্য জগতে চলে যান। ইন্টারভিউ চলাকালীন একাধিকবার ওঁকে ‘কানন মা’ বলে সম্বোধন করেছিলাম। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল এই ডাকে খুব খুশি হচ্ছেন তিনি। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাঁধুনি এবং বউমাকে রান্নার ব্যাপারে নানা ডিরেকশন দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের চা-বিস্কুট-মিষ্টি ছাড়াও বকফুল ভাজা খাইয়েছিলেন, এমনকী দুপুর হয়ে গেছে বলে লাঞ্চ খেয়ে যাবার কথাও বলেছিলেন। ইন্টারভিউ শেষে আমার সদ্য কেনা একটি হট শট ক্যামেরায় ওঁর ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করি। প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বারবার বললেন, ‘এখন আমার এই চেহারা আর কেউ দেখতে চাইবে না। তাছাড়া এই দেখো, মাথার চুল সামনের দিকে সব উঠে গেছে (ঘোমটা সরিয়ে দেখালেন)। এই ছবি কার ভালো লাগবে বল তো! তারা আমাকে সিনেমায় যেভাবে দেখেছেন সেই চেহারাতেই মনে রাখুক।’ আমার মা বারবার বলে দিয়েছিল, পারলে কানন দেবীর ছবি তুলে আনিস, দেখব এখন কেমন দেখতে হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত মায়ের সেন্টিমেন্ট দিলাম এবং ওঁকে রাজি করিয়েই ছাড়লাম। আমি ওঁর পাশে বসলাম, আমার বন্ধু দীপু ফটো তুলল, আবার দীপু ওঁর পাশে বসল, আমি ফটো তুললাম। এছাড়া কয়েকটি সিঙ্গেল ফটোও তুললাম।

বিদায় নিয়ে চলে আসার আগের মুহূর্তে বললেন, দেখুন বাবা, আপনাদের একটা রিকোয়েস্ট করি, এই ফটোগুলো কিন্তু আপনার মা-কে ছাড়া আর কাউকে দেখাবেন না। ‘কানন মা’-কে দেওয়া সেই কথা আমি দীর্ঘদিন রেখেওছিলাম। কিন্তু ছয় বছর আগে ২০১৬ সালে কানন দেবীর জন্মশতবর্ষে ৩৬ বছর আগে আমার সেই হট শট ক্যামেরায় তোলা কয়েকটি ফটো আমি ফেসবুকে পোস্ট করি এবং এজন্য এই মহান শিল্পীর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিই। এবার আমার এই লেখার সঙ্গে আবার কয়েকটি ফটো পোস্ট করছি এবং যথারীতি ওঁর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিচ্ছি। কারণ এই ফটোগুলোর একটা ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে। আশা করি, যে লোকেই থাকুন না কেন, আমাকে উনি মার্জনা করবেন। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম তার স্মৃতির প্রতি।

Skip to content